বিষয়বস্তুতে চলুন

নকশী কাঁথার মাঠ

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
নকশী কাঁথার মাঠ
লেখকজসীম উদ্ দীন
দেশবাংলাদেশ
ভাষাবাংলা
ধরনরোমান্টিক
প্রকাশনার তারিখ
১৯২৯
মিডিয়া ধরনকাব্যগ্রন্থ

নকশী কাঁথার মাঠ ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত বাংলা সাহিত্যের একটি অনবদ্য আখ্যানকাব্য। বাংলা ভাষায় রচিত এই আখ্যানকাব্যের লেখক বাংলাদেশের পল্লীকবি জসীম উদ্ দীন। বাংলা কবিতার জগতে যখন ইউরোপীয় ধাঁচের আধুনিকতার আন্দোলন চলছিল তখন প্রকাশিত এই কাব্যকাহিনী ঐতিহ্যগত ধারার শক্তিমত্তাকে পুনঃপ্রতিপন্ন করে। এটি জসীমউদদীনের একটি অমর সৃষ্টি হিসাবে বিবেচিত। কাব্যগ্রন্থটি ইংরেজিতে অনুবাদিত হয়ে বিশ্বপাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিল। নকশী কাঁথার মাঠ কাব্যোপন্যাসটি রূপাই ও সাজু নামক দুই গ্রামীণ যুবক-যুবতীর অবিনশ্বর প্রেমের করুণ কাহিনী। এই দুজনই ছিলেন বাস্তব চরিত্র।

কাহিনী সংক্ষেপ

[সম্পাদনা]

নকশী কাঁথার মাঠ-এর নায়ক রূপাই গাঁয়ের ছেলে, কৃষ্ণকায়, কাঁধ পর্যন্ত চুল। তার কতগুলো গুণ আছে : সে ভালো ঘর ছাইতে জানে, যে হাত দিয়ে সে সুন্দর ঘর ছায়, সেই হাতেই লড়কি চালাতে জানে, সড়কি চালাতে জানে, আবার বাঁশের বাঁশিতে তার মতো আড় আর কেউ দিতে পারে না, এমনকি তার মতো আর কেউ গান গাইতেও পারে না। পাশের গ্রামের মেয়ে সাজু। নাম তার সোনা হলেও মুসলমান পারিবারিক সংস্কৃতি অনুযায়ী সাজু বলে ডাকে সকলে। অপূর্ব সুন্দরী সাজু গ্রামের লক্ষ্মী মেয়ে হিসেবে পরিচিত। জ্বালাময়ী রৌদ্র আর উত্তাপের মৌসুমে বদনা-বিয়ের গান গাইতে গাইতে রূপাইয়ের গ্রামে আসে পাঁচ মেয়ে। এদের মাঝের জন সাজু। তারা রূপাইয়ের বাড়ির সামনে এলে চাল-ডাল দেওয়া হয়। মেয়ের দল বাড়ি ফেরার সময় সাজু একটু পেছন ফিরে চাইলে তার রূপে অভিভূত রূপাইয়ের সাথে চোখে চোখ মিলে সাজুর। রূপাই দা নিয়ে পাশের গ্রামের শেখ বাড়িতে যায় বাঁশ কাটতে। বাঁশ কাটতে সাজু তার চোখে পড়ে। মোহমুগ্ধ হয় সে সাজুর দিকে তাকিয়ে। একসময় সাজুর মা রূপাইকে লক্ষ্য করে এবং চিনতে সক্ষম হয়। লাজুক সাজু ও তার মা তরকারি রান্না করে রূপাইয়ের জন্য এবং রূপাইও তৃপ্তিসহকারে খায়। সাজুর কথা ভাবতে ভাবতে সবসময় আনমনা থেকে রূপাই। হাটে আসা-যাওয়ার পথে সে সাজুর বাসায় যায় এবং নানা অজুহাতে সাজুকে উপহার দিতে থাকে। একসময় গ্রামের লোকজন সাজু-রূপাইকে নিয়ে বলাবলি করতে থাকে। এ সম্পর্কে জানতে পেরে রূপাই ক্ষুব্ধ ও হতাশ হয়। বাঁশিতে সুর তুলে রূপাই তার মনের কষ্ট প্রকাশ করে। গ্রামের এক বুড়ি রূপাইকে নিয়ে রটানো কুৎসার ব্যাপারটা তুলে তার বিষণ্ন মায়ের নিকট। আরও কয়েকজন একই কথা তুললে ক্লান্ত রূপাইয়ের মা সাক্ষাত করে ঘটক দুখাই মিঞার সঙ্গে। দুখাই মিঞা ওই গ্রামে গিয়ে বিয়ের প্রসঙ্গ তুলে সাজুর মায়ের নিকট। মুরব্বি হওয়াতে তার সকল কথা মেনে নেয় সাজুর মা। রূপাইয়ের সঙ্গে সাজুর বিয়ে হয়। তারা সুখের সংসার পাতে। একদিন গভীর রাতে চাঁদ ওঠে, গোবর নিকানো আঙিনায় মাদুর পেতে সাজু রূপাইয়ের কোলে শুয়ে রয়, তাই একসময় বাঁশির বাজনা থেমে যায়। কারণ যাকে শোনানোর জন্য রূপাই এতদিন বাঁশি বাজিয়েছে, সেই মানুষটি এখন তারই ঘরে। সেদিন রাতের পূর্ণিমার আলোতে সাজুর রূপ দেখে দারুণ মুগ্ধ হয় রূপাই, কিন্তু পরক্ষণেই তার মনে কী যেন এক সংশয় জেগে ওঠে। সে ভাবে, এত সুখ আমার সইবে তো! এক অজানা আশঙ্কায় তার অন্তরের বেদনাশ্রু সাজুর কোমল মুখের ওপর পড়ে, সাজুর ঘুম ভেঙে যায়, স্বামীর চোখে জলের ধারা দেখে সাজু বলে, তুমি কাঁদছ কেন? তোমাকে তো আমি কোনো আঘাত দিইনি। রূপাই বলে, এক অজানা আশঙ্কায় কাঁদছি। সাজু বলে, না না, আমরা তো কোনো অন্যায় করিনি। এমন সময় হঠাৎ খবর আসে, বনগেঁয়োরা তাদের গাজনা-চরের পাকা ধান কেটে নিয়ে যাচ্ছে। রূপাই ছুটে যায় লড়কি-সড়কি হাতে বনগেঁয়োদের প্রতিরোধ করতে। সেখানে লড়াই হয় (স্থানীয় ভাষায় কাইজ্জা), কয়েকটি খুন হয় এবং ফলশ্রুতিতে রূপাই ফেরার হয়ে যায়। আর সাজু রোজ একটা পিদিম বা মাটির প্রদীপ জ্বালিয়ে বসে থাকে রূপাইয়ের পথ চেয়ে। একটা মরা পাতা ঝরে পড়লেও রূপাই-বিরহিণী সাজু, পাতার শব্দ লক্ষ করে আলোটা নিয়ে ছুটে যায়, কোথায় রূপাই? দিন চলে যায়। একদিন গভীর রাতে রূপাই এসে দাঁড়ায় সাজুর সামনে। সাজু দেখে, রূপাইয়ের সারা গায়ে মাটি মাখা, রক্তের দাগও লেগে আছে কোথাও কোথাও। সাজু তাকে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘তোমাকে আর যেতে দেবো না।’ রূপাই বলেছে, ‘আমার না যেয়ে উপায় নেই, যেতেই হবে। কেননা, আমি যদি ধরা পড়ি, আমার ফাঁসি অথবা কালাপানি হবে।’ সাজু এখানে বলেছিল, ‘তুমি তো চলে যাবে আমাকে কার কাছে তুমি রেখে যাবে’, তখন রূপাই বলে,

ইহলোকে রূপাইয়ের সঙ্গে সাজুর এই ছিল শেষ দেখা। সাজু আর কী করবে, সেই প্রথম দেখা ও বৃষ্টির জন্য কুলা নামানোর দিনের দৃষ্টি বিনিময় থেকে শুরু করে তাদের জীবনের সব কথাকে এমনকি যে রাতে রূপাই জন্মের মতো চলে গেল, এসব অতীত স্মৃতি কাঁথার ওপর ফুটিয়ে তুলতে লাগলো সুঁই-সুতা দিয়ে। যেদিন সেই কাঁথা বোনা শেষ হয়ে গেলো, সাজু তার মায়ের কাছে দিয়ে বললো, ‘মা, আমার মরণের পরে যেখানে কবর দেওয়া হবে, সেই কবরের ওপরে যেন এই নকশী কাঁথাখানা বিছিয়ে দেওয়া হয়। আর যদি কোনোদিন রূপাই এসে আমার খোঁজ করে, তাকে বোলো, তোমার আশায় সাজু ওই কবরের নিচে আছে।’
বহুদিন পরে গাঁয়ের কৃষকেরা গভীর রাতে বেদনার্ত এক বাঁশির সুর শুনতে পায়, আর ভোরে সবাই এসে দেখে, সাজুর কবরের পাশে এক ভিনদেশি লোক মরে পড়ে আছে। কবি জসীমউদ্দীন এই আখ্যানের একেবারে শেষ পর্বে এর করুণ বেদনাকে প্রকাশ করতে লিখেছেন:

শুধু তা-ই নয়, তিনি এ কাহিনীর বেদনাকে বিস্তার করে দিতে আরও লিখেছেন,

বাস্তব চরিত্র

[সম্পাদনা]

এই কাব্যগ্রন্থের রূপাই চরিত্রটি জসীমউদ্দীন রূপায়ণ করেছিলেন বাস্তবের একজন ব্যক্তিকে উপজীব্য করে, যার প্রকৃত নাম রূপা। রূপার বাড়ি ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলার শিলাসী গ্রামে৷ বাস্তবের রূপাও কাব্যের রূপাইয়ের মতো বলবান বীর ছিলেন, ছিলেন সেরা লাঠিয়াল। কৃষিজীবী শহর আলীর ৭ ছেলে ও ৪ মেয়ের মধ্যে রূপার অবস্থান তৃতীয়৷ আর রূপার রয়েছেন ৩ ছেলে ও ২ মেয়ে। ময়মনসিংহ গীতিকার সংগ্রাহক ড. দীনেশ চন্দ্র সেনের কথায় ময়মনসিংহ অঞ্চলের লোকজ সঙ্গীত সংগ্রহ করতে জসীমউদ্দীন গফরগাঁওয়ে এসেছিলেন৷ সেখানে এসেই কবি তার সাহিত্যচর্চার অন্যতম সঙ্গী খ্যাতনামা সাহিত্যিক মৌলভী শেখ আবদুল জব্বারের বনগাঁও গ্রামের বাড়িতে ওঠেন৷ এখানে অবস্থানকালে বনগাঁও গ্রামে জমির ধান কাটা নিয়ে একদিন বড় ধরনের এক দাঙ্গা (স্থানীয় ভাষায় কাইজ্জা) হয়৷ সেই দাঙ্গায় গফরগাঁওয়ের লাঠিয়াল দলের নেতৃত্ব দেন শিলাসী গ্রামের কৃষ্ণবর্ণের হালকা-পাতলা ছোটখাটো গড়নের যুবক রূপা৷ পল্লীকবি সেই দাঙ্গা দেখেন; দেখেন গ্রামাঞ্চলে জমি দখলের এক নারকীয় দৃশ্য৷ লাঠিয়াল দলের নেতৃত্বদানকারী রূপার তেজোদীপ্ত এক ভয়ঙ্কর বীরত্ব৷ ওই দাঙ্গাই কবির মনে রেখাপাত করে৷ নকশী কাঁথার মাঠ কাব্যের মূল উপজীব্য হয়ে ওঠে সেই দাঙ্গার ঘটনা৷ সেসময় এই রূপাকে মানুষ ‘রূপা গুণ্ডা’ বলেই জানতেন৷ বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর একবার তিনি ইউপি ‘সদস্য’ নির্বাচিত হন৷ অবিভক্ত ভারতে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার সময় তিনি সরাসরি দাঙ্গায় জড়িয়ে পড়েছিলেন, আর তখন গফরগাঁও বাজারে ১১ জন মারা গেলে তাকে এ ঘটনায় দুই দফায় ১৫ মাস কারাভোগ করতে হয়। গফরগাঁও বাজারের কাইয়ুম মার্কেটে একটি স্টলে আড্ডা দিতেন জসীমউদ্দীন, সেখানে বসেই রূপাই সম্পর্কে খোঁজখবর নেন তিনি৷ সেই স্টলেই কবির সঙ্গে রূপার পরিচয় হয় এবং রূপা তার নিজের সম্পর্কে জানান জসীমউদ্দীনকে, যা উপজীব্য করে কবি পরে কাব্যগ্রন্থটি রচনা করেছিলেন।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]

কাব্যে, রূপাইয়ের বিপরীতে সাজু নামক যে নারী চরিত্র ছিল, তিনিও বাস্তবের এক ব্যক্তিত্ব, নাম ছিল ললিতা। রূপা ললিতাকে ভালোবাসতেন। ললিতা ছিলেন রূপার প্রতিবেশী গ্রাম মশাখালীর বাসিন্দা। ললিতা ২০০৬ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারিতে মারা যান।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]

অনুবাদ

[সম্পাদনা]

১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম প্রকাশের পর এই কাব্যগ্রন্থটি ইংরেজিতে ই. এম. মিলফোর্ড কর্তৃক অনুদিত হয় The Field of Embroidered Quilt নামে।[][] এটি কবির শ্রেষ্ঠ রচনা। প্রচলিত পল্লীগীতিকার চেয়ে ব্যতিক্রমী এ রচনাটিতে তিনি কাহিনীর আবর্তনে অসম্ভব দক্ষতার পরিচয় দেন।

জনপ্রিয় মাধ্যমে উপস্থাপনা

[সম্পাদনা]

নকশি কাঁথার মাঠ কাব্যগ্রন্থের নায়ক রূপাকে নিয়ে জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ইত্যাদি-তে দেখানো হয় একটি প্রতিবেদন। এছাড়া মূল কাব্যগ্রন্থ নিয়ে তৈরি হয় অনন্ত হীরা পরিচালিত টেলিফিল্ম নকশী কাঁথার মাঠ । এছাড়া বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন কর্তৃক পরিবেশিত হয়েছে নৃত্যনাট্য। ওস্তাদ খাদেম হোসেন খান নকশী কাঁথার মাঠ নৃত্যনাট্যের সঙ্গীত পরিচালনা করে ইরান, ইরাক, এবং পাকিস্তানও সফর করেন।[] ২০১৩ সালে এই কাব্যগ্রন্থ অবলম্বনে নির্মিত হয় টেলিফিল্ম 'নকশী কাঁথার মাঠ'। এটি পরিচালনা করেন রাজিব হাসান ও প্রধান দু'টি চরিত্রে অভিনয় করেন চঞ্চল চৌধুরী এবং ফারহানা মিলি।[]

আরও দেখুন

[সম্পাদনা]

তথ্যসূত্র

[সম্পাদনা]
  1. কবিগানের আসরে পাওয়া জসীমউদ্‌দীন, সাইমন জাকারিয়া, সাহিত্য সাময়িকী, দৈনিক প্রথম আলো; ৫ আগস্ট ২০১১ খ্রিস্টাব্দ। পৃষ্ঠা ২৬। পরিদর্শনের তারিখ: ৯ নভেম্বর ২০১১ খ্রিস্টাব্দ।
  2. জসীমউদ্‌দীন, বিমল গুহ; বাংলাপিডিয়া (সিডি সংস্করণ), ফেব্রুয়ারি ২০০৮; সংগ্রহের তারিখ: ৯ নভেম্বর ২০১১ খ্রিস্টাব্দ।
  3. শামীমা আক্তার (২০১২)। "নক্সী কাঁথার মাঠ"ইসলাম, সিরাজুল; মিয়া, সাজাহান; খানম, মাহফুজা; আহমেদ, সাব্বীর। বাংলাপিডিয়া: বাংলাদেশের জাতীয় বিশ্বকোষ (২য় সংস্করণ)। ঢাকা, বাংলাদেশ: বাংলাপিডিয়া ট্রাস্ট, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটিআইএসবিএন 9843205901ওএল 30677644Mওসিএলসি 883871743। সংগ্রহের তারিখ ৯ জুলাই ২০২০ 
  4. খাদেম হোসেন খান, ওস্তাদ, মোবারক হোসেন খান; বাংলাপিডিয়া (সিডি সংস্করণ), ফেব্রুয়ারি ২০০৮; সংগ্রহের তারিখ: ১৩ ডিসেম্বর ২০১১ খ্রিস্টাব্দ।
  5. আবার সেই জুটি চঞ্চল-মিলি[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]

বহিঃসংযোগ

[সম্পাদনা]