ধূমকেতু

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
(ধুমকেতু থেকে পুনর্নির্দেশিত)
হেল-বপ ধূমকেতু

ধুমকেতু হল ধুলো, বরফগ্যাসের তৈরি এক ধরনের মহাজাগতিক বস্তু। ধূমকেতু একটি ক্ষুদ্র বরফাবৃত সৌরজাগতিক বস্তু যা সূর্যের খুব নিকট দিয়ে পরিভ্রমণ করার সময় দর্শনীয় কমা (একটি পাতলা, ক্ষণস্থায়ী বায়ুমন্ডল) এবং কখনও লেজও প্রদর্শন করে । ধূমকেতুর নিউক্লিয়াসের ওপর সূর্যের বিকিরণ ও সৌরবায়ুর প্রভাবের কারণে এমনটি ঘটে। ধূমকেতুর নিউক্লিয়াস বরফ, ধুলা ও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পাথুরে কণিকার একটি দুর্বল সংকলনে গঠিত। প্রস্থে কয়েকশ মিটার থেকে দশ কি.মি. এবং লেজ দৈর্ঘ্যে কয়েকশ কোটি কি.মি. পর্যন্ত হতে পারে । মানুষ সুপ্রাচীন কাল থেকে ধূমকেতু পর্যবেক্ষণ করছে।

একটি ধূমকেতুর পর্যায়কাল কয়েক বছর থেকে শুরু করে কয়েকশ’ হাজার বছর পর্যন্ত হতে পারে। ধারণা করা হয় স্বল্পকালীন ধূমকেতুর উৎপত্তি কুইপার বেল্ট থেকে যার অবস্থান নেপচুনের কক্ষপথের বাইরে এবং দীর্ঘকালীন ধূমকেতুর উৎপত্তি ওরট মেঘ থেকে, যা সৌরজগতের বাইরে একটি বরফময় বস্তুর গোলাকার মেঘ।[১] আমাদের সৌরজগতের বড় গ্রহগুলোর ( বৃহস্পতি, শনি, ইউরেনাস ও নেপচুন) অথবা সৌরজগতের খুব কাছ দিয়ে পরিক্রমণকারী নক্ষত্রের কারণে ওরট মেঘে যে মাধ্যাকর্ষণ বল ক্রিয়া করে তাতে বস্তুগুলো সূর্যের দিকে ছুটে আসে এবং তখনি কমার উৎপত্তি হলে আমরা ধূমকেতু দেখি। বিরল কিছু ধূমকেতু অধিবৃত্তাকার কক্ষপথে সৌরজগতের ভেতরে প্রবেশ করে এসব গ্রহের মাধ্যমে আন্তনাক্ষত্রিক স্থানে নিক্ষিপ্ত হতে পারে।

ধুমকেতু উল্কা বা গ্রহাণু থেকে পৃথক কারণ এর কমা ও লেজের উপস্থিতি। কিছু বিরল ধূমকেতু সূর্যের খুব নিকট দিয়ে বারবার পরিভ্রমণ করার কারণে উদ্বায়ী বরফ ও ধুলা হারিয়ে ছোট গ্রহাণুর মত বস্তুতে পরিণত হয়।

এপ্রিল ২০১৯ এর পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী ৬৬১৯ টি ধূমকেতু [২] আমাদের জানা । এ সংখ্যা ক্রমবর্ধমান কারণ মোট ধূমকেতুর (যা ধারণা করা হয় শত কোটি) একটি নগণ্য অংশ।[৩][৪] খালি চোখে দেখা যাওয়া উজ্জ্বল ধূমকেতুকে বৃহৎ ধূমকেতু বলা হয়।[৫]

কিছু ধুমকেতু নির্দিষ্ট সময় পরপর একই স্থানে ফিরে আসে। যেমন হ্যালীর ধুমকেতু

১৮৫৮ সালের এই ধূমকেতুটির নাম Donati । এই চিত্রটি ১৮৮৮ সালে প্রকাশিত Edmund.Weissএর Bilderatlas der Sternenwelt বইটি থেকে নেয়া হয়েছে। ছবিটি Weiss নিজেই এঁকেছেন। ধূমকেতুর ডানদিকে সপ্তর্ষি ও ধূমকেতুর মাথায় স্বাতী (আর্কটুরাস) তারাটি দেখা যাচ্ছে।

গঠন[সম্পাদনা]

Deep Impact মহাকাশযান থেকে তোলা Tempel 1 ধূমকেতুর নিউক্লিয়াসের ছবি। নিউক্লিয়াসটি চওড়ায় ৬ কিমি

নিউক্লিয়াস[সম্পাদনা]

এটি চওড়ায় ১০০ মিটার থেকে ৪০ কি.মি. পর্যন্ত হতে পারে। নিউক্লিয়াই’টি পাথর, ধূলা, জলীয় বরফ, বরফায়িত গ্যাস – কার্বন মনোক্সাইড, কার্বন ডাইঅক্সাইড, মিথেন, অ্যামোনিয়া[৬] দিয়ে গঠিত। এর সারফেস বা তলদেশ শুষ্ক ধূলোময় বা পাথুরে অর্থাৎ বরফ পাথরের ভাঁজে ভাঁজে থাকে। 'ডার্টি স্নোবল' তত্ত্ব [৭] মতে, নিউক্লিয়াসে ৮৫% বরফ থাকলে তাকে ধূমকেতুর নিউক্লিয়াস বলা যাবে। এরকম স্বল্প ভরের কারণে নিউক্লিয়াইটি গোলাকার না হয়ে অনিয়মিত আকৃতির হয়।

উপর্যুক্ত গ্যাসগুলো ছাড়াও মিথানল, সায়ানাইড, ফরমালডিহাইড, ইথানল, ইথেন প্রভৃতি জৈব যৌগও[৮][৯] থাকে।

২০০৯ এ নাসার স্টারডাস্ট মিশনে নিউক্লিয়াসের ধূলায় গ্লাইসিন অ্যামিনো এসিডের উপস্থিতি পাওয়া গেছে[১০]

নিউক্লিয়াইটির প্রতিফলন ক্ষমতা সৌরজগতের মধ্যে সবচেয়ে কম; হ্যালির ধূমকেতুর ক্ষেত্রে ১-২% [১১]বোরেলীর ধূমকেতুর ২.৪% - ৩.০%।

এ কারণে নিউক্লিয়াইটি প্রয়োজনীয় সূর্যালোক শোষণ করে গ্যাসীয় প্রক্রিয়াগুলো সম্পন্ন করে।

ধুমকেতুর নিউক্লিয়ের বাইরের পৃষ্ঠতলগুলির খুব কম আলবেডো থাকে যা এগুলি সৌরজগতের মধ্যে পাওয়া সর্বনিম্ন প্রতিফলিত বস্তুগুলিতে পরিণত করে।  জিত্তো স্থান অনুসন্ধানে দেখা গেছে যে হ্যালি ধূমকেতুর নিউক্লিয়াস তার উপর পড়ার প্রায় চার শতাংশ আলোক প্রতিফলিত করে,[১২] এবং ডিপ স্পেস ১ আবিষ্কার করেছে যে ধূমকেত বোর্লির পৃষ্ঠটি ৩.০% এরও কম প্রতিফলিত করে;[১২] যেখানে অ্যাসফল্ট সাত শতাংশ প্রতিবিম্বিত করে।  নিউক্লিয়াসের কৃষ্ণ পৃষ্ঠের উপাদানগুলি জটিল জৈব যৌগগুলি নিয়ে গঠিত হতে পারে।  সোলার হিটিং হালকা উদ্বায়ী যৌগগুলি ছড়িয়ে দেয়, বড় বা জৈব যৌগগুলিকে পিছনে ফেলে যা টার অপরিশোধিত তেলের মতো খুব কালো হয়। ধুমকেতুর পৃষ্ঠগুলির স্বল্প প্রতিবিম্বতা তাদের তাপ শোষণ করে তোলে যা তাদের আউটগ্যাসিং প্রক্রিয়াগুলি চালিত করে।[১৩]

৩০ কিলোমিটার (১৯ মাইল)ব্যাসার্ধ ধূমকেতু নিউক্লিয়াই লক্ষ্য করা গেছে,[১৪] তবে তাদের সঠিক আকার নির্ধারণ করা কঠিন।[১৫]

কমা ও লেজ[সম্পাদনা]

ধূমকেতু সৌরজগতের ভেতরে অগ্রসর হলে সূর্যের বিকিরণে উদ্বায়ী পদার্থগুলো ধূলো ও গ্যাস হয়ে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। এর ফলে যে বায়ুমণ্ডল তৈরী হয় তাকে বলে কমা। সূর্যের বিকিরণ বল ও সৌরবায়ুর প্রভাবে কমার ওপর যে বল প্রযুক্ত হয় তাতে সূর্যাবিমূখি একটি বিশাল লেজ তৈরি হয়। কমা ও লেজে যেসব অতিক্ষুদ্র উপাদান থাকে সেগুলো নিউক্লিয়াস থেকে বেরিয়ে আসা উপাদান, সূর্যের আলোয় যা অত্যুজ্জ্বল হয়ে ওঠায় আমরা তা দেখতে পাই। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা খুবই অনুজ্জ্বল বলে দূরবীক্ষণ যন্ত্র ছাড়া দেখা যায় না।

চার্জযুক্ত পরমাণুর এই লেজটি সৃষ্টি হয় নিউক্লিয়াসের গ্যাসীয় বস্তুগুলোর বাষ্পীভবনের কারণে। অতিবেগুনি রশ্মির সংস্পর্শে তা ভেঙ্গে চার্জযুক্ত বস্তুতে পরিণত হয়ে সৌরবায়ুতে তরঙ্গের আকারে প্রবাহিত হয়।

কখনও ধূমকেতুতে আকস্মিক ধুলা ও গ্যাসের বিস্ফোরণের কারণে কমার আকৃতি বড় হয়ে যেতে পারে।

কক্ষপথের প্রকৃতি ও ধূমকেতুর প্রকারভেদ[সম্পাদনা]

Orbits of the Kohoutek Comet (red) and the Earth (blue), illustrating the high eccentricity of its orbit and its rapid motion when close to the Sun.

অধিকাংশ ধূমকেতুর কক্ষপথের ক্ষুদ্র অংশ সূর্যের কাছাকাছি (অনুসূর) এবং বাকি অংশ বা প্রায় পুরোটা সময় সৌরজগেতের দূরবর্তী অঞ্চলে (অপসূর) থাকে। এজন্য কিছু ধূমকেতুকে কক্ষপথের পর্যায়কালের ওপর ভাগ করা হয়।

স্বল্পকালীন ধূমকেতু হল যাদের পর্যায়কাল ২০০ বছরের কম। সাধারণত এগুলো গ্রহগুলোর মত একটি উপবৃত্তাকার তলে ঘোরে। এসব ধূমকেতুর অপসূর দূরত্ব হয় বৃহস্পতির কক্ষপথের বাইরে। যেমন হ্যালীর পর্যায়কাল ৭৬ বছর এবং এর অপসূর নেপচুনের কক্ষপথের বাইরে। যেসব ধূমকেতু সরাসরি বৃহস্পতি গ্রহের সাথে সম্পর্ক রেখে চলে তাদেরকে বৃহস্পতি পরিবারের ধূমকেতু বলে হয়। বৃহস্পতি পরিবারের ধূমকেতুর সংখ্যা ৪৬৫ টি ও অন্যদের সংখ্যা ১০৮ টি ।

দীর্ঘকালীন ধূমকেতুর পর্যায়কাল ২০০ বছর থেকে কয়েক লক্ষ বছর হতে পারে এবং এদের কক্ষপথের উৎকেন্দ্রিকতা অনেক বেশি। এসব ধূমকেতু কোনও বড় গ্রহের কাছাকাছি এলে সৌরজগত থেকে বিক্ষিপ্ত হতে পারে এবং তখন এদের পর্যায়কাল থাকে না । একবার দেখা যাওয়া ধূমকেতুগুলোর অনুসূরে এদের কক্ষপথ অধিবৃত্তাকার বা কিছুটা উপবৃত্তাকার বলে মনে হয়। কিন্তু বড় গ্রহগুলোর মাধ্যাকর্ষণ এদেরকে ছুঁড়ে দিলে এদের অপসূর ওরট মেঘে পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে। আসলে খুব কম দীর্ঘকালীন ধূমকেতুরই পুরোপুরি উপবৃত্তাকার কক্ষপথ ও পর্যায়কাল পাওয়া গেছে। এদের সংখ্যা ৪,১৮৪ টি।

বর্তমানে নব-আবিষ্কৃত মেইন-বেল্ট ধূমকেতু প্রায় বৃত্তাকার কক্ষপথে গ্রহাণুপুঞ্জের মধ্যে ঘোরে ।

ধূমকেতুর জন্ম[সম্পাদনা]

ধারণা করা হয় স্বল্পকালীন ধূমকেতুর জন্ম বামন গ্রহগুলো বা সেন্টর থেকে এবং কুইপার বেল্ট ও নেপচুনের কক্ষপথের বাইরের এলাকায় যে ছড়িয়ে থাকা বিভিন্ন বস্তুর চাকতির মত এলাকা আছে সেখান থেকে, প্রায় ৩০ থেকে ৫০ জ্যোতির্বিদ্যার একক দূরত্বে; দীর্ঘকালীন ধূমকেতুর জন্ম ওরট মেঘ থেকে যা সৌরজগতের সবচে দূরের এলাকা এবং এখানে বরফপিণ্ডের মত অনেক বস্তু গোলাকার কক্ষপথে ঘূর্ণায়মান বলে মনে করা হয়। কুইপার বেল্টে বড় গ্রহগুলোর মাধ্যাকর্ষণ বলের প্রভাবে বা ওরট মেঘে নিকটবর্তী কোনও নক্ষত্রের প্রভাবে কোনও বস্তু উপবৃত্তাকার কক্ষপথে সূর্যের দিকে এলে নতুন ধূমকেতুর জন্ম হবে। কিন্তু ধূমকেতুর জন্মের এই প্রক্রিয়া হিসাব করে বের করা সম্ভব হয়নি। হ্যালির ধূমকেতু কাইপার বেল্ট থেকে আসলেও বেশীর ভাগ ধূমকেতুর উৎস হচ্ছে ওর্ট মেঘ। অনুমান করা হয় মূল সৌর জগতের বাইরে, প্রায় ৫০,০০০ জ্যোতির্বিদ্যার একক দূরত্বে অবস্থিত, এই অঞ্চলে হচ্ছে প্রায় এক ট্রিলিয়ন বা দশ লক্ষ কোটি ধূমকেতুর বসবাস। কোন কোন সময়ে সৌর জগতের কাছাকাছি কোন নক্ষত্র আসলে সেটার মাধ্যাকর্ষণজনিত অভিঘাতে এই ধূমকেতুগুলি সূর্যের দিকে রওনা হয়। সূর্যের কাছাকাছি পৌঁছাতে সেগুলির কয়েক মিলিয়ন বা কয়েক দশক লক্ষ বছর লেগে যায়। এই ধূমকেতুগুলির কক্ষপথ অধিবৃত্ত (প্যারাবলিক) বা পরাবৃত্ত (হাইপারবলিক) আকারের হয়ে থাকে। ওর্ট মেঘ থেকে আগত বেশীরভাগ ধূমকেতুই পুনরায় ফিরে আসে না।

কিছু ধূমকেতুর পর্যায়কাল বড় গ্রহগুলোর মাধ্যাকর্ষণ বলের প্রভাবে পরিবর্তিত হতে পারে। যেমন 11P/Tempel-Swift-LINEAR ধূমকেতু ১৮৬৯ সালে আবিষ্কৃত হলেও ১৯০৮ সালের পর আর দেখা যায় নি কারণ হল বৃহস্পতি। পরে ২০০১ সালে LINEAR দ্বারা পুনরায় আবিষ্কৃত হয়।

ধূমকেতুর ভাগ্য[সম্পাদনা]

Material coming off Component B of 73P/Schwassmann-Wachmann which broke up starting in 1995, as seen by the HST. This animation covers a span of three days.

সৌরজগত ছেড়ে চলে যাওয়া[সম্পাদনা]

বৃহস্পতির মত বড় গ্রহগুলোর মাধ্যাকর্ষণ বলের প্রভাবে একটি ধূমকেতু সৌরজগত ছেড়ে চলে যেতে পারে।

উদ্বায়ী পদার্থ পুরোপুরি শেষ হয়ে যাওয়া[সম্পাদনা]

এই কারণে বৃহস্পতি পরিবারের ধূমকেতুর আয়ু ১০০০০ বছর বা প্রায় ১০০০ বার সূর্যকে প্রদক্ষিণ করা। কিন্তু দীর্ঘকালীন ধূমকেতুগুলোর ১০% মাত্র ৫০বার সূর্যকে প্রদক্ষিণ করতে পারে এবং মাত্র ১% প্রায় ২০০০ বার সূর্যকে প্রদক্ষিণ করতে পারে। এরপরে ভেতরের উদ্বায়ী পদার্থ পুরোপুরি শেষ হয়ে যায়।

খণ্ড খণ্ড হয়ে যাওয়া[সম্পাদনা]

প্রাচীন ইতিহাসবিদ ইফোরাস প্রথম খ্রি. পূর্ব ৪র্থ শতকে বলেন একটি ধূমকেতু দুইভাগে ভাগ হয়ে গেছিল। বিশাল সেপ্টেম্বর (1882 II) ধূমকেতুর নিউক্লিয়াস সূর্যের খুব কাছে গিয়ে চারটি স্বতন্ত্র নিউক্লিয়াসে ভাগ হয় যা ২৫০০ থেকে ২৯০০ সালের মধ্যে আবার ফিরে আসবে। এছাড়া ১৯৯৫ সালে Comet 73P/Schwassmann-Wachmann 3 ধূমকেতু ভেঙ্গে যেতে শুরু করে। এগুলোকে ক্রেজ সানগ্রেজার পরিবারের ধূমকেতু বলা হয়। এই ভাঙ্গন সূর্যের খুব কাছ দিয়ে গেলে সৌর জোয়ার বা বড় গ্রহগুলোর মাধ্যাকর্ষণ বলের প্রভাবে হতে পারে।

সংঘর্ষ ও আত্মাহুতি[সম্পাদনা]

Brown spots mark impact sites of the Shoemaker-Levy Comet on Jupiter's southern hemisphere.

কোনও ধূমকেতু সূর্যে সফলভাবে পতিত হতে পারে যেমন হাওয়ার্ড-কূমন-মিশেল (1979 XI) ১৯৭৯ সালের আগস্টের শেষে অথবা গ্রহের সাথে সংঘর্ষ হতে পারে যেমন Shoemaker-Levy ধূমকেতু ১৯৯৪ সালের জুলাইতে খণ্ড খণ্ড হয়ে বৃহস্পতিতে পতিত হয়। লুইস ও ওয়াল্টার আলভারেজের মতে ৬.৫ কোটি বছর আগে কোনও ধূমকেতু বা বৃহৎ কোন উল্কাপাতের ফলে ডাইনোসরসহ অনেক প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে যায়। অনেকের ধারণা পৃথিবীর জন্মের পর যথেষ্ট পরিমাণ পানি ধূমকেতু থেকে এসেছিল। ২০১৩ সালের ২৮ নভেম্বর ধূমকেতু ISON অনুসূর দূরত্বে এসে হারিয়ে যায়। ধারণা করে হচ্ছে এটি সূর্যের সম্মুখে এসে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে।

Halley's Comet, named after the astronomer Edmund Halley for successfully calculating its orbit

নামকরণ[সম্পাদনা]

বিজ্ঞানী হ্যালী প্রথম দেখান যে ১৫৩১, ১৬০৭, ১৬৮২ সালের ধূমকেতু ১৭৫৯ সালের শেষে আবার দেখা যাবে। তার এই সফল হিসাবের জন্য এই ধূমকেতুর নাম হ্যালীর ধূমকেতু। একইভাবে ইনকার ধূমকেতু, বিলার ধূমকেতুর নামকরণ করা হয় এই ধূমকেতুগুলোর প্রথম আবিষ্কর্তার নাম না দিয়ে। পরবর্তীতে অধিকাংশ ধূমকেতুর নামকরণ প্রথম আবিষ্কর্তার নামে করা হয়। IRAS-Araki-Alcock ধূমকেতুর নাম IRAS উপগ্রহ এবং Genichi Araki ও George Alcock নামের দুই জ্যোতির্বিদের নামে করা হয়। ১৯৬৯i(Bennet) এর অর্থ ১৯৬৯ সালের নবম ধূমকেতু। বর্তমানে প্রচলিত নামকরণের পদ্ধতি ১৯৯৪ সালে আন্তর্জাতিক জ্যোতির্বিদ্যা সংস্থা অনুমোদন করে। এই পদ্ধতিতে-

P/ পর্যায়কালীন ধূমকেতু যেমন হ্যালীর ধূমকেতু হল 1P/1682 Q1

C/ যেগুলো পর্যায়কালীন নয় যেমন – হেল-বপ ধূমকেতু হল C/1995 O1

X/ যেগুলোর পর্যায়কাল হিসাব করা সম্ভব হয়নি

D/ হারিয়ে যাওয়া পর্যায়কালীন ধূমকেতু

A/ আসলে যা বামন গ্রহ কিন্তু ভুল করে ধূমকেতু বলে চিহ্নিত করা হয়েছে।

ধুমকেতুর বিস্তৃতি[সম্পাদনা]

বেশিরভাগ ধুমকেতুর নিউক্লিয়াস (ধুমকেতুর কেন্দ্র) ৬মাইল বা ১০ কি.মি. এর কম হয়ে থাকে। কোনো ধুমকেতুর বিস্তৃতি নির্ভর করে সেটি সূর্য থেকে কত দূরে অবস্থান করছে। যখন কোনো ধুমকেতু সূর্যের কাছাকাছি যায় তখন তার নিউক্লিয়াসে অবস্থিত বরফ বাষ্পীভূত হয়ে শুরু করে। আর নিউক্লিয়াসের বরফ বাষ্পীভূত হওয়ার কারণে Coma’র বিস্তৃতি বেড়ে গিয়ে হয়ে যায় ৫০,০০০ মাইল বা প্রায় ৮০,০০০কি.মি. এর ফলে ধুমকেতুর লেজ গুলোর বিস্তৃতি বেড়ে গিয়ে প্রায় ৬০০,০০০ মাইল বা প্রায় ১মিলিয়ন কি.মি. হয়ে যেতে পারে।

কোনো ধুমকেতু কি সত্যিই বৃহস্পতি গ্রহে পতিত হয়েছিল?[সম্পাদনা]

হ্যাঁ, জুলাইয়ের ১৬-২২ তারিখে ১৯৯৪তে, Comet Shoemaker-Levy 9 এর কিছু অংশ বৃহস্পতি গ্রহের সঙ্গে সংঘর্ষিত হয়েছিল। এখন পর্যন্ত পর্যবেক্ষণকৃত আমাদের সোলার সিস্টেমের দু’টি বস্তুর সংঘর্ষ একমাত্র এটিই। বৃহস্পতি গ্রহের প্রবল মধ্যাকর্ষনের জন্য ধুমকেতুটি বৃহস্পতিতে পতিত হয়েছিল। Comet Shoemaker-Levy 9 ধুমকেতুটির ২০টির বেশি টুকরো বৃহস্পতি গ্রহের দক্ষিণ গোলার্ধে ঘণ্টায় প্রায় ১৩০,০০০মাইল বা ২১০,০০০কি.মি বেগে পতিত হয়েছিল।

সাহিত্য সংস্কৃতিতে ধূমকেতু[সম্পাদনা]

১০৩১ সালে আল বিরুনি রচিত 'ভারততত্ত্ব' বইতে তিনি দেখিয়েছেন, ধূমকেতুর আবির্ভাবকে ভারতীয়রা পূর্বজন্মের কর্মফল হিসেবে দেখেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বরাহমিহিরের বক্তব্যের উদ্ধৃতি দিয়েছেন এভাবে, "ধূমকেতুর আবির্ভাবকালে মানুষ অমংগলের আশঙ্কায় এত ভীত হয়ে পড়ে যে, তারা বাড়িঘর ছেড়ে সন্তান-সন্ততির হাত ধরে বিলাপ করতে করতে আশ্রয়ের জন্য ছুটাছুটি করতে থাকে এবং পরস্পরকে বলতে থাকে যে ' রাজার পাপের জন্য আমাদের এই শাস্তি।' অন্যেরা তার উত্তরে বলে , ' না, এ আমাদেরই পূর্বজন্মের কর্মফল।'

১৩০১ সালে বিখ্যাত ফ্লোরেন্টাইন চিত্রশিল্পী Giotto di Bondone ১৩০১ সালের হ্যালীর ধূমকেতুর স্মরণার্থে পাদুয়ার এরেনা চ্যাপেলের দেয়ালে ফ্রেসকো আঁকেন যার নাম Adoration of the Magi । এটি শেষ হয় ১৩০৪ সালে। তাঁর স্মরণার্থে ১৯৮৬ সালে হ্যালীর ধূমকেতুর পর্যবেক্ষণে Giotto মহাকাশযান ছাড়া হয়। ১৮১১ সালের বিশাল ধূমকেতু নিয়ে লিও তলস্তয় লিখেছেন War and Peace গ্রন্থে।

১৯১০ সালের হ্যালীর ধূমকেতু নিয়ে কবিতা লেখেন এবং ১৯২২ সালে ১২ আগস্ট "ধূমকেতু" নামের অর্ধসাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি ধূমকেতুকে দেখেছেন প্রচণ্ড শক্তিশালী কিন্তু খেয়ালী অনাসৃষ্টি হিসেবে। পত্রিকার ২৬ সেপ্টেম্বর, ১৯২২ সংখ্যায় নজরুলের কবিতা আনন্দময়ীর আগমনে প্রকাশিত হয়। এই রাজনৈতিক কবিতা প্রকাশিত হওয়ায় ৮ নভেম্বর পত্রিকার উক্ত সংখ্যাটি নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়, কবিতার জন্য তিনি ২৩ নভেম্বর গ্রেফতার হন।

এই পত্রিকাকে আশীর্বাদ করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন,

পত্রিকার প্রথম পাতার শীর্ষে এই বাণী লিখা থাকতো। ১৯২০-এর দশকে অসহযোগ ও খিলাফত আন্দোলন এক সময় ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। এর পরপর স্বরাজ গঠনে যে সশস্ত্র বিপ্লববাদের আবির্ভাব ঘটে তাতে ধূমকেতু পত্রিকার বিশেষ অবদান ছিল।

পশ্চিমা 'সংস্কৃতিতে ধূমকেতুকে ধ্বংসের প্রতীক ও দুনিয়ার দুর্যোগ আগমনের ভবিষ্যদ্বাণী বলে মনে করা হয়। হ্যালীর শৈশবকালেই ৪টি বিশাল ধূমকেতু লন্ডনের আকাশে দেখা যায় যার একটিকে লন্ডনের অগ্নিকাণ্ডের জন্য দায়ী করা হয়েছিল।

অনুবাদ-চর্চা নামক সঙ্কলনে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, ‘অষ্টাদশ শতাব্দী পর্য্যন্ত সকল যুগের সাহিত্যেই দেখা যায় যে, ধূমকেতুকে লোকে তখন দুঃখের ভীষণ অগ্রদূত বলিয়া বিশ্বাস করিত... Milton বলেন যে, ধূমকেতু তাহার ভয়াবহ কেশজাল ঝাড়া দিয়া মহামারী ও যুদ্ধবিগ্রহ বর্ষণ করে। রাজা হইতে আরম্ভ করিয়া দীনতম কৃষক পর্য্যন্ত সমগ্র জাতি এই অমঙ্গলের দূতসকলের আবির্ভাবে ক্ষণে ক্ষণে দারুণতম আতঙ্কে নিমগ্ন হইত। ১৪৫৬ খ্রীষ্টাব্দে, হ্যালির নামে পরিচিত ধূমকেতুর পুনরাগমনে যেমন সুদূরব্যাপী ভয়ের সঞ্চার হইয়াছিল পূর্ব্বে আর কখনও তেমন হইয়াছে বলিয়া জানা যায় নাই। বিধাতার শেষ বিচারের দিন আগতপ্রায় এই বিশ্বাস ব্যাপক হইয়াছিল। লোকে সমস্ত আশা ভরসা ছাড়িয়া দিয়া তাহাদের বিনাশদণ্ডের জন্য প্রস্তুত হইতে লাগিল। ১৬০৭ খ্রীষ্টাব্দে ইহা আবার স্বীয় আবির্ভাবে জগৎকে শঙ্কিত করিয়া তুলিল এবং ভজনালয়গুলি ভয়াভিহত জনসঙ্ঘে পূর্ণ হইয়া গেল।’

কিছু বিখ্যাত মানুষের জন্ম-মৃত্যুর সাথে ধূমকেতুর আগমনের সময়ের মিল পাওয়া যায়। মার্ক টোয়াইন সফলভাবে ভবিষ্যদ্বাণী করেন যে তিনি ধূমকেতুর সাথে চলে যাবেন (১৯১০ সালের হ্যালীর ধূমকেতু)।

সায়েন্স ফিকশনে ধূমকেতুকে প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে বিপদকে থামানোর প্রতীক হিসেবে দেখা হয়।

পর্যবেক্ষণের ইতিহাস[সম্পাদনা]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. Randall, Lisa, (২০১৫)। Dark matter and the dinosaurs : the astounding interconnectedness of the universe (১ম সংস্করণ)। New York, NY। পৃষ্ঠা ১০৪–০৫। আইএসবিএন 978-0-06-232847-2ওসিএলসি 915740676 
  2. Johnston, Robert (১৩ জুলাই ২০১৯)। "Known populations of solar system objects"। ৯ জুন ২০১৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৩ নভেম্বর ২০১৯ 
  3. Erickson, Jon (২০১৪-০৫-১৪)। Asteroids, Comets, and Meteorites: Cosmic Invaders of the Earth (ইংরেজি ভাষায়)। Infobase Publishing। পৃষ্ঠা ১২৩। আইএসবিএন 978-1-4381-0962-6 
  4. DK (২০১৪-০৯-০১)। The Planets: The Definitive Visual Guide to Our Solar System (ইংরেজি ভাষায়)। Penguin। পৃষ্ঠা ২২২। আইএসবিএন 978-1-4654-3573-6 
  5. Licht, A.Lewis (১৯৯৯)। "The Rate of Naked-Eye Comets from 101 BC to 1970 AD"Icarus (ইংরেজি ভাষায়)। 137 (2): 355–356। ডিওআই:10.1006/icar.1998.6048বিবকোড:1999Icar..137..355L 
  6. Greenberg, J. Mayo (১৯৯৮)। "Making a comet nucleus"। Astronomy and Astrophysics330: 375। বিবকোড:1998A&A...330..375G 
  7. "Small Bodies in the Solar System" (পিডিএফ) 
  8. Meech, M. (২৪ মার্চ ১৯৯৭)। "1997 Apparition of Comet Hale–Bopp: What We Can Learn from Bright Comets"। Planetary Science Research Discoveries। সংগ্রহের তারিখ ৩০ এপ্রিল ২০১৩ 
  9. "Stardust Findings Suggest Comets More Complex Than Thought"। NASA। ১৪ ডিসেম্বর ২০০৬। সংগ্রহের তারিখ ৩১ জুলাই ২০১৩ 
  10. Elsila, Jamie E.; Glavin, Daniel P.; Dworkin, Jason P. (২০০৯)। "Cometary glycine detected in samples returned by Stardust"। Meteoritics & Planetary Science44 (9): 1323। ডিওআই:10.1111/j.1945-5100.2009.tb01224.xবিবকোড:2009M&PS...44.1323E 
  11. "HALLEY'S COMET. - Research Assistance" 
  12. Weaver, H. A. (১৯৯৭-০৩-২৮)। "The Activity and Size of the Nucleus of Comet Hale-Bopp (C/1995 O1)"Science275 (5308): 1900–1904। ডিওআই:10.1126/science.275.5308.1900বিবকোড:1997Sci...275.1900W 
  13. Hanslmeier, Arnold (২০০৮-১১-১৪)। Habitability and Cosmic Catastrophes (ইংরেজি ভাষায়)। Springer Science & Business Media। পৃষ্ঠা ৯১। আইএসবিএন 978-3-540-76945-3 
  14. Fernández, Yanga R. (২০০০)। "The Nucleus of Comet Hale-Bopp (C/1995 O1): Size and Activity"Earth, Moon, and Planets89 (1/4): 3–25। ডিওআই:10.1023/A:1021545031431 
  15. "comet nucleus"www2.ess.ucla.edu। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৭-২৯ 

বহিঃসংযোগ[সম্পাদনা]