ক্বলব (মন)
ইসলামিক দর্শনে, ক্বলব বা কলব ( আরবি: قلب অর্থঃ হৃৎপিণ্ড বা মন) হলো উদ্দেশ্যমূলক ক্রিয়াকলাপগুলির উৎস যা মানুষের সমস্ত স্বজ্ঞাত কর্মের পিছনের কারণ। মস্তিষ্ক শারীরিক ছাপগুলি পরিচালনা করার সময় ক্বলব (মন) দায়ী। [১] মন এবং মস্তিষ্ক একসাথে কাজ করে তবে মন থেকে সত্যের জ্ঞান পাওয়া যায়।
ইসলামী চিন্তার মধ্যে, মন অনুভূতি ও আবেগ আসন নয়।[২] কিন্তু রূহু আরবি: روح ): অমর জ্ঞান । এটা যুক্তিযুক্ত আত্মা । [৩]
কুরআনে ক্বালব শব্দটি ১৩২ বার ব্যবহৃত হয়েছে।[৪]
শব্দতত্ত্ব
[সম্পাদনা]ক্বলব শব্দের দুটি অর্থ রয়েছে, হৃৎপিণ্ড তথা হৃদয়, অন্তর বা মন ও আরেকটি অর্থ হলো বুদ্ধিমত্ত্বা যা মাথা তথা মস্তিষ্কের সাথে সম্পর্কিত, শব্দটি আরবি শব্দ সদর-এর সঙ্গে কোরআন ও হাদীসে সম্পৃক্ত রয়েছে, এই সদর শব্দটিরও দুটি অর্থ রয়েছে, একটি হলো বুক বা বক্ষ এবং অপরটি হল কেন্দ্র, যা দৈহিক বুদ্ধিবৃত্তিক কেন্দ্র হিসেবে মাথা বা মস্তিষ্ককেও বোঝায়। এই দুটি অর্থই কাব্যিক ও বৈজ্ঞানিক উভয় দিক থেকেই ব্যখ্যাগত সামঞ্জস্যের সাথে প্রামাণ্য সঠিকতা রক্ষা করে, যা ওহী তথা কোরআন ও হাদীসের ঐশী অলৌকিকতার একটি নিদর্শন বলে ইসলামী পণ্ডিতগণ দাবি করেন। তবে ইসলামী নবী মুহাম্মদ (সাঃ) এর বক্ষ বিদারণের ঘটনা থেকে, যেখানে তার কলব বা হৃৎপিণ্ড পরিষ্কার করা হয় এবং কিছু হাদীসে তার বক্তব্য থেকে অধিকাংশ আলেমগণ কলব বা অন্তর বলতে হৃৎপিণ্ডকে নির্দেশ করে থাকেন।
হাদিস
[সম্পাদনা]নু‘মান ইবনু বাশীর (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ হালাল সুস্পষ্ট এবং হারামও সুস্পষ্ট। আর এ উভয়ের মধ্যে এমন অনেক সন্দেহভাজন বিষয় বা বস্ত্ত আছে, যে ব্যাপারে অনেক মানুষই এগুলো হালাল, কি হারাম- এ বিষয়ে অবগত নয়। এক্ষেত্রে যে ব্যক্তি সন্দেহজনক বিষয় হতে বিরত থাকবে, তার দীন ও মান-মর্যাদা পুত-পবিত্র থাকবে। আর যে ব্যক্তি সন্দেহে পতিত থাকবে, সে সহসাই হারামে জড়িয়ে পড়বে। বিষয়টি সেই রাখালের ন্যায়, যে রাখাল তার পশুপালকে নিষিদ্ধ এলাকার সীমার কাছাকাছি নিয়ে চরালো, তার পাল অজান্তেই নিষিদ্ধ এলাকায় ঢুকে পড়ার সম্ভাবনা থাকে। সাবধান! প্রত্যেক দায়িত্বশীলেরই (প্রশাসন বা সরকারেরই) চারণভূমি (নিষিদ্ধ এলাকা) আছে, আর আল্লাহ তা‘আলার নিষিদ্ধ চারণভূমি হারামসমূহকে নির্ধারিত করেছেন। মনে রাখতে হবে, মানব দেহের ভিতরে একটি গোশতপিন্ড আছে, যা ভালো থাকলে গোটা শরীরই ভালো থাকে। আর এটি নষ্ট হয়ে গেলে বা বিকৃতি ঘটলে সমস্ত শরীরটাই নষ্ট হয়ে যায়। সেই গোশতপিন্ডটিই হলো ‘কলব’ (অন্তঃকরণ)।
— বুখারী ৫২, মুসলিম ১৫৯৯, তিরমিযী ১২০৫, ইবনে মাজাহ ৪৯৮৪, আবূ দাঊদ ৩৩৩০, আহমাদ ১৮৩৭৪, মিশকাত ২৭৬২, দারিমী ২৫৭৩, চল্লিশ হাদিস ৬, সহীহ আত্ তারগীব ১৭৩১
রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ ... এরপর উসামাহ্ ইবনু যায়দ যায়দ এর হাদীসের অনুরূপ উল্লেখ করেছেন। তবে এ বর্ণনায় তিনি সামান্য কম-বেশি করেছেন। তারা উভয়ে যতটুকু বাড়িয়ে বলেছেন, তা হচ্ছে “নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের দেহকায় ও বাহ্যিক আকৃতির প্রতি দৃষ্টিপাত করেন না; বরং তিনি তোমাদের অন্তরসমূহের (ক্বলব) প্রতি দৃষ্টিপাত করেন। (এ বলে) তিনি তার আঙ্গুলের মাধ্যমে স্বীয় বক্ষের দিকে ইঙ্গিত করেন।
— মুসলিম ৬৪৩৬
আবূ হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ এক মুসলিম অপর মুসলিমের (দীনী) ভাই। মুসলিম ব্যক্তি অপর মুসলিমের ওপর অবিচার করবে না, তাকে অপদস্থ করবে না এবং অবজ্ঞা করবে না। আল্লাহভীতি এখানে! এ কথা বলে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) নিজের বক্ষের দিকে তিনবার ইঙ্গিত করে বললেনঃ একজন মানুষের জন্য এতটুকু অন্যায়ই যথেষ্ট যে, সে নিজের মুসলিম ভাইকে হেয় জ্ঞান করবে। মুসলিমের জন্য অপর মুসলিমের রক্ত, ধন-সম্পদ ও মান-সম্মান হারাম।
— মুসলিম ৩২-(২৫৬৪), সহীহ আত্ তারগীব ২৯৫৮, আহমাদ ৭৭২৭, শু‘আবুল ঈমান ৬৬৬০, আস্ সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী ১১৮৩০।
কেউ কেউ উপরে শেষোক্ত হাদীসটি দ্বারা দলীল দিয়ে বলেছেন, ‘আকল জ্ঞান কলবে থাকে, মাথায় (মস্তিষ্কে) নয়।[৫] অর্থাৎ এর দ্বারা তারা কলব বলতে হৃৎপিণ্ডকে বুঝিয়েছেন, যা ইসলামের সমসাময়িক প্রাচীন ও আধুনিক বর্তমান আরবি ভাষায় একই সাথে মন ও হৃৎপিণ্ড উভয়কেই বোঝাতে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর তার হাদীসের নামে জালিয়াতি বইতে এ বিষয়ে বলেন, "সমাজের বহুল প্রচলিত একটি বাক্য: ‘‘মুমিনের হৃদয় আল্লাহর আরশ’’: ‘বাড়ির পাশে আরশি নগর’!! এ বিষয়ে বিভিন্ন বাক্য প্রচলিত, যেমন: الْـقَـلْـبُ بَـيْـتُ الـرَّبِّ : হৃদয় প্রভুর বাড়ি। قَلْـبُ الْمُـؤْمِنِ عَـرْشُ اللهِ : মুমিনের হৃদয় আল্লাহর আরশ। مَا وَسِعَنِيْ أَرْضِيْ وَلاَ سَمَائِيْ وَلَكِنْ وَسِعَنِيْ قَلْبُ عَبْدِيْ الْمُؤْمِن আমার যমিন এবং আমার আসমান আমাকে ধারণ করতে পারে নি, কিন্তু আমার মুমিন বান্দার কলব বা হৃদয় আমাকে ধারণ করেছে। এগুলো সবই বানোয়াট হাদীস। কোনো কোনো আলিম বাক্যগুলি তাঁদের গ্রন্থে সনদবিহীনভাবে হাদীস হিসাবে উল্লেখ করেছেন। মুহাদ্দিসগণ অনেক গবেষণা করেও এগুলোর কোন সনদ পান নি, বা কোন হাদীসের গ্রন্থে এগুলোর উল্লেখ পান নি। এগুলি সনদবিহীন জাল কথা।[৬]"
ক্বলব দূষিত হওয়ার কারণ
[সম্পাদনা]সালাফি মতবাদ অনুসারে, মানুষের কলব নাপাক হয় তার ভ্রান্ত আকীদা-বিশ্বাসের কারণে। আর এটা হলো, সবচেয়ে মারাত্মক নাপাকি। যেসব ভুল আকীদার কারণে কলব নাপাক হয় তা হলো:
১. শির্ক করা: মহান আল্লাহর উলুহিয়্যাত, রুবুবিয়্যাত ও নাম-গুণাবলির সাথে শির্ক করা।
২. সন্দেহ পোষণ: আল্লাহর অস্তিত্ব ও পরকাল আছে কি না এ বিষয়ে সন্দেহ পোষণ করা বা তা অবিশ্বাস করা । যেমন- কাফিরেরা পরকালে বিশ্বাস করে না। আবার কিছু মুসলিমের মনে পরকাল নিয়ে সন্দেহ-সংশয় রয়েছে।
৩. মুনাফিকী চরিত্র: অন্তরের বিশ্বাসের সাথে বাস্তব কাজের গরমিল। অর্থাৎ বাইরে যা সে আমল করে প্রকৃতপক্ষে অন্তরে তা বিশ্বাস করে না।
৪. শির্ক মিশ্রিত আকীদা: এমন আকীদা বিশ্বাস পোষণ ও আমল করা যার সাথে শির্কী চিন্তা ও ধ্যান-ধারণা মিশ্রিত রয়েছে ।
৫. রিয়া বা লোকদেখানো ইবাদাত: মানুষকে দেখানো বা সমাজে সুনাম-সুখ্যাতি অর্জনের জন্য ভালো কাজ করা।
৬. গোঁড়ামি বশতঃ সত্য বর্জন করা: সত্যকে সত্য বলে জানা সত্ত্বেও গোঁড়ামি বশতঃ তা গ্রহণ না করা।
৭. হিংসা করা: অন্যের ভালো দেখতে না পারা, এতে ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়া এবং তা নষ্ট হয়ে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা করা।
৮. তাকাব্বরী বা অহংকার করা: কথায় ও কাজে-কর্মে নিজেকে বড় ও অন্যকে ছোট মনে করা।
৯. বিদআতী ও কুফরী আকীদা-বিশ্বাস পোষণ করা: এ কাজগুলোর সবকটাই কলবের সাথে জড়িত। এতেই কলব নাপাক হয় । আর কলব নাপাক হওয়া বান্দা যদি ওযু-গোসল করার মাধ্যমে পবিত্র হয় না। এ থেকে পবিত্র হতে হলে তাকে অবশ্যই তাওবা করতে হবে, এগুলো থেকে বেরিয়ে আসতে হবে এবং খালেস দিলে আল্লাহ ও পরকালের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে ।[৭]
কলব কঠিন হওয়ার কারণ
[সম্পাদনা]আবুল কাসেম মুহাম্মাদ মাসুম বিল্লাহ তার "অন্তর (ক্বালব) কঠিন হয়ে যায় কেন?" রচনায় অন্তর (ক্বালব) কঠিন হয়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে বলেনঃ[৮]
- . নামাযের জামা‘আতে হাযির হওয়ার ব্যাপারে অবহেলা ও গাফলতি করা এবং মসজিদে সকাল সকাল না যাওয়া বরং দেরী করা।
- - কুরআনকে পরিত্যাগ করা অর্থাৎ বিনয়-নম্রতা আর মনোযোগ এবং চিন্তা গবেষণাসহকারে কুরআন তেলাওয়াত না করা।
- - হারাম রুজি যেমন: সুদ, ঘুষ, মাল্টিপারপাস, ইন্স্যুরেন্স এবং বেচাকেনাসহ বিভিন্ন লেনদেনে প্রতারণা ও জালিয়াতি সহ অন্যান্য হারাম পদ্ধতিতে রুজি-রোজগার করার কারণে।
- - অহংকার, বড়াই, প্রতিশোধপরায়ণতা, মানুষের দোষ-ত্রুটি বা অপরাধকে মাফ না করা, মানুষকে অবহেলা করে নিকৃষ্ট মনে করা, মানুষকে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করা।
- - দুনিয়ার প্রতি আসক্ত হয়ে ঝুঁকে পড়া, দুনিয়া দ্বারা প্রতারিত হওয়া এবং মৃত্যুকে, কবরকে এমনকি আখেরাতকে ভুলে যাওয়া।
- - যে কোনো বেগানা নারীর দিকে তাকানো হারাম; যা অন্তরকে কঠোর করে দেয়।
- দাঁড়ি গজায়নি এখনো এমন সুন্দর ছেলের দিকে অযথা তাকানো হারাম; তাই সেটাও অন্তর কঠোর করে দেওয়ার অন্যতম কারণ।
- - আমি নিজে প্রতিদিন কি কি খারাপ কাজ করলাম? নিজের সমালোচনা নিজে না করা, বরং মানুষের সমালোচনা করা।
- - অনেক দিন দুনিয়ায় থাকবো, অনেক কিছুর মালিক হবো এমন ভুল ধারণা মনের ভিতর থাকা।
- - আল্লার যিকির বেশী বেশী না করে বরং বেশী বেশী কথা বলা, বেশী বেশী হাসাহাসি-তামাশা এবং মশকারী বা মজাক করা।
- - বেশী খাওয়া-দাওয়া করা।
- - বেশী ঘুম যাওয়া।
- - মানুষের উপর জুলুম করা।
- - শরীয়তের কোনো আদেশ-নিষেধ লঙ্ঘন হওয়ার কারণ ব্যতীত অন্য কোনো কারণে রাগ করা।
- - ইসলামের দাওয়াত দেওয়ার উদ্দেশ্য ব্যতীত কাফেরের দেশ ভ্রমণে বের হওয়া।
- - মিথ্যা, গীবত (পরচর্চা) এবং একজনের কথা অন্যের নিকট গিয়ে বলার মাধ্যমে উভয়ের মধ্যে ফাসাদ সৃষ্টি করা।
- - খারাপ মানুষের সাথে উঠাবসাও চলাফেরা করা।
- অন্য মুসলিমকে মনে মনে অথবা প্রকাশ্য হিংসা করা।
- - একজন মুসলিমের উন্নতি সহ্য করতে না পারা, বরং তার ধ্বংস কামনা করা।
- - অন্য মুসলিম ভাইয়ের সাথে শত্রুতা করা, ঘৃণা করা এবং তাকে অপছন্দ করা।
- - আপনার নিজের বা মুসলিম ভাইয়ের কোনো লাভ বা ফায়েদা ব্যতীত নিজের ও অপরের সময় নষ্ট করা।
- - ইসলামী জ্ঞান শিক্ষা না করা এবং ইসলামী শিক্ষা হতে নিজকে দূরে সরিয়ে রাখা।
- - জাদুকর, গণক, জোতিষী, তন্ত্রমন্ত্রকারীর নিকট যাওয়া।
- - মাদক, নেশাজাতীয় দ্রব্য, বিড়ি-সিগারেট, হুক্কা সহ যাবতীয় তামাক ও তামাকজাত এবং ক্ষতিকর দ্রব্য পান করা।
- - সকাল-সন্ধ্যার যিকরসমুহ পাঠ না করা।
- - গান শোনা, হিন্দী সহ যাবতীয় নগ্ন, চরিত্রহীন হারাম চলচ্চিত্র দেখা, পতিত (খারাপ) অশ্লীল পত্রিকা ম্যাগাজিন পাঠ করা।
- - আল্লাহর নিকট সর্বদা গুরুত্বসহকারে দো‘আ না করা।
ক্বালব বিশুদ্ধ করার পদ্ধতি
[সম্পাদনা]ক্বলব বা অন্তর বিশুদ্ধ করার সর্বোত্তম পন্থা হলো আল্লাহ তাআলার জিকির,স্মরণ,নামের কীর্তন করা।পবিত্র কুরআনে বর্ণিত রয়েছেঃ
'আলা বি জিকরিল্লাহি তাত্বমাইন্নুল ক্বুলুব' অর্থাৎ জেনে রেখো! আল্লাহর জিকিরেই অন্তরে প্রশান্তি আসে।
সেজন্যই সূফী-সাধক,পীর-মাশায়েখগন অতি গুরুত্বের সাথে জিকিরের তালিম দিয়ে থাকেন।
সুফি
[সম্পাদনা]ক্বলব সুফি দর্শনে ছয়টি পবিত্রতা বা লাতাইফ-ই-সত্তার এর মধ্যে দ্বিতীয় বোঝায়। পরিচর্যা করা তাসফিয়া-ই-ক্বলব, সালিক নিম্নলিখিত ষোল লক্ষ্য অর্জন করতে হবে।
- সন্ন্যাসব্রত বা মন্দ থেকে অব্যাহতি ।
- তাকওয়া
- আল্লাহর সাথে সম্পর্কিত নয় এমন বিষয় থেকে দূরে সরে যাওয়ার চেষ্টা।
- তাওয়াক্কুল বা আল্লাহ যা কিছু দেন তাতে সন্তুষ্ট থাকা।
- আল্লাহ যা কিছু করেন সে সম্পর্কে সাবর বা ধৈর্য রাখা।
- শুকর বা আল্লাহ যা কিছু দেন তাতে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা।
- আল্লাহর সন্তুষ্টি চাওয়া।
- খাউফ বা আল্লাহর ক্রোধের ভয় করা।
- রিজা বা আল্লাহর নেয়ামতের আশা করা।
- ইয়াকিন বা আল্লাহর প্রতি সম্পূর্ণ বিশ্বাস
- ইখলাস বা নিয়তের বিশুদ্ধতা।
- সিদক বা আল্লাহর সত্য বহন করা।
- মুরাকাবা
- আল্লাহর জন্য খুলক বা বিনীততা
- ধিকর বা আল্লাহর স্মরণ
- আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোন ঈশ্বরের কাছ থেকে খুলত বা বিচ্ছিন্নতা।
সালাফি
[সম্পাদনা]সালাফি মতে, ক্বলবের রোগের প্রতিকার বা চিকিৎসা হলো সত্যের আশ্রয় নেয়া, বেশী বেশী করে নফল ছালাত আদায় করা, গভীর রাতে ছালাতে অশ্রু ঝরানো, সকল প্রকার পাপ পরিহার করা।[৪]
وَالَّذِيْنَ جَاهَدُوْا فِيْنَا لَنَهْدِيَنَّهُمْ سُبُلَنَا وَإِنَّ اللهَ لَمَعَ الْمُحْسِنِيْنَ. ‘যারা আমার পথে সাধনায় আত্মনিয়োগ করে, আমি তাদেরকে অবশ্যই আমার পথে পরিচালিত করব। নিশ্চয়ই আল্লাহ সৎ কর্মপরায়ণদের সাথে আছেন’
— (আনকাবূত ৬৯)।
এ জন্য কলব পরিষ্করণের জন্য তারা ইসলামী নবী মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর জীবনাদর্শ বাস্তবে রূপায়িত করাকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেন। কুরআনে রয়েছে,,
لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِيْ رَسُوْلِ اللهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِّمَنْ كَانَ يَرْجُو اللهَ وَالْيَوْمَ الْآخِرَ وَذَكَرَ اللهَ كَثِيْرًا.‘যারা আল্লাহ ও শেষ দিবসের আশা রাখে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে, তাদের জন্য রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর মধ্যে উত্তম নমুনা রয়েছে’
— (আহযাব ২১)।
কলবের জন্য দোয়া ও জিকির
[সম্পাদনা]সালাফী মতে, ক্বলবের চিকিৎসায় সুন্নাতী যিকির চির সঙ্গী করা একান্ত কর্তব্য। কারণ যিকির ক্বলবের সকল প্রকার ময়লা দূরীভূত করতে সক্ষম। উল্লেখ্য, বর্তমানে প্রচলিত মিথ্যা, বানোয়াট ও ভেজাল প্রক্রিয়ার যিকির সবার জন্যে সর্বদা পরিতাজ্য। যেমন- ছেলে-মেয়ে একাকার হয়ে অন্ধকারে সমস্বরে ‘ইল্লাল্লাহ’ ইল্লাল্লাহ, আল্লাহ-আল্লাহ, হু-হু ইত্যাদি যিকির। এ ধরনের যিকির ক্বলবের রোগ আরো বৃদ্ধি করে।[৪]
উম্মু সালামা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) প্রায়ই নিম্নে বর্ণিত দো‘আটি পাঠ করতেন, يَامُقَلِّبَ الْقُلُوْبِ ثَبِّتْ قَلْبِىْ عَلَى دِيْنِكَ ‘হে অন্তর সমূহের পরিবর্তনকারী! আমার অন্তরকে আপনার দ্বীনের উপর স্থির রাখুন’। رَبَّنَا لاَ تُزِغْ قُلُوْبَنَا بَعْدَ إِذْ هَدَيْتَنَا وَهَبْ لَنَا مِن لَّدُنْكَ رَحْمَةً إِنَّكَ أَنْتَ الْوَهَّابُ. ‘হে আমার প্রতিপালক! আমাদের পথ-প্রদর্শনের পর আমাদের অন্তরসমূহ বক্র করবেন না এবং আমাদেরকে আপনার নিকট হ’তে করুণা প্রদান করুন, নিশ্চয়ই আপনি প্রচুর প্রদানকারী’ (আলে ইমরান ৮)।
ইসলামী নবী মুহাম্মাদ (সাঃ) এই দো‘আটিও পাঠ করতেন,
اَللَّهُمَّ مُصَرِّفَ الْقُلْوْبِ صَرِّفْ قُلُوْبَنَا عَلَى طَاعَتِكَ ‘হে ক্বলব পরিবর্তনকারী আল্লাহ! আমাদের ক্বলবগুলোকে আপনার আনুগত্যের দিকে ঘুরিয়ে দিন’।
اَللَّهُمَّ إِنِّىْ اَعُوْذُبِكَ مِنَ الْعَجْزِ وَالْكَسَلِ وَالْبُخْلِ وَالْهَرَمِ وَعَذَابِ الْقَبْرِ، اَللَّهُمَّ آتِ نَفْسِىْ تَقْوَاهَا وَزَكِّهَا أَنْتَ خَيْرُ مَنْ زَكَّاهَا أَنْتَ وَلِيُّهَا وَمَوْلاَهَا، اَللَّهُمَّ إِنِّىْ أَعُوْذُبِكَ مِنْ عِلْمٍ لاَ يَنْفَعُ وَمِنْ قَلْبٍ لاَيَخْشَعُ وَمِنْ نَفْسٍ لاَتَشْبَعُ وِمِنْ دَعْوَةٍ لاَيُسْتَجَابُ لَهَا.
‘হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে আশ্রয় চাচ্ছি অক্ষমতা ও অলস্য থেকে, কার্পণ্য ও বার্ধক্য থেকে এবং কবরের আযাব থেকে। হে আল্লাহ! আমার ক্বলবে তাক্বওয়া দান করুন এবং তাকে পাক করে দিন, আপনি সবচাইতে পাক-পবিত্রকারী। আপনি তার অভিভাবক ও মালিক। হে আল্লাহ! আপনার কাছে আশ্রয় চাই অপকারী ইলম থেকে, আল্লাহর ভয়শূন্য ক্বলব থেকে, অতৃপ্ত আত্মা থেকে এবং এমন দো‘আ থেকে যা কবুল হয় না’।
শাকাল ইবনে হুমাইদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি বললাম, ‘হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আমাকে একটি দো‘আ শিখিয়ে দিন। তিনি বললেন, তুমি বল,
اَللَّهُمَّ إِنِّىْ أَعُوْذُبِكَ مِنْ شَرِّ سَمْعِىْ وِمِنْ شَرِّ بَصَرِىْ وِمِنْ شَرِّ لِسَانِىْ وَمِنْ شَرِّ قَلْبِىْ وِمِنْ شَرِّ مَنِيِّىْ.
‘হে আল্লাহ! আমি আশ্রয় চাই আপনার কাছে আমার শ্রবণের অনিষ্ট থেকে, আমার দৃষ্টির অনিষ্ট থেকে, আমার জিহবার অনিষ্ট থেকে, আমার ক্বলবের অনিষ্ট থেকে এবং আমার লজ্জাস্থানের অনিষ্ট থেকে’।
পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছে এরূপ অসংখ্য যিকির রয়েছে, যা দ্বারা ক্বলব পরিষ্কার করা যায়।
আরও দেখুন
[সম্পাদনা]তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ Treiger, Alexander (২০১১)। Inspired Knowledge in Islamic Thought: Al-Ghazali's Theory of Mystical Cognition and Its Avicennian Foundation। Routledge। পৃষ্ঠা 8। আইএসবিএন 978-1-136-65562-3।
- ↑ von Grunebaum, Gustave E. (২০১০)। Medieval Islam: A Study in Cultural Orientation। University of Chicago Press। পৃষ্ঠা 116। আইএসবিএন 978-0-226-86492-1।
- ↑ Rassool, G. Hussein (২০১৫)। Islamic Counselling: An Introduction to Theory and Practice। Routledge। পৃষ্ঠা 41। আইএসবিএন 978-1-317-44125-0।
- ↑ ক খ গ বিন ইলইয়াস, খাইরুল ইসলাম (ডিসেম্বর ২০১০)। "ক্বলব : মানব দেহের রাজধানী - খাইরুল ইসলাম বিন ইলইয়াস"। মাসিক আত-তাহরীক।
- ↑ (শারহে মুসলিম ১৬শ খন্ড, হাঃ ২৫৬৪)
- ↑ মোল্লা আলী কারী, আল আসরার, ১৭০ ও ২০৬ পৃ; আল-মাসনূয়, ১০০ ও ১৩০ পৃ; যারকানী, মুখতাসারুল মাকাসিদ ১৪৬ ও ১৭১ পৃ; আহমাদ ইবন তাইমিয়া, আহাদীসুল কুসসাস, ৫৩-৫৫ পৃ; সাখাবী, আল-মাকাসিদ আল-হাসানা, ৩১৫ ও ৩৭৪ পৃ; ইবনু আর্রাক, তানযীহ ১/১৪৮।
- ↑ "২. কী কী কাজে কলব নাপাক হয়?"। www.hadithbd.com। সংগ্রহের তারিখ ১৮ মার্চ ২০২৩।
- ↑ "অন্তর কঠিন হয়ে যায় কেন? - বাংলা"। IslamHouse.com। সংগ্রহের তারিখ ২৫ মার্চ ২০২৩।