কোয়ান্টাম সুড়ঙ্গ

কোয়ান্টাম সুড়ঙ্গ (ইংরেজি: Quantum tunneling) হল কোয়ান্টাম বলবিজ্ঞানের একটি ঘটনা যেখানে একটি অতিপারমাণবিক কণা এমন একটি বিভব বাধা অতিক্রম করতে পারে, যা চিরায়ত বলবিজ্ঞান অনুযায়ী সম্ভব নয়।
বিভিন্ন বাস্তব ঘটনাবলীতে কোয়ান্টাম সুড়ঙ্গের ভূমিকা প্রয়োজনীয়। উদাহরণস্বরূপ একটি প্রধান অনুক্রম তারকা, যেমন সূর্যের কেন্দ্রীণ সংযোজন প্রক্রিয়াতে (নিউক্লিয়ার ফিউশন) কোয়ান্টাম সুড়ঙ্গের সৃষ্টি হয়।[১] সুড়ঙ্গ ডায়োড,[২] কোয়ান্টাম পরিগণনা এবং ক্রমবেক্ষক সুড়ঙ্গ অণুবীক্ষণ যন্ত্রে এর গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োগ রয়েছে। বিংশ শতাব্দীর শুরুতেই কোয়ান্টাম সুড়ঙ্গের অস্তিত্বের ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছিল। এরপর ঐ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে এসে এটিকে সাধারণ বাস্তব ঘটনা হিসেবে স্বীকার করে নেয়া হয়।[৩]
এই ঘটনাটিতে কোয়ান্টাম বলবৈজ্ঞানিক ধারণা ভিত্তি হিসেবে কাজ করে, যেটি কোয়ান্টাম টানেলিংকে কোয়ান্টাম বলবিদ্যার একটি মহৎ নিহিতার্থ হিসেবে তুলে ধরেছে। অণুপ্রক্রিয়াজাতকারক বা মাইক্রোপ্রসেসরে ব্যবহৃত ট্রানজিস্টরগুলির আকার কী হবে, তা কোয়ান্টাম সুড়ঙ্গ ঠিক করে দেয়। কেননা ট্রানজিস্টরের আকার বেশি ছোট হলে ইলেকট্রনগুলি ট্রানজিস্টর থেকে সুড়ঙ্গের মাধ্যমে বের হয়ে যেতে সক্ষম হয়।[৪][৫]
কোয়ান্টাম সুড়ঙ্গকে প্রায়ই হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা নীতির দ্বারা ব্যাখ্যা করা হয়, যা অনুযায়ী কোনও কোয়ান্টাম বস্তুকে সাধারণভাবে একই সাথে একটি তরঙ্গ ও একটি কণা হিসেবে গণ্য করা হয়।
ইতিহাস
[সম্পাদনা]তেজস্ক্রিয়তা নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে প্রথম কোয়ান্টাম সুড়ঙ্গের ধারণাটির উৎপত্তি ঘটে।[৩] অঁরি বেকেরেল ১৮৯৬ সালে তেজস্ক্রিয়তা আবিষ্কার করেন।[৬] মারি ক্যুরি ও পিয়ের ক্যুরি তেজস্ক্রিয়তা নিয়ে আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন এবং এই গবেষণাকর্মগুলির জন্য ১৯০৩ খ্রিস্টাবে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পান।[৬] নিউজিল্যান্ডের পদার্থবিজ্ঞানী আর্নেস্ট রাদারফোর্ড ও অস্ট্রীয় পদার্থবিজ্ঞানী এগন শভাইডলার তেজস্ক্রিয়তার প্রকৃতি নিয়ে গবেষণা করেন, এবং পরবর্তীতে ফ্রিডরিখ কোলরাউশ পরীক্ষার সাহায্যে এর সত্যতা প্রতিপাদিত করেন। অর্ধায়ু এবং ক্ষয়ের ভবিষ্যদ্বাণীর ধারণা তাঁর গবেষণাকর্ম থেকেই পাওয়া যায়।[৩]
১৯০১ সালে রবার্ট ফ্রান্সিস এয়ারহার্ট মাইকেলসন ইন্টারফেরোমিটার ব্যবহার করে অল্প দূরত্বে থাকা তড়িৎদ্বারগুলির মধ্যবর্তী গ্যাসের তড়িৎ পরিবাহিতা নিয়ে গবেষণা করার সময় একটি পরিবাহিতার একটি অপ্রত্যাশিত জগৎ আবিষ্কার করেন। জে. জে. টমসন মন্তব্য করেন যে এটা নিয়ে আরও গবেষণার দরকার। এরপর ১৯১৪ সালে স্নাতক শিক্ষার্থী ফ্রানৎস রোটার একটি সংবেদী প্লাটফর্ম গ্যালভানোমিটার দিয়ে এয়ারহার্টের পদ্ধতিটি তড়িৎদ্বার বিচ্ছিন্নতা নিয়ন্ত্রণ ও পরিমাপ করার জন্য ব্যবহার করেন, এবং তার সাহায্যে সরাসরি স্থিরক্ষেত্র নির্গমন বিদ্যুৎ পরিমাপ করেন। ১৯২৬ সালে রোটার, 26 pA সংবেদনশীলতার একটি নতুন প্লাটফর্ম গ্যালভানোমিটার ব্যবহার করে একটি "শক্ত" শূন্যস্থানে কাছাকাছি দূরত্বের ইলেক্ট্রোডের মধ্যে ক্ষেত্র নির্গমন বিদ্যুৎ এর পরিমাপ করেন।[৭]
জার্মান পদার্থবিজ্ঞানী ফ্রিডরিখ হুন্ড দ্বি-কূপ বিভবের ভিত্তি দশা গণনা করতে গিয়ে প্রথম ১৯২৭ সালে কোয়ান্টাম সুড়ঙ্গ লক্ষ করেন।[৬] এবং স্বাধীনভাবে একই বছরে লিওনিড ম্যান্ডেলস্টাম এবং মিখাইল লিওনটোভিচ একটি সীমিত স্থানের আবদ্ধ বিভবে একটি কণার গতির জন্য সেইসময় নতুন আবিষ্কৃত শ্রোডিঙারের তরঙ্গ সমীকরণের তাৎপর্য বিশ্লেষণ করতে গিয়ে কোয়ান্টাম সুড়ঙ্গ আবিষ্কার করেন।[৮] এর প্রথম প্রয়োগ ছিল আলফা ক্ষয় এর একটি গাণিতিক ব্যাখ্যা, যা ১৯২৮ সালে জর্জ গ্যামোর কাজ ছিল। তিনি মান্ডেলস্টাম এবং লিওন্টোভিচ এর আবিষ্কার সম্পর্কে জানতেন।[৯] আবার স্বাধীনভাবে রোনাল্ড গারনি এবং এডওয়ারড কনডনও এই প্রয়োগটি আবিষ্কার করেন।[১০][১১][১২][১৩] এই দুই গবেষক একইসাথে একটি আদর্শ নিউক্লীয় বিভব এর জন্য শ্রোডিঙারের সমীকরণের সমাধান করেন এবং কণার অর্ধায়ু এবং নির্গমনের শক্তির মধ্যে সম্পর্ক প্রতিপাদন করেন যা প্রত্যক্ষভাবে সুড়ঙ্গের গাণিতিক বৈশিষ্ট্যের উপর নির্ভরশীল।
গ্যামো এর একটি আলোচনাসভায় উপস্থিত হবার পর মাক্স বর্ন সুড়ঙ্গের সাধরনতাকে বুঝতে পারেন। তিনি অনুধাবন করেন যে এটি কেবল পারমাণবিক পদার্থবিজ্ঞান ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি কোয়ান্টাম বলবিদ্যার একটি সাধারণ ফলাফল যা বিভিন্ন ব্যবস্থাতেই প্রয়োগযোগ্য।[৩] এর খুব কম সময়ের মধ্যেই কেন্দ্রীণে কণার সুড়ঙ্গের পরিস্থিতি নিয়ে বিবেচনা করা হয়। অর্ধপরিবাহী নিয়ে গবেষণা এবং ট্রানজিস্টর ও ডায়োড এর আবিষ্কারের ফলে ১৯৫৭ সালে ইলেকট্রনের সুড়ঙ্গ স্বীকৃত হয়। লিও এসাকি, ইভার ইয়্যাভার এবং ব্রায়ান জোসেফসন অতিপরিবাহী কুপার যুগলের সুড়ঙ্গের ভবিষ্যদ্বাণী করেন, যার জন্য তারা ১৯৭৩ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পান।[৩] ২০১৬ সালে জলের কোয়ান্টাম সুড়ঙ্গ আবিষ্কৃত হয়।[১৪]
তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ Serway; Vuille (২০০৮)। College Physics। খণ্ড ২ (Eighth সংস্করণ)। Belmont: Brooks/Cole। আইএসবিএন ৯৭৮-০-৪৯৫-৫৫৪৭৫-২।
- ↑ Taylor, J. (২০০৪)। Modern Physics for Scientists and Engineers। Prentice Hall। পৃ. ২৩৪। আইএসবিএন ৯৭৮-০-১৩-৮০৫৭১৫-২।
- 1 2 3 4 5 Razavy, Mohsen (২০০৩)। Quantum Theory of Tunneling। World Scientific। পৃ. ৪, ৪৬২। আইএসবিএন ৯৭৮-৯৮১২৫৬৪৮৮৭।
- ↑ "Quantum Computers Explained – Limits of Human Technology"। youtube.com। Kurzgesagt। ৮ ডিসেম্বর ২০১৭। সংগ্রহের তারিখ ৩০ ডিসেম্বর ২০১৭।
- ↑ "Quantum Effects At 7/5nm And Beyond"। Semiconductor Engineering (মার্কিন ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ১৫ জুলাই ২০১৮।
- 1 2 3 Nimtz; Haibel (২০০৮)। Zero Time Space। Wiley-VCH। পৃ. ১।
- ↑ Thomas Cuff। "The STM (Scanning Tunneling Microscope) [The forgotten contribution of Robert Francis Earhart to the discovery of quantum tunneling.]"। ResearchGate।
- ↑ Mandelstam, L.; Leontowitsch, M. (১৯২৮)। "Zur Theorie der Schrödingerschen Gleichung"। Zeitschrift für Physik। ৪৭ (1–2): ১৩১–১৩৬। বিবকোড:1928ZPhy...47..131M। ডিওআই:10.1007/BF01391061।
- ↑ Feinberg, E. L. (২০০২)। "The forefather (about Leonid Isaakovich Mandelstam)"। Physics-Uspekhi। ৪৫ (1): ৮১–১০০। বিবকোড:2002PhyU...45...81F। ডিওআই:10.1070/PU2002v045n01ABEH001126।
- ↑ Gurney, R. W.; Condon, E. U. (১৯২৮)। "Quantum Mechanics and Radioactive Disintegration"। Nature। ১২২ (3073): ৪৩৯। বিবকোড:1928Natur.122..439G। ডিওআই:10.1038/122439a0।
- ↑ Gurney, R. W.; Condon, E. U. (১৯২৯)। "Quantum Mechanics and Radioactive Disintegration"। Phys. Rev.। ৩৩ (2): ১২৭–১৪০। বিবকোড:1929PhRv...33..127G। ডিওআই:10.1103/PhysRev.33.127।
- ↑ Bethe, Hans (২৭ অক্টোবর ১৯৬৬)। "Hans Bethe - Session I"। Niels Bohr Library & Archives, American Institute of Physics, College Park, MD USA (সাক্ষাৎকার)। সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন Charles Weiner; Jagdish Mehra। Cornell University। সংগ্রহের তারিখ ১ মে ২০১৬।
{{সাক্ষাৎকার উদ্ধৃতি}}: উদ্ধৃতি শৈলী রক্ষণাবেক্ষণ: একাধিক নাম: সাক্ষাৎকারগ্রাহকগণের তালিকা (লিঙ্ক) - ↑ Friedlander, Gerhart; Kennedy, Joseph E.; Miller, Julian Malcolm (১৯৬৪)। Nuclear and Radiochemistry (2nd সংস্করণ)। New York: John Wiley & Sons। পৃ. ২২৫–৭। আইএসবিএন ৯৭৮-০-৪৭১-৮৬২৫৫-০।
{{বই উদ্ধৃতি}}: আইএসবিএন / তারিখের অসামঞ্জস্যতা (সাহায্য) - ↑ Kolesnikov, Alexander I.; Reiter, George F.; Choudhury, Narayani; Prisk, Timothy R.; Mamontov, Eugene; Podlesnyak, Andrey; Ehlers, George; Seel, Andrew G.; Wesolowski, David J. (২০১৬)। "Quantum Tunneling of Water in Beryl: A New State of the Water Molecule"। Physical Review Letters। ১১৬ (16): ১৬৭৮০২। ডিওআই:10.1103/PhysRevLett.116.167802।
পরিভাষা
[সম্পাদনা]- Classical mechanics - চিরায়ত বলবিজ্ঞান
- Double-well potential - দ্বি-কূপ বিভব
- Field electron emission - ক্ষেত্র ইলেকট্রন নির্গমন
- Field emission currents - ক্ষেত্র নির্গমন বিদ্যুৎ
- Ground state - ভিত্তি দশা
- Main sequence - প্রধান অনুক্রম
- Nuclear fusion - কেন্দ্রীণ সংযোজন
- Nuclear physics - নিউক্লীয় পদার্থবিজ্ঞান, পারমাণবিক পদার্থবিজ্ঞান
- Nucleus - কেন্দ্রীণ
- Phenomenon - ঘটনা, প্রপঞ্চ
- Potential - বিভব
- Potential barrier - বিভব বাধা
- Quantum computing - কোয়ান্টাম গণনা
- Quantum mechanics - কোয়ান্টাম বলবিজ্ঞান
- Radioactivity - তেজস্ক্রিয়তা
- Subatomic particle - অতিপারমাণবিক কণা
- Superconducting Cooper pair - অতিপরিবাহী কুপার যুগল
- Uncertainty principle - অনিশ্চয়তা নীতি