করদোবার রোমান সেতু
করদোবার রোমান সেতু (স্পেনীয় - Puente romano de Córdoba, উচ্চারন - পুয়েন্তে রোমানো দে করদোবা) হল দক্ষিণ স্পেনের আন্দালুসিয়া স্বায়ত্ত্বশাসিত কমিউনিটির অন্তর্গত করদোবা শহরের পাশ দিয়ে প্রবাহিত গুয়াদালকিবির নদীর উপরে প্রতিষ্ঠিত একটি প্রাচীন সেতু। প্রায় দুই সহস্রাব্দ পুরনো এই সেতুটি পুয়েন্তে বিয়েখো (Puente viejo) বা "পুরনো সেতু" নামেও সাধারণ্যে পরিচিত। করদোবা শহরের ঐতিহ্য ও পরিচিতির সাথে এই সেতুটির নাম আজ অঙ্গাঙ্গীভাবেই জড়িত। বস্তুত বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে সান রাফায়েল সেতু (Puente de San Rafael) তৈরি[১] হবার আগে পর্যন্ত গুয়াদালকিবির নদীর উপর দিয়ে শহরে যাতায়াতের জন্য এই একটি সেতুর উপরেই মানুষ প্রায় ২০০০ বছর ধরে নির্ভর করে এসেছে।
১৯৩১ সাল থেকে এই সেতু্কে সেতু সংলগ্ন ফটক লা পুয়েরতা দে পুয়েন্তে (la Puerta de puente) ও কালাওরা মিনার (Torre de calahorra)'এর সঙ্গে একযোগে স্পেনের সংস্কৃতিমন্ত্রক "মনুমেন্ট" হিসেবে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য'এর (Bien de interés cultural; বিয়েন দে ইনতেরেস কুলতুরাল) মর্যাদা দান করে।[২] করদোবা শহরের ঐতিহাসিক অংশের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ এই সেতু। ১৯৮৪ সালে ইউনেস্কো থেকে করদোবা শহরের ঐতিহাসিক কেন্দ্রকে যে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের মর্যাদা দান করা হয়, তার অন্যতম অংশ হিসেবে এই সেতুকেও বিবেচনা করা হয়ে থাকে।[৩] ২০০৪ সালের ১ মে থেকে এই সেতুতে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। এখন এটি শুধুমাত্র পদচারীদের জন্য উন্মুক্ত।[৪][৫]
ইতিহাস
[সম্পাদনা]দুই সহস্রাধিক বছরের পুরনো এই সেতু স্বভাবতই অনেক ইতিহাসের সাক্ষী। প্রথম নির্মাণ থেকে আরম্ভ করে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সংস্কার ও পুনর্নির্মাণের মধ্য দিয়ে গিয়ে তা এখন তার বর্তমান চেহারায় পৌঁছেছে। এর ইতিহাসের বিভিন্ন পর্ব নিচে সংক্ষেপে আলোচনা করা হল।
রোমান আমল
[সম্পাদনা]রোমান ঐতিহাসিক আউলো হিরথিও'র লেখায় পাওয়া যায়, পম্পের বিরুদ্ধে লড়াই'এর সময় (৪৯ - ৪৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) জুলিয়াস সিজার যখন কর্দোবা শহরে উপস্থিত হন, তখন গুয়াদালকিবির নদী পেরিয়ে শহরে সেনাবাহিনীর প্রবেশের উদ্দেশ্যে একটি অস্থায়ী সেতু নির্মাণ করান, যার উপর দিয়ে সিজারের সেনা অন্তত তিনবার পারাপার করে।[৬] অর্থাৎ, জুলিয়াস সিজারের আগমণের আগে পর্যন্ত নদী পার হয়ে শহরে প্রবেশের জন্য কোনও সেতু ছিল না। যতদূর সম্ভব, সিজারনির্মিত এই কাঠের সেতুটির স্থলেই খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীতে (মতান্তরে খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দীতে) গুয়াদালকিবির নদীর উপরে বর্তমান সেতুটি নির্মিত হয়।[৭] সম্রাট অগাস্টাসের আমলে নির্মিত[৪] এই সেতুটি লম্বায় ২৪৭ মিটার[৭] ও চওড়ায় মোটামুটি ৯ মিটারের মতো। যদিও বর্তমানে মোট ১৬টি খিলানের উপর দাঁড়িয়ে আছে সেতুটি, শুরুতে এর সংখ্যা ছিল ১৭টি।[৮] সেইসময় এই সেতুটি ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যপথের অংশ।[৯] করদোবা থেকে গুয়াদালকিবির নদী পার হয়ে ইবেরীয় উপদ্বীপের দক্ষিণ দিকের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বন্দর ও বাণিজ্যকেন্দ্রে যাওয়ার এটিই ছিল একমাত্র সেতু। রোম থেকে কাদিথ পর্যন্ত বিস্তৃত[১০] প্রায় ১৫০০ কিলোমিটার দীর্ঘ বিখ্যাত ঐতিহাসিক রোমান রাস্তা ভিয়া আউগুস্তার[১১] অংশ ছিল এটি।
মুসলমান আমল
[সম্পাদনা]অষ্টম শতাব্দীতে স্পেনে মুসলমানদের আগমনের পর এই সেতুটির বড় রকমের সংস্কার হয়। উপদ্বীপের পুরনো রোমান রাস্তাগুলি যোগাযোগব্যবস্থা উন্নতির অঙ্গ হিসেবে পুনরায় ব্যবহারযোগ্য করে তোলা হয়।[১১] করদোবা সে'সময় মুসলমান শাসিত স্পেনের প্রথমে প্রধান কেন্দ্র ও পরে রাজধানীতে রূপান্তরিত হয়। ফলে যোগাযোগব্যবস্থার কেন্দ্র হিসেবে তার গুরুত্বও বৃদ্ধি পায়। অষ্টম শতাব্দীতেই প্রথম দিকের মুসলমান শাসক ও সেনাপতি আল সামা ইবন মালিক আল খলানি (আল আন্দালুসের আরব গভর্নর ছিলেন ৭১৯ - ৭২১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত) পুরনো রোমান সেতুটিকে নূতন করে গড়ে তোলার ফরমান জারি করেন। পরবর্তীতেও এইসময় সেতুটির ব্যাপক সংস্কার হয়। বিশেষত ৯১৮ সালটিকে সেতুর সবচেয়ে বড় সংস্কারের বছর বলে ধরা হয়ে থাকে।[৯] এই সব সংস্কারগুলির মাধ্যমেই সেতুটি বর্তমান আকার ধারণ করে। বর্তমানে সেতুটির ১৬টি স্তম্ভের মধ্যে প্রায় সবগুলিই এই আমলের নির্মাণকৌশল ও শিল্পের নিদর্শন। এছাড়া এই সময়েই সেতু রক্ষার উদ্দেশ্যে সেতুর দক্ষিণে তৈরি হয় কালাওরা মিনার (দ্বাদশ শতাব্দী)[১২][১৩] ও উত্তরেও তৈরি হয় একটি তোরণ, লা পুয়েরতা দেল পুয়েন্তে।[১৪] সে'সময় এটি ছিল শহরের প্রধান প্রবেশদ্বার।[১৫] যদিও বর্তমানে যে তোরণটি সেখানে দেখা যায়, সেটি পরবর্তীকালে নবজাগরণের সময়ে তৈরি। ১৫৭২ খ্রিষ্টাব্দে প্রখ্যাত স্পেনীয় আর্কিটেক্ট এরনান রুইথের পরিকল্পনায় এটি নির্মিত।[১৪]
নবজাগরণ ও তৎপরবর্তী সময়
[সম্পাদনা]রেকনকিস্তা ও তৎপরবর্তী সময়েও এই সেতু ও সংলগ্ন নানা স্থাপত্যের উল্লেখযোগ্য সংস্কার, সংযোজন ও পুনর্নির্মাণ হয়। এর মধ্যে এরনান রুইথ কৃত নূতন পুয়েরতা দেল পুয়েন্তে তোরণটির উল্লেখ আগেই করা হয়েছে। এছাড়াও ১৬৫১ খ্রিষ্টাব্দে বিখ্যাত ভাস্কর বেরনাবে গোমেথ দেল রিও সান রাফায়েলের একটি মূর্তি তৈরি করেন। এটি সেতুর উপর স্থাপিত হয়।[১৬]
সাম্প্রতিক সংস্কার
[সম্পাদনা]এই দুই হাজারবছরব্যাপী ইতিহাসে সেতুটিকে অসংখ্যবার নানারকমের সংস্কার ও সংযোজনের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে। বিশেষত করদোবার খিলাফৎ আমলে, নবজাগরণ পরবর্তী সময়ে এবং বিংশ শতাব্দীতে যে বৃহৎ সংস্কারগুলি পরিচালিত হয়, তার ফলে সেতুর মূল কাঠামো ও চরিত্রেরই যথেষ্ট বদল ঘটে যায়। বর্তমানে পুয়েরতা দেল পুয়েন্তের দিক থেকে গুনলে শুধুমাত্র ১৪ ও ১৫ নম্বর খিলানদুটিইর ক্ষেত্রেই মূল রোমান সেতুর কাঠামো বর্তমান আছে।
সেতুটির কাঠামো সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে ২০০৬ সাল থেকে সেতুটিকে কিছুদিনের জন্য সম্পূর্ণ বন্ধ রাখা হয়। এইসময় সেতুটির কাঠামো বাইরে থেকে এবং ভিতর থেকে সম্পূর্ণ পর্যবেক্ষণ ও প্রয়োজনীয় সংস্কার করে তাকে ঐতিহ্যশালী সেতু হিসেবে সংরক্ষণ করা হয়। করদোবার পৌরস্থপতি খুয়ান কুয়েঙ্কোর নেতৃত্বে ৩ কোটি ইউরো বাজেটের সেতুর এই সংস্কারকর্ম[১৭] ২০০৮ সালের ৯ জানুয়ারি শেষ হয় ও সেতুটি নতুন করে খুলে দেওয়া হয়।[৬] তবে সেতুর এই ব্যাপক সংস্কার যথেষ্ট বিতর্কেরও জন্ম দেয়। প্রশ্ন ওঠে, এর ফলে সেতুর মূল কাঠামোগত বৈশিষ্ট্যরও কিছুটা পরিবর্তন ঘটেছে। তাছাড়া এর ফলে তার শতাব্দী প্রাচীন পরিচিত রূপেরও কিছু পরিবর্তন ঘটে: তার স্তম্ভগুলির নিচের দিকে জলবিভাজিকাগুলি (Sterlings) অনেকাংশেই পরিষ্কার করে ফেলা হয়, মূল সেতুর পালিশ না থাকা রাফ পাথরে গড়া চেহারাটি, যা বহুদিন ঢাকা পড়ে গিয়েছিল, পুনরুদ্ধার হয়; সেতুর উপরে কবলস্টোন (cobblestone) দিয়ে তৈরি রাস্তাটি আর্ধেক পালিশ করা গ্রানাইট দিয়ে মসৃণ করে তোলা হয়; তাছাড়া উনবিংশ শতাব্দী থেকে থাকা সেতুর আলোকস্তম্ভগুলিকেও সরিয়ে ফেলা হয়, তার বদলে আধুনিক আলো দিয়ে সজ্জিত করা হয় সেতুটিকে; সেতুর গাত্রে বসানো বেশ ক'টি প্রাচীন কুলুঙ্গিরও (niche) পরিবর্তন ঘটানো হয় এবং সেখানে বসানো ভাস্কর্যগুলিকে অন্যত্র পুনর্স্থাপিত করা হয়, এগুলির মধ্যে বেশ ক'টি, যেমন সান্তা ভিক্তোরিয়ার ভাস্কর্যটি ছিল বেশ প্রাচীন।[৬] এছাড়াও সেতুর উত্তর প্রান্তের উচ্চতারও কিছু পরিবর্তন ঘটানো হয় যাতে তা পুয়েরতা দেল পুয়েন্তে ও পাসেও দে লা রিবেরার সাথে এক সমতলে থাকতে পারে।
তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ Romero, Ana (17 de enero de 2004). «El Puente de San Rafael se queda sin placas franquistas». Diario Córdoba. সংগৃহীত ১৫ জুলাই, ২০১৯।
- ↑ «Base de datos de bienes inmuebles inscritos en el Registro de Bienes de Interés Cultural (buscar escribiendo "Puente sobre El Guadalquivir, su Puerta" en el campo "General")». Web oficial del Ministerio de Cultura de España. সংগৃহীত ১৫ জুলাই, ২০১৯।
- ↑ «Historic Centre of Cordoba». UNESCO. World Heritage List. সংগৃহীত ১৫ জুলাই, ২০১৯।
- ↑ ক খ "El Puente Romano de Córdoba, libre de coches". El País. 3 de Mayo, 2004. সংগৃহীত ১৬ জুলাই, ২০১৯।
- ↑ "Puente Romano de Córdoba" ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ৭ জুন ২০০৭ তারিখে. CastillosNet. সংগৃহীত ১৮ জুলাই, ২০১৯।
- ↑ ক খ গ "Puente romano de Córdoba". artencordoba. Visitas guiadas. সংগৃহীত ২০ জুলাই, ২০১৯।
- ↑ ক খ "Roman Bridge in Cordoba". Structurae. সংগৃহীত ১৬ জুলাই, ২০১৯।
- ↑ "Puente Romano". Córdoba 24. সংগৃহীত ১৮ জুলাই, ২০১৯।
- ↑ ক খ "Puente Romano: Die Römische Brücke". Córdoba 24. সংগৃহীত ১৮ জুলাই, ২০১৯।
- ↑ Joseph F. O'Callaghan (15 April 2013). A History of Medieval Spain. Cornell University Press. p. 33. ISBN 978-0-8014-6871-1.
- ↑ ক খ Enrique Melchor Gil. [C:/Users/Manager/Downloads/La_red_viaria_romana_en_la_comarca_del.pdf "LA RED VIARIA ROMANA EN LA COMARCA DEL ALTO GUADALQUIVIR: LA ZONA DE VILLAFRANCA DE CÓRDOBA"]. Orígenes Históricos de Villafranca de Córdoba, Córdoba, 2013, pp. 101-124. সংগৃহীত ১৮ জুলাই, ২০১৯।
- ↑ "Historia" Torre de la Calahorra. সংগৃহীত ১৮ জুলাই, ২০১৯।
- ↑ "Torre de la Calahorra". Córdoba 24. সংগৃহীত ১৮ জুলাই, ২০১৯।
- ↑ ক খ "Puerta del Puente". Córdoba 24. সংগৃহীত ১৮ জুলাই, ২০১৯।
- ↑ "Puerta del Puente". artencordoba. Visitas guiadas. সংগৃহীত ২৮ জুলাই, ২০১৯।
- ↑ "Bernabé Gómez del Río". Córdobapedia. সংগৃহীত ১৯ জুলাই, ২০১৯।
- ↑ Manuel Planelles. "La Puerta del Puente Romano de Córdoba vuelve a dominar el Guadalquivir" El País. 10 de Marzo, 2007. সংগৃহীত ২১ জুলাই, ২০১৯।