আনজেনের যুদ্ধ

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
আনজেনের যুদ্ধ
মূল যুদ্ধ: আরব-বাইজেন্টাইন যুদ্ধ

৮৩৭-৮৩৮ সালে আরব ও বাইজেন্টাইন অভিযানের মানচিত্র
তারিখ২২ জুলাই ৮৩৮ (838-07-22)
অবস্থান
দাজমানের নিকটে
ফলাফল আব্বাসীয়দের বিজয়
বিবাদমান পক্ষ
বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য আব্বাসীয় খিলাফত
সেনাধিপতি ও নেতৃত্ব প্রদানকারী
সম্রাট থিওফিলোস
থিওফোবোস
ম্যানুয়েল দ্য আর্মেনিয়ান  আহত অবস্থায় মৃত?
আফশিন
আমির উমর আল-আকতা
শক্তি
২৫,০০০[১]–৪০,০০০[২] ২০,০০০[৩]–৩০,০০০[২]

আনজেনের যুদ্ধ ৮৩৮ সালের ২২ জুলাই বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যআব্বাসীয় খিলাফতের মধ্যে আনজেন বা দাজিমনে (বর্তমান তুরস্কের দাজমানায়) সংঘটিত হয়। পূর্বের বছরের সম্রাট থিওফিলোসের অভিযানের পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে আব্বাসীয়রা দুইটি পৃথক বাহিনী নিয়ে এসময় ব্যাপক অভিযান চালায়। অন্যতম বৃহৎ বাইজেন্টাইন শহর আমোরিয়াম ছিল আব্বাসীয়দের মূল লক্ষ্যবস্তু। সম্রাট থিওফিলোস তার বাহিনী নিয়ে অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র মুসলিম বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন। মুসলিম বাহিনীর প্রধান ছিলেন ইরানের আঞ্চলিক শাসক আফশিন

প্রথমদিকে সংখ্যাধিক বাইজেন্টাইন বাহিনী সফলতা লাভ করলেও থিওফিলোস ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ পরিচালনা করা থেকে বিরত হওয়ার পর বাইজেন্টাইন সৈনিকরা তার মৃত্যুর কথা ভেবে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। আফশিনের তুর্কি অশ্বারোহী-তীরন্দাজরা প্রবল আক্রমণ চালানোর পর বাইজেন্টাইনরা পালিয়ে যায়। থিওফিলোস ও রক্ষীরা পালানোর পূর্বে একটি পাহাড়ে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। এই পরাজয়ের ফলে কয়েক সপ্তাহ পরে আমোরিয়ামে অভিযানের পথ উন্মুক্ত হয়।

পটভূমি[সম্পাদনা]

৮২৯ সালে থিওফিলোস সিংহাসনে বসেন। তিনি উচ্চাভিলাষী ছিলেন এবং আব্বাসীয়দের বিরুদ্ধে সামরিক সফলতা অর্জন করেন নিজ শাসনকে শক্তিশালী করতে এবং তার ধর্মীয় নীতির প্রতি সমর্থন আদায় করতে চেয়েছিলেন। ৮৩০ এর দশকজুড়ে থিওফিলোস খিলাফতের বিরুদ্ধে ধারাবাহিকভাবে অভিযান পরিচালনা করেন। এসকল অভিযান আংশিকভাবে সফল হলেও থিওফিলোস রোমান কায়দায় "বিজয়ী সম্রাট" হিসেবে পরিচিতি লাভের জন্য যথেষ্ট ছিল।[৪][৫] ৮৩৭ সালে থিওফিলোস ব্যক্তিগতভাবে ফোরাত নদী অঞ্চলে একটি বড় অভিযানে নেতৃত্ব দেন। এসময় আরসামোসাতা ও সাজোপেত্রা শহর ধ্বংস করে দেয়া হয়। এছাড়াও মালাতিয়া শহরের নিরাপত্তার বিনিময়ে কর প্রদান ও জিম্মি প্রেরণের জন্য বাধ্য করা হয়।[৩][৬][৭]

এ কারণে পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে খলিফা আল-মুতাসিম মধ্য আনাতোলিয়ার দুটি প্রধান বাইজেন্টাইন শহর আনকাইরাআমোরিয়াম দখলের জন্য বাইজেন্টাইনদের বিরুদ্ধে একটি বড় অভিযানের সিদ্ধান্ত নেন। ধারণা করা হয় যে দ্বিতীয় শহরটি তৎকালীন আনাতোলিয়ার সর্ববৃহৎ শহর ছিল। প্রাচীন বিবরণ অনুযায়ী আল-মুতাসিমের সৈনিকরা তাদের ঢাল ও ব্যানারে আমোরিয়াম শব্দটি উৎকীর্ণ করে রেখেছিল।[২][৬] একটি বড় বাহিনী তারসুস শহরে জড়ো হয়, একে পরে দুইটি প্রধান ভাগে ভাগ করা হয়। উত্তরের বাহিনী ছিল ইরানি আঞ্চলিক শাসক আফশিনের অধীনে। তাকে মালাতিয়ার আমির উমর আল-আকতার সাথে যোগ দিয়ে মালাতিয়া অঞ্চল থেকে আর্মেনিয়াক থিমে আক্রমণ করার নির্দেশ দেয়া হয়। দক্ষিণের বাহিনীকে খলিফা নিজে নেতৃত্ব দেন। তারা সিলিসিয়ান গিরিপথ দিয়ে কাপাডোকিয়া হয়ে আনকাইরা যাত্রার পরিকল্পনা করে। এই শহর অধিকার করার আরব বাহিনীগুলি একত্রিত হয়ে আমোরিয়াম আক্রমণের পরিকল্পনা ছিল।[২][৬][৮] একাদশ শতাব্দীর গ্রিক ইতিহাসবিদ জন স্কাইলিটজেসের বর্ণনা অনুযায়ী আফশিনের বাহিনীতে আর্মেনীয় রাজাদের পুরো সেনাবাহিনী অন্তর্ভুক্ত ছিল এবং তাদের সংখ্যা ছিল ২০,০০০ থেকে ৩০,০০০ যাদের মধ্যে ১০,০০০ ছিল তুর্কি অশ্বারোহী-তীরন্দাজ।[২][৩][৬]

এদিকে সম্রাট থিওফিলোস খলিফা আল-মুতাসিমের পদক্ষেপ সম্পর্কে জানতে পারেন এবং জুনের শুরুর দিকে কনস্টান্টিনোপল থেকে যাত্রা শুরু করেন। বাইজেন্টাইনরা ডোরিলাইয়ামে শিবির স্থাপন করে। এখানে বাইজেন্টাইন বাহিনীকে বিভক্ত করা হয়। আমোরিয়ামের সুরক্ষার জন্য একটি শক্তিশালী বাহিনী প্রেরণ করা হয় এবং সম্রাট নিজে বাকি ২৫,০০০ থেকে ৪০,০০০ সৈনিক নিয়ে সামনে অগ্রসর হন।[১][২]

যুদ্ধ[সম্পাদনা]

পর্বতের দিকে থিওফিলোস ও বাইজেন্টাইন বাহিনীর পলায়ন, মাদ্রিদ স্কাইলিটজেস বিবরণের একটি অণুচিত্র।।

জুনের মধ্যভাগে আফশিন তোরোসের বিপরীত পর্বতমালা অতিক্রম করে দাজিমনের দুর্গে শিবির স্থাপন করেন। এর অবস্থান ছিল আমাসেইয়া ও তোকাতের মধ্যবর্তী স্থানে এবং এটি কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কয়েকদিন পরে ১৯ জুন আব্বাসীয় বাহিনীর একটি অগ্রবর্তী দল বাইজেন্টাইন অঞ্চলে আক্রমণ চালায় এবং এর দুইদিন পরে খলিফা মূল বাহিনী নিয়ে যোগ দেন।[৩][৬] মধ্য জুলাইয়ে থিওফিলোস এই সংক্রান্ত খবর পান। আফশিনের বাহিনী আকারে ছোট ছিল এবং সরবরাহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার ঝুকি ছিল। এসময় থিওফিলোস খলিফার বাহিনীর সাথে মোকাবেলা করার জন্য একটি ক্ষুদ্র সেনাদল রেখে আফশিনের সাথে লড়াইয়ের জন্য পূর্ব দিকে অগ্রসর হন। ২১ জুলাই বাইজেন্টাইনরা আরব বাহিনীর দেখা পায় এবং দাজিমন দুর্গের দক্ষিণে পাহাড়ে শিবির স্থাপন করে।[৩][৯]

থিওফিলোসের প্রধান কমান্ডার থিওফোবোস ও ম্যানুয়েল উভয়ে রাতের বেলা ঝটিকা আক্রমণের পরামর্শ প্রদান করলেও সম্রাট অন্য অফিসারদের প্রস্তাবে সায় দেন এবং পরের দিন আক্রমণ চালানোর সিদ্ধান্ত নেন। বাইজেন্টাইনরা ভোরে আক্রমণ করে এবং প্রাথমিকভাবে সফলতা লাভ করে। আরব বাহিনীর একটি পার্শ্বভাগ ব্যাপক আক্রান্ত হয় এবং আরবদের পক্ষে ৩,০০০ জন হতাহত হয়। দুপুরের দিকে থিওফিলোস অন্য পার্শ্বভাগে আক্রমণের জন্য ২,০০০ বাইজেন্টাইন ও কুর্দিকে প্রেরণ করেন এবং নিজ অবস্থান ত্যাগ করে বাহিনীর পেছনে অবস্থান নেন।[৩][৯] এসময় আফশিন তার তুর্কি অশ্বারোহী-তীরন্দাজদের মাঠে নামান। তাদের মারাত্মক আক্রমণের ফলে বাইজেন্টাইনরা বাঁধা পায় এবং আরবরা সংগঠিত হওয়ার সুযোগ পায়। এসময় বাইজেন্টাইনরা সম্রাটের অণুপস্থিতি লক্ষ্য করে এবং তার মৃত্যুর কথা ভেবে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। ফলে দ্রুত সেনারা পিছু হটতে থাকে।[৩][৯]

এর ফলে থিওফিলোস তার বাহিনী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। আরবরা পাহাড় ঘিরে ফেলার জন্য অগ্রসর হয় কিন্তু আকস্মিক বৃষ্টিপাতের ফলে বাইজেন্টাইনরা বেঁচে যায়। আফশিন এরপর আক্রমণের জন্য ক্যাটাপুল্ট প্রেরণ করেন।[১০] এসময় থিওফিলোসের অফিসাররা পিছু হটার পরামর্শ দেন এবং থিওফিলোস তার ক্ষুদ্র দল নিয়ে চিলিওকোমোন পৌছায়। এখানে তিনি সেনাবাহিনীর বাকি অংশকে সংগঠিত করতে থাকেন।[২][৯][১১]

ফলাফল[সম্পাদনা]

থিওফিলোস ও তার দরবার, মাদ্রিদ স্কাইলিটজেস বিবরণের অণুচিত্র।

পরাজয় এবং মৃত্যুর খবর প্রচারিত হওয়ার ফলে থিওফিলোসের অবস্থান বিপজ্জনক হয়ে পড়ে। তিনি অভিযান ত্যাগ করে ডোরিলাইয়ামে পিছু হটেন এবং এখান থেকে দ্রুত রাজধানী রওয়ানা হন। আনকাইরা শহরও ত্যাগ করা হয় এবং ২৭ জুলাই আরবরা এখানে আক্রমণ করে।[১১] এরপর সম্মিলিত আব্বাসীয় বাহিনী আমোরিয়ামের দিকে অগ্রসর হয়। দুই সপ্তাহ অবরোধের পর শহরের পতন ঘটে। ৯ম শতাব্দীতে বাইজেন্টাইনদের আক্রমণের মধ্যে শহরের পতন অন্যতম মারাত্মক ঘটনা ছিল। অন্যদিকে বিদ্রোহের খবর পাওয়ার ফলে খলিফা আল-মুতাসিমও আর সামনে অগ্রসর হননি।[২][১১]

একই সময়ে থিওফিলোসকেও থিওফোবোস ও তার কুর্দিদের বিদ্রোহের মোকাবেলা করতে হয়। থিওফিলোসের মৃত্যুর খবর রাজধানীতে পৌছানোর পর কেউ কেউ নতুন সম্রাট হিসেবে থিওফিলোসের নাম প্রস্তাব করে। রাজধানীতে ফেরার পর থিওফিলোস তাকে তলব করেন কিন্তু শাস্তির ভয়ে থিওফোবোস তার অণুগত কুর্দিদের নিয়ে সিনোপে পালিয়ে যান এবং সেখানে নিজেকে সম্রাট ঘোষণা করেন।[২][১২] পরের বছর থিওফোবোস শান্তিপূর্ণভাবে আত্মসমর্পণ করতে রাজি হন।[১৩]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. Haldon 2001, পৃ. 78.
  2. Treadgold 1997, পৃ. 441.
  3. Haldon 2001, পৃ. 80.
  4. Whittow 1996, পৃ. 152–153
  5. Treadgold 1997, পৃ. 437–440.
  6. Kiapidou 2003, Chapter 1 ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১২ তারিখে.
  7. Treadgold 1997, পৃ. 440–441.
  8. Haldon 2001, পৃ. 78, 80.
  9. Kiapidou 2003, Chapter 2 ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১২ তারিখে.
  10. Haldon 2001, পৃ. 80, 82.
  11. Haldon 2001, পৃ. 82.
  12. Kazhdan 1991, পৃ. 2067–2068.
  13. Treadgold 1997, পৃ. 442–443; Kazhdan 1991, পৃ. 2068.

উৎস[সম্পাদনা]