বাইজেন্টাইন সেনাবাহিনী
বিশ্বকোষীয় পর্যায়ে যেতে এই নিবন্ধে আরো বেশি অন্য নিবন্ধের সাথে সংযোগ করা প্রয়োজন। (ডিসেম্বর ২০২০) |
বাইজেন্টাইন সেনাবাহিনী | |
---|---|
নেতা | রোমান সম্রাটগণ |
অপারেশনের তারিখ | খ্রি. ৩৯৫-১৪৫৩ |
সদরদপ্তর | কনস্টান্টিনোপল |
সক্রিয়তার অঞ্চল | বলকান, এশিয়া মাইনর, লেভান্ট, মেসোপটেমিয়া, ইতালী, উত্তর আফ্রিকা, স্পেন, ককেশাস, ক্রিমিয়া |
এর অংশ | বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য |
মিত্র | হান, লম্বার্ড, সার্ব, ক্রুসেডার রাষ্ট্রসমূহ, কাজার, রুশ, হাঙ্গেরীয় সাম্রাজ্য, অ্যাভার জাতি |
বিপক্ষ | গথ, হান, সাসানীয় পারস্য সাম্রাজ্য, ভ্যান্ডাল, অস্ট্রোগথ সাম্রাজ্য, অ্যাভার, স্লাভ জাতি, খিলাফতে রাশেদা, বুলগেরীয় সাম্রাজ্য, রুশ, নর্ম্যান জাতি, ক্রুসেডার রাষ্ট্রসমূহ, সেলজুক সালতানাত, উসমানীয় সাম্রাজ্য, আইয়ুবি সালতানাত, মামলুক সালতানাত সহ অন্যান্য |
খণ্ডযুদ্ধ ও যুদ্ধ | বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের যুদ্ধসমূহ |
মধ্যযুগের অন্যতম পরাশক্তি বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের সামরিক শক্তির প্রধান অংশ ছিল বাইজেন্টাইন সেনাবাহিনী বা পূর্ব রোমান সেনাবাহিনী, যা বাইজেন্টাইন নৌবাহিনীর সঙ্গে সম্মিলিতভাবে বাইজেন্টাইন সশস্ত্র বাহিনী গঠন করে। এই পূর্ব-রোমান বাহিনী তাদের পূর্বসূরী রোমান বাহিনীর শৃঙ্খলা, তুখোড় রণকৌশল এবং গঠনপ্রণালী অনেকাংশেই বজায় রাখে। মধ্যযুগীয় পশ্চিম ইউরেশিয়ায় সবচেয়ে সংগঠিত ও সুশৃঙ্খল বাহিনীগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল এ বাহিনী। ৭ম শতাব্দীর শুরুতে রোমান লিজিয়ন প্রথা বিলুপ্ত হওয়ায় কালক্রমে বাইজেন্টাইন সেনাবাহিনীতে অশ্বারোহী বাহিনীর গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়। পরবর্তীতে এ বাহিনীর গঠনপ্রণালীতে জার্মানিক ও এশীয় বাহিনীসমূহের প্রভাব দেখা যায়[১]। প্রায়ই এ বাহিনীতে ভাড়াটে সৈন্য হিসেবে বিভিন্ন প্রতিদ্বন্দ্বী ও বিজাতীয় সৈন্যদের নিয়োগ দেয়া হয়, যেমন: হান, কিউমান, অ্যালান এবং তুর্কী সৈন্য, এসব অশ্বারোহী বাহিনী অর্থের বিনিময়ে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের হয়ে যুদ্ধ করে থাকত। বাইজেন্টাইন বাহিনী মূলতঃ এর সেনাপতিদের রণকৌশল ও দক্ষতার বলে স্বদেশী বেসামরিক বাহিনীসমূহকে (militia) কাজে লাগিয়ে যুদ্ধ পরিচালনা করত, তবুও পদাতিক বাহিনীতে ফরাসী (ফ্র্যান্ক) এবং পরবর্তীতে ভ্যারাঞ্জিয়ান প্রভৃতি ভিনদেশীয় ভাড়াটে সৈন্যদের নিয়োগ দেয়া হত।
৭ম থেকে ১২শ শতাব্দীতে বাইজেন্টাইন বাহিনী পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী ও সংগঠিত বাহিনীগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল। মধ্যযুগীয় ইউরোপীয় বাহিনীসমূহ এমনকি অন্তর্দ্বন্দ্বের শিকার ইসলামী খেলাফত বাহিনীও রণকৌশল ও সংগঠনগত দিক থেকে তাদের থেকে পিছিয়ে ছিল। ৭ম থেকে মধ্য ৯ম শতাব্দীতে তৎকালীন শক্তিশালী ইসলামী খেলাফত বাহিনীর প্রতিরোধ করতে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য "থীম প্রথা" (Theme system) চালু করে, যা অনেকাংশেই তাদের সাম্রাজ্যের প্রতিরক্ষার ভূমিকা পালন করে। তবে, মধ্য ৯ম শতাব্দীর পরবর্তীতে তারা ক্রমশঃ আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে এবং এর ফলশ্রুতিতে সম্রাট ২য় নিকেফোরোস ফোকাস, জন জিমিসকেস ও ২য় বাসিলের মত সেনাপতি-সম্রাটগণের নেতৃত্বে ১০ম শতাব্দীতে তারা একের পর এক বিজয় অভিযান পরিচালনা করে। পরবর্তী কালের এ বাহিনীগুলো পূর্ববর্তী থীম বা জমিদারী বেসামরিক বাহিনীর ওপর নির্ভরশীল ছিলনা বরং তাদের মূলভিত্তি ছিল সংগঠিত ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পদাতিক বাহিনী ও তাদের সাহায্যকারী শক্তিশালী অশ্বারোহী বাহিনী। এসময় তাদের অত্যন্ত সুদৃঢ় অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সাহায্যে তারা পৃথিবীর অন্যতম শক্তিশালী একটি বাহিনী গঠন করে এবং তাদের বহু হারানো ভূখণ্ড পুনরুদ্ধারে সক্ষম হয়।
১১শ শতাব্দীতে থীম প্রথা বিলু্প্ত হওয়ায় বাইজেন্টাইনরা পেশাদার টাগমাটা বাহিনীসমূহের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে, এসকল বাহিনীতে বিজাতীয় ভাড়াটে সৈন্যের সংখ্যা দিনদিন বাড়তে থাকে। কোম্নেনীয় বংশের সম্রাটগণ একটি স্বদেশীয় সৈন্যেবাহিনী পুনর্নির্মাণে তৎপর হন এবং "প্রনইয়া" প্রথা চালু করেন, এ প্রথা অনুসারে স্বদেশীয়দের সেনাবাহিনীতে চাকরির মজুরি হিসেবে ভূমির ইজারা প্রদান করা হত। এতদসত্বেও সাম্রজ্যের বাহিনীতে ভাড়াটে সেনাদের বিপুল উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। এর কারণ- এশিয়া মাইনরে বিস্তর ভূখণ্ড ও এর জনগোষ্ঠী তখন সাম্রাজ্যের হস্তচ্যুত হওয়ায় সেনাবাহিনীর জন্য লোকবলের অভাব হয়ে পড়ে। প্রকারান্তরে এই "প্রনইয়া" প্রথার কারণে সাম্রাজ্যে সামন্ততন্ত্রের (feudalism) প্রসার ঘটে। পরবর্তীতে অ্যাঙ্গেলোস রাজবংশের হাতে কোম্নেনীয় বংশের পতন হয়। এবং অবশেষে ১২০৪ খ্রিষ্টাব্দে ৪র্থ ক্রুসেডের ফলশ্রুতিতে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের পতন হয়।
বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের পরে তাদের উত্তরসূরি নাইসিয়া সাম্রাজ্যের সম্রাটগণ একই কাঠামোর একটি ছোট কিন্তু সুগঠিত বাহিনী গড়ে তুলতে সক্ষম হন, যাতে স্বদেশীয় ও বিজাতীয় উভয় প্রকারের সেনাদের নিয়োগ দেয়া হয়। এ বাহিনী বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের অবশিষ্ট আনাতোলিয়া ভূখণ্ড প্রতিরক্ষা করতে সক্ষম হয়। এবং পরবর্তীতে তারা বলকানের অনেকাংশ পুনরুদ্ধার করে এমনকি ১২৬১ খ্রিষ্টাব্দে তারা কনস্ট্যান্টিনোপল নগরীও পুনরুদ্ধারে সক্ষম হয়। তবে সম্রাট ২য় অ্যান্ড্রোনিকোস প্যালিওলোগোস এর শাসনকালে পুনরায় অবহেলার দরুণ সেনাবাহিনী দূর্বল হয়ে পড়ে এবং তৎকালীন উঠতি শক্তি অটোমান সাম্রাজ্যের হাতে আনাতোলিয়া ভূখণ্ডের কর্তৃত্ব হারায়। ১৪শ শতাব্দীতে একের পর এক গৃহযুদ্ধে এ সাম্রাজ্য একেবারেই দূর্বল হয়ে পড়ে এবং তাদের শক্তি পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনাও বিলীন হয়ে আসে। সাম্রাজ্যের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব দূর্বল হয়ে পড়ে এবং স্থানীয় নেতাদের ওপর সাম্রাজ্য কর্তৃত্ব হারায়। ফলে এককালের তুমুল ক্ষমতাশালী বাইজেন্টাইন বাহিনী কতিপয় ছোট ছোট বেসামরিক, ব্যক্তিগত ও ভাড়াটে বাহিনীর সমষ্টিতে পরিণত হয়।[২]
ইতিহাস
[সম্পাদনা]যা এখন বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য নামে পরিচিত তা বাস্তবে ছিল রোমান সাম্রাজ্যেরই ধারাবাহিকতা এবং সমসাময়িকদের কাছে তা রোমান সাম্রাজ্যের উত্তরসূরি হিসেবেই গণ্য হত। একারণে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য ছিল রোমান সাম্রাজ্যের অবকাঠামোর এক বিশেষ প্রবৃদ্ধিস্বরূপ, যা মোটামুটি ৭ম শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত টিকে ছিল। এরপরও কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত সেনাবাহিনীর সরকারী ভাষা ছিল লাতিন, যদিও সাম্রাজ্যের অন্যান্য প্রান্তে গ্রীক ভাষার প্রচলন ছিল বেশি, তবুও ইতিহাস জুড়েই সামরিক পরিভাষায় বিভিন্ন লাতিন শব্দের ব্যবহার প্রচলিত ছিল।
ইসলামী বিজয় অভিযানে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য মিসর ও সিরিয়ার কর্তৃত্ব হারায়। পরবর্তীতে অবশিষ্ট আঞ্চলিক বাহিনীসমূহ এশিয়া মাইনরে একত্রিত হয়ে সেখানে ঘাঁটি গাঁড়ে এবং থীম প্রথা চালু করে। সাম্রাজ্যের এই অভূতপূর্ব দুঃসময়েও তাদের সেনাবাহিনীর গঠনতন্ত্র অনেকাংশেই অপরিবর্তিত থাকে। ৬ষ্ঠ থেকে ১১শ শতাব্দীর মধ্যে তাদের রণকৌশল ও যুদ্ধরীতিতে অনবদ্য ধারাবাহিকতা লক্ষ্য করা যায়। তবে, ১০৭১ খ্রিষ্টাব্দে মালাজগির্দের যুদ্ধ এবং সেলজুক বাহিনীর আক্রমণে অতঃপর একের পর এর ক্রুসেড ও নরম্যান বাহিনীর আক্রমণ ইত্যাদি কারণে বাইজেন্টাইন সেনাবাহিনী ও সাম্রাজ্য ব্যপকভাবে দূর্বল হয়ে পড়ে এবং ক্রমশঃ বিজাতীয় ভাড়াটে যোদ্ধাদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে।
ডিওক্লিটান এবং কনস্ট্যান্টিনের নেতৃত্বাধীন বাহিনী
[সম্পাদনা]পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন হয় ২৯৩ খ্রিষ্টাব্দে যখন সম্রাট ডিওক্লিটান "টেট্রার্কি" (tetrarchy) বা "চার সম্রাটের শাসন" প্রচলন করেন। তবে নানান কারণে তার জীবনকালেই তার প্রচলিত এই শাসনপ্রথা রদ হয়ে যায়, তবে তিনি রোমান সেনাবাহিনীতে যেসকল সংস্কার করেছিলেন তা কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত বিদ্যমান ছিল। তিনি চিরাচরিত রোমান পদাতিক বাহিনী লিজিয়ন পদ্ধতিতে সীমাবদ্ধ না থেকে তার বাহিনীকে লিমিটানেই ("সীমান্তরক্ষী") এবং কমিটাটেনসিস ("মাঠবাহিনী") এই দুই ভাগে বিভক্ত করেছিলেন।[৩] এসময় অশ্বারোহী বাহিনীর ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়, যদিও তখনো পদাতিক বাহিনীই ছিল রোমান সেনাবাহিনীর মেরুদণ্ড। ৫৩৩-৫৩৮ খ্রিষ্টাব্দে সম্রাট জাস্টিনিয়ানের আফ্রিকা অভিযানের প্রস্তুতিস্বরূপ যে সেনাবাহিনী সাজানো হয় তাতে ১০,০০০ পদাতিক সেনা এবং ৫,০০০ অশ্বারোহী তীরন্দাজ ও বল্লমধারী অশ্বারোহী (lancer) সেনা অন্তর্ভুক্ত হয়।[৪]
রোমান সীমান্ত রক্ষার্থে মোতায়েন করা হয় সীমান্ত সেনা লিমিটানেই ও রিপেনসেস । অপরদিকে মাঠবাহিনীর দায়িত্ব ছিল সীমান্তের অনেকটা ভেতরে অবস্থান করা, প্রয়োজন অনুযায়ী যেকোনো স্থানে যাতায়াত করতে প্রস্তুত থাকা, প্রতিরক্ষা এবং আক্রমণে মোতায়েন হওয়া এবং বিদ্রোহ দমন করা। এই মাঠবাহিনীর যোদ্ধারা সম্মান এবং বেতন-ভাতা উভয় ক্ষেত্রেই সীমান্তরক্ষীদের থেকে উচ্চস্তরে ছিল।
সেনাদের এক তৃতীয়াংশ ছিল অশ্বারোহী, এবং অশ্বারোহী সেনাদের অর্ধেক ছিল ভারী অশ্বারোহী। এদের অস্ত্র ছিল বল্লম এবং তলোয়ার এবং তারা ভারী বর্মে (mail) বর্মাবৃত ছিল। এদের মধ্যে কিছু ছিল তীরন্দাজ অশ্বারোহী যাদের কাজ ছিল প্রধান অশ্বারোহী বাহিনীকে আক্রমণে সহায়তা করা।[৫]
মাঠ বাহিনীসমূহের একটি বিভাগ ছিল ক্যাটাফ্রাক্ট বাহিনী, যারা ছিল ভারি বর্ম পরিহিত অশ্বারোহী যোদ্ধা, যুদ্ধক্ষেত্রে অতর্কিত হামলায় (cavalry charge) এদেরকে ব্যবহার করা হত। অপরদিকে হালকা অশ্বারোহী যোদ্ধাদের লিমিটানেই বা সীমান্ত বাহিনিতে ব্যবহার করা হত, যারা টহল দেয়ার দায়িত্বে নিয়োজিত থাকত। এদেরও অনেকে ছিল অশ্বারোহী তীরন্দাজ যোদ্ধা। কমিটাটেনসেস বা মাঠ বাহিনীর পদাতিক সেনারা ৫০০ থেকে ১২০০ সৈন্যের এক একটি রেজিমেন্টে বিভক্ত ছিল। এসব রেজিমেন্টকে বলা হত লিজিয়ন, অক্সিলিয়াস বা নুমেন । এরা ছিল প্রাচীন রোমান বাহিনীর ন্যায় ভারি পদাতিক সেনাবাহিনী, তাদের অস্ত্র ছিল বল্লম ও তলোয়ার, হাতে থাকত ঢাল, গায়ে ভারি বর্ম ও মাথায় শিরস্ত্রাণ। এদের সাহায্য করতে প্রতি রেজিমেন্টের সাথে থাকত কিছু হালকা বর্ম পরিহিত বা বর্মহীন কিছু সেনা, এদের হাতে থাকত তীর-ধনুক, বর্শা, গুলতি, পাথর ইত্যাদি। যুদ্ধক্ষেত্রে বিচ্ছিন্নভাবে শত্রুদের হেনস্তা করা ছিল এদের দায়িত্ব।[৬]
ভারি পদাতিক সেনারা দ্রুত চলাচলের জন্যে অনেকসময় তাদের বর্ম বা এর কিছু অংশ খুলে ফেলত, যেমনটা তারা করেছিল ৩৭০ খ্রিষ্টাব্দে গথিক যুদ্ধে। এসব রেজিমেন্টের দায়িত্বে থাকতেন দু'জন ট্রিবিউন যারা একে দু'টি ব্রিগেডে ভাগ করে যুদ্ধ পরিচালনা করতেন। অশ্বারোহী বাহিনীও অনুরূপভাবে পরিচালিত হত।
অপরদিকে লিমিটানেই বা সীমান্ত বাহিনী সম্পর্কে খুব একটা জানা যায় না, ধারণা করা হয়, তারা ভারি পদাতিক সেনাদের থেকে হালকা বর্ম ও অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার করত, যদিও তার কোনো প্রমাণ মেলে না। তাদের স্থানীয়ভাবে সংগ্রহ ও মোতায়েন করা হত, এবং পেশাদের কমিটাটেনসিস সেনাদের থেকে তারা বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুযোগসুবিধা কম পেত। এবং যুদ্ধবিদ্যা ও রণকৌশলেও এরা পিছিয়ে ছিল। বিভিন্ন বিদ্রোহ, আকস্মিক আক্রমণ ইত্যাদি ঠেকাতে এদের কাজে লাগানো হত।
বাইজেন্টাইন বাহিনীতে প্রাচীন রোমান সেনাবাহিনীর ন্যায় লিজিয়ন, কোহর্ট ও অশ্বারোহী অ্যালি প্রভৃতি সামরিক শাখাবিভক্তি দেখা যায়।
এসকল বাহিনী ছাড়াও আরেকটি সম্ভ্রান্ত বাহিনীর নাম ছিল স্কলি প্ল্যাটিনি, যারা রাজকীয় প্রহরী বাহিনী ও সম্রাটের ব্যক্তিগত দেহরক্ষী বাহিনী হিসেবে নিয়োজিত ছিল। সম্রাট প্রথম কনস্টান্টিন প্রাচীন প্রিটোরিয়ান রক্ষীবাহিনীকে বিলুপ্ত করে দেয়ার পর তাদের স্থলাভিষিক্ত করে এই নতুন বাহিনী।
সম্রাট ডিওক্লিটানের শাসনামলে (খ্রি.২৮৪- খ্রি.৩০৫) বাইজেন্টাইন সেনাবাহিনীতে বিপুল সংস্কার ও পরিবর্তন আনাতে ৩য় ও ৪র্থ শতাব্দীতে লিজিয়ন বাহিনীগুলোর সাথে প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্যের বাহিনীর খুব একটা সাদৃশ্য দেখা যায় না। লিজিয়নপ্রতি সেনার সংখ্যা কমিয়ে ১০০০ জনে নিয়ে আসা হয়। এসব লিজিয়নগুলো স্থানীয় রক্ষীসেনা হিসেবে মোতায়েন থাকত, নতুন যুদ্ধগামী মাঠবাহিনী-গুলো থেকে এরা পৃথক ছিল।[৭]
সম্রাট প্রথম জাস্টিনিয়ান ও তাঁর উত্তরসূরীদের নেতৃত্বাধীন বাহিনী
[সম্পাদনা]৫ম শতাব্দীতে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য বিভিন্ন দিক থেকে হুমকির সম্মুখীন হয়, যার মধ্যে সবচেয়ে গুরুতর ছিল পূর্বের দ্রুত বিস্তারকারী পারস্য সাম্রাজ্য। এসব কারণে এ শতাব্দীতে সম্রাট প্রথম জাস্টিনিয়ানের বাহিনীতে বিপুল সংস্কার সাধন করা হয়। পুরাতন রোমান লিজিয়ন, কোহর্ট ও অ্যালি ইত্যাদি নিয়ম বাতিল করা হয় এবং সেনাবাহিনীকে ছোট ছোট পদাতিক ব্যাটালিয়ন ও অশ্বারোহী রেজিমেন্টে বিভক্ত করা হয়, এসব রেজিমেন্টকে বলা হত অ্যারিথমোস, টাগমা বা নিউমেরাস। প্রতি নিউমেরাস এ অন্তর্ভুক্ত ছিল ৩০০ থেকে ৪০০ জন সেনা, এদের পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন একজন ট্রিবিউন। দুই বা ততোধিক নিউমেরাস দিয়ে গঠিত হয় একটি ব্রিগেড বা মইরা, এবং দুই বা ততোধিক ব্রিগেড দিয়ে গঠিত হয় একটি ডিভিশন বা মেরোস।[৮]
সেনাবাহিনীতে ছয় শ্রণীর সৈন্য ছিল:
- রাজধানী কনস্টান্টিনোপল নগরীতে মোতায়েন ছিল রক্ষী বাহিনী এক্সকিউবিটর।
- কমিটাটেনসিস বা রোমান মাঠবাহিনী। জাস্টিনিয়ানের আমলে এদের বলা হত স্ট্রাটিওরাই। এদের সংগ্রহ করা হত রোমান প্রজাদের মধ্য থেকে এবং থ্রেস, ইলিরিকাম, ইসরিয়া প্রভৃতি জনপদ থেকে।
- লিমিটানেই বা সীমান্ত বাহিনী। এদের সংগঠন অনেকটাই অপরিবর্তিত ছিল। এরা পূর্বের ন্যায় সীমান্ত প্রহরা ও সীমান্ত চৌকিসমূহ রক্ষার কাজে নিয়োজিত ছিল। তবে এসময়ে এদের গ্রীক ভাষায় আক্রিটাই নামে ডাকা হত। বিভিন্ন যুদ্ধে এই সেনাদের বীরত্বের কথকতা গ্রীক জনগণের মধ্যে প্রচলিত ছিল।
- ফেডেরাটাই। বাইজেন্টাইন বাহিনীতে এরা ছিল নতুন সংযোজন। এরা বিভিন্ন বর্বর জনপদ থেকে সংগ্রহিত যোদ্ধা ছিল, যারা রোমান অফিসারদের অধীনে কাজ করত। ৬ষ্ঠ শতাব্দীর পূর্বে রোমান বাহিনীতে রোমান ব্যতীত অন্য কোন বিজাতীয় সেনা নিয়োগ নিষিদ্ধ ছিল। ৬ষ্ঠ শতাব্দীতে এ নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়।
- মিত্র বাহিনী সমূহ। এরা ছিল হান, গথ ও অন্যান্য বর্বর জাতি বা গোত্রসমূহ যারা রোমানদের সাথে সামরিক চুক্তিবদ্ধ ছিল।
- ব্যুকেলারাই। এরা ছিল বিভিন্ন ধনাঢ্য নাগরিক বা সেনাপতিদের ব্যক্তিগত বাহিনী। অশ্বারোহী বাহিনীর একটি বড় অংশ এদের দ্বারা গঠিত ছিল। এসব বাহিনীর সেনাসংখ্যা তাদের নিয়োগকর্তার সম্পদের পরিমাণের ওপর নির্ভর করত। এদের সেনাদের বলা হত হাইপাসপিসটাই বা "ঢালবাহী" এবং এদের সেনাপতিদের বা কর্তাদের বলা হত ডরিফোরই বা "বর্শাধারী"। এই সেনারা তাদের কর্তাদের প্রতি অনুগত ছিল এবং সম্রাটের প্রতিও তাদের আনুগত্য প্রদর্শন করতে হত। এরা মূলত ছিল হান, গথ, পার্বত্য থ্রেস ও এশিয়া মাইনরের অশ্বারোহী যোদ্ধা।[৯]
সম্রাট জাস্টিনিয়ানের বাহিনীর সৈন্যসংখ্যা সম্পর্কে সুস্পষ্ট তথ্য পাওয়া যায় না। ঐতিহাসিক জে. বি. ব্যুরির মতে এ বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ছিল প্রায় ১,৫০,০০০ জন।[১০] আধুনিক ইতিহাসবিদেরা ধারণা করেন সম্রাট জাস্টিনিয়ানের বাহিনীতে আনুমানিক ৩,০০,০০০ থেকে ৩,৫০,০০০ সৈন্য ছিল।[১১] মাঠ বাহিনীগুলোতে সাধারণতঃ ১৫,০০০ থেকে ২০,০০০ জন সৈন্য থাকত। এর সাথে সংযুক্ত হত সেনাপতির ব্যক্তিগত বাহিনী ও বর্বর মিত্ররা। সম্রাট জাস্টিনিয়ানের সেনাপতি বেলিসারিয়াস ৫৩৩ খ্রিষ্টাব্দে ভ্যান্ডালদের থেকে কার্থেজ পুনরুদ্ধারে যে অভিযান পরিচালনা করেন, সে অভিযানে অংশগ্রহণকারী বাহিনী বিশদ বিবরণ পাওয়া যায়।
এই বাহিনীতি ছিল ১০,০০০ কমিটাটেনসিস ও ফেডেরাটাই পদাতিক সৈন্য এবং ৩,০০০ অশ্বারোহী। আরো ছিল ৬০০ হান এবং ৪০০ হেরুলিস গোত্রীয় অশ্বারোহী তীরন্দাজ। এছাড়াও ছিল সেনাপতি বেলিসারিয়াসের ব্যক্তিগত বাহিনীর ১,৪০০ থেকে ১,৫০০ অশ্বারোহী। ১৬,০০০ সৈন্যের এই তুলনামূলকভাবে ক্ষুদ্র বাহিনীটি ৫০০টি জাহাজ ও ৯২টি রণতরী বিশিষ্ট রণবহর নিয়ে বসফরাস প্রণালী থেকে উত্তর আফ্রিকা পর্যন্ত যাত্রা করে।[১২]
পারস্য সাম্রাজ্যের মুকাবিলা করতে রোমানরা তাদের রণকৌশল, যুদ্ধ পরিচালনা ও অস্ত্রশস্ত্রে ব্যপক পরিবর্তন আনে। পারসীয়দের থেকে তারা বিস্তৃত দেহবর্ম (mail), উরস্ত্রাণ(cuirass), শিরস্ত্রাণ, অশ্বারোহী সেনার জন্যে তৈরি ইস্পাতের হাটু-বর্ম ইত্যাদি বর্মের কৌশল রপ্ত করে। এসব দেহব্যপী বিস্তৃত বর্ম পরিহিত অশ্বারোহী সৈন্যদের বলা হত ক্যাটাফ্রাক্ট। এরা কখনো বল্লম ও তরবারী বহন করত আবার কখনো তীর-ধনুকও ব্যবহার করত।
বাহিনীর প্রধান অংশ পদাতিক বাহিনীকে সহায়তা করার জন্যে বহুসংখ্যক তীরন্দাজ নিয়োজিত থাকত, যাদের বলা হত স্কুটাটোই বা ঢালধারী। তারা ইস্পাতের হেলমেট ও বর্ম পরিধান করত এবং বল্লম ও ছুরি বহন করত। যুদ্ধে এরা রোমান বাহিনীর সেনাব্যূহের কেন্দ্রে অবস্থান করত। পাহাড়ি এলাকায় যুদ্ধকালে বর্শাধারী সৈন্যদের ব্যবহার করা হত।
সম্রাট জাস্টিনিয়ানের শাসনামলে উল্লেখযোগ্য যুদ্ধের মধ্যে দারার যুদ্ধ (৫৩০ খ্রিষ্টাব্দে সংঘটিত) অন্যতম। এ যুদ্ধে সেনাপতি বেলিসারিয়াস ২৫,০০০ সৈন্যের একটি সেনাবাহিনী নিয়ে পারস্য সম্রাট ১ম খসরুকে পরাজিত করেন। সম্রাট খসরুর বাহিনীতে ছিল ৪০,০০০ সৈন্য। এছাড়াও সেনাপতি বেলিসারিয়াস ভ্যান্ডালদের থেকে উত্তর আফ্রিকার কার্থেজ অঞ্চল পুনরুদ্ধার করেন এবং ৫৩৫-৫৫৪ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে গথ বাহিনীকে পরাজিত করে সিসিলি, নেপল্স, রোম ও ইতালির অন্যান্য অংশ পুনরুদ্ধার করেন। এসময়কার আরেকজন বিখ্যাত সেনাপতি ছিলেন নার্সিস যিনি ৫৫২ খ্রিষ্টাব্দে ইতালীর পূর্ব উপকূলে বুস্টা গ্যালোরামের যুদ্ধে গথ বাহিনীকে পরাজিত করেন।
৬ষ্ঠ শতাব্দীর শেষাংশে সম্রাট মরিসের দাপ্তরিকগণ তৎকালীন বাইজেন্টাইন বাহিনীর পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দিয়ে দ্য স্ট্র্যাটেজিকন নামক গ্রন্থ রচনা করেন। সম্রাট মরিস ৫৮২-৬০২ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত শাসন করেন। তার ছিল সুদীর্ঘ সামরিক অভিজ্ঞতা। ৫৯২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি পারস্য সাম্রাজ্যকে একটি চুক্তি সাক্ষর করতে বাধ্য করেন, যে চুক্তি অনুযায়ী পারসীয়রা আরমেনিয়া ভূখণ্ড সম্রাটকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। এরপর তিনি বলকান অঞ্চলে অ্যাভার ও স্লাভ জাতিদের পরাজিত করেন, যদিও তিনি এ যুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করতে ব্যর্থ হন।[১৩]
দ্য স্ট্র্যাটেজিকন গ্রন্থে এর লেখক তৎকালীন বাইজেন্টা্ইন সৈন্য, অস্ত্রশস্ত্র ইত্যাদির বিশদ বিবরণ দেন। এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল গথ, স্লাভ, জার্মানিক, অ্যাভার প্রভৃতি শত্রুদের কাছ থেকে প্রাপ্ত অস্ত্রসমূহ। গ্রন্থের বর্ণনা অনুযায়ী- "অশ্বারোহী যোদ্ধারা পরিধান করবে শিরবেষ্টনসহ বর্মের লম্বা পোশাক যা তাদের গোড়ালি পর্যন্ত ঝোলানো থাকবে, বর্মের সাথে সুতলি ও আংটার সাহায্যে পায়ের বর্ম ঝুলিয়ে রাখার ব্যবস্থা থাকবে, এবং তা বহন করার জন্যে খাপ থাকতে হবে।" এছাড়া শিরস্ত্রাণের সাথে পাখির পালক যুক্ত থাকত। তীরন্দাজেরা তাদের নিজ নিজ শক্তি অনুযায়ী ছোট বা বড় ধনুক বহন করত। সাথে থাকত ধনুক রাখার খাপ, বাড়তি জ্যা। তূণে জায়গা হত প্রায় ৩০/৪০টি তীর। তাদের কাঁধ থেকে ঝোলানো বেল্টে সূঁচ, উখা ইত্যাদি রাখার ব্যবস্থা ছিল। অশ্বারোহীদের বল্লমের লাঠিতে ধরার সুবিধার জন্যে চামড়ার সুতো লাগানো থাকত এবং অগ্রভাগে লাগানো থাকত পতাকা। সৈন্যরা এর সাথে তলোয়ারও বহন করত। গ্রন্থটিতে আরো বলা হয়েছে, "সৈন্যদের তলোয়ার ও উর্দির কলারে সুতির ফিতা ঝোলানো থাকবে ও উল দিয়ে ভিতর অংশ মোড়ানো থাকবে।" যেসব বিজাতীয় তরুণ যোদ্ধারা তীর-ধনুক চালাতে অপটু ছিল তারা বল্লম ও ঢাল বহন করত। ব্যক্তিগত বাহিনীর সৈন্যরা লোহার তৈরি দস্তানা পরিধান করত। তাদের ঘোড়ার লাগাম ও স্ট্র্যাপের সাথে লাগানো থাকত সুতার ঝালর। এছাড়াও তাদের কাঁধ ও দেহ বর্ম থেকে ছোট ছোট পতাকা ঝোলানো থাকত। গ্রন্থকার এসব সজ্জার কারণ উল্লেখ করে লিখেছেন "একজন সৈন্যের সাজসজ্জা যত জাঁকজমকপূর্ণ হবে, তার আত্মবিশ্বাস তত বৃদ্ধি পাবে এবং শত্রুদের মনে সে তত ভীতি সঞ্চার করতে পারবে।" বল্লমগুলো ছোড়ার জন্য ব্যবহৃত হত। বলা আছে, "যোদ্ধারা দু'টি করে বল্লম বহন করবে, যাতে একটি লক্ষ্যচ্যুত হলে আরেকটি ব্যবহার করতে পারে। অপটু তীরন্দাজেরা ওজনে হালকা ধনুক ব্যবহার করবে।"[১৪]
এরপর গ্রন্থটিতে অশ্বারোহীদের সরঞ্জাম ও পোশাক পরিচ্ছদের বর্ণনা দেয়া রয়েছে। "ঘোড়াদের মাথায় নিরাপত্তামূলক লোহার আবরণ ও বক্ষদেশ লোহা ও পশমের তৈরি বর্ম দ্বারা আবৃত থাকবে, বিশেষ করে অফিসার ও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের ঘোড়া এবং যুদ্ধক্ষেত্রে প্রথম সারির সেনাদের ঘোড়াদের এরূপ বর্ম পরিধান করতে হবে। নতুবা অ্যাভার জাতিদের ন্যায় মাথা ও ঘাড় রক্ষাকারী বর্মও পরা যাবে। ঘোড়ার জিনে প্রশস্ত ও পুরু কাপড় ব্যবহার করতে হবে। লাগামসমূহ উচ্চমানের হতে হবে। জিনের সাথে ২টি লোহার রেকার যুক্ত থাকতে হবে, ঘোড়া বাঁধার জন্যে ফাঁসযুক্ত দঁড়ি রাখতে হবে। তিন-চারদিনের রেশন মজুদ করা যায় এমন থলে জিনের সঙ্গে থাকতে হবে। ঘোড়ার পেছনের বকলসের সাথে চারটি ফিতা সংযুক্ত থাকতে হবে, এছাড়া মাথার সাথে একটি ও থুতনির নিচে একটি ফিতা যুক্ত করতে হবে।"[১৫]
স্ট্র্যাটেজিকন-এ আরো বলা আছে, "সেনাদের পোশাক, বিশেষত তাদের টিউনিক সুতি, ছাগলের পশম কিংবা উলের হতে পারে, তবে তা হতে হবে প্রশস্ত ও পরিপূর্ণ। এবং এ পোশাকের ধরন অ্যাভারদের ন্যায় হতে হবে, যাতে তা ঘোড়া চলাকালে হাঁটুর ওপর বেঁধে রাখা যায়, এবং দেখতেও সুশ্রী হয়। এছাড়াও সৈন্যদেরকে পশমের তৈরি হাতাসহ প্রশস্ত আলখাল্লা সরবরাহ করা হবে যা তারা তাদের বর্ম ও অস্ত্রশস্ত্রের ওপর পরতে পারে।" আরও বলা আছে, "সেনাদের প্রতিটি ছোট দল বা স্কোয়াডকে থাকার জন্যে তাঁবু এবং নিত্যপ্রয়োজনে ব্যবহারের জন্যে কাস্তে, কুঠার প্রভৃতি দেয়া হবে। এই তাঁবুগুলো অ্যাভারদের ন্যায় হওয়া উত্তম, কারণ সেগুলো ব্যবহারিকভাবে কার্যকর ও সুশ্রী।"[১৫]
স্ট্র্যাটেজিকন-এ এরপর লেখা হয়েছে, "সৈন্যদের নিজেদের জন্যে চাকরের ব্যবস্থা করতে হবে, দাস হোক অথবা স্বাধীন। ব্যক্তিগত চাকরের ব্যবস্থা করতে অক্ষম হলে সৈন্যদেরকে যুদ্ধক্ষেত্রে মালামাল বহন ও রক্ষণাবেক্ষণে ব্যস্ত থাকতে হবে এবং এতে করে যুদ্ধক্ষেত্রে লড়াই করার জন্যে সৈন্যের অভাব দেখা দেবে। যেহেতু প্রত্যেক সৈন্যের পক্ষে চাকরের ব্যবস্থা করা সম্ভব নয়, সেহেতু প্রতি তিন বা চার জন সৈন্যের জন্য একজন চাকর নিয়োগ করাই যথেষ্ট। একইভাবে প্রতি তিন-চার জনের জন্যে একটি করে ভারবাহী জন্তু থাকবে, যা বর্ম, তাঁবু প্রভৃতি বহনে ব্যবহৃত হবে।"[১৬]
এরপর গ্রন্থটিতে সেনাবাহিনীর বিভিন্ন শাখা ও শ্রেণী চিহ্নিত করার নিয়মকানুন বর্ণনা করে। এসব নিয়মকানুন মধ্যযুগের রাজ্যগুলোর প্রতীকসমূহের ("coat of arms") পূর্বসূরি বলে মনে হয়। একই ডিভিশন বা মেরোস - এর পতাকাসমূহ একই রঙের হত। এবং ঐ ডিভিশনের অন্তর্ভুক্ত ব্যাটালিয়নগুলো ঐ রংয়ের পতাকার সাথে নিজ নিজ রঙের ঝালর যুক্ত করত, এতে করে প্রতিটি শাখার পতাকা দেখে তার ডিভিশন, ব্যাটালিয়ন ইত্যাদি সহজেই নির্ণয় করা যেত। গ্রন্থের বর্ণনা অনুযায়ী, "প্রতিটি ট্যাগমা (ব্যাটালিয়ন বা স্কোয়াড)- এর পতাকা দেখে তাদের মেরোস, মইরা ও ট্যাগমা (বাহিনীর বিভিন্ন শাখা-প্রশাখাসমূহ) সহজেই শনাক্ত করা যেতে হবে। ঐ ব্যাটালিয়ন প্রধান যে পতাকা বহন করবেন, তা দেখে তার অধস্তন সৈনিকেরা যাতে তাঁকে দূর থেকে শনাক্ত করতে পারে।"[১৭]
স্ট্র্যাটেজিকন এরপর সংক্ষিপ্ত আকারে পদাতিক বাহিনীর সাজসজ্জা নিয়ে আলোচনা করে। তাদের পরনে থাকত গথিক টিউনিক যা- "তাদের হাঁটু পর্যন্ত নেমে আসে, এবং কখনো কখনো খাট এবং দু'পাশে ফালি করা থাকে। এবং তাদের পায়ে থাকত গথিক জুতো যা পুরু তলা ও মোটা আঙুল বিশিষ্ট এবং সেলাই করে বানানো। মজবুতির জন্য দুপাশে আঁকড়া ও পেরেক দ্বারা জুতার তলা আটকানো।" পদাতিক সৈন্যদের বুট বা পায়ের বর্ম পরতে নিরুৎসাহিত করা হত- "কারণ তা কুঁচকাওয়াজ ও দ্রুতবেগে অগ্রসর হতে বাঁধা সৃষ্টি করতে পারে। তাদের আলখেল্লা হবে সাধারণ, বুলগেরীয় আলখেল্লার মত নয়। তাদের চুল ছোট করে ছাঁটা থাকবে, দীর্ঘ চুল রাখা নিষেধ।"[১৮]
"ভারি অস্ত্রসজ্জিত পদাতিক বাহিনীর" বর্ণনাও সংক্ষিপ্ত আকারে দেয়া হয়েছে। "প্রত্যেক ব্যাটালিয়নের যোদ্ধারা নিজ নিজ ব্যাটালিয়নের রঙের ঢাল ব্যবহার করবে। তলোয়ার, বল্লম, পালক লাগানো হেলমেট, গুলতি এবং বাণ- অন্তত প্রথম সারির যোদ্ধারা এসব সাথে রাখবে। প্রত্যেক ফাইলে অন্তত কিছু সৈন্য বর্ম পরিহিত হতে হবে, সম্ভব হলে সব সৈন্য বর্ম পরবে। তা সম্ভব না হলে অন্তত প্রথম দুই সারির যোদ্ধাদের বর্মবিশিষ্ট হতে হবে এবং তাদেরকে কাঠ বা লোহার তৈরি জুতা পরিহিত হতে হবে।"[১৯]
স্ট্র্যাটেজিকনে এরপর "হালকা অস্ত্রে সজ্জিত" পদাতিক সৈন্যদের বিবরণ দেয়া হয়েছে- "তারা কাঁধে ধনুক ও তূণ বহন করবে যাতে অন্তত ৩০-৪০ টি তীর আঁটে। তাদের সাথে ঢাল ও আড়ধনু (crossbow) এবং এর জন্য ছোট আকৃতির তূণে ছোট তীর থাকতে হবে। যাতে এই তীরগুলো ধনুকের সাহায্যে বেশ দূর থেকে শত্রুর ওপর নিক্ষেপ করা যায়। যেসব সৈন্য তীরন্দাজীতে পারদর্শী নয় তাদের জন্য বর্শা ও বল্লম সরবরাহ করা হবে। তাদের সাথে ছোট ছোট বাণ ও গুলতিও থাকবে।"
ইতিহাসবিদ ট্রেডগোল্ডের অনুমানমতে ৫৬৫ খ্রিষ্টাব্দে বাইজেন্টাইন বাহিনীর সদস্যসংখ্যা ছিল ৩,৭৯,৩০০, যার মধ্যে ১,৫০,৩০০ জন সমরসেনা এবং ২,২৯,০০০ জন সীমান্তরক্ষী ও নাবিক ছিল। এই বিশালাকার বাহিনী সম্রাট মরিস এর শাসনামলজুড়ে বজায় ছিল। যদিও স্ট্র্যাটেজিকনের বর্ণনামতে একইসাথে মোতায়েন করা সর্ববৃহৎ বাহিনীতে সর্বমোট ৩৪,৩৮৪ জন সেনা ছিল (১৬,৩৮৪ জন ভারি পদাতিক সেনা, ৮,০০০ জন হালকা অস্ত্রবিশিষ্ট সেনা এবং ১০,০০০ অশ্বারোহী)। বর্ণনামতে যা "অতীতে বিশালাকার লিজিয়ন বাহিনীর উদাহরণ"। সম্রাট মরিসের ভাষ্যমতে ২৪,০০০ এর অধিক সৈন্য সংবলিত বাহিনীগুলো চারটি অংশে এবং ২৪,০০০ এর কম সৈন্যের বাহিনীগুলো তিনটি অংশে বিভক্ত করতে হত। আরেক স্থানে মরিস বর্ণনা করেন অশ্বারোহী বাহিনীর প্রতি ট্যাগমা ৩০০-৪০০ জন সৈন্য, প্রতি মরিয়া ২,০০০-৩,০০০ জন এবং প্রতি মেরোস ৭,০০০-৮,০০০ জন সৈন্য নিয়ে গঠিত হবে।[২০][২১]
মধ্য বাইজেন্টাইন সাম্রজ্যের সেনাবাহিনী, ৭ম-১১শ শতাব্দী
[সম্পাদনা]থীমাটা বাহিনী
[সম্পাদনা]এসময়ে সাম্রাজ্যের প্রশাসনিক বিভাগসমূহকে বলা হত থীমাটা (গ্রীক: θέματα)। এই প্রশাসনিক বিভাগসমূহে একজন সেনাপতি (স্ট্র্যাটেগোস , গ্রীক:στρατηγός) সামরিক ও বেসামরিক সকল এখতিয়ারের অধিকারী হতেন এবং একজন প্রধান বিচারকের হাতে থাকত বিচার বিভাগীয় ক্ষমতা। ইতিহাসবিদ ট্রেডগোল্ডের অনুমান করেন, থীমা বলতে "দায়িত্ব আরোপণ" বোঝানো হত। আধুনিক ইতিহাসবিদরা এবিষয়ে একমত যে, এশিয়া মাইনরের মোতায়েন সেনাবাহিনীগুলোতে সর্বপ্রথমথীম প্রথা চালু হয়।
ইসলামী রাশিদুন খেলাফতের অভিযানে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য ব্যপক ক্ষয়ক্ষতির স্বীকার হয় এবং বিস্তর ভূখণ্ড তাদের হস্তচ্যুত হয়। এর মধ্যে ৬৩৭ খ্রিষ্টাব্দে সিরিয়া, ৬৩৯ খ্রিষ্টাব্দে আরমেনিয়া ও মিসর, ৬৫২ খ্রিষ্টাব্দে উত্তর আফ্রিকা এবং ৬৫৪ খ্রিষ্টাব্দে তারা সাইপ্রাসের কর্তৃত্ব হারায়। ট্রেডগোল্ডের মতে সাম্রাজ্যের জনসংখ্যা ৫৬০ খ্রিষ্টাব্দে ১.৯৫ কোটি থেকে ৬৪১ খ্রিষ্টাব্দে ১.০৫ কোটিতে নেমে আসে। এবং তাদের সেনাবাহিনীর সদস্যসংখ্যা ৩,৭৯,৩০০ জন থেকে কমে ১,২৯,০০০ জনে নেমে আসে। এসব ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলা করতে এই থীম প্রথার প্রথম প্রচলন হয়।[২০]
৬৬২ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে, মাত্র ৩০ বছর সময়ে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য তার মোট ভূখণ্ডের অর্ধেকেরও বেশি অংশ হারায়। এসময় পরাজিত সেনাবাহিনী-সমূহের সেনাপতিরা তাদের অবশিষ্ট বাহিনী নিয়ে সাম্রাজ্যের বিভিন্ন প্রদেশে স্থায়ীভাবে মোতায়েন হতেন এবং সর্বপ্রথম থীমসমূহ প্রতিষ্ঠা করতেন। পরবর্তীতে সৈন্যদের বেতন মুদ্রা দ্বারা পরিশোধ করা কঠিন হয়ে পড়ে। ফলে সেনাপতিরা তাদের সৈন্যদেরকে নিজ নিজ অঞ্চলে জমিজমা প্রদান করে তাদের মজুরি পরিশোধ করতে থাকেন। এভাবেই থীমাটাসমূহ গড়ে ওঠে।[২২]
এই প্রথার প্রচলন ঠিক কোন সালে শুরু হয়েছিল সে তথ্য কোথাও পাওয়া যায় না। তবে ট্রেডগোল্ড ধারণা করেন ৬৫৯ - ৬৬২ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যেই তা প্রচলিত হয়। কারণ এ সময়েই সম্রাট ২য় কনস্টান্স আরবগণের সাথে যুদ্ধবিরতি চুক্তি করেন যাতে তার সাম্রাজ্য ক্ষয়ক্ষতি সামাল দেয়ার কিছু সময় পায়। তবে, সাম্রাজ্যের অর্থনীতির করুণ অবস্থার দরুন তারা সৈন্যদের মজুরি দিতে ব্যর্থ হয়। কিন্তু যুদ্ধবিরতি চলায় সাম্রাজ্য আর নতুন করে কোন ভূখণ্ড না হারানোতে তারা সৈনিকদের দেয়ার জন্যে যথেষ্ট ভূমির যোগান পায়। সেনাপতি ও সৈনিকগণ নিজ নিজ ভূমি বা থীমাটা রক্ষায় সচেষ্ট থাকেন। এই থীমাটা প্রথা ১১শ শতাব্দী পর্যন্ত সাম্রাজ্যের ওপর আরব আক্রমণ প্রতিহত করতে অনেকটা সক্ষম হয়। আবার সাম্রাজ্যের পশ্চিম অংশে সার্ব ও বুলগার জাতির আক্রমণের ফলশ্রুতিতে এসব অঞ্চলেও থীমাটাসমূহ গড়ে ওঠে। এসব জাতির আক্রমণে সাম্রাজ্যের সীমান্ত দানিউব নদী থেকে দক্ষিণে থ্রেস ও পেলোপোনিস পর্যন্ত সরে আসে।[২৩]
সর্বপ্রথম যে ৫টি থীমের উৎপত্তি হয় তার সবকটিই ছিল এশিয়া মাইনর অঞ্চলে। এগুলো হল:
- আরমেনিয়ান থীম, প্রথম উল্লেখ করা হয় ৬৬৭ সালে, প্রাক্তন আরমেনীয় বাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত হয়। এর বিস্তার ছিল আরমেনিয়া মাইনর, পন্টাস, উত্তর কাপাডোচিয়া অঞ্চলে। রাজধানী: অ্যামাসিয়া।
- আনাতোলিয়ান থীম, প্রথম উল্লেখ করা হয় ৬৬৯ সালে, রোমের প্রাক্তন প্রাচ্য বাহিনী এই থীম গঠন করে, এর অবস্থান ছিল মধ্য এশিয়া মাইনরে। রাজধানী: আমোরিয়াম।
- অপসিকিয়ান থীম, প্রথম উল্লেখ করা হয় ৬৮০ সালে, রোমের রাজকীয় বাহিনী এই থীম গঠন করে, উত্তর-পশ্চিম এশিয়া মাইনরে এর অবস্থান ছিল, এর কেন্দ্র ছিল নাইসিয়া নগরী।
- থ্রাকেসিয়ান থীম, ৬৮০ সালে প্রথম উল্লেখ করা হয়, থ্রেস সেনাবাহিনী থেকে এর উদ্ভব, এশিয়া মাইনরের মধ্য-পশ্চিম উপকূল জুড়ে এর অবস্থান ছিল, রাজধানী: এফেসাস।
- কারাবিসিয়ানি বাহিনী, ৬৮০ সালে প্রথম উল্লেখ করা হয়, সম্ভবত ইলিরিকাম এর সেনাবাহিনী এর গোড়াপত্তন করে। এশিয়া মাইনরের দক্ষিণ উপকূল ও এজিন সাগরের দ্বীপপুঞ্জজুড়ে এর বিস্তার ছিল। এর রাজধানীর নাম ছিল অ্যাটেলিয়া। এই থীম নৌবাহিনী নির্ভর ছিল।
প্রতিটি থীমে যোগ্য যোদ্ধাদের ভূমি বরাদ্দ দেয়া হত তাদের পরিবার ভরণপোষণের জন্যে এবং যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণের জন্যে। কোন কোন থীম পরবর্তী সময়ে শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং সম্রাটের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে থাকে, যা সম্ভব হয় থীমসমূহের সংগঠিত বৃহদাকার সেনাবাহিনীর দ্বারা। এসকল বিদ্রোহ ঠেকাতে সম্রাট ৩য় লিও দ্য ইসরিয়ান, সম্রাট থিওফিলিয়াস, সম্রাট ৪র্থ লিও দ্য ওয়াইজ প্রমুখ থীমগুলোকে ভেঙে দিয়ে ছোট ছোট অঞ্চলে বিভক্ত করেন, এবং সেনাবাহিনীগুলোকে ক্ষুদ্রতর শাখায় বিভক্ত করেন, এই শাখাগুলোর নাম দেয়া হয় টুর্মা । ৮ম থেকে ৯ম শতাব্দীতে বিশাল আয়তনের থীমসমূহ ভেঙে দিয়ে ছোট ছোট অঙ্গরাজ্যে বিভক্ত করে এর গভর্নরদের ক্ষমতা সীমিত করা হয়। ১০ম শতাব্দীতে আরো ক্ষুদ্রতর থীমের উদ্ভব ঘটে, যা পূর্বদিকের নতুন দখলকৃত অঞ্চলগুলোতে স্থাপিত হয়। এসব থীমে আরমেনীয় জাতিগোষ্ঠীর লোকেরা বাস করায় এগুলো আরমেনীয় থীম নামে পরিচিতি লাভ করে। খ্রি. ৯৭১-৯৭৫ এর মধ্যে এরূপ ৯০টি থীমের শাসকদের নামের তালিকা তৈরি করা হয়।[২৪]
৯০৫ সালে, সম্রাট ৭ম কনস্টান্টিনের শাসনামলে সাম্রাজ্য সিসিলী আমিরাতের কাছে পরাজিত হয়ে সিসিলীর কর্তৃত্ব সম্পূর্ণভাবে হারায়। ৯৬৫ সাল পর্যন্ত সাইপ্রাসে আব্বাসী খেলাফত ও বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য যুগ্মশাসন পরিচালনা করে। ৯৬৫ সালে সম্রাট ২য় নিকেফোরোস ফোকাস সিসিলী পুনর্দখল করেন। রাজধানী কনস্টান্টিনোপলের শাসনভার অর্পণ করা হত একজন এপার্ক বা প্রিফেক্ট-এর ওপর। এবং এর প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত থাকত বেশকিছু সংখ্যক ট্যাগমা বাহিনী ও স্থানীয় পুলিশ বাহিনী।
ট্রেডগোল্ডের মতে ৭৭৪ সালে সাম্রাজ্যের জনসংখ্যা ছিল ৭০ লক্ষ। সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনী মিলে সৈন্যসংখ্যা ছিল ১,১৮,৪০০। এর অন্তর্ভুক্ত ছিল ১০টি থীমের ৬২,০০০ সেনা, যার মধ্যে ছিল ৪,০০০ নৌসেনা। ৬টি ট্যাগমা -তে ছিল ১৮,০০০ সৈন্য। রাজকীয় নৌবাহিনী ও থীমসমূহের নৌবাহিনী নিয়ে দাঁড়বেয়ে নাবিকের সংখ্যা ছিল ৩৮,৪০০। খ্রিষ্টাব্দ ৮৪০ এর মধ্যে মোট জনসংখ্যা আরো ১০ লক্ষ বৃদ্ধি পায় এবং সেনাসদস্য সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১,৫৪,৬০০ জনে। এসময়ে ২০টি থীমে মোট ৯৬,০০০ সৈন্য ছিল এবং ট্যাগমা সমূহে ছিল ২৪,০০০ সৈন্য, নাবিকের সংখ্যা ছিল ৩৪,২০০।[২৫]
থীম সেনাপতি বা স্ট্র্যাটেগোই-এর নেতৃত্বে থীমের সেনাবাহিনী ২ থেকে ৪টি শাখায় ভাগ হয়ে যুদ্ধ করত। শাখাগুলোকে বলা হত ট্যুর্মাই এবং এর প্রতিটির কমান্ডে থাকতেন একজন করে ট্যুর্মার্কাই। এরা আবার বিভক্ত হত উপশাখায়, যাদের বলা হত ড্রঙ্গই এবং এর প্রতিটির নেতৃত্বে থাকতেন একজন ড্রঙ্গারিওই। এগুলোর প্রতিটিতে থাকত ১০০০ সৈন্য। যুদ্ধক্ষেত্রে এগুলো আবার বিভক্ত হত ৫০ থেকে ৩০০ সদস্যবিশিষ্ট দল বান্ডা-য়। বিদ্রোহের ভয় থেকেই সেনাবাহিনীকে এই শাখা উপশাখায় বিভক্ত করা হত।
নিম্নের সারণীতে আনুমানিক ৯০২-৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দে থ্রাকেসিয়ান থীমের সেনাবাহিনীর শ্রেণিবিন্যাস ও কাঠামো বর্ণিত হল।
শ্রেণীর নাম | সৈন্য সংখ্যা | অন্তর্ভুক্ত উপশ্রেণীর সংখ্যা | অধিনায়ক/অফিসারের পদবী |
---|---|---|---|
থীমা | ৯,৬০০ | ৪টি ট্যুরমা | স্ট্র্যাটেগোস |
ট্যুরমা | ২,৪০০ | ৬টি ড্রোঙ্গোস | ট্যুর্মার্চেস |
ড্রোঙ্গোস | ৪০০ | ২টি ব্যান্ডন | ড্রোঙ্গারিয়োস |
ব্যান্ডন | ২০০ | ২টি কেন্টার্কিয়া | কোমেস |
কেন্টার্কিয়া/সেঞ্চুরিয়া | ১০০ | ১০টি কোন্টোবার্নিয়ন | কেন্টার্চেস/হেকাটনটার্চেস |
৫০ | ৫টি কোন্টোবার্নিয়ন | পেন্টেকোন্টার্চেস | |
কোন্টোবার্নিয়ন | ১০ | ১টি অগ্রগামী সৈন্যদল + ১টি পশ্চাৎরক্ষী সৈন্যদল | ডেকার্কোস |
অগ্রগামী দল | ৫ | নেই | পেন্টার্কেস |
পশ্চাৎরক্ষী দল | ৪ | নেই | টেট্রার্কেস |
রাজকীয় ট্যাগমাটা বাহিনী
[সম্পাদনা]ট্যাগমাটা (গ্রীক: τάγματα , অর্থ: "রেজিমেন্ট") ছিল সাম্রাজ্যের পেশাদার স্থায়ী বাহিনী। সম্রাট ৫ম কনস্টান্টিন, থ্রাকেসিয়ান থীমে ৭৪১-৭৪৩ খ্রিষ্টাব্দে একটি গুরুতর বিদ্রোহ দমনের পর সর্বপ্রথম এই বাহিনী গঠন করেন। থীম বাহিনীগুলোর পক্ষ থেকে ভবিষ্যতে আরো বিদ্রোহের আশংকায়, সম্রাট তার সিংহাসনকে থেকে রক্ষা করতে এই বাহিনী গড়ে তোলেন। রাজধানী কনস্টান্টিনোপলের পুরনো রক্ষী বাহিনীকে সংস্কার করে এই নতুন ট্যাগমাটা বাহিনী সংগঠিত হয়, যা সম্রাটের অধীনে একটি পেশাদার ও অনুগত সৈন্যদল হিসেবে কাজ করে।[২৬] এদের সদর দফতর ছিল কনস্টান্টিনোপল ও তার নিকটস্থ অঞ্চলগুলিতে, যদিও পরবর্তীতে তারা বিভিন্ন প্রদেশে বাহিনী প্রেরণ করে থাকত। এই ট্যাগমাটা বাহিনীসমূহ মূলতঃ সম্পূর্ণভাবে শক্তিশালী অশ্বারোহী সেনাদের দ্বারা গঠিত ছিল। বিভিন্ন যুদ্ধ ও অভিযানে তারা সেনাবাহিনীর কেন্দ্রীয় শক্তি হিসেবে কাজ করত। তাদের সাহায্যকারী হিসেবে অন্যান্য প্রাদেশিক বাহিনী ও থীম বাহিনীসমূহ মোতায়েন থাকত, যাদের মূল কাজ ছিল নিজ নিজ অঞ্চলের প্রতিরক্ষা।
প্রধান ৪টি ট্যাগমাটা ছিল-
- স্কোলাই (গ্রীক: Σχολαί, অর্থ: "স্কুল/ বিদ্যালয়"), এরা ছিল সর্বাপেক্ষা প্রবীণ ও অভিজ্ঞ সৈন্য, যারা কনস্টান্টিনোপলের রক্ষীবাহিনী থেকে গঠিত সর্বপ্রথম ট্যাগমা বাহিনী।
- এক্সকোবিটোই (গ্রীক: Ἐξκούβιτοι, অর্থ: "রক্ষী"), সম্রাট ১ম লিও সর্বপ্রথম এ বাহিনী গঠন করেন।
- অ্যারিথমোস (অর্থ: "সংখ্যা) বা ভিগলা (অর্থ: "প্রহরা"), সম্রাজ্ঞী আইরিন ৭৮০ খ্রিষ্টাব্দে থীম বাহিনীসমূহ থেকে পদন্নতি দিয়ে এ বাহিনী গঠন করেন। তবে এসব বাহিনীগুলোর উৎপত্তি আরো পূর্বেই হয়েছিল।[২৭] সম্রাট ১ম নিকেফোরাসের শাসনামলে (খ্রি. ৮০২-৮১১) তারা রাজপ্রাসাদ ও রাজধানী কনস্টান্টিনোপলের স্টেডিয়াম হিপ্পোড্রোম-এর রক্ষীর দায়িত্ব পালন করত।[২৮] বিভিন্ন অভিযানে এরা রাজকীয় ঘাঁটি প্রহরা, সম্রাটের আদেশ ও বার্তা বহন করা, বন্দীদের পাহারা দেয়া ইত্যাদি বিশেষ দায়িত্বে নিয়োজিত থাকত।[২৯]
- হিকানাটোই (অর্থ: "সামর্থবানেরা"), সম্রাট ১ম নিকেফোরাস ৮১০ সালে প্রথম এই বাহিনী গঠন করেন।[৩০]
এছাড়াও একটি সাহায্যকারী ট্যাগমাটা বাহিনী ছিল যার নাম নিউমেরোই তারা রাজধানী কনস্টান্টিনোপলের মোতায়েন ছিল, এবং রাজধানীর দেয়াল রক্ষীবাহিনীও এর অন্তর্ভুক্ত ছিল। তদ্রূপ আরেকটি বাহিনীর নাম অপটিমাটোই , যারা বাহিনী রসদ, মালামাল প্রভৃতির দেখভাল করত।[৩০] and the Optimatoi (Gr. Ὀπτιμάτοι, "the Best"), a support unit responsible for the mules of the army's baggage train (the τοῦλδον, touldon).[৩১]
ট্রেডগোল্ডের মতে, ৭৭৩-৮৯৯ সালের মধ্যে প্রধান ৪টি ট্যাগমাটা বাহিনীর অধীনে ছিল ১৬,০০০ অশ্বারোহী সেনা, নিউমেরা ও দেয়ালরক্ষী ছিল ৪,০০০ এবং অপটিমাটোই বাহিনীতে ছিল আরো ২,০০০ সহকারী সৈন্য, পরে এতে আরো ২,০০০ সৈন্য নিয়োগ দেয়া হয়। আনুমানিক ৮৪০ খ্রিষ্টাব্দে সাম্রাজ্যের রাজকীয় নৌবাহিনী গঠন করা হয়, যাতে ৪,০০০ নৌসেনা নিয়োগ দেয়া হয়, এতে করে মোট সৈন্যসংখ্যা বেড়ে ২৮,০০০ জনে দাঁড়ায়।[৩২]
এছাড়াও ছিল হেটাইরেয়া (অর্থ: "সহকারী/সাথী"), যারা ছিল বিভিন্ন জাতির ভাড়াটে যোদ্ধা যারা সাম্রাজ্যের হয়ে যুদ্ধ করত। এরা উচ্চতর, মধ্যম ও নিম্ন এ তিন শ্রেণীতে বিভক্ত ছিল এবং প্রত্যেক শ্রেণীর অধিনায়ক ছিলেন একজন অফিসার, যাকে বলা হত হেটাইরেয়ার্কেস।
এসকল স্থায়ী বাহিনী ছাড়াও বিভিন্ন প্রয়োজনে অস্থায়ী ট্যাগমাটা বাহিনী গঠন করা হত। সম্রাট ২য় মাইকেল টেসারাকন্টারিওই নামে এরূপ একটি বিশেষ নৌবাহিনী গঠন করেন। সম্রাট ১ম জন জিমিস্কেস পারস্যের আদলে অ্যাথানাটোই বা "অমর সৈন্য" ("Immortals") নামক সেনাবাহিনী গঠন করেন।
কোম্নেনিয়ান রাজবংশের শাসনামলে সেনাবাহিনী
[সম্পাদনা]গোড়াপত্তন ও সাফল্য
[সম্পাদনা]১০৮১ খ্রিষ্টাব্দে কোম্নেনিয়ান শাসনামলের সূচনালগ্নে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য বহুল পরিমাণে ভূখণ্ড হারায়, এসময়ে সাম্রাজ্যের আয়তন এর ইতিহাসে যেকোন সময়ের তুলনায় ক্ষুদ্র ছিল। সাম্রাজ্য চারদিক থেকে শত্রুদের দ্বারা বেষ্টিত ছিল এবং দীর্ঘকাল ধরে যুদ্ধে অবতীর্ণ থাকায় এর অর্থনীতির দশাও শোচনীয় ছিল। তথাপি সম্রাট ১ম আলেক্সিওস কোম্নেনোস, সম্রাট ২য় জন কোম্নেনোস এবং ১ম ম্যানুয়েল কোম্নেনোস তাদের দক্ষতা, অধ্যবসায় ও সুদীর্ঘ প্রচেষ্টার দ্বারা সাম্রাজ্যের ব্যপক উন্নতি সাধনে সক্ষম হন এবং একটি নতুন সেনাবাহিনী থেকে সংগঠিত করেন।
এই নবগঠিত কোম্নেনিয়ান সেনাবাহিনী সুশৃঙ্খল এবং পেশাদার ছিল। এ বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত ছিল শক্তিশালী ভ্যরাঞ্জিয়ান রক্ষীবাহিনী এবং ইম্মর্টাল্স বা "অমর" বাহিনী, এরা অশ্বারোহী বাহিনীর অংশ ছিল। কনস্টান্টিনোপল নগরীতে এদের সদরঘাঁটি ছিল এবং অন্যান্য প্রদেশ থেকেও এ বাহিনীতে সেনা নিয়োগ দেয়া হত। ম্যাসেডোনিয়া, থ্রেস, থেসালি, এশিয়া মাইনরের কৃষ্ণ সাগর উপকূল এবং অন্যান্য প্রদেশসমূহ থেকে অশ্বারোহী ক্যাটাফ্রাক্ট সৈন্য নিয়োগ দেয়া হত।
সম্রাট ২য় জনের শাসনামলে একটি ম্যাসেডোনিয়ান সেনা ডিভিশন সর্বদা বজায় রাখা হত, এবং অন্যান্য বাইজেন্টাইন প্রদেশসমূহ থেকে সেনা নিয়োগ করা হত। সম্রাট জন ও সম্রাট ম্যানুয়েলের শাসনকালে সাম্রাজ্যের এশিয়া মাইনর অঞ্চলসমূহের ব্যপক উন্নয়ন সাধিত হয়, ফলে এসমস্ত অঞ্চল থেকে অধিক পরিমাণে সৈন্য সামন্ত নিয়োগ করা সম্ভব হয়। তদুপরি, বিজিত জনগোষ্ঠীগুলো থেকেও সেনাবাহিনীর জন্য সৈন্য নেয়া হত, যেমন পেচেনেগ নামক যাযাবর যাতি থেকে অশ্বারোহী তীরন্দাজদের নিয়োগ দেয়া হত। নাইকোমিডিয়া অঞ্চলের সার্ব জাতির মধ্য থেকেও লোকবল সংগ্রহ করা হত।
স্বজাতীয় সেনাদের বিভিন্ন শাখায় বিভক্ত করে এশিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন প্রদেশে মোতায়েন করা হত। বিভিন্ন মিত্ররাষ্ট্র কোম্নেনিয়ার বাহিনীর সহায়তায় সৈন্য রেজিমেন্ট পাঠাত, এর মধ্যে অন্যতম ছিল আন্তিয়খিয়া, সার্বিয়া ও হাঙ্গেরীয় রাজ্য। এভাবে বাইজেন্টাইন সেনাবাহিনীতে দুই-তৃতীয়াংশ স্বদেশী যোদ্ধা ও এক তৃতীয়াংশ বিদেশী সেনা ছিল। তীরন্দাজ, পদাতিক ও অশ্বারোহীর সমন্বয়ে সেনাদের এক একটি দল গঠিত হত যাতে করে যুদ্ধক্ষেত্রে তারা একে অপরকে সহায়তা করতে পারে।
এই কোম্নেনিয়ান বাহিনী অত্যন্ত কার্যকর, উন্নত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও উন্নতমানের সমরাস্ত্রে সজ্জিত ছিল। মিসর, হাঙ্গেরী, ইতালি, ফিলিস্তিনসহ বিভিন্ন স্থানে তারা সফল অভিযান চালাতে সক্ষম হয়। এতদসত্বেও এই বিশালাকার বাহিনী নেতৃত্ব ও পরিচালনার জন্যে এর দক্ষ ও শক্তিশালী সম্রাটগণের ওপর নির্ভরশীল ছিল। যদিও সম্রাট অ্যালেক্সিওস, সম্রাট জন ও সম্রাট ম্যানুয়েলের শাসনামলে (খ্রি.১০৮১-১১৮০) কোম্নেনিয়ান বাহিনী এ সাম্রাজ্যকে সফলভাবে প্রতিরক্ষা করে ও সাম্রাজ্যের উন্নতি ও অগ্রগতির সুযোগ করে দেয়, তাদের শাসনের অবসানের পর ১২শ শতাব্দীতে পুনরায় বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যে সুযোগ্য সম্রাটের অভাবে তাদের সেনাবাহিনী তার কার্যকারিতা অনেকাংশেই হারিয়ে ফেলে। এতে করে যোগ্য নেতৃত্ব না থাকায় সাম্রাজ্যে পুনরায় বিপর্যয় নেমে আসে।
অ্যাঙ্গেলোই বংশের শাসনামলের অবহেলা
[সম্পাদনা]১১৮৫ খ্রিষ্টাব্দে সম্রাট ১ম অ্যান্ড্রোনিকোস কোম্নেনাসকে হত্যা করা হয় এবং তার সাথে কোম্নেনাস রাজবংশের সমাপ্তি ঘটে, যে রাজবংশের সম্রাটেরা যোগ্য সেনানায়ক ছিলেন এবং এক শতাব্দীব্যপী বাইজেন্টাইন সেনাবাহিনীকে সফলভাবে সংগঠিত ও পরিচালিত করেছিলেন। এ বংশের অবসানের পর তাদের স্থলাভিষিক্ত হয় অ্যাঙ্গেলোই রাজবংশ। এ বংশ বাইজেন্টাইন ইতিহাসে সবচেয়ে অযোগ্য ও অকার্যকর হিসেবে পরিচিত।
এ পর্যায়ে সেনাবাহিনী ছিল অত্যন্ত কেন্দ্রীভূত। সম্রাটেরা নিজেরাই সেনাবাহিনীকে নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে যুদ্ধ পরিচালনা করতেন। সেনাপতিদের কঠোর নিয়ন্ত্রণে রাখা হত। রাজ্যের সকল বাহিনী আদেশ-নির্দেশ ও মজুরি, পুরস্কার ইত্যাদির জন্য কনস্টান্টিনোপলের ওপর নির্ভরশীল ছিল।
অ্যাঙ্গেলোই শাসকদের নিস্ক্রয়তা ও অযোগ্যতার কারণে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য জলে-স্থলে দ্রুত ক্ষমতা হারাতে থাকে। এই সম্রাটেরা নিজেদেরকে তোষামোদকারী, দাস-দাসী ও রক্ষিতাদের দিয়ে বেষ্টিত রাখতেন। সাম্রাজ্যের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক পদে বসানো হত সম্রাটের অযোগ্য আত্মীয়-স্বজন ও চাটুকারদের। যারা সাম্রাজ্যের অর্থসম্পদ বিলাসব্যসনে, গীর্জা, দালানকোঠা প্রভৃতির সাজসজ্জায় যথেচ্ছ অপচয় করে রাজকোষের অর্থ নিঃশেষ করার উপক্রম করেছিল। সেনাপতিদের নেতৃত্বের অভাবে সাম্রাজ্যের নিরাপত্তা ব্যপক আকারে হুমকের সম্মুখীন হয়। সবকিছু মিলে সাম্রাজ্যের অর্থনীতিতে ধস নামে।
সাম্রাজ্যের এই দুর্বলতার সুযোগে নানান দিক থেকে শত্রুরা তৎপর হয়ে ওঠে। পূর্ব সীমান্ত থেকে তুর্কিরা আক্রমণ চালায় এবং কালক্রমে তারা এশিয়া মাইনর অনেকাংশে দখল করে নেয়। অপরপক্ষে পশ্চিমে সার্ব ও হাঙ্গেরীয়রা সাম্রাজ্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীন হয়ে যায়। বুলগেরিয়ায় অ্যাঙ্গেলোই সম্রাটের অতিরিক্ত কর আদায়ে স্থানীয়রা ক্রমেই অসন্তুষ্ট হয়ে পড়ে এবং ১১৮৫ খ্রিষ্টাব্দে ভ্লাক-বুলগেরিয়ান বিদ্রোহের সূচনা হয়। এই বিদ্রোহের সুত্র ধরে পরবর্তীতে ২য় বুলগেরীয় সাম্রাজ্যের ব্যুৎপত্তি ঘটে। এতে বলকান অঞ্চলে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের নিরাপত্তা হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়ে।
বুলগেরিয়ার সম্রাট কালোইয়ান বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ নগরী দখল করে নেন। এমনকালে অ্যাঙ্গেলোইরা রাজকোষের অর্থ অপব্যবহার করে প্রাসাদ, বাগান ইত্যাদি নির্মাণে ব্যস্ত থাকে এবং হারানো ভূখণ্ড উদ্ধারের বদলে কুটনৈতিকভাবে তাদের বিপর্যয় নিরসনের চেষ্টা চালায়। বাইজেন্টাইনদের কতৃত্ব মারাত্মকভাবে দূর্বল হয়ে পড়ে, এবং কেন্দ্রের এই দূর্বলতার কারণে সাম্রাজ্য বহুখণ্ডে বিভক্ত হয়ে পড়ে। স্থানীয় জনগণ সম্রাটের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলে এবং প্রাদেশিক ও স্থানীয় নেতাদের নেতৃত্ব বরণ করে। এতে করে সাম্রাজ্যের সেনাবাহিনী লোকবল হারায় এবং বহু রেজিমেন্ট কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।
বাইজেন্টাইন সেনাবাহিনীর পতনের কারণ পর্যালোচনা
[সম্পাদনা]কাঠামোগত দূর্বলতা
[সম্পাদনা]উপরোল্লিখিত পরিস্থিতিতে সাম্রাজ্যের সামরিক ক্ষমতার মেরুদণ্ড থীম প্রথার বিলুপ্তি ঘটে। এ প্রথার জোরেই ৮ম থেকে ১১শ শতাব্দীতে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য একটি শক্তিশালী সামরিক বাহিনী গঠন করতে সক্ষম হয়েছিল। এর বিলুপ্তি তাই সাম্রাজ্যের সর্বনাশ ডেকে আনে।
থীম প্রথার একটি প্রধান উপকারিতা ছিল এর সংখ্যাগত আধিক্য। ধারণা করা হয় সম্রাট ১ম ম্যানুয়েল কোম্নেনোসের (খ্রি. ১১৪৩-১১৮০) বাহিনীতে ৪০,০০০ জন সৈন্য ছিল। তবে প্রমাণ মেলে অতীতে থীমাটা বাহিনীসমূহ সাম্রাজ্যকে এর অপেক্ষা সংখ্যাগরিষ্ঠ বাহিনী যোগান দিতে সক্ষম হয়। ৯০২-৯৩৬ সালে শুধুমাত্র থ্রাকেসিয়ান থীম থেকেই ৯,৬০০ সৈন্য প্রেরণ করা হয়। তদুপরি থীম বাহিনীসমূহ স্বাধীনভাবে পরিচালিত হওয়ায় কেন্দ্রের সরাসরি নির্দেশনা ছাড়াই তারা বিভিন্ন প্রাদেশিক অঞ্চলগুলোতে সাম্রাজ্যের প্রতিরক্ষায় এগিয়ে আসতে সক্ষম ছিল। একারণে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ বাহিনী সাহায্যে বৃহৎ পরিসরে তারা সাম্রাজ্যের প্রতিরক্ষা করতে পারত।
থীমসমূহের আরেকটি উপকারিতা ছিল, এ প্রথার দরুন সেনা মোতায়েন করতে ব্যপক অর্থ ব্যয় হত না। সাম্রাজ্যের প্রদেশগুলোতে সবসময় থীম বাহিনীগুলো মোতায়েন থাকত বলে সহজে ও কম অর্থব্যয়ে যথেষ্ট পরিমাণ সৈন্য চলাচল করা সম্ভব হত। থীম প্রথার বিলুপ্তি হওয়াতে সকল সেনা কেন্দ্র থেকে মোতায়েন করতে হত যা ছিল ব্যয়বহুল। ফলে সেনাবাহিনীতে সৈন্যের সংখ্যা কমিয়ে এর খরচ কমানো হত। কোম্নেনীয় রাজবংশের সম্রাটেরা এ সমস্যার সমাধান করেছিলেন তাদের বিপুল ধনভান্ডার, বুদ্ধিদীপ্ত যুদ্ধচালনা, সামরিক বিষয়সমূহে সর্বদা মনোনিবেশ এবং তেজস্বী নেতৃত্বের দ্বারা। তাই থীম প্রথার বিলুপ্তিতে যে সমস্যা সৃষ্টি হয়েছিল তা কোম্নেনিয়ান সম্রাটদের দক্ষ নেতৃত্বের কারণে অনেকটা সমাধান হলেও তাদের পতনের পর বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের সমস্যাসমূহ উপলব্ধি হয়।
১১৮০ সালে সম্রাট ১ম ম্যানুয়েল কোম্নেনোসের মৃত্যুর পর অ্যাঙ্গেলোই সম্রাটগণ সামরিক বাহিনীগুলোর প্রতি কোম্নেনোসদের ন্যায় মনোযোগ দেননি। ফলে সেনাবাহিনীর কাঠামো ভেঙে পড়ে এবং দ্রুত তা শক্তি হারাতে থাকে। ১১৮৫ সালের পর বাইজেন্টাইন সম্রাটগণ তাদের বাহিনীকে নিয়ন্ত্রণ করতে ও তাদের বেতন-ভাতা পরিশোধ করতে হিমশিম খান। তাদের অযোগ্যতার কারণে সাম্রাজ্যের দূর্বলতাগুলো ক্রমেই সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে, এবং সেনাবাহিনী যে সম্রাটের নির্দেশনার ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল ছিল তা উপলব্ধি হয়। অবশেষে ১২০৪ সালে অ্যাঙ্গেলোই সম্রাটদের ব্যর্থতা চূড়ান্ত পর্যায় পৌঁছে যখন ৪র্থ ক্রুসেডের বাহিনীগুলো রাজধানী কনস্টান্টিনোপলে প্রবেশ করে লুঠতরাজ শুরু করে ও নগরী তছনছ করে দেয়।
উপসংহার
[সম্পাদনা]তাই বলা চলে, কোম্নেনিয়ান বাহিনীর মূল সমস্যা এই ছিল না যে তারা যুদ্ধক্ষেত্রে অকার্যকর ছিল। বরং, তারা অতীতের থীম বাহিনীসমূহের মতই সফল ছিল। তাদের প্রধান সমস্যা ছিল লোকবলের অভাব ও কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা। ১২শ শতাব্দীর রাজবাহিনী তাই বহুলাংশে এর দক্ষ নেতৃত্বের ওপর নির্ভর করত। তাই কোম্নেনিয়ান সম্রাটদের পর অযোগ্য ও অলস নেতৃত্বের কারণে এই বাহিনী ভেঙে পড়ে। অপরপক্ষে থীম বাহিনীগুলো স্বাধীনভাবে পরিচালিত এবং সংগঠিত হওয়ায় তা সাম্রাজ্যকে সামরিক কাঠামোগত সুবিধা দান করত, যে সুবিধাসমূহ পরবর্তী যুগে হারিয়ে যায়।
উপর্যুক্ত কারণসমূহ থেকে বলা যায়, থীম প্রথার বিলুপ্তিই ছিল বাইজেন্টাইন সামরিক শক্তির পতনের মূল কারণ। যদিও এর ফল পরিলক্ষিত হয় পরবর্তী শতাব্দীগুলোতে, তথাপি সাম্রাজ্যের অতীতের কাঠামোগত শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছিল। তাই বাইজেন্টাইন বাহিনীর পতনের কারণ এর সেনাদের অক্ষমতা নয় বরং এর প্রথার পরিবর্তন। এক সম্রাটের মৃত্যুর পরেও বজায় থাকে এমন সুগঠিত ও সুশৃঙ্খল সামরিক সংগঠন বিদ্যমান না থাকায়, দুর্যোগকালে সাম্রাজ্য অত্যন্ত নাজুক পরিস্থিতির শিকার হয়। সাম্রাজ্য এর দক্ষ সম্রাটের নেতৃত্বের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে পড়ে, ফলে এর দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। এই ছিল বাইজেন্টাইন সেনাবাহিনীর পতনের মূল কারণ। অন্যান্য কারণসমূহের মধ্যে অন্যতম-
- বিজাতীয় ভাড়াটে সৈন্যদের ওপর নির্ভরশীলতা, যা বাইজেন্টাইন নৌবাহিনীকে দূর্বল করে দেয়।
- সাধারণ পদাতিক সেনাদের গুণমান হ্রাস পাওয়া।
- সামন্তবাদ (feudalism) এর ব্যপক প্রসার, যা কেন্দীয় ক্ষমতাকে হ্রাস করে দেয়।
- পশ্চিম বা লাতিন অস্ত্রশস্ত্রের অধিকমাত্রায় অনুকরণ, যা শুরু হয় সম্রাট ১ম ম্যানুয়েল কোম্নেনিয়াসের শাসনামলে।
বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের উত্তরসূরি রাষ্ট্রসমূহের সেনাবাহিনী ও প্যালিওলোগান বাহিনী
[সম্পাদনা]১২০৪ খ্রিষ্টাব্দে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের পতনের পর নাইসিয়ার সম্রাটগণ অতীতের কোম্নেনিয়াস বংশের কতিপয় প্রথা প্রচলিত রাখেন। ১২৬১ সালে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হলেও এর অতীতের ধনসম্পদ, লোকবল ও বিস্তর ভূখণ্ড তারা আর কোনদিন ফিরে পেতে সক্ষম হয়নি, যা কোম্নেনিয়াস বংশ ও এর পূর্বসূরিদের আমলে তাদের অধিকারে ছিল। এতে করে সামরিক বাহিনী প্রায়ই অর্থাভাবে পড়ত। ১২৮২ সালে সম্রাট ৮ম মাইকেল প্যালাইওলোগোস এর মৃত্যুর পরে সাম্রাজ্যের সেনাবাহিনী অনির্ভরযোগ্য ভাড়াটে সৈন্যদের ওপর নির্ভর করতে শুরু করে, এদের মধ্যে অন্যতম ছিল কাতালান কোম্পানী নামক ভাড়াটে যোদ্ধাদল, যারা বাহিনীর একটি বড় অংশ গঠন করে।
১৪৫৩ খ্রিষ্টাব্দে কনস্টান্টিনোপলের পতনের পর বাইজেন্টাইন বাহিনীতে ছিল মাত্র ৭,০০০ সেনা, যার মধ্যে ২,০০০ ছিল ভাড়াটে যোদ্ধা। অপরদিকে আক্রমণকারী অটোমান বাহিনীতে ছিল ৮০,০০০ সৈন্য, তাই সৈন্যসংখ্যায় ছিল আকাশ-পাতাল পার্থক্য। তবুও বাইজেন্টাইনরা সুলতানের জ্যানিসারি বাহিনীর প্রথম তিনটি আক্রমণ প্রতিরোধ করতে সক্ষম হয়। কোন কোন বর্ণনামতে প্রতিরোধ যুদ্ধ চলাকালে জেনোভার একজন সেনাপতি গুরুতর আহত হন, যার নাম ছিল জিওভান্নি গিউস্তিয়ানি। তাকে আহত অবস্থায় দেয়াল থেকে সরিয়ে নেয়ার সময় প্রতিরোধকারী সেনাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পরে। জিওভান্নির অধীনস্থ ইতালীয় সেনারা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলায়ন করে।
অনেক ইতিহাসবিদের মতে, রক্ষীরা ভুলক্রমে কনস্টান্টিনোপল নগরীর কের্কোপোর্টা ফটকের তালা খোলা রেখে দেয়, যা অটোমান বাহিনীর দৃষ্টিগোচর হয় এবং তারা ঐ ফটক দিয়ে নগরীতে ঢুকে পড়ে। যদিও বর্ণনামতে রক্ষীরা এ আক্রমণ প্রতিহত করে দেয়। তবুও একসময় অটোমানরা সফলভাবে নগরীতে প্রবেশ করে। এসময় সম্রাট ১১শ কনস্টান্টিন তার বেগুনী রাজপোশাক খুলে রেখে নিজেই ঢাল-তলোয়ার হাতে যুদ্ধে নেমে পড়েন এবং সেনাদের নেতৃত্ব দেন।
তুর্কি সেনাদের আঘাতে সম্রাট আহত হন। এবং তার সেনারা তাকে ছেড়ে প্রস্থান করে, নগরীর দেয়ালে আহত ও একাকী অবস্থায় সম্রাটের মৃত্যু হয়। বাইজেন্টাইন রাজধানীর পতনের মাধ্যমে রোমান সাম্রাজ্যের অবসান ঘটে, যুগ যুগ ধরে চলে আসা বাইজেন্টাইন সেনাবাহিনী, যারা ছিল প্রাচীন রোমান সেনাবাহিনীর উত্তরসূরিস্বরূপ, অবশেষে বিলুপ্ত হয়।
বাহিনীর সৈন্যসংখ্যা
[সম্পাদনা]বাইজেন্টাইন বাহিনীর আকৃতি ও সংগঠন ব্যপক বিতর্কের বিষয়। এসম্পর্কে প্রাপ্ত তথ্য অপ্রতুল ও প্রধান উৎসসমূহ অস্পষ্ট। নিম্নের তালিকায় আনুমানিক সৈন্যসংখ্যা দেয়া হল। এসকল গণনায় নাবিকদের সংখ্যা ধরা হয়নি।
|
|
ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ মার্ক হুইটো-এর মতে বাইজেন্টাইন সেনাবাহিনীর লোকবলের সাথে, মধ্যযুগীয় ইউরোপের রাজ্যগুলোর লোকবলের তুলনা করা চলে। বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য হয়ত মধ্যযুগীয় ইউরোপীয় রাজ্যসমূহের মত ধনবান বা শক্তিশালী ছিল না, তবে তারা অপেক্ষাকৃতভাবে কেন্দ্রীভূত ও সংঘবদ্ধ ছিল, যে কারণে তারা টিকে থাকতে পেরেছিল।[৪৮] বিভিন্ন বাইজেন্টাইন সূত্র পর্যালোচনা করে তিনি এই মত দেন যে, ৮ম থেকে ১০ম শতাব্দীর মধ্যে বাইজেন্টাইন বাহিনীতে মোটে ১০,০০০ এর কিছু বেশি অশ্বারোহী ও ২০,০০০ পদাতিক সেনা ছিল।[৪৯] তার মতে, বাইজেন্টাইন বাহিনীর সেনাসংখ্যা শতকে বা হাজারে গণনা করতে হবে, দশ হাজারের হিসেবে নয়।[৪৮]
বাইজেন্টাইন সৈন্যদের প্রকারভেদ
[সম্পাদনা]ক্যাটাফ্রাক্ট
[সম্পাদনা]পারস্য বাহিনীর ভারি বর্মাবৃত অশ্বারোহী বাহিনীর সাথে পাল্লা দিতে না পেরে বাইজেন্টাইনরা তাদের অনুকরণে নিজেদের অশ্বারোহী বাহিনীকে বর্মে সজ্জিত করা শুরু করে, তারা এসব সৈন্যের নাম দেয় "ক্যাটাফ্রাক্ট",[৫০] গ্রীক ভাষায় যার অর্থ হল "পরিপূর্ণ বর্মাবৃত"। গ্রীক ও পরবর্তীতে লাতিনেরা তাদের ভারি অশ্বারোহী বাহিনীকে এ নামে ডাকতে শুরু করে। এই সেনারা পুরো দেহ ভারি বর্মে ঢাকা থাকত, এবং তারা ভারি অস্ত্র ব্যবহার করত। নব্য প্রাচীন যুগ থেকে শুরু করে মধ্যম মধ্যযুগ পর্যন্ত এই প্রকার সেনাদের যুদ্ধে ব্যবহার করা হত। প্রাথমিকভাবে ক্যাটাফ্রাক্ট বলতে ঘোড়া এবং তার আরোহীর পরিহিত লম্বা দেহব্যপী বর্মকে বোঝানো হত। পরে অশ্বারোহীকে বোঝাতে এই শব্দ ব্যবহৃত হতে থাকে। ক্যাটাফ্রাক্টরা ছিল দুর্ধর্ষ ও সুশৃঙ্খল যোদ্ধা। পারস্যের অশ্বারোহীদের মত ঘোড়া এবং আরোহী উভয়েই বর্মাবৃত থাকত, আরোহীর অস্ত্র ছিল বল্লম, তীর-ধনুক বা মুগুর। তারা অন্যান্য অশ্বারোহীর তুলনায় ধীরগতির হলেও যুদ্ধক্ষেত্রে তারা ত্রাস সৃষ্টিকারী বাহিনী ছিল। এদের থেকেও ভারি বর্ম পরিহিত অশ্বারোহীদের বলা হত ক্লিবানারাই , তবে পরে এরা ক্যাটাফ্রাক্টদের সাথে একীভূত হয়ে যায়।
অশ্বারোহী বাহিনী
[সম্পাদনা]বাইজেন্টাইন অশ্বারোহী বাহিনী উত্তর সিরিয়া ও আনাতোলিয়ার সমতল ভূমিতে যুদ্ধের উপযোগী ছিল, এসকল এলাকায় মুসলিম বাহিনীর সাথে বাইজেন্টাইনদের সংঘর্ষ বাঁধে। এরা তরবারী, বল্লম, বা মুগুর ব্যবহার করত, এবং সাথে তীর-ধনুকও বহন করত। পূর্বে আরব এবং তুর্কি বাহিনীদের সাথে যুদ্ধে এদের ব্যবহার করা হয়, আবার পশ্চিমে হাঙ্গেরীয় ও পেচেনেগদের সাথেও এরা যুদ্ধ করে থাকত।
মধ্যম বাইজেন্টাইন সময়কালে (খ্রি. ৯০০-১২০০), অশ্বারোহী বাহিনী তিনভাগে বিভক্ত ছিল। এর মধ্যে ছিল ভারি অশ্বারোহী ক্যাটাফ্রাক্ট বাহিনী, মধ্যম মানের বর্ম ও অস্ত্রধারী কৌর্সোর্সেস বাহিনী, এবং হালকা বর্ম পরিহিত তীরন্দাজ অশ্বারোহী বাহিনী।[৫১]
পদাতিক বাহিনী
[সম্পাদনা]বাইজেন্টাইন বাহিনীর সামরিক রীতিনীতির উৎপত্তি প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্যের আমলে এবং এর সেনাবাহিনীতে সর্বদাই দক্ষ পেশাদার পদাতিক বাহিনী থাকত। তবে মধ্য বাইজেন্টাইন আমলে অশ্বারোহী বাহিনী সেনাবাহিনীর মূল শাখা হয়ে দাঁড়ায় এবং যুদ্ধক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। ফলে পদাতিক বাহিনীর ভূমিকা অনেকটাই গৌণ হয়ে যায়। তাদের অস্ত্রশস্ত্র নানান প্রকার হয়ে থাকত। একজন পদাতিক সেনার হাতে থাকত বল্লম, তলোয়ার বা কুড়াল, ছোট বাণ, সাথে বড় ডিম্বাকৃতি বা ত্রিকোণাকার ঢাল, মাথায় ধাতব শিরোস্ত্রাণ অথবা পশমের টুপি, এবং পরণে থাকত মোটা কাপড় সেলাই করা বর্ম অথবা চামড়ার বর্ম। আরো সচ্ছল সৈন্যেরা লোহার পাতযুক্ত (lamellar) অথবা লোহার শৃঙ্খলবিশিষ্ট বর্ম (chain mail), তবে সাধারণতঃ এসব দামী বর্ম অশ্বারোহী ও অফিসারগণ পরে থাকতেন। ১০ম ও ১১শ শতাব্দীর সামরিক গ্রন্থগুলো পদাতিক বাহিনীর এসব বর্ম পরিধান করার উল্লেখ করে না। বাইজেন্টাইন পদাতিক বাহিনী এর পূর্বসূরি রোমান বাহিনীর তুলনায় হালকা বর্ম পরিধান করত, এবং তাদের কার্যকারিতা তাদের দক্ষতা ও কৌশলের উপর নির্ভর করত, লোহার বর্মের উপরে নয়।[৫২]
প্রনইয়া বাহিনী
[সম্পাদনা]দ্বাদশ শতাব্দীতে প্রনইয়া বাহিনীসমূহের আবির্ভাব হয়, বিশেষ করে সম্রাট ১ম ম্যানুয়েল কোম্নেনাসের আমলে (১১৪৩-১১৮০ খ্রিষ্টাব্দ) এদের উদ্ভব হয়। এসকল সৈন্যদের মজুরি হিসেবে মুদ্রার পরিবর্তে ভূমি ইজারা দেয়া হত। তবে এরা অতীতের থীম প্রথার ন্যায় ছিল না। থীম প্রথা থেকে এদের পার্থক্য ছিল এই- এরা এদের ভূমিতে বসবাসকারি জনগণের নিকট থেকে কর আদায় করতে পারত। প্রনইয়ারগণ (যাদেরকে প্রনইয়া দেয়া হত) সম্রাটের হয়ে রাজস্ব আদায়কারীর ভূমিকা পালন করত, এ রাজস্বের কিছু অংশ তাদের নিজেদের ভোগ করার অনুমতি ছিল।
এরূপে এই সৈন্যদের ভূমিকা অনেকাংশে মধ্যযুগীয় পশ্চিম ইউরোপের "নাইট"দের ন্যায় ছিল: এরা একই সাথে যোদ্ধা ও স্থানীয় নেতা হিসেবে গণ্য হত। যদিও একথা সত্য যে, প্রনইয়ারদের ভূমির মূল মালিক সম্রাট নিজেই থাকতেন। এই প্রনইয়ারগণ সাধারণতঃ অশ্বারোহী যোদ্ধা ছিল, এদের ধাতব আংটা বিশিষ্ট বর্ম (mail armor), বল্লম, এবং বর্ম পরিহিত ঘোড়া থাকত। সম্রাট ম্যানুয়েল কোন এক সময়ে এদেরকে পশ্চিমা অশ্বারোহী যোদ্ধাদের ধাঁচে সজ্জিত করে থাকেন। ১২০৪ সালের পর এসব সৈন্যের প্রচলন বৃদ্ধি পায়, বিশেষত পশ্চিম এশিয়া মাইনরে নাইসিয়া সাম্রাজ্যের পক্ষে এদের অনেকে যুদ্ধ করে থাকে।
আক্রিটোই
[সম্পাদনা]আক্রিটেস (বহুবচন: আক্রিটোই) বাহিনী সাম্রাজ্যের আনাতোলিয়া সীমান্ত রক্ষায় নিয়োজিত ছিল। সম্ভবত আরব আগ্রাসনের পরবর্তী সময়ে অথবা আরো পরে তুর্কিদের আনাতোলিয়া আক্রমণের সময়ে এ বাহিনী সংগঠিত হয়। পূর্ব সীমান্তের স্থানীয় বাসিন্দা গ্রীকদের সমন্বয়ে এ বাহিনী গঠিত হয়। এরা কৃষক-যোদ্ধা ছিল নতুবা বর্গা জমির ভাড়া দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করত এবং সৈন্যের ভূমিকা পালনে মনোযোগ দিত- এ নিয়ে মতদ্বন্দ্ব রয়েছে। এরা সম্ভবত লঘু সৈন্য ছিল, যাদের অস্ত্র ছিল তীর-ধনুক, বর্শা ইত্যাদি।
এরা মূলতঃ প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত থাকত, আনাতোলিয়ায় তুর্কি ঘোড়সওয়ারদের আক্রমণের বিরুদ্ধে এরা প্রতিরোধ গড়ে তুলত। আবার বাইজেন্টাইন প্রধান সেনাবাহিনীর চলাচলের সময়ে এরা সুরক্ষা প্রদান করত। এদের কৌশল ছিল বিক্ষিপ্ত হামলা ও অতর্কিত আক্রমণ করা যাতে করে অপেক্ষাকৃত দ্রুতগতির তুর্কি ঘোড়সওয়ারদের মোকাবিলা করা যায়। গ্রীকদের লোকগাঁথায় ও লোকসংগীতে এই আক্রিটোই বাহিনীর বিভিন্ন কীর্তিকলাপের কাহিনী পাওয়া যায় (যা অনেকাংশেই অতিরঞ্জিত)।[৫৩]
ভিনদেশীয় ও ভাড়াটে সৈন্যদল
[সম্পাদনা]বাইজেন্টাইন সেনাবাহিনী প্রায়ই বিভিন্ন ভিনদেশীয় জাতিগোত্র থেকে ভাড়াটে সৈন্যবাহিনী (mercenary) নিয়োগ করত। এই বাহিনীগুলো সাম্রাজ্যের প্রধান সেনাবাহিনীকে সহায়তা করত ও সৈন্য যোগান দিত, কখনো কখনো মূল বাহিনীর একটি বড় অংশই থাকত এই ভাড়াটে বাহিনীগুলো। বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের সুদীর্ঘ ইতিহাসে এই বিদেশী বাহিনীগুলো সাম্রাজ্যের বিপুল ধনসম্পদ ও প্রভাব-প্রতিপত্তির পরিচায়ক। কেননা, সম্রাটের বাহিনীতে পৃথবীর দূরদূরান্ত ভূখণ্ড থেকে সৈন্যেরা যোগদান করতে আসত, এটি সাম্রাজ্যের সুনাম ও পৃথিবীব্যপী এর সম্মানের নিদর্শন।রোমান সাম্রাজ্যের আমলে এই বিদেশী সৈন্যদের বলা হত ফেডেরাটাই ( ল্যাটিনে যার অর্থ "মিত্র") এবং বাইজেন্টাইন আমলে এদের নাম দেয়া হয়েছিল ফোইডেরাটোই (গ্রীক, একই অর্থে)। এসময়ে ভিনদেশীয় সৈন্যদের (মূলতঃ ভাড়াটে সৈন্য) বলা হত হেটাইরোই (গ্রীক, অর্থ: "সহচর বাহিনী") এবং রাজকীয় রক্ষীবাহিনীতে এদের প্রায়ই নিয়োগ দেয়া হত। এদের আবার তিনভাগে বিভক্ত করা হত- প্রধান সহচর বাহিনী, মধ্যম সহচর বাহিনী এবং নিম্নতর সহচর বাহিনী। প্রত্যেক শাখার নেতৃত্ব দিতেন একজন হেটাইরেয়ার্কেস ("সহচর প্রধান")। এদেরকে আবার ধর্মীয় দিক থেকে বিভক্ত করা হত, যথাক্রমে খ্রিষ্টান প্রজা, বিদেশি খ্রিষ্টান ও অখ্রিষ্টান।
বর্বর গোত্রসমূহ
[সম্পাদনা]৫ম শতাব্দীতে যেসকল বর্বর জাতির আক্রমণে পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের পতন ঘটেছিল, তাদেরকেই ৬ষ্ঠ শতাব্দীর শুরুতে পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যে নিয়োগ দেয়া হয়। এদের অন্তর্ভুক্ত ছিল হেরুলাই জাতি, যারা তাদের নেতা ওডোয়াসের-এর নেতৃত্বে ৪৭৬ খ্রিষ্টাব্দে সর্বশেষ পশ্চিম রোমান সম্রাট রোমিউলাস অগাস্টিউলাসকে সিংহাসনচ্যুত করে। বর্বরদের মধ্যে আরো ছিল হান জাতি, যারা ৫ম শতাব্দীতে রাজা আটিলা দ্য হানের নেতৃত্বে পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্য আক্রমণ করে ও বিভক্ত করে। আরেকটি বর্বর জাতি ছিল গেপিড, যারা দানিউব নদীর উত্তরে রোমানিয়া অঞ্চলে বসতি স্থাপন করে।
এই বর্বর ভাড়াটে সেনাদের সাহায্যেই সম্রাট জাস্টিনিয়ান পশ্চিমে রোমান ভূখণ্ডসমূহ, ইতালী, উত্তর আফ্রিকা, সিসিলী এবং গল পুনরুদ্ধার করেন। আবার বাইজেন্টাইন দিগ্বিজয়ী সেনাপতি বেলিসারিয়াস তার বাহিনীতে হান তীরন্দাজ ও হেরূলিক যোদ্ধাদের নিয়োগ দেন। এদের সাহায্যে তিনি ভ্যান্ডাল জাতি থেকে উত্তর আফ্রিকা ও ব্যালেরিক দ্বীপপুঞ্জ পুনর্দখল করতে সক্ষম হন। এবং ৫৩৫-৫৩৭ খ্রিষ্টাব্দে সিসিলী ও দক্ষিণ ইতালী অভিযানে তিনি হান অশ্বারোহী ও হেরুলিক পদাতিক বাহিনীকে কাজে লাগান, এবং অস্ট্রোগথদের আক্রমণ থেকে রোম নগরী প্রতিরক্ষার কাজেও এদের মোতায়েন করেন।
৫৫২ খ্রিষ্টাব্দে আরমেনীয় সেনাপতি নার্সেস অস্ট্রোগথদেরকে পরাজিত করেন। তার বাহিনীতে বহুসংখ্যক জার্মানিক যোদ্ধা ছিল, এর মধ্যে ৩০০০ জন হেরুলি ও ৪০০ জন ছিল গেপিড জাতির। দুই বছর পরে নার্সেস ফ্র্যাঙ্ক ও জার্মানিকদের একটি যৌথবাহিনীকে পরাভূত করেন, সেসময়ে তার বাহিনীতে হেরুলি ভাড়াটে সৈন্যের একটি দল ছিল।
এছাড়াও কোম্নেনিয়ান শাসনামলে বাইজেন্টাইন সেনাবাহিনী নানান গোত্রের বিদেশী সৈন্য দেখা যেত, যাদেরকে জাতি অনুযায়ী বিভিন্ন দলে ভাগ করা হত, যেমন: ইংগেলোই ("ইংরেজ"), ফ্র্যাগকোই ("ফরাসী"), স্কাইথিকোই ("সিথিয়ান"), লাতিনিকোই ("লাতিন") প্রভৃতি। এমনকি সম্রাট থিওফিলোস এর শাসনামলে ইথিওপীয় সৈন্যেরাও সাম্রাজ্যের সেনাবাহিনীতে কাজ করেছিল। রাজধানী কনস্টান্টিনোপলের পুলিশ বাহিনীতে এসব ভাড়াটে সৈন্য নিয়োগ দেয়া হত।
ভ্যারাঞ্জিয়ান রক্ষীবাহিনী
[সম্পাদনা]বাইজেন্টিয়ামের ইতিহাসে সবচাইতে বিখ্যাত ও স্বনামধন্য রেজিমেন্টের নাম হল ভ্যারাঞ্জিয়ান রক্ষীবাহিনী। এই বাহিনীর প্রথম উৎপত্তি হয় যখন রুশ সম্রাট ভ্লাদিমির অব কিয়েভ, বাইজেন্টাইন সম্রাট ২য় বাসিলের নিকট ৬,০০০ রুশ সেনা প্রেরণ করেন। এই বাহিনী গঠিত ছিল ইউরোপের উত্তরাঞ্চলসমূহের কুড়ালধারী দুর্ধর্ষ যোদ্ধাদের সমন্বয়ে। এদের শক্তি ও আনুগত্যের (বিপুল পরিমাণ স্বর্ণের বিনিময়ে) জন্যে এরা একটি অভিজাত বাহিনীতে পরিণত হয়। পরবর্তীতে এরা সম্রাটের ব্যক্তিগত দেহরক্ষী হওয়ার মর্যাদা লাভ করে। এদের অধিনায়কের পদবী ছিল অ্যাকোলৌথোস (অর্থ: "সম্রাটের অনুরাগী"), এ থেকে এদের সম্মানের নমুনা পাওয়া যায়।
প্রথমত ভ্যারাঞ্জিয়ান রক্ষীরা সকলেই ছিল স্ক্যান্ডিনেভিয়া অঞ্চলের অধিবাসী। পরবর্তীতে রক্ষীবাহিনীতে অ্যাংলো-স্যাক্সনদেরও নিয়োগ দেয়া হয় (নর্ম্যান বিজয় অভিযানের পরে)। ১১২২ খ্রিষ্টাব্দে বেরোইয়ার যুদ্ধে ভ্যারাঞ্জিয়ান রক্ষীবাহিনী বীরত্বের সাথে লড়াই করে সম্মান অর্জন করে, এবং ১১৬৭ সালে সিরমিয়ামের যুদ্ধেও তারা উপস্থিত ছিল, যে যুদ্ধে বাইজেন্টাইন বাহিনী হাঙ্গেরীয় বাহিনীকে পরাভূত করে। ধারণা করা হয় ১২০৪ খ্রিষ্টাব্দে ৪র্থ ক্রুসেডের বাণী কর্তৃক ভ্যারাঞ্জিয়ান বাহিনীর বিলুপ্তি ঘটে।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]প্রায় সকল সমসাময়িক উৎস এ বিষয়ে একমত হয় যে, ভ্যারাঞ্জিয়ান বাহিনী বাইজেন্টিয়ামের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ ছিল এবং প্রথম ক্রুসেডের বাহিনী আক্রমণকে প্রতিরোধ করতে পেরেছিল।
বাইজেন্টাইন অস্ত্রশস্ত্র
[সম্পাদনা]এই অনুচ্ছেদটি সম্প্রসারণ করা প্রয়োজন। (June 2008) |
বাইজেন্টাইনরা সাধারণতঃ রোমান কায়দার অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার করে থাকত যেমন: ছোট তলোয়ার, বল্লম, বর্শা, ধনুক, বাণ, গুলতি ইত্যাদি। যদিও পরবর্তীতে তারা পার্শ্ববর্তী আরব ও তুর্কি সেনাদের আদলে নিজেদের অস্ত্রে পরিবর্তন আনে, তারা যৌগিক ধনুক (Composite bow) ও অশ্বারোহীদের মুগুর ব্যবহার করা শুরু করে।
অনেক প্রকারের তলোয়ার"জাইফোস" তারা ব্যবহার করে থাকত, সোজা, বাঁকানো, এক হাতে ও দুই হাতে ব্যবহারের উপযোগী ইত্যাদি প্রকারের তলোয়ারের চিত্র পাওয়া যায়। স্ট্র্যাটেজিকা গ্রন্থের বর্ণনা অনুযায়ী ৬ষ্ঠ শতাব্দীতে রোমান ছোট তলোয়ারগ্লাডিয়াস -এর পরিবর্তে লম্বা ও দুই ধার বিশিষ্ট স্পাথিওন তলোয়ার ব্যবহার করা শুরু হয়, যা পদাতিক ও অশ্বারোহী উভয় সেনারাই ব্যবহার করত। ১০ম শতাব্দীতে সাইলোগ ট্যাক্টিকোরাম গ্রন্থে এ তলোয়ারের দৈর্ঘ্যের কথা বলা হয়েছে ৯৪ সেন্টিমিটার। এবং একই দৈর্ঘ্যের বাঁকানো তরবারী প্যারামেরিওন -এর উল্লেখ করা হয়েছে, যা অশ্বারোহীরা ব্যবহার করে থাকত। এ দুই ধরনের অস্ত্রই কোমর অথবা কাঁধ থেকে বেল্টের সাহায্যে ঝোলানো থাকত।
পদাতিক ও অশ্বারোহীরা সম্মুখে আঘাত হানতে বল্লম ব্যবহার করত এবং বর্শা ব্যবহার করত নিক্ষেপের জন্যে। ৬ষ্ঠ ও ৭ম শতকে অশ্বারোহীরা বল্লম ব্যবহার করত, যার মাঝ বরাবর চামড়ার ফিতা লাগানো থাকত, এবং এর সাথে পতাকা সংযুক্ত থাকত। পদাতিকদের বল্লমের (কন্টারিয়া) দৈর্ঘ্য ছিল ৪ থেকে ৪.৫ মিটার, অশ্বারোহীদের বল্লম কিছুটা ছোট থাকত। এর ফলা ছিল লোহার তৈরি।
মেনোলিয়ন নামক একটি বল্লমের বিস্তারিত বর্ণনা দেয়া হয়েছে। এটি ছিল অত্যন্ত পুরু, তরুণ ওকগাছের কাঠ দিয়ে তৈরি, এর ডগায় দীর্ঘ ফলা (৪৫-৫০ সে.মি.) যুক্ত থাকত। এটি বহন করত শক্তিশালী পদাতিক যোদ্ধারা, যাদের অস্ত্রের নামানুসারে বলা হত মেনোলিটাই। এটি শত্রুপক্ষের ক্যাটাফ্রাক্ট অশ্বারোহীদের বিরুদ্ধে কার্যকর অস্ত্র বলে বিবেচিত হত। এটি বিশেষ উদ্দেশ্যে তৈরি অস্ত্রসমূহের একটি সুন্দর উদাহরণ। হালকা পদাতিক ও অশ্বারোহী বাহিনী ৩ মিটার পর্যন্ত দৈর্ঘ্যের বর্শা বহন করত।
সজোরে আঘাত হানার জন্যে ব্যবহৃত হত মুগুর (রাবডিয়া) এবং কুড়াল (পেলেকিয়া)। ১০ম শতাব্দীতে ক্যাটাফ্রাক্ট যোদ্ধারা সম্পূর্ণ লোহা দিয়ে তৈরি মুগুর ব্যবহার করত, যার অগ্রভাগ ছয়, চার অথবা তিনকোণা বিশিষ্ট ছিল। এর সাহায্যে তারা শত্রুপক্ষের পদাতিক বাহিনীকে আঘাত হানতে হানতে অগ্রসর হতে পারত। পদাতিক যোদ্ধরার সম্মুখ সমরে মুগুর, কুঠার প্রভৃতি ব্যবহার করত; ১০ম ও ১১শ শতাব্দীর রুশ ও ভ্যারাঞ্জিয়ান যোদ্ধারা দুই হাতে বহনযোগ্য ভারি কুঠার ব্যবহার করত। বাইজেন্টাইনদের কুঠার ছিল এক ধারবিশিষ্ট, কখনো ধারের অপর পাশে তীক্ষ্ণ ফলা থাকত।
লঘুভার যোদ্ধারা গুলতি (স্ফেন্ডোন) এবং তীর-ধনুক (টোক্সোন) ব্যবহার করত। গুলতিগুলো হাত থেকে ঝুলানো বিশেষ পটি ছিল যার সাহায্যে পাথর নিক্ষেপ করা যেত। বাইজেন্টাইনদের ধনুক রোমানদের ন্যায় ছিল, তারা যৌগিক ধনুক ব্যবহার করত। ধনুকের মাঝবরাবর ধরার জন্যে বেঁকে যায় না- এমন হাতল ছিল, এর দু'পাশে ধনুকের ছিলার দু'টি অগ্রভাগ ধনুকের বাঁকের বিপরীত দিকে বাঁকানো থাকত, এতে করে ধনুকের ছিলার টান বৃদ্ধি পেত।
পদাতিক তীরন্দাজদের ধনুক থেকে প্রায় ৩০০ ফুট দূরত্বে তীর নিক্ষেপ করা যেত; তবে অশ্বারোহীদের ধনুক তুলনামূলক ছোট (১.২ মিটার দীর্ঘ) ছিল, যাতে সহজে বহন করা যায় এবং এর ছিলা আরো শক্ত করে টানা থাকত, এগুলো থেকে প্রায় ১৩০-১৩৫ মিটার দূরত্বে তীর নিক্ষেপ করা যেত। এছাড়া সোলেনারিয়ন নামক একপ্রকার নল ছিল যার সাহায্যে একসাথে একাধিক ছোট ছোট তীর নিক্ষেপ করা যেত। এছাড়া উল্লেখ করা আছে, ১২শ শতাব্দীর পূর্বে বাইজেন্টাইনরা পশ্চিমা ক্রুসেডার বাহিনীগুলোর ন্যায় আড়ধনু (crossbow) ব্যবহার করত যার নাম ছিল ত্সাংরা।
অস্ত্রশস্ত্রের নমুনা প্রমাণাদি
[সম্পাদনা]বিভিন্ন মূর্তি, কারুকাজ, সমাধিক্ষেত্র, সমাধিস্তম্ভ, অলংকরণ এক্সোডাস-এ অঙ্কিত ছবি প্রভৃতি থেকে রোমান সেনাদের অস্ত্রশস্ত্র সম্পর্কে জানা যায়, তারা দুটি করে বল্লম বহন করত। একটি চিত্রে দেখা যায় এক সৈন্যের কাছে ৫টি ক্ষুদ্রাকৃতি বর্শা।[৫৪][৫৫] রোমান সমাধিক্ষেত্রগুলোতে বর্শা, বল্লম প্রভৃতি অস্ত্র পাওয়া যায়, যদিও অধিকাংশ ফলাগুলো এতদিনে টিকে থাকেনি।[৫৬][৫৭]
তথ্যচিত্র থেকে রোমান সেনাদের তলোয়ার সম্পর্কে জানা যায়,[৫৮][৫৯] গ্ল্যাডিয়াস তলোয়ার বিলুপ্ত হওয়ার প্রমাণ মেলে। স্পাথি তলোয়ার রোমান গ্ল্যাডিয়াস- স্থান নেয়।[৫৮][৬০][৬১][৬২] রোমান তলোয়ারগুলোর মত এগুলোও দুই ধারবিশিষ্ট ছিল।[৬৩][৬৪]
তথ্যচিত্রের মধ্যে কিছু কাঠের তক্তার সন্ধান পাওয়া যায়, এমনকি তীরের ফলা, বাহুবন্ধ ইত্যাদি পাওয়া যায় যা থেকে রোমানদের তীর-ধনুক সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যায়।[৬৫][৬৬]
ঢালসমূহের নমুনা
[সম্পাদনা]কারুকার্যখচিত রোমান ঢালের নমুনা উদ্ধার করা সম্ভব হয়, দারায় কিছু ঢাল অক্ষত অবস্থায় পাওয়া যায়, যা থেকে উপলব্ধি হয় যে অধিকাংশ রোমান সেনা ঢাল ব্যবহার করত।[৬৭][৬৮]
বর্মের নমুনা
[সম্পাদনা]যদিও অনেক চিত্রকর্ম ও কারুকাজে বর্মহীন সৈন্যদের চিত্র দেখা যায়, তবুও প্রত্নতাত্মিক গবেষণায় প্রমাণ মেলে যে রোমান বা বাইজেন্টাইন সেনারা ধাতব পাতযুক্ত বর্ম (lamellar armor), লোহার আঁকড়াবিশিষ্ট বর্ম (chain mail) ও শিরস্ত্রাণ ব্যবহার করত।[৬৯][৭০]
বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের প্রধান যুদ্ধসমূহের তালিকা
[সম্পাদনা]প্রাচীন বাইজেন্টাইন আমল
[সম্পাদনা]- ক্যালিনিকামের যুদ্ধ (খ্রি. ৫৩১)
- ট্রিকামেরামের যুদ্ধ (৫৩৩)
- ট্যাগিনির যুদ্ধ (৫৫২)
- নিনেভেহ-এর যুদ্ধ (৬২৭)
- মু'তা-এর যুদ্ধ (৬২৯)
- ফিরাজ-এর যুদ্ধ (৬৩৪)
- আজনাদাইনের যুদ্ধ (৬৩৪)
- ফাহ্ল-এর যুদ্ধ (৬৩৫)
- ইয়ারমুকের যুদ্ধ (৬৩৬)
- লৌহসেতুর যুদ্ধ (৬৩৭)
- ওঙ্গালার যুদ্ধ (৬৮০)
- কার্থেজের যুদ্ধ (৬৯৮)
- কনস্টান্টিনোপল অবরোধ (৭১৮)
মধ্য বাইজেন্টাইন আমল
[সম্পাদনা]- প্লিস্কা-এর যুদ্ধ (৮১১)
- বুলগারোফাইগনের যুদ্ধ (৮৯৬)
- আকিলুসের যুদ্ধ (৯১৭)
- আর্কাডিওপোলিসের যুদ্ধ (৯৭০)
- ক্লেইডিওনের যুদ্ধ (১০১৪)
- মালাজগির্দের যুদ্ধ (১০৭১)
- ডিরাকিয়ামের যুদ্ধ (১০৮১)
- লেভ্যুনিয়নের যুদ্ধ (১০৯১)
- নাইসিয়া অবরোধ (১০৯৭)
- বেরোইয়া যুদ্ধ (১১২২)
- হিত্তিনের যুদ্ধ (১১৫৭)
- সিরমিয়ামের যুদ্ধ (১১৬৭)
- মিরিওকেফালনের যুদ্ধ (১১৭৬)
- আর্কাডিওপোলিসের যুদ্ধ (১১৯৪)
নব্য বাইজেন্টাইন আমল
[সম্পাদনা]- আন্তিয়খিয়া-অন-দ্য-মিয়ান্ডার -এর যুদ্ধ (১২১১)
- পেলাগোনিয়ার যুদ্ধ (১২৫৯)
- পেলেকানোনের যুদ্ধ (১৩২৯)
- কনস্টান্টিনোপলের পতন (১৪৫৩)
আরও দেখুন
[সম্পাদনা]এ সম্পর্কিত অন্যান্য গ্রন্থ ও পাঠ্য
[সম্পাদনা]- Bartusis, Mark C. (১৯৯৭)। The Late Byzantine Army: Arms and Society 1204–1453। University of Pennsylvania Press। আইএসবিএন 0-8122-1620-2।
- Blondal, Sigfus (১৯৭৮)। The Varangians of Byzantium। Cambridge University Press। আইএসবিএন 0-521-21745-8।
- Dawson, Timothy (১৯৯৮)। "Kremasmata, Kabbadion, Klibanion: Some aspects of middle Byzantine military equipment reconsidered"। Byzantine and Modern Greek Studies (22): 38–50। ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১ জানুয়ারি ২০১১।
- Dawson, Timothy, ‘Klivanion revisited: an evolutionary typology and catalogue of middle Byzantine lamellar’, Journal of Roman Military Equipment Studies, 12/13 (2001/2) pp. 11–24.
- Dawson, Timothy, ‘Suntagma Hoplôn: the equipment of regular Byzantine troops, c. 950 – c. 1204’, in David Nicolle (ed), Companion to Medieval Arms and Armour, Boydell & Brewer, London, 2002, pp. 81–90.
- Dawson, Timothy (২০১০) [2003]। One Thousand Years of lamellar Construction in the Roman World। Levantia। আইএসবিএন 0-9580481-6-9।
- Dawson, Timothy (২০০৭)। Byzantine Infantryman: Eastern Roman Empire c. 900–1204। Warrior। 118। Osprey Publishing। আইএসবিএন 978-1-84603-105-2।
- Dawson, Timothy (২০০৭)। "Fit for the Task: Equipment Sizes and the Transmission of Military Lore, sixth to tenth centuries" (পিডিএফ)। Byzantine and Modern Greek Studies। 31: 1–12। ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১১ তারিখে মূল (পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা।
- Elton, Hugh, Warfare in Roman Europe
- Haldon, John, Byzantium at War
- Haldon, John, Byzantine Praetorians
- Harris, Jonathan (২০০৬)। Byzantium and The Crusades। Hambledon & London। আইএসবিএন 978-1-85285-501-7।
- Kollias, Taxiarchis G. (১৯৮৮)। Byzantinische Waffen: ein Beitrag zur byzantinischen Waffenkunde von den Anfangen bis zur lateinischen Eroberung (German ভাষায়)। Vienna: Verlag der Osterreichischen Akademie der Wissenschaften। আইএসবিএন 3-7001-1471-0।
- Kaegi, Walter Emil (১৯৮১)। Byzantine Military Unrest, 471–843: An Interpretation। Amsterdam: Adolf M. Hakkert। আইএসবিএন 90-256-0902-3।
- Lazaris, Stavros (২০১২)। Le cheval dans les sociétés antiques et médiévales. Actes des Journées internationales d'étude (Strasbourg, 6–7 novembre 2009) (French, English, and German ভাষায়)। Turnhout: Brepols। আইএসবিএন 978-2-503-54440-3।
- Lazaris, Stavros (২০১০)। Art et science vétérinaire à Byzance : Formes et fonctions de l’image hippiatrique (French ভাষায়)। Turnhout: Brepols। আইএসবিএন 978-2-503-53446-6।
- Mango, Cyril (২০০২)। The Oxford History of Byzantium। Oxford University Press। আইএসবিএন 0-19-814098-3।
- Moroz, Irina, "The Idea of Holy War in the Orthodox World", Quaestiones medii aevi novae v. 4. Archived from original, on 6 February, 2012. Retrieved on 21 November 2016.
- Nicolle, David (১৯৯৪)। Yarmuk 636: The Muslim Conquest of Syria। Campaign। 31। Osprey Publishing। আইএসবিএন 1-85532-414-8।
- Nicolle, David (২০০৫)। Constantinople 1453: The End of Byzantium। Praeger Publishers। আইএসবিএন 978-0-275-98856-2।
- Rance, Philip (২০০৪)। "The Fulcum, the Late Roman and Byzantine Testudo: the Germanization of Roman Infantry Tactics?" (পিডিএফ)। Greek, Roman and Byzantine Studies। 44.3: 265–326। ১৩ অক্টোবর ২০১২ তারিখে মূল (পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১২ জুন ২০১৫।
- Simkins, Michael, The Roman Army from Hadrian to Constantine
- Theotokis, Georgios (২০১২)। "Rus, Varangian and Frankish Mercenaries in the Service of the Byzantine Emperors (9th – 11th c.). Numbers, Organisation and Battle Tactics in the operational theatres of Asia Minor and the Balkans"। Byzantine Symmeikta। Athens: Institute for Byzantine Research (22): 125–156। আইএসএসএন 1105-1639। ২৬ জানুয়ারি ২০১৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২ জানুয়ারি ২০১৩।
- Wise, Terence, Armies of the Crusades
তথ্য নির্দেশিকা
[সম্পাদনা]তথ্যের সাধারণ উৎসসমূহ
[সম্পাদনা]- নোটিটিয়া ডিগনিটেটাম, ৫ম শতাব্দীর প্রারম্ভে রচিত একটি দলিল যাতে পূর্ব ও পশ্চিম রোমান বাহিনী সম্পর্ক বিবরণ দেয়া রয়েছে।
- স্ট্র্যাটেজিকন, সম্রাট মরিসের শাসনামলে রচিত সামরিক তথ্য সংবলিত একটি গ্রন্থ
- ডি অ্যাডমিনিস্ট্রান্ডো ইম্পেরিও, ১০ম শতাব্দীতে বাইজেন্টাইন সরকার কর্তৃক রচিত একটি গ্রন্থ, যা সম্রাট ৭ম কনস্টান্টিন পরফিরোগেনিটাসের কৃতিত্ব বলে স্বীকৃত
- রাজকীয় সামরিক অভিযানের বর্ণনা সংবলিত তিনটি গ্রন্থ, এগুলিও সম্রাট ৭ম কনস্টান্টিন পরফিরোগেনিটাসের কীর্তি বলে বিবেচিত
তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ Nicolle (1992)
- ↑ "Byzantine army : Who, What, Where, When"। ৬ জানুয়ারি ২০১১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা।
- ↑ MacDowall (1994), পৃ. 3–4
- ↑ MacDowall (1995), পৃ. 28
- ↑ MacDowall (1995), পৃ. 25–26
- ↑ MacDowall (1994), পৃ. 5
- ↑ MacDowall (1994), পৃ. 4, 56
- ↑ Bury (1958), পৃ. 76
- ↑ Bury (1958), পৃ. 76–78
- ↑ Bury (1958), পৃ. 78
- ↑ Maas (2005), পৃ. 118
- ↑ Bury (1958), পৃ. 127
- ↑ Dennis (1984), পৃ. xi
- ↑ Dennis (1984), পৃ. 12-13
- ↑ ক খ Dennis (1984), পৃ. 13
- ↑ Dennis (1984), পৃ. 13-14
- ↑ Dennis (1984), পৃ. 14
- ↑ Dennis (1984), পৃ. 138
- ↑ Dennis (1984), পৃ. 139
- ↑ ক খ Treadgold (1995), পৃ. 162
- ↑ Dennis (1984), পৃ. 140
- ↑ Treadgold (1995), পৃ. 23–24
- ↑ Treadgold (1995), পৃ. 24–25
- ↑ Kazhdan (1991), পৃ. 1964
- ↑ Treadgold (1995), পৃ. 67, 162
- ↑ Haldon (1999), পৃ. 78
- ↑ Haldon (1999), পৃ. 11
- ↑ D'Amato (2012), পৃ. 22
- ↑ Bury (1958), পৃ. 60
- ↑ ক খ Bury (1958), পৃ. 48
- ↑ Haldon (1999), পৃ. 158
- ↑ Treadgold (1995), পৃ. 67, 76
- ↑ ক খ Treadgold (1997), পৃ. 145
- ↑ ক খ Treadgold (1997), পৃ. 277
- ↑ Norwich (1996), পৃ. 259
- ↑ Treadgold (1997), পৃ. 374
- ↑ Treadgold (1997), পৃ. 412
- ↑ Treadgold (1997), পৃ. 373
- ↑ Haldon (1999), পৃ. 103
- ↑ Birkenmeier (2002), পৃ. 62
- ↑ Treadgold (1997), পৃ. 612
- ↑ Treadgold (2002), পৃ. 236
- ↑ Haldon (1999), পৃ. 104
- ↑ Ostrogorski (1969), পৃ. 483
- ↑ Treadgold (2002), পৃ. 224
- ↑ Treadgold (1997), পৃ. 819
- ↑ Heath (1995), পৃ. 37
- ↑ ক খ Whittow (1996), পৃ. 193
- ↑ Whittow (1996), পৃ. 192
- ↑ War: The Definitive Visual History। New York, NY: DK Publishing। ২০০৯। পৃষ্ঠা 63।
- ↑ Dawson (2009), পৃ. 10, 34, 38
- ↑ McGeer, Eric (১৯৯৫)। Sowing the Dragon's Teeth।
- ↑ Constantine VII, The Book of Ceremonies.
- ↑ Stephenson (2001), পৃ. 54–58
- ↑ Bishop & Coulston (2006), পৃ. 151–152, 175 & 200–202
- ↑ Stephenson (2001), পৃ. 52–60
- ↑ Bishop & Coulston (2006), পৃ. 151 & 200–202
- ↑ ক খ Stephenson (2001), পৃ. 61–63
- ↑ Bishop & Coulston (2006), পৃ. 154–163 & 202–205
- ↑ Stephenson (2001), পৃ. 76–80
- ↑ Bishop & Coulston (2006), পৃ. 154, 164 & 202
- ↑ Bishop & Coulston (2006), পৃ. 154–157 & 202–205
- ↑ Stephenson (2001), পৃ. 61–80
- ↑ Bishop & Coulston (2006), পৃ. 154–164 & 202–205
- ↑ Stephenson (2001), পৃ. 81–88
- ↑ Bishop & Coulston (2006), পৃ. 164–168 & 205–206
- ↑ Stephenson (2001), পৃ. 15–24
- ↑ Bishop & Coulston (2006), পৃ. 179–182 & 216–218
- ↑ Stephenson (2001), পৃ. 25–51
- ↑ Bishop & Coulston (2006), পৃ. 170–178 & 208–216
গ্রন্থাবলী
[সম্পাদনা]- Bartusis, Mark C. The late Byzantine army: arms and society, 1204-1453 (University of Pennsylvania Press, 1997).
- Birkenmeier, John W. (২০০২)। The Development of the Komnenian Army: 1081–1180। Brill। আইএসবিএন 90-04-11710-5।
- Bishop, M. C.; Coulston, J. C. N. (২০০৬)। Roman Military Equipment: From the Punic Wars to the Fall of Rome। Oxbow Books। আইএসবিএন 1-8421-7159-3।
- Bury, J. D. (১৯৫৮) [1926]। History of the Later Roman Empire, from the death of Theodsius I to the death of Justinian I। II। London: Dover Publications।
- Cheynet, Jean-Claude. The Byzantine aristocracy and its military function (Ashgate Pub., 2006).
- D'Amato, Raffaele (২০১২)। Byzantine Imperial Guardsmen 925–1025। আইএসবিএন 978-1-84908-850-3।
- Dawson, Timothy (২০০৯)। Byzantine Cavalryman: c. 900–1204। Warrior। 139। Osprey Publishing। আইএসবিএন 978-1-84603-404-6।
- Decker, Michael J. The Byzantine Art of War (2013); review[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ].
- Dennis, George T. (১৯৮৪)। Maurice's Strategikon, Handbook of Byzantine Military Strategy। University of Pennsylvania Press।
- Haldon, John F. Recruitment and Conscription in the Byzantine Army c. 550-950: a Study on the Origins of the Stratiotika Ktemata. (Verlag d. Österr. Akad. d. Wiss., 1979).
- Haldon, John F. (১৯৯৯)। Warfare, state and society in the Byzantine world, 565–1204। Routledge। আইএসবিএন 1-85728-494-1।
- Heath, Ian (১৯৯৫)। Byzantine Armies AD 1118–1461। Men-at-arms series। 287। Illustrated by Angus McBride। Osprey Publishing। আইএসবিএন 9781855323476।
- Kazhdan, Alexander, সম্পাদক (১৯৯১)। Oxford Dictionary of Byzantium। Oxford University Press। আইএসবিএন 978-0-19-504652-6।
- Maas, Micael (২০০৫)। The Cambridge Companion Guide to the Age of Justinian। Cambridge University Press।
- MacDowall, Simon (১৯৯৪)। Late Roman Infantryman AD 236–565। Warrior। 9। Osprey Publishing। আইএসবিএন 1-85532-419-9।
- MacDowall, Simon (১৯৯৫)। Late Roman Cavalryman AD 236–565। Warrior। 15। Osprey Publishing। আইএসবিএন 1-85532-567-5।
- McGeer, Eric, ed. Sowing the dragon's teeth: Byzantine warfare in the tenth century (Dumbarton Oaks Pub Service, 1995).
- Nicolle, David (১৯৯২)। Romano–Byzantine Armies: 4th-–9th Centuries। Men-at-Arms। 247। Osprey Publishing। আইএসবিএন 1-85532-224-2।
- Norwich, John Julius (১৯৯৬)। Byzantium: The Early Centuries। Penguin Books। আইএসবিএন 9780140114492।
- Ostrogorski, Georgije (১৯৬৯)। History of the Byzantine State। Rutgers Byzantine series। 2। Rutgers University Press। আইএসবিএন 9780813511986।
- Stephenson, I. P. (২০০১)। Roman Infantry Equipment: The Later Empire। Tempus। আইএসবিএন 0-7524-1908-0।
- Treadgold, Warren T. (১৯৯৫)। Byzantium and Its Army, 284–1081। Stanford University Press। আইএসবিএন 0-8047-3163-2।
- Treadgold, Warren T. (১৯৯৭)। A History of the Byzantine State and Society। Stanford University Press। আইএসবিএন 0-8047-2630-2।
- Treadgold, Warren (২০০২)। A Concise History of Byzantium। Palgrave Macmillan। আইএসবিএন 0-333-71830-5।
- Whittow, Mark (১৯৯৬)। The Making of Orthodox Byzantium, 600–1025। University of California Press। আইএসবিএন 9780520204973।
সম্পর্কিত লিঙ্কসমূহ
[সম্পাদনা]- De re militari.org – The Society for Medieval Military History
- Byzantine army page on servinghistory.com