সুনীল জানা
সুনীল জানা | |
---|---|
জন্ম | সুনীল জানা ১৭ এপ্রিল ১৯১৮ |
মৃত্যু | ২১ জুন ২০১২ বার্কলে, ক্যালিফোর্নিয়া,যুক্তরাষ্ট্র | (বয়স ৯৪)
জাতীয়তা | ভারতীয় |
পরিচিতির কারণ | ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে পঞ্চাশের মন্বন্তর |
দাম্পত্য সঙ্গী | শোভা জানা (মৃ.২০১২) |
সন্তান | অর্জুন জানা (পুত্র) মনুয়া জানা (কন্যা) (মৃ.২০০৪) |
পুরস্কার | পদ্মভূষণ(২০১২) |
ওয়েবসাইট | http://www.suniljanah.org/sjanah/ |
সুনীল জানা (১৭ এপ্রিল ১৯১৮ ― ২১ জুন ২০১২)[১][২] ছিলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ভারতীয় বাঙালি ফটো সাংবাদিক এবং তথ্যচিত্রকর তথা ডকুমেন্টারি ফটোগ্রাফার। ১৯৪০ এর দশকে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন, কৃষক ও শ্রমিক আন্দোলন, দুর্ভিক্ষ ও দাঙ্গা, গ্রামীণ ও উপজাতীয় জীবন, সেইসাথে দ্রুত নগরায়ন এবং শিল্পায়নের বছরগুলির স্মরণীয় ও আলোড়নকারী ঘটনার তার তোলা ছবি এখনও দলিল হিসাবে গণ্য করা হয়। কমিউনিস্ট আদর্শে অবিচল সুনীল জানা চিত্র সাংবাদিকরূপে ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে বাংলার মর্মান্তিক দুর্ভিক্ষের (যা পঞ্চাশের মন্বন্তর নামে খ্যাত) যেসব ছবি তিনি ক্যামেরাবন্দি করেন তা এককথায় অবিস্মরণীয় এবং সেজন্যই তিনি সর্বাধিক পরিচিতি লাভ করেন।[২]
২০১২ খ্রিস্টাব্দে ভারত সরকারের তৃতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার পদ্মভূষণ সম্মানে বিভূষিত হন। [১]
জন্ম ও প্রারম্ভিক জীবন
[সম্পাদনা]সুনীল জানা ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দের ১৭ এপ্রিল ব্রিটিশ ভারতের আসামের ডিব্রুগড়ে জন্মগ্রহণ করেন।[৩] কিন্তু তার বড়ো হয়ে ওঠা অর্থাৎ লেখাপড়া ইত্যাদি সবই কলকাতায়। কলকাতায় রাসবিহারী অ্যাভিনিউ এবং শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি রোডের সংযোগস্থলে তাদের পৈতৃক বাড়িটি ছিল প্রাসাদোপম অট্টালিকা। তবে কালীঘাট মেট্রো স্টেশন নির্মাণের কারণে সে প্রাসাদের অস্তিত্ব আজ বিলুপ্ত। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে পড়তেন ইংরাজি সাহিত্য নিয়ে। রাজনৈতিকভাবে বামপন্থী মতাদর্শে অনুপ্রাণিত ছাত্রটির লেখাপড়ার থেকে ফটোগ্রাফিচর্চাতেই প্রবল আগ্রহ ও কৌতূহল ছিল।
১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক পূরণচাঁদ জোশী সুনীলের শখের ফটোগ্রাফিচর্চার মধ্যে এক প্রতিভাসম্পন্ন ফটোগ্রাফারের সম্ভাবনা লক্ষ্য করেন এবং তাকে ইংরেজি পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে ফটোগ্রাফিতে মনোনিবেশ করতে পরামর্শ দেন। [১]
কর্মজীবন
[সম্পাদনা]তারই অনুপ্রেরণায় সুনীল চিত্রসাংবাদিকতাকে পেশারূপে গ্রহণ করে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র পিপলস্ ওয়ার বা জনযুদ্ধ-তে যোগ দেন। ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে সুনীল চিত্তপ্রসাদ ভট্টাচার্যের সঙ্গে বাংলার দুর্ভিক্ষের ফলে সৃষ্ট ক্ষতির ছবি তুলতে বাংলায় ভ্রমণে বেড়িয়ে পড়েন। মর্মান্তিক দুর্ভিক্ষের (পঞ্চাশের মন্বন্তরের) কারণে কলকাতার ফুটপাথে, রাস্তায় রাস্তায় উপোসী, বুভুক্ষ, নিরন্ন মানুষের নানা মর্মস্পর্শী ছবি তুলে বিশ্ববাসীর কাছে ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসকের প্রকৃত চরিত্র তুলে ধরেছিলেন তা এককথায় অবিস্মরণীয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কালে জাপান বিরোধী যুদ্ধে বর্মা (অধুনা মায়ানমার) সীমান্তে সেনা ও অস্ত্রশস্ত্র পাঠাতে ব্রিটিশ শাসক বাংলাকে গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ঘাঁটি হিসাবে ব্যবহার করত আর তাদের দ্বারা কৃত্রিমভাবে সৃষ্ট দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ে অসংখ্য মানুষ দলে দলে প্রাণ হারান। নির্বিকার ঔপনিবেশিক শাসকের তাতে ভ্রুক্ষেপই ছিল না। সুনীলের ক্যামেরাবন্দি ছবিগুলো ছিল সেদিনের জ্বলন্ত প্রমাণ। ছবিগুলি কমিউনিস্ট পার্টির পত্রিকা পিপলস্ ওয়ার-এ ছাপা হয়ছিল। [৪]এরপরই শুরু সুনীল জানার চিত্রসাংবাদিকতার পরবর্তী পর্যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটিশ রাজের শেষ পর্বে অভূতপূর্ব উপনিবেশ-বিরোধী গণ-উত্থান গুলোকে তিনি লেন্সে ধরে রাখেন। বিশ্বযুদ্ধোত্তর পরিস্থিতি চিত্রের ভাষায় রূপ দিতে ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে যুক্তরাষ্ট্রের লাইফ পত্রিকার ফটোগ্রাফার মার্গারেট বার্ক হোয়াইট ভারতে আসেন। তার সঙ্গে পরিচয় হয় সুনীলের। তিনি অল্পদিনেই সুনীলের প্রতিভার আঁচ পেয়ে যান। সেই আলোড়নকারী সময়ে ভারতের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক ঘটনা এবং তার ফলস্বরূপ এদেশে যা ঘটেছিল— তারা যৌথভাবে ক্যামেরাবন্দি করে রাখেন। সেসব ছবি ভারতীয় ইতিহাসের আর্কাইভে রাখা গুরুত্বপূর্ণ দলিল বা নথি হিসাবে বিবেচিত। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে দেশভাগের পর ছিন্নমূল হয়ে কাতারে কাতারে মানুষ দিশা হীন ভাবে আশ্রয়ের খোঁজে, নিরাপত্তার আশায় ছুটে বেড়াচ্ছিল, তিনি সেসব মর্মস্পর্শী ছবিগুলো ধরে রাখেন। সেই সঙ্গে তৎকালীন ভারতের রাজনৈতিক অবয়ব গঠনের রূপরেখা অঙ্কনে বিভিন্ন সময়ে স্থান দিয়েছেন মহাত্মা গান্ধী, নেহেরু, জিন্নাহ, শেখ আবদুল্লাহ এবং ইন্দিরা গান্ধীসহ প্রধান প্রধান রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের ছবিসমূহ। ফয়েজ, জে কৃষ্ণমূর্তি, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, সমর সেন, যামিনী রায়, ঋত্বিক ঘটক, সত্যজিৎ রায় প্রমুখ শিল্প ও সংস্কৃতি জগতের মানুষেরা এসেছেন সুনীল জানার ক্যামেরার সামনে। চিত্রসাংবাদিক পেশায় ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক স্তরে উন্নীত হয়ে যান।
সুনীল জানা ছিলেন বহুমুখী ব্যক্তিত্বের অধিকারী এবং তার আগ্রহের পরিসরও ছিল বহুধাবিস্তৃত। চিত্তপ্রসাদ ভট্টাচার্যের সঙ্গে বোম্বাইতে গিয়ে প্রগতিশীল লেখক সমিতি এবং ইন্ডিয়ান পিপলস থিয়েটার অ্যাসোসিয়েশনে যোগ দিয়েছিলেন। বামপন্থী রাজনীতি থেকে নৃতত্ত্ব, প্রাচীন ভারতের মিথুন-ভাস্কর্য থেকে আধুনিক ভারতীয় নৃত্যশিল্পী— সর্বত্রই তিনি ছিলেন সমান কৌতূহলী, সমান স্বচ্ছন্দ।
সুনীল জানা একদিকে যেমন রাজনৈতিক ইতিহাসকে কালানুক্রমিক বৃত্তান্তে আলোকচিত্রে ধরে রেখেছেন, অন্যদিকে মধ্য ভরতের গভীর অরণ্যের মনোমুগ্ধকর জগৎকে তুলে ধরেছেন অনবদ্য চিত্রাবলীর মাধ্যমে। আদিবাসীদের জগতে তিনি সময় কাটিয়েছেন বিখ্যাত ইংরেজ নৃতত্ত্ববিদ ভেরিয়ার এলউইনের সঙ্গে। এলউইন ভারতের নাগরিকত্ব নিয়ে বাস্তারের আদিবাসীদের সঙ্গে বসবাস করেছেন। সুনীল জানা তার সঙ্গে যৌথপ্রয়াসে তুলে রেখেছেন আদিবাসীগোষ্ঠীর সুন্দর সুন্দর ছেলেমেয়েদের ছবি। তার চিত্রকর্ম নিয়ে প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলি হল-
- জানা, সুনীল (১৯৪৯)। দ্য সেকেন্ড ক্রিয়েচার্স, সিক্সটি ফোর ফটোগ্রাফস্। সিগনেট প্রেস।
- জানা, সুনীল (১৯৮৭)। ইন্ডিয়া অ্যান্ড ইনডিপেনডেন্স।
- জানা, সুনীল (২০০৩)। দ্য ট্রাইবাল অফ ইন্ডিয়া। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস। পৃষ্ঠা ১৯৬। আইএসবিএন 9780195661279।
- জানা, সুনীল (২০১৩)। ফোটোগ্রাফিং ইন্ডিয়া। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস। পৃষ্ঠা ২৮০। আইএসবিএন 9780198065807।
সম্মাননা
[সম্পাদনা]সুনীল জানা কলকাতা ফিল্ম সোসাইটির সহ-প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন।[২] তিনি ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে ভারত সরকারের চতুর্থ সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মানপদ্মশ্রী এবং ২০১২ খ্রিস্টাব্দে তৃতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান পদ্মভূষণে ভূষিত হন। [৫]
তিনি 1943 সালের বাংলার দুর্ভিক্ষের কভারেজের জন্য সর্বাধিক পরিচিত ছিলেন। [২][৬]
নেহরুভিয়ান যুগের ফটোগ্রাফার
[সম্পাদনা]কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র 'পিপলস্ ওয়ার' এবং তার পরে 'পিপলস্ এজ'-এ সুনীল জানার ফটো ফিচারের জন্য একটি পৃষ্ঠা থাকতো। সেখানে তিনি সাধারণ মানুষের জীবন, তাদের সংগ্রাম, কর্মক্ষেত্রে শ্রমিক শ্রেণির অবস্থা, নৌকা চালানোয়, মাছ ধরায়, শ্রমিকের কয়লা খনিতে কাজের ছবি প্রকাশিত হত। ঘরে ও মাঠে কাজ করা পুরুষ ও মহিলা থেকে শুরু করে ধনুক ও তীর বহনকারী উপজাতীয় জনগণ, কৃষক ও শ্রমিকরা বিক্ষোভে যাচ্ছেন, তেলেঙ্গানার বিপ্লবীর ছবি প্রদর্শিত হত। আসলে তিনি ছবিগুলির মাধ্যমে কমিউনিস্ট পার্টির আদর্শ ও প্রতিশ্রুতি মানুষের মধ্যে আনায় সচেষ্ট ছিলেন। [৭] আলোকচিত্রকর এবং ১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দের নিউ ইয়র্ক গ্যালারি ৬৭৮ এর কিউরেটর রাম রহমান সুনীল জানার কাজের প্রশংসা করে বলেছেন, সুনীল জানার চিত্র-সাংবাদিকতা ভারতে স্বাধীনতা সংগ্রামের শেষ দশকের প্রামাণ্য এক মহাকাব্যিক দলিল এবং স্বাধীন ভারতের প্রথম দশকের - নেহরুর যুগের চিত্র কাহিনীকার। [৮]
জীবনাবসান
[সম্পাদনা]আন্তর্জাতিক খ্যাতির চিত্র-সাংবাদিক সুনীল জানা শেষ জীবন অতিবাহিত করেন তার ক্যালিফোর্নিয়ার বাড়িতে। তার স্ত্রী শোভা জানা ২০১২ খ্রিস্টাব্দের ১৮ মে মারা যান। ওই বছরের ২১ জুন ৯৪ বৎসর বয়সে সুনীল পরলোক গমন করেন। তাদের কন্যা মনুয়ারও অকাল মৃত্যু হয় ২০০৪ খ্রিস্টাব্দে।[৯] তার একমাত্র পুত্র অর্জুন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের ব্রুকলিনে থাকেন। [২]
প্রকাশনা
[সম্পাদনা]- গুহ, রামচন্দ্র। শ্যাডোইং এ ফিলান্থোফিস্ট। ইউনিভার্সিটি অফ শিকাগো প্রেস। পৃষ্ঠা ৩৯৮। আইএসবিএন 978-0-226-31047-3।
তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ ক খ গ অঞ্জলি বসু সম্পাদিত, সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান, দ্বিতীয় খণ্ড, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, জানুয়ারি ২০১৯ পৃষ্ঠা ৪৪৫, আইএসবিএন ৯৭৮-৮১-৭৯৫৫-২৯২-৬
- ↑ ক খ গ ঘ ঙ 24 June 2012 IANS। "Bengal famine lensman dies at 96"। Deccan Chronicle। ২০১৬-০২-০৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১২-০৬-২৫।
- ↑ Pandya, Haresh (৯ জুলাই ২০১২)। "Sunil Janah, Who Chronicled India in Photographs, Dies at 94"। The New York Times।
- ↑ "Sunil Janah, Who Chronicled India in Photographs, Dies at 94"। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-১১-২৫।
- ↑ "Padma Awards"। pib। ২৭ জানুয়ারি ২০১৩। সংগ্রহের তারিখ ২৭ জানুয়ারি ২০১৩।
- ↑ Ramachandran, V. K. (সেপ্টেম্বর ১৯৯৮)। http://www.frontlineonnet.com/fl1519/15190690.htm। সংগ্রহের তারিখ ১০ জুন ২০১২।
|শিরোনাম=
অনুপস্থিত বা খালি (সাহায্য) - ↑ "The One Who Did Politics with His Camera: Sunil Janah"।
- ↑ Rahman, Ram (২২ জুন ২০১২)। "Portraitist of the Nehruvian era"। The Hindu।
- ↑ "The One Who Did Politics With His Camera: Sunil Janah"। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-১১-২৫। line feed character in
|শিরোনাম=
at position 43 (সাহায্য)