পিয়ারু সর্দার

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

পিয়ারু সর্দার(১৮৯৩-১৯৬১) ঢাকার পঞ্চায়েত প্রধানদের একজন সর্দার ছিলেন। হোসনি দালান এলাকার সর্দার ছিলেন। ১৯৫২ সালে 'তার সাহসী ভূমিকার কারণেই পূর্ব বাংলায় প্রথম শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা সম্ভব হয়েছিল।[১][২]

ঢাকার সর্দার ও প্রভাব[সম্পাদনা]

পিয়ারু সর্দার ছিলেন হোসনি দালান, বকশিবাজার, নাজিমউদ্দিন রোড, উর্দু রোড, নূরকাতা লেন, আজিমপুর, পলাশীসহ বিভিন্ন মহল্লার সর্দার।[১] তিনি ছিলেন শিক্ষানুরাগী ও দানশীল মানুষ। এ দেশের প্রথম ছাত্র সংগঠন ছাত্র ফেডারেশনের অফিস ছিল তার এলাকায়ই। মাতৃভাষা আন্দোলনের প্রথম সূচনা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ভাষা আন্দোলন করতে গিয়ে ছাত্ররা পুলিশের সঙ্গে প্রায়ই সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়তেন। পুলিশের তাড়া খেয়ে ছাত্ররা পিয়ারু সর্দারের মহল্লায় এসে আশ্রয় নিত। তখন ঢাকা শহরে এত দালানকোঠা ছিল না। প্রায় ফাঁকা ছিল বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা। বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘর্ষ হলে ছাত্ররা রেললাইন পার হয়ে হোসনি দালানে এসে নিরাপদ বোধ করত। সে সময় পিয়ারু সর্দার তার মহল্লায় তল্লাশি থেকে পুলিশকে নিবৃত রাখতেন, সাহসিকতার সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতেন।[১]

১৯৫২ সালে ভূমিকা[সম্পাদনা]

১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের শুরু থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। সেদিন একুশে ফেব্রুয়ারিতে আমতলায় ঐতিহাসিক ছাত্র সমাবেশে ১৪৪ ধারা ভেঙে মিছিল করে। এ মিছিলে পুলিশ গুলি চালিয়ে ছাত্রদের হত্যা করে। সেদিন ছাত্র-জনতার এমন করুণ মৃত্যু পিয়ারু সর্দারকে নাড়া দিয়েছিল। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্ররা এই শহীদদের স্মৃতিকে চির অম্লান করে রাখার উদ্দেশে হত্যাকাণ্ডের স্থানে একটি শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়। এ সময় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের সম্প্রসারণের কাজ চলছিল। কলেজের ভেতরই ইট, বালি, রড স্তূপাকারে ছিল।[১] সিমেন্ট ছিল তালাবদ্ধ একটি গুদামে। ওই গুদামের চাবি ছিল পিয়ারু সর্দারের কাছে। সর্দারগিরির পাশাপাশি তিনি ঠিকাদারির কাজ করতেন। ছাত্ররা হোসনি দালানে অবস্থিত পিয়ারু সর্দারের বাড়িতে এসে তাকে তাদের অভিপ্রায়ের কথা জানায় এবং তাকে ইট, বালি ও সিমেন্ট দিয়ে সহযোগিতা করার জন্য অনুরোধ করে। সর্দার সাহেব কালবিলম্ব না করে বাড়ির ভেতর থেকে চাবি এনে মেডিকেল ছাত্র আলী আছগরের হাতে দিয়ে বলেন, 'যতটুকু প্রয়োজন হয় সিমেন্ট ব্যবহার করো। সিমেন্ট নেওয়া হলে চাবি ফেরত দিয়ে যেও।' তিনি সেদিন ছাত্রদের সঙ্গে শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের জন্য একজন ওস্তাগারও পাঠিয়ে দেন।[১] ২৩ ফেব্রুয়ারির এক রাতের শ্রমে গড়ে তোলা হয় ভাষা শহীদদের স্মরণে দেশের প্রথম শহীদ মিনার। পরবর্তীকালে এই স্থান থেকে গড়ে ওঠে আজকের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার

ঢাকার সর্দার[সম্পাদনা]

পিয়ারু সর্দার ব্রিটিশ আমলের শেষ দিকে ঠিকাদারী ব্যবসা শুরু করেন। পাকিস্তান আমলে তিনি ছিলে প্রথম শ্রেণীর ঠিকাদার। ঢাকার ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউশন মিলনায়তন এবং রমনা পার্ক ছাড়াও রানি এলিজাবেথের জন্য পার্কের বিরাট মঞ্চ তৈরি করেন তিনি, যা বর্তমানে শতায়ু মঞ্চ নামে পরিচিত। মন্ত্রিপাড়ার বেশকিছু ভবনের নির্মাণের সঙ্গেও তিনি জড়িত। কারো কারো মতে, ঢাকা স্টেডিয়াম নির্মাণ করেন যেসব ঠিকাদার, তাদের মধ্যে তিনিও ছিলেন। নারায়ণগঞ্জের আদমজী জুটমিল, মোহাম্মাদপুরের রিফিউজি কলোনি এবং আসাদগেটের নির্মাণকাজের ঠিকাদারও পিয়ারু সরদার। ১৯৫২ সালে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের নার্সিং হোস্টেল পিয়ারু সরদারের হাতে নির্মিত হয়। বলা হয়ে থাকে, রানী এলিজাবেথের আগমন উপলক্ষে ঢাকাকে তিলোত্তমা করে সাজাতে তেজগাঁও বিমান বন্দর থেকে লাট ভবন (বঙ্গভবন) পর্যন্ত দ্রুততম সময়ে নতুন রাস্তা নির্মাণেও পিয়ারু সরদারের ভূমিকা ছিল। পিয়ারু সরদার একবার ঢাকা পৌর করপোরেশন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে বিপুল ভোটের ব্যবধানে জয়লাভ করে কমিশনার নির্বাচিত হন। বর্তমানে পিয়ারু সর্দার অ্যান্ড কোং ঢাকার ঈদগাহের নামাজের প্যান্ডেল নির্মাণ করে।

সম্মাননা[সম্পাদনা]

ভাষা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য ২০১৫ সালে তাকে একুশে পদক (মরণোত্তর) প্রদান করা হয়।[৩]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. ভাষা আন্দোলন ও পিয়ারু সরদার[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
  2. "ভোরের কাগজ, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯"। ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২০ 
  3. প্রথম আলো, ৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৫