ওজাপালি
ওজাপালি (ইংরেজি: Ojapali)অসমের অর্ধ নাটকীয় পরিবেশ্য কলা। সর্বভারতীয় কথকতার প্রতক্ষ ধারক ও বাহক ওজাপালি প্রাচিন কাল থেকেই অসমে জনপ্রিয় কলা রুপে পরিগণিত হয়ে আসছে। ১৯৭৪ সনে অসম সরকার জনসংযোগ বিভাগের সঞ্চালক লুইতকোয়র রুদ্র বরুয়া ও আনন্দমোহন ভাগবতীর সহযোগিতায় ওজাপালি রাষ্টীয় কার্যসূচির অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
উদ্ভাবন ও বিকাশ
[সম্পাদনা]ওড্র মাগধী শৈলীর সাথে সাদৃশ থাকা ওজাপালি অনুষ্ঠান ভারতীয় মার্গী সংগীত থেকে জন্ম হয়েছে। এই ওজাপালি কলাএ উদ্ভাবন ও বিকাশের সন্দর্ভে বিভিন্ন জনশ্রুতি জড়িত হয়ে আছে। দৈবিক মতবাদ অনুযায়ী এই কলা অর্জুন স্বর্গ থেকে মর্তে এনেছিলেন। পারিজাত নামক একজন মহিলা স্বপ্নের দ্বারা এই কলা আয়ত্ত করে শিষ্যদের শিখান বলে বিয়াহের ওলাপালীরা বিশ্বাস করেন। বিয়াকলা ও কেন্দুকলা অসমের ওজাপালির জনক হিসেবে জনশ্রুতিতে প্রচলিত। খ্রীষ্টীয় ত্রয়োদশ শতিকার বিশিষ্ট পণ্ডিত বেদাচার্যের স্মৃতি রত্নাকর, অসমের তাম্র শাসন, গুরু চরিত কথা এবং বৈষ্ণব যুগের বিভিন্ন সাহিত্যতে ওজাপালি কলার উল্লেখ করা হয়েছে। ফলে ওজাপালি প্রাচিনতম কলা বলে জানা যায়।
পোশাক পরিচ্ছেদ
[সম্পাদনা]পোশাক পরিচ্ছেদ ওজাপালির একটি লক্ষনীয় দিক। সুকনানী ওজাপালি পরিবেশনকারী সাদা ধুতি ও সাদা রঙের চাদর পরিধান করেন ও কপালে চন্দনের ফোটা লাগায়। ওজাপালি পরিবেশনকারীর পাগরি ডিম্বাকৃতি হয় ও সন্মুখদিকটি বলের ন্যায় গোল। কিন্তু রামায়ণ গাওয়া ওজার পোশাক একটু ভিন্ন ধরনের হয়। রামায়ণ ও সভা পরিবেশনকারী ওজারা সুকনানী ওজার মত পোশাক পরিধান করে যদিও তাঁরা কপালে লাল-হলুদ রঙের গামছা বাধে। এই ধরনের ওজারা পাঁয়ে নুপুর, হাতে রুপার গামখারু ও কপালে চন্দনের ফোটা লাগায়। অন্যদিকে দুই ধরনের ওজার পাগরি একই ধরনের হয়। পাগরিটির সন্মুখভাগ ময়ূর পাখির ন্যায়। কাপোড়ে দশটি ভাজ দিয়ে ময়ুরপঙ্খী পাগরি বানানো হয়। প্রাচিনকালে সুকনানী ওজারা মহিলার ন্যায় দীর্ঘ কেশ রাখতেন ও খোপা বাধতেন কিন্তু বর্তমান দিনে তা লোপ পেয়েছে।
দেওধনী নৃত্য
[সম্পাদনা]সুকনানী ওজাপালির একটি আংগিক উপাদান হচ্ছে দেওধনী নৃত্য। রামায়ণ গাওয়া ওজাপালিতে দেওধনী নৃত্য থাকেনা কিন্তু দেওধনী নৃত্য সুকনানী ওজাপালির প্রধান অঙ্গ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বর্তমান দিনে এই নৃত্য প্রায় লোপ পেয়েছে। দেওধানী নৃত্যে কিছু অলৌকিক শক্তি প্রদর্শন করে দর্শকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়। শাস্ত্রমতে বেহুলা লক্ষীন্দরকে পুনঃজীবন দেওয়ার জন্য যে নৃত্য করেছিলেন সেইটিই দেওধানী নৃত্য। [১] দেওধনী নৃত্যে মহিলারা লাল পোশাক পরিধান করে চুল খোলা অবস্থায় নৃত্য করেন। এই নৃত্যটিকে মৃত সঞ্জীবনী নৃত্য বলে ধরা হয়। দেওধনী নৃত্য অসমের প্রচলিত অন্য কোন ধরনের নৃত্যের সাথে সাদৃশ্য দেখা যায়না। সংরক্ষনশীল সমাজব্যবস্থার জন্য পুর্বকালে অসমে দেওধানী নৃত্য করা মেয়ের অভাব ছিল। মৃত লক্ষীন্দরের প্রান ফিরিয়ে আনার জন্য বেহুলা এই নৃত্য করেছিলেন বলে দেওধানী নৃত্য করা মেয়েদের সতী বা বিবাহিত মহিলা হিসেবে বিবেচিত করা হত। ফলে দেওধনী নৃত্য করা মেয়েদের বিবাহের অনুপযুক্ত গণ্য করা হত। কিন্তু বর্তমান দিনে এই চিন্তাধারার যথেষ্ট পরিবর্তন হয়েছে যদিও প্রচলিত আধুনিক সমাজে দেওধনী নৃত্য করা মেয়েদের সংখ্যা এখনও নগন্য।
বর্তমানের ওজাপালি
[সম্পাদনা]ওজাপালি নৃত্য বর্তমানদিনে ধর্মীয় অনুষ্ঠান রুপে গন্য করা হয় কিন্তু প্রাচীনকালে ইহাকে অসমীয়া জাতির প্রধান কলা হিসেবে গন্য করা হত। এই নৃত্যকলা জীবিত রাখার জন্য অসমীয়া জাতি সহ বিভিন্ন জনগোষ্ঠী ও ধর্মীয় লোকের অবদান যথেষ্ট আছে। উদাহরনস্বরুপে পরশু শেখ ওজার নাম বলা যেতে পারে। তিনি ইসলাম ধর্মাবল্মীর লোক ছিলেন কিন্তু তিনি ওজাপালি ও দেওধানী নৃত্যের বিকাশের ক্ষেত্রে যথেষ্ট অবদান রেখেছেন। তাঁর নাট্যদলে বিখ্যাত কয়েকজন ওজার নাম হল: ফুটামরা শেখ, পনৌ সানা, পুরান ও দুরান। এই নাট্যদলটিতে হাফেজা বেগম নামক একজন মহিলাও ছিলেন। ইতিহাস বিশ্লেষণ করে জানা যায় যে বিশ্বসিংহের বংশধর কোচ রাজারা দরঙী কলা-কৃষ্টির বিকাশ তথা প্রচারের ক্ষেত্রে যথেষ্ট অবদান রেখেছেন। দরঙী রাজারা সাক্তধর্মী ছিলেন। তাঁরা মারৈ পূজা করিতেন( অসমের কিছু স্থানভেদে মারে পূজা নামেও প্রচলিত) এই পূজার পরিবেশ্য কলা হিসেবে ওজাপালি ও দেওধনী নৃত্যের পোষকতা করিতেন। এই অনুষ্ঠানে প্রয়োজনীয় বাদ্যযন্ত্র যেমন: খুটিতাল, বরতাল, ঢোল, জয়ঢোল ইত্যাদি রাজা বিতরন করিতেন। রাজার বংশের অন্যান্য সদস্যেরা গায়নের ক্ষেত্রে প্রয়োজন হওয়া পুস্তক ওজাদের বিতরন করিতেন। জনশ্রুতি মতে কোচরাজা ধর্মনারায়নের পৃষ্ঠপোষকোতায় সুকবি নারায়নদেবে ১০৫০০টি পদে শুকনানী বা পদ্মপুরান রচনা করেছিলেন। কিছুসংখ্যক ব্যক্তির মতে সুকবি নারায়নদেব রচনা করার জন্য ইহার নাম শুকনানী হয়েছে। কিন্তু মনসা পূজা বা মারৈ পূজার সহিত এই অনুষ্ঠানটি কীভাবে জড়িত হয়েছে তা এখন পর্যন্ত জানা যায় নাই। ওজাপালির পরম্পরাগত গীত-পদ সমূহকে শ্রেনীবন্ধ করে সুকবি নারায়নদেবে মনষা দেবীকে কেন্দ্র করে পদ্মপুরান ও মনষা নামক অন্য আরেকটি কাব্যগ্রন্থ রচনা করেন।