দেবনারায়ণ গুপ্ত

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
দেবনারায়ণ গুপ্ত
জন্ম(১৯১০-১২-০৭)৭ ডিসেম্বর ১৯১০
রানাঘাট নদীয়া ব্রিটিশ ভারত (বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ ভারত)
মৃত্যু১১ মে ২০০০(2000-05-11) (বয়স ৮৯)
পেশানাট্যকার, নাট্যনির্দেশক
পিতা-মাতাসুরেন্দ্রনাথ গুপ্ত (পিতা)
সুনীতি দেবী (মাতা)
পুরস্কারদীনবন্ধু পুরস্কার (১৯৯০)

দেবনারায়ণ গুপ্ত (৭ ডিসেম্বর, ১৯১০ - ১১ মে ২০০০) ছিলেন বাংলা চলচ্চিত্র ও নাট্যজগতের বিশিষ্ট নাট্যকার, নাট্যপরিচালক, নির্দেশক, নাট্যগবেষক। [১] তিনি পেশাদারি বাংলা রঙ্গমঞ্চের অতীত এবং তার সময়কালের সেতুবন্ধনকারী সংগঠক ছিলেন।[২] তিনি ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দ হতে পশ্চিমবঙ্গ নাট্য আকাদেমির আমৃত্যু সভাপতি ছিলেন। প্রায় ছ-দশক ধরে বাংলা রঙ্গমঞ্চের সমৃদ্ধির জন্য কাজ করে গেছেন তিনি। ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দে তিনি দীনবন্ধু পুরস্কারে সম্বর্ধিত হন।

জন্ম ও প্রারম্ভিক জীবন[সম্পাদনা]

দেবনারায়ণ গুপ্তর জন্ম ব্রিটিশ ভারতের (অধুনা পশ্চিমবঙ্গের) নদীয়া জেলার রানাঘাটে। পিতা সুরেন্দ্রনাথ গুপ্ত ছিলেন রানাঘাটের প্রখ্যাত চিকিৎসক এবং মাতা সুনীতি দেবী ছিলেন ভট্টিকাব্যের টীকাকার মহামহোপাধ্যায় ভরত মল্লিকের বংশধরের এক কন্যা। রানাঘাটে পড়াশোনার সময়ই তার কাব্য ও নাট্যচর্চার শুরু। সতের বৎসর বয়সেই তার লেখা নাটক দানের মর্যাদা বিদ্যালয়ে অভিনীত হয়ছিল। বিদ্যালয়ের পাঠ শেষে পড়াশোনা করেন মূলাজোড়ের সংস্কৃত কলেজে। [২]

কর্মজীবন[সম্পাদনা]

একুশ বৎসর বয়সে দেবপ্রসাদ সাংবাদিক হিসাবে কর্মজীবন শুরুকরেন। প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও নাট্যকার মন্মথ রায়ের সহকারী হিসাবে প্রথমে ভাণ্ডার পত্রিকায় কাজ করেন এবং তারপর কাজী নজরুল ইসলামের নবযুগ পত্রিকায় যোগ দেন। ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি ভারতবর্ষ পত্রিকায় চাকরি নেন। পত্রিকার প্রকাশনা সংস্থার মালিক হরিদাস চট্টোপাধ্যায়ের পরামর্শে ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে ভারতবর্ষ'-র চাকরি ছেড়ে দিয়ে দেবনারায়ণ থিয়েটার জগতে চলে আসেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বাংলার সাধারণ রঙ্গালয়গুলি বন্ধ হওয়ার উপক্রম, সেই সময়ে তিনি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কয়েকটি উপন্যাসের নাট্যরূপ দেন।[১] রামের সুমতি-র নাট্যরূপে মঞ্চস্থ করেন রূপমহলে। তারই নাট্যরূপ দেওয়া বিন্দুর ছেলে শ্রীরঙ্গমে মঞ্চস্থ হয় শিশিরকুমারের নির্দেশনায়। শরৎচন্দ্রের বেশ কয়েকটি উপন্যাসের নাট্যরূপ সেসময়ে বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। "রঙমহল সংবাদ নামে চার পাতার এক পত্রিকা বিনা পয়সায় কিছুদিন হাওড়া ও শিয়ালদহ স্টেশনে তিনি নিজে বিলি করেন। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ হতে চার বৎসর মিনার্ভা'তে কাজ করার পর আবার রঙমহলে ফিরে আসেন। মিনার্ভা'তেও তার নাট্যরূপ দেওয়া শরৎচন্দ্রের কাশীনাথ প্রবোধকুমারের প্রিয় বান্ধবী (শ্রীমতী নামে) অহীন্দ্র চৌধুরীর নির্দশনায় মঞ্চস্থ হয়েছিল। রঙমহলের পর ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দ হতে দীর্ঘ একুশ বৎসর দেবনারায়ণ স্টার থিয়েটারে কাজ করেন। তিনি শরৎচন্দ্র ছাড়াও উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের রাজপথ, নিরুপমা দেবীর শ্যামলী মনোজ বসুর বৃষ্টি বৃষ্টি (নাট্যরূপ- ডাক বাংলো) প্রভৃতি উপন্যাসের নাট্যরূপ দিয়েছেন।[১] স্বাধীনতা পর বাংলার রঙ্গমঞ্চ উজ্জীবিত হয়েছিল তার নাট্যরূপ দেওয়া সব নাটকে এবং ব্যবসায়িক সাফল্যও এসেছিল। তিনিই চলচ্চিত্রে নিয়ে আসেন বাংলা চলচ্চিত্রের মহানায়ক উত্তমকুমারকে এবং সঙ্গে সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়কে। তার মঞ্চ সফল অন্যান্য নাটকগুলি হল-

  • পরিনীতা
  • শ্রীকান্ত রাজলক্ষ্মী
  • ডাক বাংলো
  • শ্রেয়সী
  • শেষাগ্নি
  • একক দশক শতক
  • পরমারাধ্য শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ
  • দাবী
  • শর্মিলা
  • সীমা ইত্যাদি।

শেষোক্ত চারটি ছাড়াও তার মৌলিক নাটক গুলি হল-

  • ঋণশোধ
  • রামপ্রসাদ
  • দাবী
  • বিদ্রোহী নায়ক

রঙ্গমঞ্চের পাশাপাশি দেবনারায়ণ চলচ্চিত্রেও অংশগ্রহণ করেন। ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে প্রথম যুক্ত হন ডি জি নামে পরিচিত ধীরেন গাঙ্গুলীর সঙ্গে। তিনি বন্দিতা ছবির সংলাপ এবং কিছু দৃশ্য তিনি নির্মাণ করেন। শরৎচন্দ্রের আলো ও ছায়া নিয়ে তৈরি করেন শেষ নিবেদন । ডি জি পিকচার্সের হয়ে তিনি 'ঝরাফুল', হৃদয়পুর' কার্টুন লেখেন। এরপর দেবনারায়ণ 'কোয়লিটি ফিল্ম ডিস্ট্রিবিউটর' হয়ে যে ১৪টি চলচ্চিত্র পরিচালনা করেন, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল -

  • রামপ্রসাদ (১৯৪৭)
  • বিচারক (১৯৪৮)
  • দাসীপুত্র (১৯৪৯)
  • স্বপ্ন ও সমাধি (১৯৫২)
  • রামী চণ্ডীদাস (১৯৫৩)
  • ভক্ত রঘুনাথ
  • মা শীতলা

তার তৈরি চিত্রনাট্যের সংখ্যা প্রায় চল্লিশ। তবে ষাটের দশকের পর চলচ্চিত্রের কাজ ছেড়ে দিয়ে তিনি রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে নাটক বিভাগে অধ্যাপনায় যুক্ত হন। ১৯৭৭ খ্রিস্টাব্দ হতে প্রায় ১৪ বৎসরে অধ্যাপনা করেন।[২] মন্মথ রায়ের মৃত্যুর পর দেবনারায়ণ পশ্চিমবঙ্গ নাট্য আকাদেমির দ্বিতীয় সভাপতি হন ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দে এবং আমৃত্যু ওই পদে ছিলেন। নাটক ছাড়াও তিনি নাট্যপ্রসঙ্গে নানা মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেন। উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলি হল-[৩]

  • একশ বছরের নাটক
  • নটনটীর বিচিত্র কাহিনী
  • নটী বিনোদিনী - মঞ্চে ও সংসারে
  • উইংসের আড়ালে
  • বাংলার নটনটী

পুরস্কার ও সম্মাননা[সম্পাদনা]

দেবনারায়ণ গুপ্ত নাট্য রচনা, পরিচালনার জন্য নানা পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পেয়েছেন সুধাংশুবালা পুরস্কার'। বাংলা মঞ্চ শতবর্ষ স্টার থিয়েটার অ্যাওয়ার্ড পান। ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দে লাভ করেন পশ্চিমবঙ্গ নাট্য আকাদেমির দীনবন্ধু পুরস্কার[২]

জীবনাবসান[সম্পাদনা]

দেবনারায়ণ গুপ্ত ২০০০ খ্রিস্টাব্দের ১১ মে ৮৯ বৎসর বয়সে কলকাতায় পরলোক গমন করেন।

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. শিশির কুমার দাশ (২০১৯)। সংসদ বাংলা সাহিত্যসঙ্গী। সাহিত্য সংসদ, কলকাতা। পৃষ্ঠা ১০১। আইএসবিএন 978-81-7955-007-9 
  2. অঞ্জলি বসু সম্পাদিত, সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান, দ্বিতীয় খণ্ড, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, জানুয়ারি ২০১৯ পৃষ্ঠা ১৬৯, আইএসবিএন ৯৭৮-৮১-৭৯৫৫-২৯২-৬
  3. "দেবনারায়ণ গুপ্ত- Archives"। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-০৩-১০