আব্দুল কাদের আল-জাজায়িরি

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
আধুনিক আলজেরিয়ার পিতা

আমির আব্দুল কাদির বিন মুহিউদ্দীন

ফরাসি উপনিবেশ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে আলজেরীয় প্রতীক
স্থানীয় নাম
الأمير عبد القادر بن محي الدين
জন্ম১২২৩ হি./ ৬ সেপ্টেম্বর, ১৮০৮
মাস্কারা, আলজেরিয়া
মৃত্যু১৩০০হি. / ২৬ মে, ১৮৮৩
দামেস্ক, সিরিয়া
পদমর্যাদাআমির
যুদ্ধ/সংগ্রামআল-মাকতা যুদ্ধ, বাউদুউয়ের যুদ্ধ, উম্মালের যুদ্ধ, মিতিদজার যুদ্ধ, ওয়াদি আল-আলাইকের যুদ্ধ, বনি মুরাদের যুদ্ধ, জামালার যুদ্ধ, তাদমাইতের যুদ্ধ, দালসের যুদ্ধ, তিজিওযু যুদ্ধ, আইথ ইরাথেন অভিযান, বানি জাদের যুদ্ধ, ইউসারের যুদ্ধ, মাজগারানের যুদ্ধ, সিদি ব্রাহাম, ওউয়েদের যুদ্ধ ইত্যাদি
সন্তানআমির খালিদ
অন্য কাজসুফিবাদ, দর্শন, ধর্মীয় লেখালেখি

আমির আব্দুল কাদির বিন মুহিউদ্দীন যিনি আব্দুল কাদির আল–জাজায়িরি নামে অধিক পরিচিত–[১] ছিলেন একজন রাজনৈতিক ও সামরিক প্রধান, যিনি আলজেরিয়ায় ফরাসি দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে জিহাদ-লড়াই করার একজন মুজাহিদ হিসেবে পরিচিত। তিনি দীর্ঘ পনের বছর ধরে এই জনপ্রিয় প্রতিরোধের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। পশ্চিম আলজেরিয়ার মাসকারা শহরের কাছে কায়েত্না গ্রামে তিনি ১৮০৮ সালের ৬ সেপ্টেম্বর মোতাবেক ১২২৩ হিজরির ১৫ রজব রোজ মঙ্গলবার জন্মগ্রহণ করেন, যখন ফ্রান্স আলজেরিয়ায় প্রাথমিক আক্রমণ শুরু করেছিল। তাকে আধুনিক আলজেরীয় রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং তিনি ফরাসি উপনিবেশ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে আলজেরীয় প্রতিরোধের প্রতীক।

ফ্রান্স সরকার কর্তৃক তিনি দামেস্কে নির্বাসিত হন এবং সেখানে তিনি নিজেকে সুফিবাদ, দর্শন [২] লেখালেখি ও কবিতায় নিবেদিত করেন।[৩] সেখানেই তিনি ২৬ শে মে , ১৮৮৩ সালে মৃত্যুবরণ করেন।

প্রাথমিক জীবন[সম্পাদনা]

জন্ম ও বংশ[সম্পাদনা]

তিনি মুহিউদ্দীনের তৃতীয় পুত্র ছিলেন: যিনি কাদিরিয়া সুফি তরিকার একজন শায়খ ও লেখক ছিলেন। তাঁর মা জাহরা ছিলেন শেখ সিদি বোদুমাহেরর কন্যা এবং তিনি একজন শিক্ষিত ও জ্ঞানী মহিলা ছিলেন। তিনি ১৮০৮ সালের ৬ মে জন্মগ্রহণ করেন; অন্য বর্ণনা মতে ১৮০৮ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর।[৪] জানা যায় যে, আব্দুল কাদির তার ছাত্র আয়েশকে নিজের বংশসূত্র সম্পর্কে বলেছিলেন:

আমি আব্দুল কাদির বিন মুহিউদ্দীন বিন মুস্তাফা বিন মুহাম্মাদ বিন মুখতার বিন আব্দুল কাদি বিন আহমেদ বিন মুহাম্মদ বিন আব্দুল কাউ বিন আলী বিন আহমদ বিন আব্দুল কাবি বিন খালিদ বিন ইউসুফ বিন বাশার বিন মুহাম্মদ বিন মাসউদ বিন তাউস বিন ইয়াকুব বিন আব্দুল কাবি বিন আহমেদ বিন মুহাম্মদ ইবনে ইদ্রিস বিন আব্দুল্লাহ আল-কামেল ইবনে আল-হাসান আল-মুসান্না ইবনে হাসান, যিনি হাসানের পুত্রদের একজন, যিনি নবী মুহাম্মদ সা. এর নাতি এবং আলী ও ফাতিমা আল-জাহরার পুত্র। আমি আব্দুল কাদির নবী সা. এর বংশধর। আমার উভয় পক্ষের পূর্বপুরুষরা অভিজাত ছিলেন, যারা মদিনায় বসবাস করতেন। তাই আমার পূর্বপুরুষরা প্রত্যক্ষভাবে নবীর অনুসারী ছিলেন। [৫] [৬] [৭] [৮] [৯]

পরিবেশ ও পরিবার[সম্পাদনা]

তার পিতা মুহিউদিন মাসকার শহর থেকে প্রায় ২০ কি. মি. পশ্চিমে ওয়াদি হাম্মামের বাম তীরে একটি গ্রামে বাস করেতেন। পরিবারটি তাদের মালিকানাধীন কৃষি জমি এবং অনুসারী ও সমর্থকদের দেওয়া তোহফায় জীবিকা নির্বাহ করতেন। তারা গ্রিস সমভূমিতে উল ও গমের চাষাবাদ করতেন।

তিনি হাসান রা. এর বংশধর ও কুরাইশী ছিলেন এবং আধ্যাত্মিক কর্তৃত্ব এবং ব্যাপক প্রভাবসম্পন্ন একটি উপজাতির বংশধর ছিলেন। পরিবারটি পথচারীদের আতিথেয়তা প্রদান করতেন এবং অভাবীদের সাহায্য করতেন। এটি উদারতার জন্য বিখ্যাত ছিল এবং এই অঞ্চলের বাসিন্দারা বিরোধ নিষ্পত্তি ও সালিশের জন্য সেই পরিবারের বড়দের কাছে যেতেন। তাদের বৈচিত্র্য মতে, পরিবারের প্রধান মুহিউদ্দিন চারটি বিয়ে করেন: ওয়ারিদা, যিনি মুহাম্মদ আল-সাঈদ ও মুস্তাফা; আল-জাহরা, যিনি আব্দুল কাদির এবং খাদিজা; ফাতিমা, যিনি হুসাইন এবং খাইরা, যিনি আল-মুরতাদাকে জন্ম দিয়েছেন।[৭]

শৈশব ও শিক্ষা[সম্পাদনা]

তার ধর্মীয় শিক্ষা ছিল সুন্নি ও সুফিধারায় সমন্বিত। [৭] তিনি পাঁচ বছর বয়সে পড়ালেখায় পারদর্শী হয়ে যান। তিনি বারো বছর বয়সে কোরআননবীর হাদিসের ব্যাখ্যা করার অনুমতি পেয়েছিলেন। ২ বছর পর তিনি এ শিক্ষা গ্রহণ করে হাফিজ উপাধি লাভ করেন এবং তার পরিবারের মসজিদেই বিভিন্ন আইনশাস্ত্রের পাঠ দিতে থাকেন।[৭]

তার বাবা তাকে অশ্বারোহণসহ প্রতিদ্বন্দ্বীদের বিরুদ্ধে লড়াই এবং সেই সময় অনুষ্ঠিত বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে উৎসাহিত করেছিলেন এবং তিনি এসবে আশ্চর্যজনক শ্রেষ্ঠত্ব দেখিয়েছিলেন।

তার পিতা তাকে ওরানে পাঠান সেখানকার পণ্ডিতদের কাছ থেকে জ্ঞান অর্জনের জন্য। তিনি শেখ আহমেদ বিন আল-খোজার পাঠে অংশ নেন এবং আইনশাস্ত্রে তার গভীরতা থেকে উপকৃত হন। তিনি দার্শনিকদের বইও পড়েন এবং শেখ আহমদের হাতে পাটিগণিতভূগোল শিখেন। তার এই লেখাপড়ার যাত্রা প্রায় দুই বছর স্থায়ী হয়েছিল ( ১২৩৭–১২৩৯ হিজরি/ ১৮২১ -১৮২৩ খ্রিস্টাব্দ)।

কাইতনা শহরে ফিরে আসার পর তখন তার বয়স ১৫ বছর হয়, তখন তার বাবা তাকে বিয়ে করার উদ্যোগ নেন এবং তার চাচাতো বোন লালা খাইরাকে তার স্ত্রী হিসাবে বেছে নেন; কারণ তিনি চরিত্র ও সম্মানজনক বংশের গুণাবলীকে একত্রিত করেছিলেন।[৫]

হজ্জ যাত্রা[সম্পাদনা]

মুহিউদ্দিন (আব্দুল কাদেরের পিতা) জনগণের মাঝে কখনো অবহেলিত ছিলেন না; বরং তিনি ছিলেন এমন একজন, যারা অন্যায়ের বিরুদ্ধে কখনো নীরব থাকেন নি। তাই ওরান শহরের উসমানীয় গভর্নরের সাথে তার সংঘর্ষ হওয়া স্বাভাবিক ছিল এবং হয়েছিলও। আমির আব্দুল কাদের বাবার বাসস্থান তার বাড়িতে সীমাবদ্ধ হয়ে যায়। তাই তিনি আলজেরিয়া ছেড়ে দীর্ঘ ভ্রমণে কোথাও চলে যাওয়ার ইচ্ছা করেন।

মুহিউদিন কাদিরিয়া তরিকার শেখ হওয়ার পাশাপাশি সাধারণ মানুষের মধ্যে, বিশেষ করে প্রবীণ ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে উচ্চ মর্যাদার অধিকারী ছিলেন এবং বিভিন্ন বিষয়ে তার দেওয়া মতামত ওরানের উসমানীয় গভর্নরকে তার বাড়িতেই তার চলাচল সীমিত করতে প্ররোচিত করেছিল। তাই তিনি হজ করতে বের হয়ার কথা ভাবেন এবং এই সীমাবদ্ধ পরিবেশ থেকে বাহির হয়ে দূরে চলে যাওয়ার ইচ্ছা করেন।[৭]

মহিউদ্দীনকে ১২৪১ হি./১৮২৫ খ্রিস্টাব্দে হজের জন্য বাইরে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়; তাই তিনি বেরিয়ে যান। সাথে ছেলে আব্দুল কাদিরকে নিয়ে যান, যখন তাঁর বয়স মাত্র আঠারো বছর ছিল। আব্দুল কাদিরের হজ যাত্রা ছিল তিউনিসিয়া থেকে মিশর হয়ে লেভান্ট; তারপরে বাগদাদ হয়ে হিজাজ। ফেরার পথে মিশরে হয়ে ত্রিপোলি, তারপরে তিউনিসিয়ায় এবং অবশেষে ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দে আবার আলজেরিয়ায় পৌঁছেন। এটি ছিল একটি শিক্ষা সফর, যা তৎকালীন আরব বিশ্ব ও সেখানকার স্থানীয় জনগণ সম্পর্কে অনেক জানার সুযোগ করে দেয়। ফিরে এসে পিতা ও ছেলে তাদের গ্রামে কায়েতনায় বসতি স্থাপন করেন। আলজেরিয়া তখন একটি ভয়ানক ফরাসি সামরিক অভিযানের শিকার হওয়ার খুব কাছাকাছি ছিল। অবশেষে ১৮৩০ সালের ৫ জুলাই ফরাসিবাহিনী রাজধানী আলজিয়ার্স দখল করে এবং উসমানীয় শাসক হুসেন আত্মসমর্পণ করেন। কিন্তু আলজেরীয় জনগণ তা মেনে নেয়নি।[৭]

যুবক বয়সে আমির আব্দুল কাদের আরেকটি জ্ঞানের শাখার সাথে পরিচিত হন। তিনি দর্শন (ইখওয়ান আস সফা, এরিস্টটলপিথাগোরাসের বইপত্র ) অধ্যয়ন করেন। সেই সঙ্গে তিনি ফিকহহাদিসের কিতাবাদি অধ্যয়ন করেন। তিনি সহীহ বুখারিসহিহ মুসলিম অধ্যয়ন করেন এবং দীর্ঘদিন সেগুলি অধ্যয়ন করেন। এছাড়াও ব্যাকরণে তিনি আলফিয়াহ, আকিদায় আস সুনুসিয়াহ ও আকায়েদে নাসাফী, মানতেকে ইসাগুজি ও কোরানে আল ইতকান গ্রন্থ অধ্যয়ন করেন। এভাবে আমির আব্দুর রহমানের শরঈ ও যৌক্তিক জ্ঞান, ভ্রমণ এবং বিচক্ষণতা সম্পন্ন হয়েছিল। [৭]

জিহাদের বাইয়াত গ্রহণ[সম্পাদনা]

চলমান ফরাসি আধিপত্য বিরোধী লড়াইয়ে নেতাদের মধ্যে মতবিরোধ জনগণকেও বিভক্ত করে ফেলে এবং গারিসের জনগণ ও আলিমগণ এমন একজন নেতার সন্ধান করছিল, যার নেতৃত্বে জিহাদ করার জন্য তার প্রতি আনুগত্যের অঙ্গীকার করবে। তারা বিষয়টি তার কাছে উপস্থাপন করে; তিনি আমির হওয়ার জন্য ক্ষমা চান; তবে জিহাদের নেতৃত্ব গ্রহণ করে তিনি তাদেরকে মাগরেবের শাসক আব্দুর রহমান বিন হিশামের কাছে পাঠান, যেন তারা তাঁর নেতৃত্বে থেকেই জিহাদ করতে পারে। সুলতান প্রস্তাব গ্রহণ করেন এবং তার চাচাতো ভাই আলী বিন সুলেমানকে সে অঞ্চলের আমির করে পাঠান; তবে পরিস্থিতি স্থিতিশীল হওয়ার আগেই ফ্রান্স হস্তক্ষেপ করে সুলতানকে যুদ্ধের হুমকি দেয়। সুলতান তা প্রত্যাহার করে তার চাচাতো ভাইকে তলব করেন। ফলে আলী বিন সুলেমানের নেতত্বে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে লড়াই করা সম্ভব হয়নি।[৭]

প্রথম বাইয়াত[সম্পাদনা]

মুহম্মদ বিন জাউমের (তৎকালীন ফ্রান্সবিরোধী সুফী জিহাদি নেতা ) মিতিদজার শহরতলিতে আলী ওলদ সি সা'দির প্রতি আনুগত্যের প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পরে ফ্রান্স বিরোধী প্রতিরোধ পশ্চিম আলজেরিয়ায় চলে যায়, যেখানে মুহিউদ্দিন জাজাঈরি সামরিক নেতৃত্বের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। ফলে জনতা আবারো তার চারপাশে জড়ো হয়; বিশেষ করে তিনি বেশ কয়েকটি বিজয় অর্জন করার পর। তাঁর ছেলে আব্দুল কাদের জাজাঈরি এই সব জয়ে সেনাবাহিনীর প্রধান ছিলেন। তাই মুহিউদ্দীন তার পুত্র আব্দুল কাদিরকে এই পদের প্রস্তাব করেন এবং (নবীজির অনুকরণে) এলম গাছের নীচে তার প্রতি বাইয়াত করার জন্য স্থানীয় লোকদের একত্রিত করেন। সেখানে উপস্থিত আলেম প্রবীণ এবং উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিরা সকলে বায়াত গ্রহণ করেন এবং আব্দুল কাদের এটি বহন করতে সম্মত হন। তার পিতা তার নাম রাখেন নাসের আদ-দীন ( দীন বা ইসলামের সাহায্যকারী) এবং তারা তাকে তাদের সুলতান হওয়ার পরামর্শ দেন; কিন্তু তিনি নিজের জন্যে আমির উপাধি বেছে নেন। এটি ১২৪৮ হিজরির ৩রা রজব মোতাবেক ১৮৩২ সালের ২৭ নভেম্বর ঘটেছিল, যখন তার বয়স ছিল চব্বিশ বছর।[৬]

আনুগত্যের অঙ্গীকারের পর তিনি একটি শিবিরে যান এবং বিশাল জনতার সামনে তার মসজিদেই বক্তৃতা দেন। তিনি জনগণকে শৃঙ্খলাবদ্ধ এবং প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান এবং তাদের জিহাদ ও কাজ করার আহ্বান জানান। তিনি বাকি উপজাতি ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের কাছে বার্তাবাহক ও চিঠি পাঠান, যারা তার আনুগত্যের অঙ্গীকারে উপস্থিত ছিলেন না এবং তার প্রতি আনুগত্যের প্রতিশ্রুতি দেওয়ার আহ্বান জানান। [৬]

দ্বিতীয় বাইয়াত[সম্পাদনা]

প্রথম বায়াতের খবর ছড়িয়ে পড়লে, বাইয়াত না-করা গোত্রের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ এবং প্রধানরা আনুগত্যের প্রতিশ্রুতি দিতে ছুটে আসেন এবং তা বর্তমানে সিদি আল-হাসান মসজিদ নামে পরিচিত একটি শিবিরের মসজিদে সংঘটিত হয়, যেখানে বাইয়াতের আরেকটি দলিল তৈরি করা হয়েছিল এবং জনগণের কাছে পাঠ করা হয়েছিল এবং এটি লিখেছেন মাহমুদ বিন হাওয়া আল–মুজাহিদি, যিনি এই অঞ্চলের অন্যতম আলেম ছিলেন। তিনি সবার উদ্দেশে তার প্রথম ভাষণে বলেন, " ...আমি আমার ও তাদের আনুগত্য ( ওরান ও এতে বাসকারী মানুষ) ঘোষণা করছি এবং আমি এর প্রতি ঝুঁকে না থাকা সত্ত্বেও এই অবস্থানটিও গ্রহণ করেছি এ আশায় যে, এটি মুসলিমদের একত্রিত করার একটি মাধ্যম হবে। তাদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব এবং কলহ দূর করা, সঠিক পথ সুগম করা, শরিয়তের পরিপন্থী কর্মকান্ড প্রতিরোধ করা, শত্রুর হাত থেকে এ দেশকে রক্ষা করা এবং সবল ও দুর্বলের প্রতি সত্য এবং ন্যায়ের প্রয়োগ করার একটি মাধ্যম হবে। জেনে রাখা আমার চূড়ান্ত লক্ষ্য হল ঐক্য।[৪]

রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা[সম্পাদনা]

জাতীয় এক্য গঠন[সম্পাদনা]

আব্দুল কাদির যখন আমিরাতের দায়িত্ব গ্রহণ করেন, তখন অর্থনৈতিক এবং সামাজিক অবস্থা কঠিন ছিল। রাষ্ট্রের ভিত্তিস্থাপনের জন্য তাঁর কাছে পর্যাপ্ত অর্থ ছিল না। এর ওপর আমিরাতে শক্তিশালী ফ্রান্স প্রতিপক্ষের উপস্থিতি ছিল। তবে তিনি আশা হারাননি; কারণ তিনি ক্রমাগত ঐক্য, অভ্যন্তরীণ বিরোধ ত্যাগ ও ব্যক্তিগত লক্ষ্য পরিত্যাগ করার আহ্বান জানান এবং তিনি তার অবস্থানকে একটি বড় দায়িত্ব হিসাবে বিবেচনা করেন; কেবল সম্মান নয়। মাসকারার মসজিদে এক বক্তৃতায় তিনি প্রচার করেছিলেন যে, আমি যদি আমিরাত গ্রহণ করতাম, তবে আমার অধিকার থাকত ভ্যানগার্ডে মার্চ করার এবং আল্লাহর জন্য যুদ্ধে আপনাদের সাথে মার্চ করার। কিন্তু কেবল আমিরাত আমার লক্ষ্য নয়। আমি অন্য যে কোনো নেতাকে মানতে প্রস্তুত, যাকে আপনি আমার চেয়ে বেশি যোগ্য মনে করেন এবং আপনাকে নেতৃত্ব দিতে সক্ষম। তবে তিনি দ্বীনের সেবা ও নিজের মাতৃভূমিকে স্বাধীন করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হবেন।[৪]

জাতির ঐক্যকে তিনি তার রাষ্ট্রের নবজাগরণের ভিত্তি হিসাবে তৈরি করেছিলেন এবং ঔপনিবেশিকতার বাধা ও কিছু স্থানীয় উপজাতীয় নেতাদের কাছ থেকে তিনি বহু অসুবিধার সম্মুখীন হওয়া সত্ত্বেও তিনি এই ঐক্য অর্জনের জন্য প্রচেষ্টা করেছিলেন, যাদের রাজনৈতিক সচেতনতা সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা পর্যন্তও ছিল না। ঐক্য অর্জনে তার পদ্ধতি ছিল প্রথমে তাকে আকিদাজিহাদের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে অবগত করা এবং তা তাকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া। সচেতনতা বাড়ানোর জন্য আমির দুর্দান্ত প্রচেষ্টা করেন; কারণ অধিকাংশ উপজাতি একটি জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। স্বাধীনতা এবং একটি শক্তিশালী কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের কাছে নতি স্বীকার করতে তারা অভ্যস্ত ছিল না। তার দৃঢ় বিশ্বাসের ফলে অনেক উপজাতিই তাকে বশীভূত করার জন্য একটি গুলি ছাড়াই তার সাথে যোগ দেয়। বরং তার বাগ্মীতা ও যুক্তি সবার পক্ষেই ঐক্য অর্জন এবং শত্রুর সাথে লড়াইয়ের লক্ষ্যগুলি বোঝার জন্য যথেষ্ট ছিল। কিন্তু যখনই স্মরণ করিয়ে দেওয়া এবং বোঝানোর পদ্ধতি কাজ করেনি, তিনি তার তরবারি টেনেছিলেন তাদের বিরুদ্ধে, যারা মুসলিম দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় বা মুসলিমদের বিচ্ছিন্ন করার কাজে শত্রুকে সাহায্য করে। আমির তাকে ইসলাম ও জাতির শত্রুদের বিরুদ্ধে জিহাদ করতে সাহায্য করার জন্যে স্থানীয় আলিমদের কাছ থেকে একটি ফতোয়া জারি করিয়ে নেন।[৬]

কঠোর নীতি অবলম্বন[সম্পাদনা]

আমির অনেক সামাজিক সংস্কার করেছিলেন। তিনি নৈতিক দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর লড়াই করেন। মদজুয়াকে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করেন। সমাজকে সকল অযৌক্তিকতা থেকে দূরে রাখার জন্য ধূমপান নিষিদ্ধ করেন। তিনি পুরুষদের জন্যে স্বর্ণরৌপ্যের ব্যবহার নিষিদ্ধ করেন। কারণ তা হাদিসে নিষিদ্ধ এবং তিনি বিলাসবহুল জীবনকে ঘৃণা করতেন।[৪]

সেনাভবন নির্মাণ[সম্পাদনা]

তিনি দুটি লক্ষ্যে ছিলেন: একটি সংগঠিত সেনাবাহিনী গঠন এবং একটি ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা এবং এই মিশনে তার সহকারীরা তার অনুগত ছিল। আমির ও তার সহযোগীরা নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার জন্য একটি দুর্দান্ত প্রচেষ্টা করেন। তিনি যে পুলিশ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেন এবং তার জন্যে সকল জনগণ তার প্রতি কৃতজ্ঞ হয়ে যায়। কারণ, এতে যে দস্যুরা ভ্রমণকারীদের আক্রমণ করতো এবং দেশের শৃঙ্খলা লঙ্ঘন করেছিল তাদের নির্মূল করা হয়েছিল। এর ফলে জনগণ নিরাপদে ঘুরে বেড়াত এবং চুরি পরিপূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়।[৫]

রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের সংগঠন[সম্পাদনা]

আমির জাতীয় ভূখণ্ডকে মোট ৮টি ইউনিট বা প্রদেশে বিভক্ত করেন: মিলিয়ানা, মুয়াস্কার, তিলেমসান, আল আগওয়াত, মাদিয়া, বুর্জ বো আর্রেরিজ, বুর্জে হামজা (বুইরা) বাসকরা ও সাতিফ।

আমির আব্দুল কাদের কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রের পতাকা

তিনি অস্ত্র কারখানাও স্থাপন করেন এবং দুর্গ নির্মাণ করেন। আমির তার মন্ত্রণালয় গঠন করেন, যা পাঁচটি মন্ত্রণালয় নিয়ে গঠিত এবং মাস্কারা শহরকে নিজের সদর দফতরে পরিণত করেন এবং তিনি তার প্রতিটি মন্ত্রণালয়ে নিয়োগ দেওয়ার ক্ষেত্রে নৈতিক গুণাবলী ছাড়াও বৈজ্ঞানিক দক্ষতা এবং রাজনৈতিক দক্ষতার দ্বারা বিশিষ্ট সেরা ব্যক্তিদের বেছে নেন। তিনি রাষ্ট্রীয় বাজেট সংগঠিত করেন এবং জিহাদের যাবতীয় খরচ মেটানোর জন্য জাকাত গ্রহণ নীতি চালু করেন। তিনি জাতীয় পতাকার প্রতীক এবং একটি রাষ্ট্রীয় স্লোগানও বেছে নেন: নাসরুম মিনাল্লাহি ওয়া ফাতহুন করিব ( আরবি: نصر من الله و فتح قريب: আল্লাহর কাছ থেকে বিজয় শীঘ্রই আসবো)।[৬]

আহমেদ বিন সালেম আমীর আব্দুল কাদিরের এ ৮টি প্রদেশের মধ্যে "আল-জাবাল প্রদেশে" তার প্রতিনিধি ছিলেন।[৫]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. الأمير عبد القادر وبوادر الدولة الجزائرية المعاصرة على موقع الرئاسي الجزائري ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২০১৭-০৬-১১ তারিখে
  2. "الأمير عبد القادر محطّات متميزة في رؤية الآخر"। Insaniyat / إنسانيات. Revue algérienne d'anthropologie et de sciences sociales। ২০১৭-১২-৩১। আইএসএসএন 1111-2050ডিওআই:10.4000/insaniyat.18050 
  3. الأمير عبد القادر...الفارس الشاعر والمتصوف ورجل الحرب والسلم ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২০২০-১১-১৯ তারিখে
  4. حياة األمير عبد القادر (عربي ভাষায়)। دار الرائد - الجزائر। ২০০৯। 
  5. الأمير عبد القادر حياته وأدبه، رابح بونار، مجلة آمال، عدد خاص عن الأمير عبد القادر، جويلية، الجزائر، 1970.
  6. تحفة الزائر في مآثر الأمير عبد القادر وأخبار الجزائر، محمد بن الأمير عبد القادر، تحقيق وتعليق:ممدوح حقي، بيروت، 1964.
  7. حياة الأمير عبد القادر، شارل هنري تشرشل، ترجمه وقدم له وعلق عليه:د.أبو القاسم سعد الله، الشركة الوطنية للنشر والتوزيع، ط.2، الجزائر، 1982.
  8. ذكرى العاقل وتنبيه الغافل، الأمير عبد القادر، تحقيق: محمود حقي، دار اليقظة العربية، بيروت، 1966.
  9. Etienne, Bruno ; Abdelkader : Isthme des isthmes ( Barzakh al-barazikh).