বিষয়বস্তুতে চলুন

সুভাষচন্দ্র বসুর মৃত্যু

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
টোকিওস্থিত রেনকোজি মন্দির চত্বরে সুভাষ চন্দ্র বসুর একটা স্মারক। সুভাষ চন্দ্রের চিতাভষ্ম মন্দিরের একটা প্যাগোডায় রক্ষিত আছে। তাঁর মৃত্যু হয়েছিল ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ১৮ আগস্ট। তাঁর চিতাভস্ম ১৯৪৫, সেপ্টেম্বরের গোড়ায় জাপানে আসে; কিছু স্মরণীয় ক্রিয়াকর্মের পর, ওগুলো ১৮ সেপ্টেম্বর, ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে মন্দির কর্তৃপক্ষ গ্রহণ করে।

ভারতীয় জাতীয়তাবাদী নেতা সুভাষচন্দ্র বসুর ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ১৮ অগস্ট জাপানি-অধিকৃত ফরমোজা দ্বীপে (বর্তমান তাইওয়ান) তাঁর অধিক যাত্রীবাহিত বিমান দুর্ঘটনায় মারাত্মকভাবে পুড়ে গিয়ে দেহাবসান হয়।কিন্তু কোনো বইতে তার মৃত্যু তারিখ নেই [][][][] সে যা-ই হোক, তাঁর অনেক অনুগামীই, বিশেষত বাংলায়, সেই সময় ঘটনাটা অস্বীকার করে, এবং এমনকি এখনো তাঁর মৃত্যু সম্পর্কিত পরিস্থিতি এবং তথ্য বিশ্বাস করতে অস্বীকার করে।[][][][][][] তাঁর মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব উদ্ভূত হয় এবং তারপর একটা দীর্ঘ ব্যক্তিগত জীবন থাকবার ছিল,[][] সুভাষচন্দ্র সম্পর্কে বিভিন্ন সামরিক কাহিনি জিইয়ে রাখা হয়েছে।[][]

মৃত্যু

[সম্পাদনা]

আজাদ হিন্দ বাহিনীর সঙ্গে শেষ মাসগুলো

[সম্পাদনা]
মানচিত্রে দেখা যাচ্ছে রেঙ্গুন থেকে মৌলমেইন যাত্রাপথ যে পথে সুভাষচন্দ্র বসু এবং তাঁর আজাদ হিন্দ ফৌজ-এর (আইএনএ) ৫০০ জনের দল গিয়েছিল। এই দলটা সিতাং নদী পর্যন্ত একটা জাপানি সেনাবাহিনীর কনভয়ে ছিল। নদী পার হওয়ার পর তারা বাদবাকি ৮০ মাইল হেঁটে গিয়েছিল। মৌলমেইনে সুভাষ, তার দলবল, এবং অন্য একটা ৫০০ জনের আইএনএ গোষ্ঠী ডেথ রেলপথে জাপানি ট্রেন ধরেছিলেন (যে রেলপথ আগেই ব্রিটিশ, অস্ট্রেলীয় এবং দিনেমার যুদ্ধবন্দিদের দ্বারা গড়া হয়েছে), যেখান থেকে তারা ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের মে মাসের প্রথম সপ্তাহে ব্যাংকক পৌঁছেছিল।

১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিলের শেষ সপ্তাহ নাগাদ সুভাষচন্দ্র বসুর সঙ্গে তাঁর আজাদ হিন্দ ফৌজ-এর (আইএনএ) প্রবীণ অফিসার, কয়েকশো তালিকাভুক্ত আইএনএ সিপাহি, এবং প্রায় একশো আইএনএ-র ঝাঁসির রানি রেজিমেন্টের মহিলা সদস্য ব্রহ্মদেশের মৌলমেইন যাওয়ার জন্যে রেঙ্গুন ছাড়ে।[] সঙ্গে ছিলেন জাপানি-আইএনএ মৈত্রী সংস্থা হিকরি কিকন-এর প্রধান, লেফটেন্যান্ট জেনারেল সাবুরো ইসোদা, তাদের জাপানি সেনাবাহিনীর কনভয় সিতাং নদীর ডানদিকের তীরে তাহলেও ধীরে পৌঁছাতে সক্ষম হয়।[] (১ নম্বর মানচিত্র দেখুন) যা-ই হোক, খুব অল্প পরিবহনই নদী পার হতে সক্ষম হয়েছিল, কারণ তখন মার্কিন গোলা ছুটছিল। সুভাষচন্দ্র এবং তাঁর দলবল মৌলমেইন পৌঁছাবার জন্যে বাদবাকি ৮০ মাইল (১৩০ কিমি) পথ পরের সপ্তাহ জুড়ে হাঁটা দিয়েছিল।[]মৌলমেইন তখন ডেথ রেলপথ টার্মিনাস হয়ে গিয়েছে, যেটা আগেই ব্রিটিশ, অস্ট্রেলীয় এবং দিনেমার যুদ্ধবন্দিদের দ্বারা গড়া হয়েছে, যা বার্মাকে শ্যামদেশ (বর্তমানে থাইল্যান্ড) পর্যন্ত যোগ করেছে।[] মৌলমেইনে সুভাষের বাহিনীতে আরো ৫০০ মানুষ আইএনএ-র প্রথম গেরিলা রেজিমেন্ট এক্স-রেজিমেন্ট থেকে যোগ দিয়েছে, নিম্ন বার্মার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে যারা হাজির হয়েছিল।[১০]

দেড় বছর আগে, ১৬,০০০ আইএনএ সিপাহি এবং ১০০ মহিলা মালয় থেকে বার্মা প্রবেশ করেছিল।[১০] এখন, সেই সংখ্যার এক-দশমাংশ দেশ ছেড়ে মে মাসের প্রথম সপ্তাহ চলাকালীন ব্যাংকক পৌঁছাল।[১০] বাকি নয়-দশমাংশ হয় যুদ্ধে, ইম্ফল এবং কোহিমার যুদ্ধ-পরবর্তী আঘাতে অথবা অপুষ্টিতে মারা গিয়েছে। অন্যদের ব্রিটিশরা দখল করে নিয়েছে, তাদের ঘুরিয়ে নিয়েছে, অথবা সোজা অন্তর্হিত হয়েছে।[১০] সুভাষচন্দ্র একমাসের জন্যে ব্যাংককে ছিলেন, যেখানে তিনি পৌঁছাবার অব্যবহিত পরই খবরটা শোনেন যে, ৮ মে তারিখে [ জার্মানি আত্মসমর্পণ] করেছে।[১১] সুভাষচন্দ্র পরবর্তী দু-মাস অর্থাৎ ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের জুন এবং জুলাই সিঙ্গাপুরে কাটিয়েছিলেন,[১১] এবং দু-জায়গাতেই তিনি তাঁর সৈনিকদের বাসস্থান জোগাড় করে দেওয়ার জন্যে তহবিল সংগ্রহের চেষ্টা করেন অথবা যদি তারা নাগরিক জীবনে ফিরতে চায় তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেন, যা বেশির ভাগ মহিলা করেছিলেন।[১২] সুভাষচন্দ্র তাঁর রাতের বেতার সম্প্রচারে গান্ধির বিরুদ্ধে তীব্রতা বাড়িয়ে বক্তৃতা করেন; যিনি ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে জেল থেকে ছাড়া পেয়েছিলেন এবং ব্রিটিশ শাসকবর্গ, দূতগণ এবং মুসলিম লিগ নেতাদের সঙ্গে কথাবার্তায় নিয়োজিত ছিলেন।[১৩] কিছু প্রবীণ আইএনএ অফিসার নিরাশ হতে শুরু করেছিলেন অথবা সুভাষচন্দ্র সম্পর্কে মোহভঙ্গ হয়েছিল এবং ব্রিটিশের এবং তার প্রতিপত্তির দিকে পা বাড়াবার প্রস্তুতি নিয়েছিল।[১৩]

১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের প্রথম দু-সপ্তাহ নাগাদ ঘটনাপ্রবাহ ক্রমশ দ্রুত পরিষ্কার হতে লাগল। বিটিশের মালয় আক্রমণের হুমকি এবং প্রত্যেক দিন আমেরিকার আকাশপথে বোমা বর্ষণের ফলে সুভাষচন্দ্রের সিঙ্গাপুরে উপস্থিত থাকা সেই সমর ক্রমশ সংকটজনক হয়ে পড়ে। তাঁর সেনাবাহিনীর প্রধান জে আর ভোঁসলে পরামর্শ দেন যে, তিনি সিঙ্গাপুর ত্যাগ করার জন্যে তৈরি থাকুন।[১৪] ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ৩ অগস্ট সুভাষচন্দ্র জেনারেল ইসোদার কাছ থেকে এক সমুদ্রগর্ভে পাঠানো তারবার্তা পান, যাতে তাকে পরামর্শ দেওয়া হয় তিনি যেন ঝটিতি জাপানি-নিয়ন্ত্রিত ফরাসি ইন্দো-চিন(বর্তমান ভিয়েতনাম)স্থিত সায়গন শহরের সরণাপন্ন হন।[১৪] ১০ অগস্ট তারিখে সুভাষচন্দ্র জানতে পারেন যে, সোভিয়েত ইউনিয়ন যুদ্ধে অংশ নিয়েছে এবং মাঞ্চুরিয়া আক্রমণ করে। একই সঙ্গে তিনি হিরোশিমা এবং নাগাসাকির পারমাণবিক বোমা বর্ষণের খবর শোনেন।[১৫] চূড়ান্তভাবে, ১৬ অগস্ট তারিখে, জাপানের নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের তথ্য জানার পর, সুভাষচন্দ্র তাঁর সঙ্গে অনেক সাহায্যপাতি নিয়ে সায়গনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। [১৪]

শেষ ক-টা দিন এবং সফরগুলো

[সম্পাদনা]

বিমান দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে ফেরা দুজন ব্যক্তি, লেফ্টেন্যান্ট কর্নেলগণ নোনোগাকি এবং সাকাই, সঙ্গে ডা. ইয়োসিমি, যিনি হাসপাতালে সুভাষচন্দ্রের চিকিৎসা করেছিলেন এবং অন্যান্য মৃত্যু-পরবর্তী ব্যবস্থায় যুক্ত ছিলেন, ফিগেসের রিপোর্টের বাকি চার পৃষ্ঠায় তাঁদের সাক্ষাৎকার লেখা ছিল। লিওনার্দ গর্ডন নিজে সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন "লেফ্টেন্যান্ট কর্নেলগণ নোনোগাকি এবং সাকাই, এবং, (এর সঙ্গে যুক্ত, বিমান দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে ফেরা) মেজর কোনো; ডা. ইয়োশিমি ...; জাপানি আদেশমতো যিনি এইসব চিকিৎসার জন্যে ঘরে বসেছিলেন; এবং জাপানি অফিসার, লেফ্টেন্যান্ট হায়াশিতা, যিনি সুভাষচন্দ্রের চিতাভস্ম তাইপেইয়ের শ্মশান থেকে জাপানে বহন করেছিলেন।"[১৬]

ফিগেস রিপোর্ট এবং লিওনার্দ গর্ডনের জিজ্ঞাসাবাদগুলো চারটে ঘটনাকে নিশ্চিত করে:

  • ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ১৮ অগস্ট তাইহোকু বিমান বন্দরের কাছে একটা বিমান দুর্ঘটনা হয়েছিল, যে বিমানে সুভাষচন্দ্র বসু একজন যাত্রী ছিলেন;
  • কাছাকাছি সেনা হাসপাতালটাতে একই দিনে সুভাষচন্দ্রের মৃত্যু হয়;
  • তাইহোকুতে সুভাষচন্দ্রের মরদেহ দাহ করা হয়; এবং
  • সুভাষচন্দ্রের চিতাভস্ম টোকিয়োতে নিয়ে আসা হয়।[১৬]
সুভাষচন্দ্র বসুর শেষ বিমানযাত্রাগুলো। সম্পূর্ণ উড়ানের যাত্রাপথগুলো নীল রঙে দেখানো হয়েছে। ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ১৬ অগস্ট তিনি সিয়াম (বর্তমান থাইল্যান্ড), ব্যাংকক যাওয়ার জন্যে সিঙ্গাপুর ছাড়েন। হয় সেই ১৬ তারিখেই অথবা ১৭ তারিখ সকালে তাঁর উড়ান ব্যাংকক থেকে সায়গন, এখনকার হো চি মিন সিটি যায়। ১৭ অগস্ট বিকেলে তিনি সায়গন থেকে ফরাসি ইন্দো-চিন তৌরেন, (বর্তমান ভিয়েতনামের দানাং) উড়ে যান। পরদিন ভোর ৫টায় তৌরেন থেকে তাইহোকু, ফরমোসা, (বর্তমান তাইপেই, তাইওয়ান) যাত্রা করেন। ১৮ অগস্ট, বেলা ২:৩০ নাগাদ তিনি দাইরেন, মাঞ্চুকুও, (বর্তমান দালিয়ান, চিন) যাত্রা করেন, কিন্তু তাঁর বিমান মাটি ছেড়ে আকাশে ওঠার অল্প সময়ের মধ্যেই ধ্বংস হয়, এবং সুভাষচন্দ্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই একটা জাপানি সেনা হাসপাতালে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। ওই বিমান ধ্বংস না-ঘটলে বিমানটা সম্ভবত সুভাষচন্দ্রকে দাইরেনে নামিয়ে দিয়েছিল এবং  পাশাপাশি পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে ম্যাপে দেখানো লাল রঙের উড়ানপথে টোকিও নিয়ে গিয়েছিল।

সুভাষচন্দ্রের শেষ দিনগুলো সম্বন্ধে ঐতিহাসিক ব্যাখ্যার বিশ্বস্ত অবস্থান এই পর্যন্ত একযোগে হয়েছে। যাই হোক, তারা সংক্ষিপ্তভাবে ১৬ অগস্টের মধ্যে অল্প সময়ের জন্যে আলাদা হয়েছিলেন, যখন সুভাষচন্দ্র সিঙ্গাপুরে থাকাকালীন জাপানের আত্মসমর্পণের খবর পান, এবং ১৭ অগস্ট তারিখ সংক্ষিপ্ত বিকেলে, যখন সায়গন শহর থেকে সায়গন বিমান বন্দরে সুভাষচন্দ্র এবং তার দলবল একটা বিমান ধরবার জন্যে হাজির হন।[১৭](২ নম্বর মানচিত্র দেখুন) 

একটা মত অনুযায়ী, সুভাষচন্দ্র ১৬ তারিখে ব্যাংককে কিছুক্ষণ থেমে সিঙ্গাপুর থেকে সায়গনে উড়ে যান। সায়গনে পৌঁছানোর অব্যবহিত পরই তিনি দক্ষিণ এশিয়ায় জাপানি বাহিনীর প্রধান ফিল্ড মার্শাল হিসাইচি তেরাউচির সঙ্গে সাক্ষাত করেন এবং তাঁকে সোভিয়েত রাশিয়ার যাওয়ার জন্যে একটা উড়ানের ব্যবস্থা করতে বলেন।[১৪] যদিও ক-দিন আগেও রাশিয়া জাপানের সঙ্গে যুদ্ধরত ছিল, অন্তত সুভাষচন্দ্রের ধারণায় তাদের ব্রিটিশ-বিরোধী[১৮] মনে হয়েছিল, এবং তার ফলস্বরূপ ব্রিটিশ রাজ-বিরোধী একটা সম্ভাব্য ভিত্তি সেদেশে প্রস্তুত করতে ভবিষ্যৎ সক্রিয়তা দরকার হয়।[১৪] তেরাউচি পালাক্রমে টোকিওতে জাপানের ইম্পিরিয়াল জেনারেল হেডকোয়ার্টার্সকে (আইজিএইচকিউ) সমুদ্রগর্ভে তারবার্তা পাঠান অনুমতির জন্যে, যেটা সঙ্গে সঙ্গে বাতিল করা হয়।[১৪] ঐতিহাসিক জয়েস চ্যাপম্যান লেব্রার ভাষায়, আইজিএইচকিউ এটা মনে করে যে, "জাপানের কাছ থেকে প্রভূত সাহায্য পেয়েও, জাপানকে বাদ দিয়ে রাশিয়ায় পাড়ি জমানো সুভাষচন্দ্রের পক্ষে অশোভন হবে। তেরাউচি সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে কথা বলে আরো জানান যে, জাপান যে বিষয়ের বিপক্ষে সেই ব্যাপারে পদক্ষেপ করা অসঙ্গত হবে।"[১৪] যা-ই হোক, ব্যক্তিগতভাবে তেরাউচি তখনো সুভাষচন্দ্রের প্রতি সহানুভূতিশীল--কেননা, দীর্ঘ দু-বছর ধরে তাঁর সঙ্গে একযোগে কাজ করার ফলে এটা সম্ভব হয়েছে।[১৪]  ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ১৭ অগস্ট সকালে তিনি কোনোক্রমে সায়গন ছেড়ে টোকিও ঘুরে যাওয়ার বিমানের উড়ানে সুভাষচন্দ্রের জন্যে জায়গার ব্যবস্থা করে দেন, কিন্তু মাঝপথে মাঞ্চুরিয়ার দাইরেন বিমান বন্দরে থামবে; যে জায়গা এখনো জাপানিদের দখলে, কিন্তু সেই অঞ্চলের দিকে সোভিয়েত সেনাবাহিনী দ্রুত এগোচ্ছে--যেখানে সুভাষচন্দ্রকে অবনমন করতে হোত এবং তাঁকে রাশিয়ানদের হাতে তাঁর ভাগ্যের জন্যে প্রতীক্ষায় থাকতে হতো।[১৪]  

অন্য এক মতে, সুভাষচন্দ্র তাঁর দলবল সঙ্গে নিয়ে ১৬ তারিখে সিঙ্গাপুর ত্যাগ করেন এবং পথিমধ্যে ব্যাংককে যাত্রাবিরতি করেন, আজাদ হিন্দ ফৌজের অফিসার ইন-চার্জ জে আর ভোঁসলে সেখানে কিছুটা অবাক হয়ে যান, যিনি তাড়াহুড়ো করে সুভাষচন্দ্রের রাত্রিবাসের ব্যবস্থা করেন।[১৭] সুভাষচন্দ্রের ব্যাংককে আগমনের খবর যেভাবেই হোক, প্রচার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয় স্বাধীনতা লিগ (আইআইএল)-এর স্থানীয় সদস্যরা, আইএনএ, এবং থাইল্যান্ডের ভারতীয় ব্যবসায়ী মহল হোটেলে ভিড় করে।[১৭] ঐতিহাসিক পিটার ওয়ার্ড ফে-এর মতে, সুভাষচন্দ্র "অর্ধেক রাত কোর্ট পরে বসেছিলেন--এবং পরদিন সকালেই সায়গনে উড়ে যান, এই সময় সঙ্গে ছিলেন জেনারেল ইসোদা ..."[১৭] সকালের শেষে সায়গনে পৌঁছে সেখানে সামান্য সময় ফিল্ড মার্শাল তেরাউচির সঙ্গে সাক্ষাত করার ছিল, যিনি এক ঘণ্টা বরাবর বিমানে ফরাসি ইন্দো-চিন-এর কেন্দ্রীয় উচ্চভূমি দালত-এ ছিলেন।[১৭] ফলস্বরূপ, ইসোদা নিজে ওপর মহলের সঙ্গে আলোচনা না-করে, একটা উড়ানের ব্যবস্থা সুভাষচন্দ্রের জন্যে করেন যেটা অল্প সময়ের মধ্যেই ছাড়ার কথা।[১৭]

একটা তৃতীয় খসড়া বর্ণনায় বলা হয়, সুভাষচন্দ্র ১৭ তারিখে সিঙ্গাপুর ছাড়েন।[১৮] ঐতিহাসিক ক্রিস্টোফার বেলি এবং টিম হার্পারের মত অনুযায়ী, "১৭ অগস্ট তারিখে তিনি আইএনএ ভেঙে দিয়ে এই বলে দিনের একটা চূড়ান্ত আদেশ দেন যে, 'দিল্লি যাওয়ার রাস্তা অনেক এবং দিল্লিই আমাদের লক্ষ্য থাকছে'। তারপর তিনি ফরাসি ইন্দো-চিন হয়ে চিনে উড়ে যান। যদি এই সব প্রয়াস অসফল হয়, তিনি সোভিয়েতের একজন বন্দি হতে চেয়েছিলেন: 'একমাত্র তারা-ই, যারা ব্রিটিশদের বাধা দিতে পারে। আমার ভাগ্য তাদের হাতে'।"[১৮]

মিৎসুবিশি কেআই-২১ জোড়া-ইঞ্জিন হেভি বোম্বার (মিত্রদের কোড স্যালি) যাতে সুভাষচন্দ্র বসু এবং হাবিবুর রহমান সায়গন বিমান বন্দরে ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ১৭ অগস্ট বেলা ২টো নাগাদ চড়েছিলেন।

১৭ তারিখ দুপুর নাগাদ অসহায় অবস্থায় পুনর্মিলন ঘটে। সায়গন বিমান বন্দরে একটা মিৎসুবিশি কেআই-২১ হেভি বোম্বার, মিত্ররা যার টাইপ কোড নাম দেয় স্যালি, যেটা সুভাষচন্দ্র এবং তাঁর দলবলের জন্যে অপেক্ষা করছিল।[১৯][২০] সুভাষচন্দ্র ছাড়াও তাঁর সঙ্গে ছিলেন আইএনএ গোষ্ঠী, যেমন - কর্নেল হাবিবুর রহমান, তাঁর সচিব; এসএ আয়ার, তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্য; মেজর আবিদ হাসান, তাঁর পুরোনো সহকর্মী যিনি ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে জার্মানি থেকে সুমাত্রা ঝুঁকিপূর্ণ ডুবোজাহাজ অভিযান করেছিলেন; এবং অন্যান্য তিনজন।[১৯] তাঁদের আতঙ্কের মধ্যে, তাঁরা আগমনে জানতে পারেন যে, সেখানে একজন মাত্র আইএনএ যাত্রীর জায়গা ছিল।[২০] সুভাষচন্দ্র অভিযোগ করেন, এবং অবরুদ্ধ জেনারেল ইসোদা হার মানেন এবং তাড়াহুড়ো করে একটা দ্বিতীয় আসনের ব্যবস্থা করেন।[২০] সুভাষচন্দ্র হাবিবুর রহমানকে তাঁর সঙ্গে নিতে চাইলেন।[২০] এটা বোঝা গেল যে, আইএনএ দলের অন্যান্যরা অন্য একটা উড়ানে তাঁকে অনুসরণ করবে। সায়গন বিমান বন্দরে আবারো বিলম্বের ঘটনা। ঐতিহাসিক জয়েস চ্যাপম্যান লেব্রার মতে, "সুভাষচন্দ্র বিমানে চড়ার সময় স্থানীয় ভারভীয়রা তাঁকে বিপুল ধনসম্পদের এক উপহার প্রদান করেন। দুটো অত্যন্ত ভারী শক্ত বাকসো বিমানের বিধিবদ্ধ ওজনকে অতিক্রম করেছিল।"[১৯] দুপুর থেকে ২টোর মধ্যে কোনো এক সময়, জোড়া ইঞ্জিনের বিমান ১২ অথবা ১৩ জন যাত্রীকে কোলে নিয়ে মাটি ছেড়ে উড়ে যায়: তিন অথবা চার জন বিমান চালক, জাপানি সেনা এবং বিমান বাহিনীর কয়েকজন অফিসার, লেফটেন্যান্ট-জেনারেল সুনামাসা শিদেই, জাপানি কোয়াংতুং সেনাবাহিনীর সহ-প্রধান, যারা যদিও মাঞ্চুরিয়ায় পশ্চাদপসরণ করে তখনো মাঞ্চুরিয়ান উপদ্বীপ ধরে রেখেছিল, এবং সুভাষচন্দ্র ও রহমান সাহেব। সুভাষচন্দ্র বসেছিলেন একটু দূরের বন্দরদিক বরাবর।[১৯] বোমারু বিমান স্বাভাবিক অবস্থায় পাঁচ জন বিমান চালক বহন করে।

জাপানের আত্মসমর্পণের কয়েকদিন পর যে এই উড়ানগুলো সম্ভব হয়েছিল, তবে সেই অবস্থায় কী ঘটছে তাতে স্পষ্টতার অভাব ছিল। যদিও জাপান নিঃশর্তভাবে আত্মসমর্পণ করেছিল, যখন সম্রাট হিরোহিতো তাঁর বেতারে প্রদত্ত ঘোষণায় চিরাচরিত জাপানি ভাষা ব্যবহার করেন, যা পুরোপুরি সাধারণ জনতার বোধগম্য নয়, 'আত্মসমর্পণ' (জাপানি ভাষায়) শব্দ ব্যবহার করার বদলে, তিনি শুধু বিবৃত করেন, "পটসডাম ঘোষণা-র শর্তগুলো মেনে চলার জন্যে।" পরবর্তীকালে, অনেক মানুষ, বিশেষ করে জাপানি-অধিকৃত ভূখণ্ডে, যারা অনিশ্চিতভাবে যদি যেকোনো উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটে, একটা বিমানপথে কিছুদিনের জন্যে জাপানি বিমান বাহিনীকে ক্রমাগত ওড়ার অনুমোদন দেয়। যদিও বোমারু বিমানটার গন্তব্যস্থল নিয়ে সুভাষচন্দ্র এবং জাপানিরা নীরব ছিল, সায়গন বিমান বন্দরের পিচরাস্তার পিছনে থাকা সুভাষচন্দ্রের সহকর্মীদের দৃঢ় আন্দাজ ছিল যে, মাঞ্চুরিয়ান উপদ্বীপে দাইরেন হয়ে বিমানটা ঘুরবে, এবং ওপরে যেমন বলা হয়েছে, এটা তখনো জাপানিদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। উভয় কমিউনিস্ট দেশ রাশিয়া এবং চিনের সঙ্গে যোগাযোগ করাটা গুরুত্বপূর্ণ—এই কথা সুভাষচন্দ্র এক বছরের বেশি সময় ধরে বলে আসছেন। ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্য আনন্দ মোহন সহায়কে টোকিওতে গিয়ে সেখানে সোভিয়েত রাষ্ট্রদূত জেকব মালিক-এর সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন।[১৯] যাইহোক, জাপানি বিদেশ মন্ত্রী মামোরু শিগেমিৎসু-এর সঙ্গে যোগাযোগ করার পর আনন্দ মোহন এর বিপক্ষে সিদ্ধান্ত নেন।[১৯] ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে তিনি আবার সুভাষচন্দ্রের হয়ে সোভিয়েত কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করার অনুরোধ জানিয়ে শিগেমিৎসুকে চিঠি লেখেন; আবারো উত্তরটা এসেছিল না-বাচক।[১৯] সুভাষচন্দ্র মাঞ্চুরিয়ায় জাপানি সেনাবাহিনীর প্রস্তুত থাকা সম্পর্কে জেনারেল ইসোদার কাছে ক্রমাগত জানতে চাইছিলেন।[১৯] যুদ্ধের পর, জাপানিরা ব্রিটিশ তদন্তকারী এবং পরে ভারতীয় কমিশনকে জিজ্ঞাসাবাদের উত্তরে দৃঢ়ভাবে প্রতিপন্ন করেছিল যে, ওই বিমান প্রকৃতপক্ষে দাইরেনের দিকে ঘোরানো হয়েছিল, এবং সেই সহযাত্রী কোয়াংতুং সেনাবাহিনীর জেনারেল শিদেয়াকে সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে বিমান থেকে দাইরেনে নামাতে হয়েছিল এবং তাঁকে সুভাষচন্দ্রের মাঞ্চুরিয়ায় সোভিয়েত অধিকৃত ভূখণ্ডে বদলির জন্যে প্রধান সংযোগ এবং মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজে লাগানো হয়েছিল।[১৮][১৯]  

বিমানটা উত্তর দিকে উড়ছিল। ইতিমধ্যে এটা ফরাসি ইন্দো-চিনের উত্তর তিরের কাছে ছিল, অন্ধকার ক্রমশ কাছে আসতে আরম্ভ করে, এবং বিমান চালক তৌরেন বিমান বন্দরে (বর্তমান দানাং, ভিয়েতনাম) অ-নথিভুক্ত অবতরণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।[২১] যাত্রীরা অধিক রাতে একটা হোটেলে অবস্থান করে, এবং চালক আশঙ্কিত হন যে, বিমানটা অত্যধিক বোঝাই, ৫০০ পাউন্ডের মতো জিনিসপত্র এবং লটবহর নামিয়েছিল, এবং বিমানে জ্বালানিও ভরেছিল।[২১] পরদিন ভোরের আগে, ওই গোষ্ঠী আবার উড়ে গিয়েছিল, এই সময় তাইহোকু বিমান বন্দরে, ফরমোসা (বর্তমান তাইপেই, তাইওয়ান), যেটা ছিল নথিভুক্ত থামা, সেখানে পৌঁছায় ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ১৮ অগস্ট দুপুর নাগাদ।[২১] তাইহোকুতে দু-ঘণ্টা থেমে থাকাকালীন সময়ে, বিমানে আবার জ্বালানি ভরা হয়, যখন বিমান যাত্রীরা দুপুরের খাওয়াদাওয়া সারছিলেন।[২১] প্রধান বিমান চালক এবং গ্রাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার, এবং মেজর কোনো, মনে হয়েছিল বন্দরের দিকের ইঞ্জিন সম্বন্ধে সংশ্লিষ্ট, এবং যখন সমস্ত যাত্রী চড়েছেন, ইঞ্জিনকে বারংবার নিয়ন্ত্রিত অবস্থায় আস্তে-জোরে চালিয়ে পরীক্ষা করা হয়েছিল।[২১][২২] সংশ্লিষ্ট অসুবিধে হ্রাস করে, বিমানটা চূড়ান্তভাবে মাটি ত্যাগ করে, বিভিন্ন হিসেবে যত আগে হয় বেলা ২টো[২১] এবং যত দেরি হয় বেলা ২.৩০টা[২২][২৩] যেটা গ্রাউন্ড ইঞ্জিনিয়াররা দেখেছেন।[২১]

বিমান দুর্ঘটনায় মৃত্যু

[সম্পাদনা]

বোমারু বিমানটা চিরাচরিত পথ ধরে মাটি থেকে ওপরে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই ভিতরের যাত্রীরা একটা বিকট শব্দ শুনতে পায়, যেটা ইঞ্জিনে আগুন লাগার মতো ছিল।[২২][২৩]টারম্যাকে থাকা কারিগররা বিমান থেকে কিছু একটা পড়ে যেতে দেখেন।[২১] এটা ছিল বন্দরদিকের ইঞ্জিন, অথবা এর অংশ, এবং চালক-পাখা।[২১][২২] বিমানটা বিস্তৃতভাবে ডানদিকে দুলে ওঠে এবং পড়ে যায়, চূর্ণ হয়ে, ভেঙে দু-খণ্ড হয়ে যায়, এবং প্রচণ্ড শব্দে বিদীর্ণ হয়ে আগুন লেগে যায়।[২১][২২] ভিতরে প্রধান চালক, সহচালক এবং জেনারেল ইসোদা সঙ্গে সঙ্গে নিহত হন।[২১][২৪] রহমান হতচকিত হয়ে যান, আস্তে আস্তে বের হতে থাকেন, এবং সুভাষচন্দ্র, যদিও জ্ঞান ছিল এবং মারাত্মকভাবে জখম ছিলেন না, গ্যাসোলিনে শরীর ভিজে।[২১] রহমান কাছে এলেন, তিনি এবং সুভাষচন্দ্র উলটোদিকের দরজা দিয়ে বাইরে আসার চেষ্টা করেন, কিন্তু দেখা গেল সেখানে লটবহরের চাপে বদ্ধ অবস্থা।[২৪] তখন তাঁরা সিদ্ধান্ত নেন আগুনের শিখার মধ্যে দিয়ে দৌড় লাগিয়ে সামনের গেট দিয়ে বেরিয়ে আসবেন।[২৪] বন্দরভূমির বিমান কর্মীরা বিমানের কাছাকাছি আসছেন, তাঁরা দেখলেন দুজন মানুষ হতচকিত হয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে আছেন, তাঁদের মধ্যে একজন মানব মশালে পরিণত হয়েছেন।[২১] ওই মানব মশাল সুভাষচন্দ্র বসুতে পরিবর্তিত হয়েছিল, যাঁর পোশাক-পরিচ্ছদ গ্যাসোলিনে-চুঁইয়ে তাৎক্ষণিকভাবে প্রজ্বলিত ওঠে।[২৪] রহমান এবং অন্য কয়েকজন আগুনের শিখাকে চাপা দিতে পেরেছিলেন, কিন্তু এটাও লক্ষ করেন যে, সুভাষচন্দ্রের মুখ এবং মাথা মারাত্মকভাবে পুড়ে গিয়েছে।[২৪] জয়েস চ্যাপম্যান লেব্রার মতে, "একটা লরি যেটা অ্যাম্বুল্যান্স হিসেবে কাজে লাগানো হয়েছিল, সেটা সুভাষচন্দ্র এবং অন্য যাত্রীদের নিয়ে তাইহোকুর দক্ষিণে নানমন সৈনিক হাসপাতালে ছুটেছিল।[২১]বিমান বন্দর আধিকারিকরা বেলা ৩টে নাগাদ হাসপাতালের সার্জেন-ইন-চার্জ ডা. তানেয়োশি ইয়োশিমিকে ডেকেছিলেন।[২৪] তারা যখন হাসপাতালে পৌঁছান, এবং তার কিছুক্ষণ পরও সুভাষ চন্দ সচেতন ও সঙ্গতিপূর্ণ ছিলেন।[২৫] সুভাষচন্দ্রের পোশাক খুলে তাঁর শরীরে একটা তোয়ালে ঢাকা দেওয়া হয়েছিল, এবং ডা. ইয়োশিমি তৎক্ষণাৎ দেখলেন তাঁর শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ, বিশেষত তাঁর বুকের তিন-চতুর্থাংশ পুড়ে গিয়েছে, তাতে তাঁর খুব সন্দেহ হয় তিনি বাঁচবেন কী না।[২৫] ডা. ইয়োশিমি ঝটিতি তাঁর চিকিৎসা শুরু করেন এবং তাঁকে সাহায্য করেন ডা. সুরুতা।[২৫] ঐতিহাসিক লিওনার্দ এ গর্ডন, যিনি পরে সকল হাসপাতাল আধিকারিকের সাক্ষাতকার নিয়েছিলেন, তাঁর বক্তব্য হল: 

"একটা সংক্রমণবিরোধী, রিভামল, তাঁর শরীরের বেশির ভাগ জায়গায় লাগানো হয় এবং তখন একটা সাদা মলম প্রয়োগ করে তাঁর শরীরের অধিকাংশে ব্যান্ডেজ করে দেওয়া হয়। ডা. ইয়োশিমি সুভাষচন্দ্রের হৃদয়ের দুর্বলতার জন্যে তাঁকে চারটে ভিটা ক্যাম্ফর এবং দুটো ডিজিটামাইন ইঞ্জেকশন দেন। এগুলো প্রত্যেক ৩০ মিনিটে দেওয়া হয়েছিল। যেহেতু পুড়ে যাওয়ার জন্যে তাঁর শরীরের জলীয় পদার্থ কমেছে, তাঁকে ধমনীর মধ্যে দিয়ে রিঙ্গার সলিউশন দেওয়া হয়েছিল। ডা. ইশি, একজন তৃতীয় ডাক্তার তাঁকে রক্ত দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। কাজুও মিতসুই, একজন হাসপাতাল পরিচারক, একজন সৈনিক নিজস্ব, সেই ঘরে ছিলেন এবং অন্যান্য নার্সরা সহায়তা করেছিলেন। তখনো সুভাষচন্দ্রের পুরো জ্ঞান ছিল, ডা. ইয়োশিমি দেখেন যেটা লক্ষ করার মতো যার শরীরে এরকম মারাত্মক জখম আছে।[২৬]

তখনই, চিকিৎসা করা সত্ত্বেও সুভাষচন্দ্র একটা আচ্ছন্নতার মধ্যে চলে যান।[২৬][২১] কয়েক ঘণ্টা পর, রাত ৯টা থেকে ১০টার মধ্যে তাঁর মৃত্যু হয়।[২৬][২১]

দুদিন পর, ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ২০ অগস্ট তাইহোকু শ্মশানে সুভাষচন্দ্রের মরদেহ দাহ করা হয়।[২৭] ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ২৩ অগস্ট জাপানি সংবাদ সংস্থা দোমেই সুভাষচন্দ্র এবং শিদেয়ার মৃত্যুর খবর ঘোষণা করে।[২১] ৭ সেপ্টেম্বর তারিখে জাপানি আধিকারিক লেফটেন্যান্ট তাতসুও হায়াশিদা সুভাষচন্দ্রের চিতাভস্ম টোকিওতে বয়ে নিয়ে যান, এবং পরদিন সকালে তাঁরা সেটা টোকিওর ভারতীয় স্বাধীনতা লিগের সভাপতি রামা মূর্তির হাতে তুলে দেন।[২৮] ১৪ সেপ্টেম্বর তারিখে টোকিওতে সুভাষচন্দ্র বসুর এক স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হয় এবং তার কয়েকদিন পর চিতাভস্মগুলো টোকিওর নিচিরেন বৌদ্ধধর্ম সম্প্রদায়ের রেনকোজি মন্দির-এর সন্ন্যাসীর কাছে জমা দেওয়া হয়।[২৯][৩০] এখনো পর্যন্ত সেগুলো ওখানেই রাখা আছে।[৩০]

আইএনএ আধিকারিকদের মধ্যে অধিক বিস্তৃত অবিশ্বাস, মানসিক এবং শারীরিক অসুস্থতা ছিল। বেশির ভাগ ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে মালয় এবং সিঙ্গাপুর থেকে নবীন তামিল ভারতীয় পুরুষ ও মহিলারা ছিল, তাদের মধ্যে অধিকাংশ আইএনএ নথিভুক্ত নাগরিক ছিল।[৩১] আইএনএভুক্ত পেশাদার সৈনিকদের বেশির ভাগ মহিলা-ই ছিল পাঞ্জাবি, অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে, ব্রিটিশের থেকে প্রতিহিংসামূলক অধিকারে অদৃষ্টবাদীভাবে অনেকে ছিল।[৩১]ভারতে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস তার দলগত অবস্থান ছিল: সংক্ষিপ্তভাবে একটা চিঠিতে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধি রাজকুমারী অমৃত কাউর-কে লেখেন।[৩১] গান্ধি বলেন, "সুভাষচন্দ্র বসুর মৃত্যু হয়েছে ভালো। তিনি সন্দেহাতীতভাবে একজন দেশপ্রেমী ছিলেন, কিন্তু ভুলপথে চালিত হয়েছিলেন।[৩১] গান্ধির সঙ্গে বিবাদ করা এবং যাকে তারা জাপানি ফ্যাসিবাদ বলে ভাবে তাদের সঙ্গে হাত মেলানোর জন্যে অনেক কংগ্রেসী সুভাষচন্দ্রকে ক্ষমা করেনি।[৩১]ব্রিটিশ ভারতীয় সৈন্যবাহিনীতে যেসব ভারতীয় সৈনিক ছিলেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন যারা যুদ্ধ করেছিল, সেই পঁচিশ লক্ষ সেনা আইএনএ সম্পর্কে বিরোধিতা করেছিল। অনেকে আইএনএ-কে বিশ্বাসঘাতক হিসেবে দেখত এবং চাইত তাদের শাস্তি হোক; অন্যেরা ছিল একটু বেশি সহানুভূতিশীল। ব্রিটিশ রাজ, যাকে যদিও কখনো গুরুতরভাবে আইএনএ হুমকি দেয়নি, ৩০০ আইএনএ আধিকারিককে বিশ্বাসঘাতকতার জন্যে আইএনএ ট্রায়াল নিতে হয়েছিল, কিন্তু পরিণতিতে উলটোপথে নিজেদের তরফে এটা সামনে আসে।[৩১]

সুভাষচন্দ্রের জীবিত থাকার উপকথাগুলো

[সম্পাদনা]

তাৎক্ষণিক যুদ্ধ-পরবর্তী উপকথাগুলো

[সম্পাদনা]

সুভাষচন্দ্র বসুর কৃতিত্বগুলো অগস্ট, ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের আগেই উপকথার আকার নিতে শুরু করে।[৩২][] ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় গৃহবন্দি অবস্থায় অন্তর্ধানের সময় থেকে ভারতে জনশ্রুতি প্রচলিত ছিল যে, তিনি জীবিত আছেন কী না, যদি থাকেন, তবে কোথায় এবং তিনি কী করছেন।[৩২]১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে সুদূর জার্মানিতে তাঁর অবস্থান তাঁর কাজকর্ম সম্পর্কে একটা রহস্যের বাতাবরণ তৈরি করেছিল। কংগ্রেস নেতারা জেলে থাকাকালে ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে ভারত ছাড়ো প্রস্তাব জেগে ওঠে এবং ভারতীয় জনগণ রাজনৈতিক খবর পাওয়ার জন্যে অকাঙ্ক্ষিত, বার্লিন থেকে সুভাষচন্দ্রের বেতার সম্প্রচার ভারতীয় স্বাধীনতার জন্যে মৌলিক পরিকল্পনার নকশা সেই সময় তৈরি হচ্ছিল, যখন জার্মানির ভাগ্য খুলছে এবং ব্রিটেনের ভাগ্য নিচের দিকে, তাঁকে ভারত এবং দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় তোষামোদের ব্যক্তি বানানো হয়েছিল।[৩৩] জার্মানিতে তাঁর দুবছর থাকাকালীন সময়ে, রোমেইন হায়েসের ভাষ্য অনুযায়ী, "যদি সুভাষচন্দ্র বার্লিনে সম্মান পেয়ে থাকেন, তবে টোকিওতে তিনি পেয়েছেন উষ্ণ শ্রদ্ধা এবং তাঁকে দেখা হোত 'ভারতীয় সেনাধ্যক্ষ' হিসেবে।[৩৪] এইভাবে তাঁকে যখন দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দের জুলাইতে দেখা গেল, রহস্যজনকভাবে জার্মান এবং জাপানি ডুবোজাহাজে এনেছিল, তিনি ইতিমধ্যেই প্রকৃতিগত দিক থেকে একটা অবাস্তব কাহিনির নায়ক হিসেবে প্রতিভাত হয়েছেন।[৩৩]

সুভাষচন্দ্রের মৃত্যুর পর, তাঁর অন্য লেফটেন্যান্টরা, মাঞ্চুরিয়াতে তাঁর সঙ্গে যাঁদের থাকার কথা ছিল, কিন্তু তাঁদের সায়গনে টারম্যাকে ছেড়ে যাওয়া হয়েছে, তাঁরা কখনোই একটা দেহ দেখেননি।[৩৫] সেখানে সুভাষচন্দ্রের জখম হওয়া কিংবা অসুস্থ অবস্থার কোনো ফটোগ্রাফ নেওয়া হয়নি, এমনকি মৃত্যুর কোনো নথিভুক্তিকরণ (মৃত্যুর সার্টিফিকেট প্রদান) করা হয়নি।[৩৫] ঐতিহাসিক লিওনার্দ এ গর্ডনের ভাষ্য হল:  

"যুদ্ধ শেষ হয় যাচ্ছিল; পূর্ব এশিয়ায় সবকিছু গোলমেলে, ভারত এবং ব্রিটেনের সরকারগুলোর দ্বারা কোনো সরকারি রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়নি। এই সরকারেরা সন্দেহ দূর করার মতো কোনো কিছুই করেনি। এমনকি ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে ভারতের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতিনিধিরা এই বিষয় নিয়ে বকবক করেছিল। সুভাষচন্দ্র তাঁর প্রথম জীবনে বিভিন্ন সময়ে অন্তরীণ হয়েছেন; সেজন্যে গুজব আবারো শুরু হয়েছিল ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে এবং একটা শক্তিশালী অবাস্তব গল্পের সূচনা হয়েছিল।"[৩৫]

এই দুটো কারণে, যখন সুভাষচন্দ্রের মৃত্যুর খবর এল, আইএনএ-এর অনেকে এটা বিশ্বাস করতে অস্বীকার করে এবং তাদের অবিশ্বাস বিপুল জনতার মধ্যে ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়।[]আইএনএ-তে এই সন্দেহবাদের উৎস হলেন সম্ভবত সুভাষচন্দ্রের প্রবীণ আধিকারিক জে আর ভোঁসলে[] ভোঁসলে, অন্যান্য প্রবীণ আধিকারিকদের মতো নয়, সুভাষচন্দ্রের চূড়ান্ত পরিকল্পনা আড়াল করে রাখতেন, অংশত কারণ তিনি তখন ব্রিটিশের একজন এজেন্ট হয়ে গিয়েছেন। যখন জেনারেল ইসোদাসহ এক জাপানি প্রতিনিধিদল ১৯ অগস্ট, ১৯৪৫, তারিখে সংবাদটা যাচাই এবং সহমর্মিতা জানাতে ভোঁসলের সঙ্গে সাক্ষাত করেন, তিনি তাঁর উত্তরে ইসোদাকে বলেন যে, সুভাষচন্দ্রের মৃত্যু হয়নি, বরং তাঁর অনুপস্থিতিকে সামাল দিয়েছিলেন।[] এমনকি মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধি তাড়াহুড়ো করে বলেন যে, তিনি বিমান দুর্ঘটনা সম্পর্কে সন্দিহান, কিন্তু বেঁচে ফেরা ভারতীয়, হাবিবুর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাত করার পর তাঁর মত বদল করেন।[৩৬]১৯৪০-এর মতো ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দেও দীর্ঘ সময় সুভাষচন্দ্র সম্পর্কে ঘটনাবলির গুজব ছড়ায়, হয় তিনি সোভিয়েত-অধিকৃত মাঞ্চুরিয়ায় সোভিয়েত সেনাবাহিনীর একজন বন্দি ছিলেন, নতুবা তিনি সোভিয়েত সেনাবাহিনীর সঙ্গে সহযোগিতা করে লুকিয়ে গিয়েছেন।[] আজাদ হিন্দ ফৌজের মহিলা দল ঝাঁসির রানি বাহিনী-এর লক্ষ্মী স্বামীনাথন, পরবর্তীকালে লক্ষ্মী সায়গল, ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের বসন্তে বলেন যে, তাঁর মনে হয় সুভাষচন্দ্র চিনে ছিলেন।[৩৬] অনেক গুজবে বলা হয় সুভাষচন্দ্র তাঁর দিল্লি অভিযানের চূড়ান্ত প্রস্তুতি নিচ্ছেন।[] সেই সময় এমনই ছিল যে সুভাষচন্দ্রকে মানুষ দেখেছেন বলে বলা হয়, একজন দর্শক দাবি করেন, "তিনি বোম্বে এক্সপ্রেসের একটা তৃতীয় শ্রেণির কামরায় সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে এক বৃহস্পতিবার দিন সাক্ষাত করেছেন।"[[৩৬]

স্থায়ী উপকথাগুলো

[সম্পাদনা]

১৯৫০ খ্রিস্টাব্দ-দশকে গল্পগুলো সামনে এল, যাতে বলা হল সুভাষচন্দ্র এক সাধু, অথবা হিন্দু সন্ন্যাসী হয়েছেন। সর্বাধিক জ্ঞাত এবং ভীষণ জটিল সুভাষচন্দ্রের সন্ন্যাসী হওয়ার একট গল্প, ঐতিহাসিক লিওনার্দ এ গর্ডনের ভাষায় যেটা সম্ভবত "ঠিকঠাক বললে এটা একটা অতিকথন," বলা হয়ছিল ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দ-দশকের প্রথম দিকে।[৩৭] সুভাষচন্দ্রের কয়েকজন সহযোগী দু-দশক আগে 'সুভাষবাদী জনতা' নামে একটা সংস্থা সংগঠিত করে, এই গল্প প্রচার করতে, যেখানে সুভাষচন্দ্র এখন উত্তর বঙ্গের শাউলমারি (শৌলমারিও)-তে এক আশ্রম (অথব নির্জন আবাস)-এর প্রধান সাধু।[৩৭] জনতা প্রকাশিত বিভিন্ন বিষয় এনেছিল, এতে ছিল সংবাদপত্র এবং সাময়িক পত্রাদি। এর মধ্যে কিছু দীর্ঘজীবী এবং কিছু স্বল্প, কিন্তু সবই, তাদের তৈরি সংখ্যা, তাদের লক্ষ্য ছিল সংবাদসত্যতার দ্বারা ভ্রম সৃষ্টি করা।[৩৭] প্রধান সাধু নিজে ভীষণভাবে সুভাষচন্দ্র হতে অস্বীকার করেছিলেন।[৩৮] সুভাষচন্দ্রের অন্তরঙ্গ অনেকে, এঁদের মধ্যে কিছু রাজনীতিবিদ ছিলেন, যাঁরা ওই সাধুর সঙ্গে দেখা করেছিলেন, অস্বীকারকে সমর্থন করেছিলেন।[৩৮]এমনকি সুভাষবাদী জনতা সুভাষচন্দ্রের যুদ্ধ-পরবর্তী কাজকর্মের একটা কালক্রম বানাতেও সক্ষম হয়েছিল।[৩৮]

এই কালক্রম অনুযায়ী, তাঁর ভারতে ফিরে আসার পর, সুভাষচন্দ্র তাঁর যৌবনের পেশায় ফিরে যান: তিনি একজন হিন্দু সন্ন্যাসী হয়ে যান।[৩৮] ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসের গোড়ায় তিনি দিল্লিতে অদেখা গান্ধির শেষকৃত্যে হাজির হয়েছিলেন; বিভিন্ন সময়ে এবং সারা ভারত জুড়ে হেঁটে বেড়ান; ১৯৫৬ থেকে ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি উত্তরমধ্য ভারতের বেরেলিস্থিত একটা শিব মন্দিরের যোগী হয়েছিলেন; বনৌষধির চিকিৎসক হয়েছিলেন, একজন টিবি রোগী সমেত অনেককে ভালো করেন; এবং শ্রীমৎ সারদানন্দজি ধর্মীয় নাম নিয়ে, ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে শাউলমারি আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন।[৩৮]অধিকন্তু, সুভাষচন্দ্র ব্যস্ত হয়ে যান তপস্যা, অথবা ধ্যানে, জগতকে মুক্ত করতে, তাঁর লক্ষ্য বিস্তৃত হয়ে যায়, তাঁর প্রথম লক্ষ্যের পর—ভারত মুক্ত করা--যেটা উপলব্ধ হয়েছে।[[৩৯] তাঁর এই প্রয়াসকে, যাই হোক, এবং তাঁর প্রকৃত পরিচয় আন্দাজ করতে, রাজনৈতিক দলগুলো, সংবাদপত্রগুলো, ভারত সরকার, এমনকি বিদেশি সরকারগুলো যৌথভাবে ব্যর্থ করেছিল।[৩৯]

অন্যান্য গল্পগুলো প্রকাশ হল, বাড়িয়ে বলল জনতা এবং অন্যরা।[৪০] সুভাষচন্দ্র এখনো সোভিয়েত ইউনিয়ন অথবা চিন গণ প্রজাতন্ত্র-তে আছেন; ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে জওহরলাল নেহরুর শেষকৃত্যে হাজির ছিলেন, কিন্তু, এই সময়, জনতা-প্রকাশিত সংবাদপত্রে তাঁর ছবি ছাপতে অনুমতি দিতে অবহেলা করেছিল; এবং জনতাকে তাঁর কলকাতায় ফেরার নোটিশ দিয়েছিল, যে জন্যে কয়েকটা জনবহুল মিছিল সংগঠিত করেছিল।[৪০] সুভাষচন্দ্র সামনে আসেননি।[৪০] পরিণামে জনতা ভেঙে গিয়েছিল, বারংবার অধিনায়কের প্রকাশ্য না-হওয়াগুলো এর জনপ্রিয়তা কমিয়ে দিয়েছিল।[৪০] শাউলমারির আসল সাধু, যিনি ধারাবাহিকভাবে নিজেকে সুভাষচন্দ্র বলতে অস্বীকার করছিলেন, তিনি ১৯৭৭ খ্রিস্টাব্দে মারা যান।[৪০] এটা দাবি করা হয়েছিল যে,নিকিতা ক্রুশ্চেভ তাঁর নয়াদিল্লি সফরের সময় একজন অনুবাদককে বলেছিলেন যে, যদি নেহরু ইচ্ছে করেন সুভাষচন্দ্রকে ৪৫ মিনিটের মধ্যে হাজির করতে পারেন।[৪১]

তখনো অন্য গল্প অথবা গুজবগুলো--ষড়যন্ত্র করে এবং নকল ছবি সঙ্গে ব্যাখ্যা করা--এখনকার সুভাষচন্দ্র ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দের দশকের প্রথমদিকে, সোভিয়েত ইউনিয়ন অথবা চিনে অবস্থান করছেন।[৪০] সুভাষচন্দ্রকে একটা ছবিতে দেখা গিয়েছে, অনির্বচনীয়ভাবে চিনা লাল ফৌজ-এর সঙ্গে প্যারেড করা অবস্থায়।[৪০] সুভাষচন্দ্র একটা সোভিয়েত গুলাগ-এ আছে বলে বলা হয়। এটা বলা হয় সুভাষচন্দ্রকে মুক্ত করার হুমকি দিয়ে সোভিয়েত নেতৃত্ব নেহরুকে, পরে ইন্দিরা গান্ধিকে ব্ল্যাক মেলিং করেছিলেন।[৪২] একজন ভারতীয় সাংসদ, সমর গুহ, ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দে সুভাষচন্দ্রের একটা ছবি প্রকাশ করে দাবি করেন যে, এটা সমসাময়িক। এটা মেরামত করার দরকার হয়ছিল, কেননা, অর্ধেকটা ছিল সুভাষচন্দ্রের এবং বাকি অর্ধকটা তাঁর বড়দা শরৎ চন্দ্র বসু[৪৩] সমর গুহ অভিযোগ করেন যে, ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নে সুভাষচন্দ্রের কারাবরোধের খবর নেহরুর জানা ছিল, অভিযোগটা সমরবাবু তাঁর আদালতে অভিযুক্ত হওয়ার পর প্রত্যাহার করেছিলেন।[৪৩]

বিগত শতকের বাদবাকি বছরগুলোতে এবং তারপর আবার হারিয়ে যাওয়া উপকথাগুলো সামনে আসতে থাকে। অতি স্পষ্টভাবে, ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে ভারত সরকার একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিকে সুভাষচন্দ্রের মৃত্যুর তদন্ত করার ভার অর্পণ  করেন, অন্য একজন সন্ন্যাসী অথবা আড়ালে চলে যাওয়া, 'গুমনামী বাবা' জনতার নজরে এসেছিল, এছাড়াও তাঁর ধর্মীয় নামে পরিচিতি ছিল--'ভগবানজি' যিনি নাকি ভারতের উত্তর প্রদেশ রাজ্যের ফৈজাবাদ শহরে বসবাস করেন।[৪৪] ঐতিহাসিক সুগত বসুর মত এরকমই:

২০০২ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসে, তিনি (বিচারপতি মহোদয়) সুভাষচন্দ্রের পরিবারকে একাধিক চিঠিতে এক মিলিলিটার রক্তদান করতে বলেন, 'এক গুমনামী বাবা'র সঙ্গে ডিএনএ মেলানোর জন্যে, 'কিছু লোক' অভিযোগ করেন, "অন্য কেউ নন সুভাষচন্দ্র বসু। এরকম উদ্ভট তত্ত্ব স্বাভাবিকভাবেই প্রমাণিত হয়নি।"[৪৪]

শুরুতে, ১৯৭৭ খ্রিস্টাব্দে, এ পর্যন্ত বর্তমান সুভাষচন্দ্রের উপকথাগুলো সাজিয়ে ঐতিহাসিক জয়েস চ্যাপম্যান লেব্রা লিখেছিলেন: 

"গল্পগুলো চালু ছিল যে: নেতাজি অসম রাজ্যের নাগা পাহাড় অঞ্চলে একজন সন্ন্যাসী হয়েছেন; পিকিং শহরে তিনি একজন মঙ্গোলীয় বাণিজ্য প্রতিনধি হয়েছেন; তিনি রাশিয়ায় বাস করেন; তিনি চিনা সেনাবাহিনীতে আছেন। ... নেতাজি এখনো জীবিত আছেন এরকম ছবি হাজির করা হয়েছিল। সুভাষচন্দ্রের পরিবার এক সময় ঘোষণা করেন যে, তিনি অন্তরীণ আছেন এবং যথা সময়ে ভারতে ফিরে আসবেন। ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে সুরেশ চন্দ্র বসু সাংবাদিকদের কাছে ঘোষণা করেন যে, তাঁর ভাই মার্চে ফিরে আসবেন। এপর্যন্ত যাই ঘটুক, তাইওয়ানে বিমান দুর্ঘটনায় মৃত্যুর খবরে বিতর্ক জাগিয়ে সুভাষচন্দ্রের পুনরাবির্ভাব ঘটেনি। কিন্তু কাহিনি চালু থাকল।"[৪৫]

উপকথাগুলোর স্থায়িত্বের সম্ভাবনা

[সম্পাদনা]

ইতিহাসবেত্তা ক্রিস্টোফার বেলি এবং টিম হার্পারের মতে:

'নেতাজি' সুভাষচন্দ্রের জীবিত থাকার উপকথা পরাজিত হওয়া আজাদ হিন্দ ফৌজকে একসঙ্গ যুক্ত হতে সাহায্য করেছিল। বাংলায় এটা রাজ্যের মধ্যে মাতৃভূমির স্বাধীনতার প্রধান গুরুত্বপূর্ণ আশ্বাসের জায়গা তৈরি করেছিল। এটা ভারত এবং দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার অনেকেরই নৈতিক অবস্থা বজায় রেখেছিল, যারা ব্রিটিশের ফিরে আসায় বিলাপ করেছিল অথবা রাজনৈতিক বন্দোবস্ত চূড়ান্তভাবে গান্ধি এবং নেহরু দ্বারা অর্জিত হয়েছিল।[]

এই সবের মধ্যে, জয়েস চ্যাপম্যান লেব্রা[৪৬]২০০৮ খ্রিস্টাব্দে লিখেছেন:

"জাপানিদের সব সময়ের ইচ্ছা চিতাভস্ম বাংলায় ফিরুক, কেননা, তারা বিশ্বাস করে যে, চিতাভস্ম গৃহে না-আনা পর্যন্ত আত্মার শান্তি হয়না। নেতাজির চিতাভস্ম বাংলায় আনার ব্যাপারে যাই হোক, যেমন, এক বছর ২৩ জানুয়ারি নেতাজির জন্মদিনে কলকাতায় নেতজি রিসার্চ ব্যুরোর সম্মেলনে উত্তেজনাপূর্ণ হই হট্টগোল হয়েছিল। প্রগতিবাদী বাঙালি যুবকরা মাথা গরম করে হুড়মুড়িয়ে সম্মেলন হলে ঢুকে, যেখানে আইএনএ প্রতিষ্ঠাতা ফুজিওয়ারার জমায়েতে ভাষণ দেওয়ার কথা ছিল, তাকে কটূকথা বলে চিৎকার করতে থাকে। আপাতদৃষ্টিতে কিছু সংবাদপত্র একটা গুজব প্রকাশ করেছিল যে, ফুজিওয়ারা নেতাজির চিতাভস্ম এদেশে এনেছে।"[৪৬] 

অনুসন্ধানগুলো

[সম্পাদনা]

ফিগেস রিপোর্ট, ১৯৪৬

[সম্পাদনা]

সুভাষচন্দ্রের মৃত্যুর পরপরই তাঁর সম্পর্কে যেসব গুজব রটেছিল, সেগুলোর বিরুদ্ধে লড়বার জন্যে, মাউন্টব্যাটেনকে মাথায় রেখে, সুপ্রিম অ্যালায়েড কম্যান্ড, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, কর্নেল (পরে স্যার) জন ফিগেস নামে এক গোয়েন্দা অফিসারকে সুভাষচন্দ্রের মৃত্যুর তদন্তভার অর্পণ করে।[৩৫] ফিগেসের রিপোর্ট ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ২৫ জুলাই পেশ হয়েছিল, যাই হোক, এটা গোপন ছিল, কাজটা হয়েছিল ইন্ডিয়ান পলিটিক্যাল ইন্টেলিজেন্স (আইপিআই), ভারত সরকারের এক আংশিক গোপন শাখার অধীনে।[৩৫]ঐতিহাসিক লিওনার্দ এ গর্ডন ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দের দশকে ফিগেসের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন এবং রিপোর্ট লেখা নিশ্চিত করেছিলেন।[৩৫]১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার বেশির ভাগ আইপিআই ফাইল ব্রিটিশ লাইব্রেরির ইন্ডিয়া অফিস রেকর্ডস-এ জনসাধারণের দেখার জন্যে ব্যবস্থা করেছিল।[৩৫] যাই হোক, ফিগেস রিপোর্ট সেই সবের মধ্যে ছিলনা। ফিগেস রিপোর্টের একটা ফটোকপি সত্বর সর্বসম্মতভাবে ব্রিটিশ লাইব্রেরিকে দান করা হয়েছিল ইউরোপীয় পাণ্ডুলিপি সংগ্রহ, ইউর. এমএসএস. সি ৭৮৫-তে জনসাধারণের দেখার জন্যে।[১৬] ঐতিহাসিক লিওনার্দ গর্ডনের মতে, দাতার ভালো প্রার্থীর মধ্যে ফিগেস নিজেই ছিলেন, যিনি ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে মারা গিয়েছেন, অথবা খুব সম্ভবত যুদ্ধকালীন ভারতে অন্য একজন ব্রিটিশ গোয়েন্দা অফিসার, হাগ তোয়ে, যে বইয়ের লেখক: তোয়ে, হাগ (১৯৫৯), দ্য স্প্রিঙ্গিং টাইগার: আ স্টাডি অফ দ্য ইন্ডিয়ান আর্মি অ্যান্ড অফ নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোস, Bombay: অ্যালায়েড পাবলিশার্স, আইএসবিএন 978-81-8424-392-5 [১৬]

ফিগেস রিপোর্টের মধ্যে কঠোর অনুচ্ছেদটা (কর্নেল জন ফিগেস কৃত, ইন্ডিয়ান পলিটিক্যাল ইন্টেলিজেন্স, ২৫ জুলাই, ১৯৪৬) হল:[১৬]

"একটা ধারাবাহিক ব্যক্তিদেরকে জিজ্ঞাসাবাদের ফলাফল অনুযায়ী যে নাম নিচের অনুচ্ছেদগুলোতে আছে, অবশ্যই এটা নিশ্চিত করে বলা যায় যে, সুভাষচন্দ্র বোস ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ১৮ অগস্ট, তাইহোকু সেনা হাসপাতালে স্থানীয় সময় বিকেল পাঁচটা থেকে রাত আটটার মাঝামাঝি কোনো সময়ে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছেন। মৃত্যুর কারণ ছিল বহুল পরিমাণে পুড়ে যাওয়া এবং আঘাতের কারণে হৃৎস্পন্দন বন্ধ হয়ে যাওয়া। নিচে যাদের নাম দেওয়া হয়েছে তাদের বিভিন্ন সময়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল কিন্তু তারা বিভিন্ন জিনিস এবং সব বিষয়ে বিস্তৃত যেখানে তাদের জ্ঞান একটা সাধারণ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত। যেহেতু জিজ্ঞাসাবাদের আগে তাদের মধ্যে কোনো যোগাযোগের সুযোগ ছিলনা, বেশির ভাগ ব্যক্তিই আলাদা ছিল, তাই নিজেদের মনগড়া পূর্বনির্ধারিত সাজানো কথা বলার জো ছিলনা।"

শাহ নওয়াজ কমিটি ১৯৫৬

[সম্পাদনা]

১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের অগস্ট মাসের মাঝামাঝি সুভাষচন্দ্র বসু সম্পর্কে কী ঘটেছে, সেইসব গুজবকে থামানোর জন্যে, ভারত সরকার ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে শাহ নওয়াজ খান-এর নেতৃত্বে একটা তিন সদস্যের কমিটি নিয়োগ করে।[৩৬][২৯] শাহ নওয়াজ খান এক সময় সংসদ সদস্য ছিলেন, একই সঙ্গে তিনি আজাদ হিন্দ ফৌজের একজন লেফ্টেন্যান্ট কর্নেল এবং এক দশক আগে স্বনামধন্য আইএনএ ট্রায়াল-এর সমর্থক ছিলেন।[৩৬][২৯] কমিটির অন্য সদস্যদের একজন ছিলেন এস এন মৈত্র, আইসিএস, যিনি পশ্চিমবঙ্গ সরকার দ্বারা মনোনীত হয়েছিলেন, এবং অন্যজন ছিলেন সুভাষচন্দ্রের দাদা, সুরেশ চন্দ্র বসু।[৩৬][[২৯] এই কমিটি "শাহ নওয়াজ কমিটি" অথবা "নেতাজি অনুসন্ধান কমিটি" নামে পরিচিত ছিল।[৩৬]

১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল থেকে জুলাই, এই কমিটি ভারত, জাপান, থাইল্যান্ড এবং ভিয়েতনামে ৬৭ জন সাক্ষীর সাক্ষাৎকার নিয়েছে।[৩৬][২৯] বিশেষ করে, এই কমিটি বিমান দুর্ঘটনায় বেঁচে ফেরা মানুষদেরই সাক্ষাৎকার নিয়েছিল, যার মধ্যে কয়েকজনের শরীরে পুড়ে যাওয়ার ক্ষতচিহ্ন ছিল।[৩৬]কমিটি ডা. ইয়োশিমিকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল, যিনি তাইহোকু সেনা হাসপাতালে সুভাষচন্দ্রের শেষ সময়ে তাঁর চিকিৎসা করেছিলেন।[৩৬] তারা ও উড়ানে সুভাষচন্দ্রের ভারতীয় সহযাত্রী, হাবিবুর রহমানেরও সাক্ষাৎকার নিয়েছিল, যিনি দেশ ভাগের পর, পাকিস্তানে চলে গিয়েছিলেন এবং বিমান দুর্ঘটনায় তাঁর শরীরে পোড়া ক্ষত ছিল।[৩৬] যদিও প্রমাণের মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে কিছু অসামঞ্জস্য সেখানে ছিল, কমিটির প্রথম দুজন সদস্য, শাহ নওয়াজ খান এবং এস এন মৈত্র, সিদ্ধান্তে এসেছিলেন যে, ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ১৮ অগস্ট তাইহোকু বিমান দুর্ঘটনায়ই সুভাষচন্দ্রের মৃত্যু হয়েছে।[৩৬][২৯]

সুভাষচন্দ্রের দাদা সুরেশ চন্দ্র বসু, যেভাবেই হোক, প্রাথমিক সিদ্ধান্তে স্বাক্ষর করার পর চূড়ান্ত রিপোর্টে স্বাক্ষর করতে অস্বীকার করেন।[৩৬] এমনকি তিনি ভিন্নমত পোষণ করে একটা নোট লেখেন, যেখানে তিনি অভিযোগ করেন যে, শাহ নওয়াজ কমিটির অন্য সদস্যরা ইচ্ছাকৃতভাবে তাঁর কাছ থেকে কিছু কঠোর প্রমাণ আটকে রেখেছেন, কেননা কমিটি জওহরলাল নেহরু কর্তৃক নির্দেশিত হয়েছে যে, সিদ্ধান্ত হোক মৃত্যু বিমান দুর্ঘটনায় হয়েছে, এবং কমিটির অন্য সদস্যরা, এর পাশাপাশি বাংলার মুখ্যমন্ত্রী বি সি রায়, স্পষ্টভাবে চাপ সৃষ্টি করছিলেন যাতে শেষে তাঁদের চূড়ান্ত রিপোর্টে স্বাক্ষর করেন।[৩৬][২৯]

ঐতিহাসিক লিওনার্দ গর্ডনের মতানুযায়ী,[৩৬]

"১৮১ পৃষ্ঠার পুনরাবৃত্তিতে পূর্ণ দলিলের মধ্যে যেটাতে সুরেশ চন্দ্র বসুর রিপোর্ট তৈরি হয়েছিল, যে বিষয়ের প্রমাণ একটা প্রধান নীতিতে পুনঃপ্রকাশিত হয়েছিল: যদি দুই বা তার বেশি গল্প সাক্ষীদের দ্বারা বানানোতে তাদের মধ্যে গরমিল থাকে, তখন পুরো সাক্ষীদের প্রামাণিক তথ্যগুলো অখ্যাতিপূর্ণ এবং ভুয়ো বলে মনে হয়। এই নীতি ব্যবহার করে, সুরেশ চন্দ্র সক্ষম হন ... দেখা যাচ্ছে যে, সেখানে কোনো সংঘর্ষ হয়নি এবং তাঁর ভাই বেঁচে আছেন। একটা আধা-বিবৃত অনুমান সামনে আসে: সুভাষচন্দ্র বসু ভারতের স্বাধীনতা প্রাপ্তির আগে মারা যাননি। সুতরাং যেটা বলা হয়েছিল যে, ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ১৮ অগস্ট বিমান দুর্ঘটনা হয়ছিল, সেখানে তাঁর মৃত্যু হয়নি।"[৩৬]

খোসলা কমিশন ১৯৭০

[সম্পাদনা]

দুই দশক পর, ১৯৭৭ খ্রিস্টাব্দে শাহ নওয়াজ কমিটি তার রিপোর্ট পেশ করেছিল, ঐতিহাসিক জয়েস চ্যাপম্যান লেব্রা সুরেশ চন্দ্র বসুর ভিন্নমতে প্রকাশিত নোট সম্পর্কে লেখেন: "সুরেশ চন্দ্রের সংখ্যালঘু রিপোর্ট সম্পর্কে যে উদ্দেশ্যই থাক না কেন, সুভাষচন্দ্র বসু যে এখনো বেঁচে আছেন, এ পর্যন্ত এই বিশ্বাসকে তিনি চিরস্থায়ী করেছিলেন।"[২৯]ঘটনাচক্রে, ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দের দশক জুড়ে সুভাষচন্দ্র সম্পর্কে গুজব উত্তরোত্তর বেড়েই গিয়েছিল।[৩৭]

১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে ভারত সরকার সুভাষচন্দ্রের 'অন্তর্ধান' নিয়ে তদন্ত করার জন্যে একটা নতুন কমিশন নিয়োগ করে।[৩৭]অনেক সংখ্যালঘু রিপোর্টকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে, এই সময় এটা ছিল 'এক সদস্যের কমিশন'।[৩৭]একজন তদন্তকারী ছিলেন, পাঞ্জাব উচ্চ ন্যায়ালয়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি জি ডি খোসলা।[৩৭] বিচারপতি খোসলা অন্যান্য কাজে যুক্ত থাকায় তিনি শুধুমাত্র ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে তাঁর রিপোর্ট পেশ করেন।[৩৭]

বিচারপতি খোসলা তাঁর আইনি অতীত থেকে একটা পদ্ধতিগত কায়দায় এই বিষয়ে কাজ করেছিলেন,[৪৭] শুধু যে ফিগেস এবং শাহ নওয়াজ কমিটির সুভাষচন্দ্রের মৃত্যুর আসল তথ্য সম্পর্কিত রিপোর্টের সঙ্গে সহমতের ভিত্তিতে, [৪৭] তা নয়, উপরন্তু সুভাষচন্দ্রের অন্তর্ধান এবং নেতাজির সাক্ষাৎ পাওয়ার গল্পগুলোর প্রচারের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বিকল্প ব্যাখ্যার মূল্যায়নও করেছিলেন।[৩৭] ঐতিহাসিক লিওনার্দ গর্ডন লিখেছেন:  

"বিচারপতি খোসলার পরামর্শ অনুযায়ী বেশির ভাগ গল্প-সংগ্রাহক ততটা পরার্থবাদসম্মত ছিলনা। কিছু গল্প ফাঁদার ব্যক্তি সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন, তারা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত ছিল অথবা নিজেদের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছিল। এসম্পর্কে কিছু কাহিনি শোনার জন্যে তাঁর ধৈর্য ছিল অবশ্যই লক্ষ করার মতো। তিনি, অথবা যে কেউ কী ভাবছেন, তা শুনেছিলেন, যেমন, শোলাপুরের সেন্ট্রাল ব্যাঙ্কের এজেন্ট পি এম করেপুকার, যিনি '... দাবি করেন যে, তিনি বেতার গ্রাহক যন্ত্রের মতো তাঁর শরীরে সুভাষচন্দ্রের কাছ থেকে সরাসরি বার্তা পান'।[৩৭]

মুখার্জি কমিশন ২০০৫

[সম্পাদনা]

১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে আদালতের আদেশ মোতাবেক, ভারত সরকার সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মনোজ কুমার মুখোপাধ্যায় মহাশয়কে সুভাষচন্দ্রের মৃত্যুর সত্যতা প্রমাণ করার জন্যে নিয়োগ করে। এই কমিশন বিভিন্ন দেশ থেকে সুভাষচন্দ্রের মৃত্যু নিয়ে ব্যাখ্যা করা বিষয়ের ওপর শতাধিক ফাইল পর্যালোচনা করেছিল এবং জাপান, রাশিয়া ও তাইওয়ান সফর করেছিল। যদিও মুখে বলা হয়েছিল যে, সুভাষচন্দ্রের মৃত্যু হয়েছে বিমান দুর্ঘটনায়, কমিশন সিদ্ধান্তে পৌঁছায়, তার মধ্যেই সুভাষচন্দ্রকে নিরাপদে রাশিয়ায় পাঠানোর একটা গোপন পরিকল্পনা ছিল, যে ব্যাপারটা জাপানি কর্তৃপক্ষ এবং হাবিবুর রহমানের জানা ছিল। মুখার্জি কমিশনের উপলব্ধি ছিল: রেনকোজি মন্দিরে চিতাভস্ম রাখা হয়েছিল, যা সুভাষচন্দ্রের বলে প্রচার করা হয়েছিল, সেটা আদতে ছিল ইকিরো ওকুরা নামে এক জাপানি সৈনিকের, যিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছিলেন।[৪৮] মুখার্জি কমিশন তার রিপোর্ট পেশ করে ২০০৫ খ্রিস্টাব্দের ৮ নভেম্বর। ওই রিপোর্ট ভারতীয় সংসদে আলোচিত হয় ২০০৬ খ্রিস্টাব্দের ১৭ মে। তৎকালীন ভারত সরকার মুখার্জি কমিশনের রায়কে বাতিল করে দেয়।[৪৮]

জাপান সরকারের রিপোর্ট ১৯৫৬, উন্মুক্ত: সেপ্টেম্বর ২০১৬

[সম্পাদনা]

'প্রয়াত সুভাষচন্দ্র বসুর মৃত্যু এবং অন্যান্য বিষয় নিয়ে তদন্ত' শিরোনামে জাপান সরকার দ্বারা তদন্তমূলক একটা রিপোর্ট ২০১৬ খ্রিস্টাব্দের ১ সেপ্টেম্বর উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। ওই রিপোর্টে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল যে, সুভাষচন্দ্র বসু ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ১৮ অগস্ট তাইওয়ানে এক বিমান দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন। ওই রিপোর্ট ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দের জানয়ারি মাসে সম্পূর্ণ হয়েছিল এবং টোকিও শহরে ভারতীয় রাষ্ট্রদূতাবাসে হস্তান্তর করা হয়েছিল, কিন্তু ওই রিপোর্ট গোপন রাখার কারণে ৬০ বছরের বেশি সময় ধরে জনসমক্ষে আসেনি। রিপোর্ট অনুযায়ী, উড়ান আকাশে ওঠার পরপরই সুভাষচন্দ্র যে বিমানে সফর করছিলেন, সেই বিমানপোতের চালক-পাখা ভেঙে ইঞ্জিনটা ভূমিতে পড়ে যায়, যেটা সংঘর্ষে বিস্ফারিত হয়ে জ্বলন্ত আগুনে পরিণত হয়। যখন সুভাষচন্দ্র ধ্বংসাবশেষ থেকে বেরিয়ে আসেন তার পোশাকে আগুন লেগে যায় এবং তিনি মারাত্মকভাবে পুড়ে যান। তাঁকে হাসপাতালে ভরতি করা হয়, এবং যদিও তখন তার জ্ঞান ছিল ও তিনি কিছু সময়ের জন্যে কথা বলতে পারছিলেন, কয়েক ঘণ্টা পরে তার মৃত্যু হয়।[৪৯][৫০]

তথ্যসূত্র

[সম্পাদনা]

ব্যাখ্যামূলক টীকা

[সম্পাদনা]

উদ্ধৃতিসমূহ

[সম্পাদনা]
  1. "If all else failed (Bose) wanted to become a prisoner of the Soviets: 'They are the only ones who will resist the British. My fate is with them. But as the Japanese plane took off from Taipei airport its engines faltered and then failed. Bose was badly burned in the crash. According to several witnesses, he died on 18 August in a Japanese military hospital, talking to the very last of India's freedom."[]
  2. "The retreat was even more devastating, finally ending the dream of liberating India through military campaign. But Bose still remained optimistic, thought of regrouping after the Japanese surrender, contemplated seeking help from Soviet Russia. The Japanese agreed to provide him transport up to Manchuria from where he could travel to Russia. But on his way, on 18 August 1945 at Taihoku airport in Taiwan, he died in an air crash, which many Indians still believe never happened."[]
  3. "British and Indian commissions later established convincingly that Bose had died in Taiwan. These were legendary and apocalyptic times, however. Having witnessed the first Indian leader to fight against the British since the great mutiny of 1857, many in both Southeast Asia and India refused to accept the loss of their hero."[]
  4. "There are still some in India today who believe that Bose remained alive and in Soviet custody, a once and future king of Indian independence. The legend of 'Netaii' Bose's survival helped bind together the defeated INA. In Bengal it became an assurance of the province's supreme importance in the liberation of the motherland. It sustained the morale of many across India and Southeast Asia who deplored the return of British power or felt alienated from the political settlement finally achieved by Gandhi and Nehru.[]
  5. "On March 21, 1944, Subhas Bose and advanced units of the INA crossed the borders of India, entering Manipur, and by May they had advanced to the outskirts of that state's capital, Imphal. That was the closest Bose came to Bengal, where millions of his devoted followers awaited his army's "liberation." The British garrison at Imphal and its air arm withstood Bose's much larger force long enough for the monsoon rains to defer all possibility of warfare in that jungle region for the three months the British so desperately needed to strengthen their eastern wing. Bose had promised his men freedom in exchange for their blood, but the tide of battle turned against them after the 1944 rains, and in May 1945 the INA surrendered in Rangoon. Bose escaped on the last Japanese plane to leave Saigon, but he died in Formosa after a crash landing there in August. By that time, however, his death had been falsely reported so many times that a myth soon emerged in Bengal that Netaji Subhas Chandra was alive—raising another army in China or Tibet or the Soviet Union—and would return with it to "liberate" India.[]
  6. "Rumours that Bose had survived and was waiting to come out of hiding and begin the final struggle for independence were rampant by the end of 1945."[]
  7. "Marginalized within Congress and a target for British surveillance, Bose chose to embrace the fascist powers as allies against the British and fled India, first to Hitler's Germany, then, on a German submarine, to a Japanese-occupied Singapore. The force that he put together ... known as the Indian National Army (INA) and thus claiming to represent free India, saw action against the British in Burma but accomplished little toward the goal of a march on Delhi. ... Bose himself died in an airplane crash trying to reach Japanese-occupied territory in the last months of the war. His romantic saga, coupled with his defiant nationalism, has made Bose a near-mythic figure, not only in his native Bengal, but across India. It is this heroic, martial myth that is today remembered, rather than Bose's wartime vision of a free India under the authoritarian rule of someone like himself."[]
  8. "THE MYTH: But Bose had become a myth in his own lifetime, dating from the time he eluded house arrest and escaped from India to Afghanistan and Europe. Thousands of Indians refused to believe he was dead. Man is very mortal but myths die hard."[৩২]

বর্ণনসমূহ

[সম্পাদনা]
  1. Bayly ও Harper 2007, পৃ. 2a।
  2. Bandyopādhyāẏa 2004, পৃ. ৪২৭।
  3. Bayly ও Harper 2007, পৃ. 2b।
  4. Bayly ও Harper 2007, পৃ. ২২।
  5. Wolpert 2000, পৃ. 339–340।
  6. Bayly ও Harper 2007, পৃ. ২।
  7. Metcalf ও Metcalf 2012, পৃ. ২১০।
  8. Fay 1995, পৃ. ৩৭২।
  9. Fay 1995, পৃ. ৩৭৩।
  10. Fay 1995, পৃ. ৩৭৪।
  11. Fay 1995, পৃ. ৩৭৬।
  12. Fay 1995, পৃ. ৩৭৬–৩৮০।
  13. Fay 1995, পৃ. ৩৭৭–৩৭৯।
  14. Lebra 2008a, পৃ. ১৯৪–১৯৫।
  15. Fay 1995, পৃ. ৩৮০।
  16. Gordon 2006, পৃ. ১১০।
  17. Fay 1995, পৃ. ৩৮২।
  18. Bayly ও Harper 2007, পৃ. ২১।
  19. Lebra 2008a, পৃ. ১৯৫–১৯৬।
  20. Fay 1995, পৃ. ৩৮৩।
  21. Lebra 2008a, পৃ. ১৯৬–১৯৭।
  22. Gordon 1990, পৃ. ৫৪০।
  23. Fay 1995, পৃ. ৩৮৪।
  24. Gordon 1990, পৃ. ৫৪১।
  25. Gordon 1990, পৃ. ৫৪১–৫৪২।
  26. Gordon 1990, পৃ. ৫৪২।
  27. Gordon 1990, পৃ. ৫৪৩।
  28. Gordon 1990, পৃ. ৫৪৪–৫৪৫।
  29. Lebra 2008a, পৃ. ১৯৭–১৯৮।
  30. Gordon 1990, পৃ. ৫৪৫।
  31. Bayly ও Harper 2007, পৃ. 21।
  32. Lebra 2008a, পৃ. ১৯৭।
  33. Hayes 2011, পৃ. ১৬৩।
  34. Hayes 2011, পৃ. ১৬৪।
  35. Gordon 2006, পৃ. ১০৯।
  36. Gordon 1990, পৃ. ৬০৫।
  37. Gordon 1990, পৃ. ৬০৬।
  38. Gordon 1990, পৃ. ৬০৭।
  39. Gordon 1990, পৃ. ৬০৭–৬০৮।
  40. Gordon 1990, পৃ. ৬০৮।
  41. Bhattacharjee 2012
  42. Gordon 1990, পৃ. ৬০৮–৬০৯।
  43. Gordon 1990, পৃ. ৬১০।
  44. Bose 2011, পৃ. ৩১৯।
  45. Lebra 2008a, পৃ. ১৯৮–১৯৯।
  46. Lebra 2008b, পৃ. ১০০।
  47. Gordon 2006, পৃ. ১১০–১১১।
  48. Ramesh 2006
  49. Sonwalkar 2016
  50. NDTV 2016

উৎসসমূহ

[সম্পাদনা]

আরো পড়ুন

[সম্পাদনা]