বিষয়বস্তুতে চলুন

বাংলার মসলিন বাণিজ্য

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
জর্জ ওয়াশিংটনের পরিবারের সদস্যরা মসলিন পরতেন 
নেপোলিয়নের স্ত্রী, সম্রাজ্ঞী জোসেফিন এর মসলিন পরা পেইন্টিং।

মসলিন বিশেষ এক প্রকার তুলার আঁশ থেকে প্রস্তুতকৃত সূতা দিয়ে বয়ন করা এক প্রকারের অতি সূক্ষ্ম কাপড়বিশেষ। ঢাকাবাংলাদেশ এলাকায় এই বস্ত্র তৈরী হত এবং ইউরোপমধ্যপ্রাচ্যে রপ্তানি করা হত।[]

প্রাচীন হস্ত-লিখিত ও মুদ্রিত নথি অনুযায়ী  শত শত বছর ধরে বাংলায় বস্ত্রশিল্পের প্রমাণ পাওয়া যায়। পেরিপ্লাস অব দি ইরিথ্রিয়েইন সী(Periplus of the Erythraean Sea) অনুযায়ী আরব ও গ্রীক ব্যবসায়ীরা দ্বিতীয় শতাব্দীতে ভারত ও লোহিত সাগরের আদুলির (দি ইরিট্রেয়া) মাধ্যমে মিশরে এবং ইথিওপিয়াতে বাণিজ্য করত। সেই সময়ে মসলিন কাপড়এর বিনিময়ে হাতির দাঁত, কচ্ছপের খোল ও গণ্ডার-শিংয়ের আমদানি করা হত। ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন অংশে ইউরোপীয় বণিকদের আসার আগেই গুজরাতে অবস্থিত ভারতের একটি প্রাচীন বন্দর - বারজিজার থেকে মসলিনের ব্যবসার প্রমাণ পাওয়া যায়।[]

রোমানরা মসলিনের খুব কদর করত।বুলিয়ান এবং সোনার কয়েন ব্যবহার করে দাক্ষিণাত্য এবং দক্ষিণ ভারত থেকে তারা মসলিন কিনে নিয়ে যেত।রোমানরাই ইউরোপে প্রথম মসলিন চালু করে, এবং ধীরে ধীরে এটি প্রবল জনপ্রিয়তা লাভ করে।[]

একজন চীনা সমুদ্রযাত্রী মা হুয়ান তার যাত্রাবিবরনীতে পঞ্চদশ শতকের শুরুতে বাংলায় পাঁচ থেকে ছয় রকমের সূক্ষ্ম কাপড়ের উল্লেখ করেছেন। মা হুয়ানের বিবরণ অনুযায়ী বাংলার মসলিন তখন চীনে বেশ মুল্যবান ছিল।

মুঘল যুগে মসলিন

[সম্পাদনা]
মসলিন কাপড় পরিহিত  মুঘল রাজকুমার  ১৬৬৫
অষ্টাদশ শতাব্দীতে বাংলা মসলিন পরিহিত একটি মহিলার চিত্র ঢাকা
একটি জামদানী পরিহিত মহিলা - ১৭৮৭ সালে

মুঘল শাসনের সময় বঙ্গদেশ ছিল গোটা বিশ্বের মসলিন, সিল্ক এবং মুক্তো ব্যবসার কেন্দ্র।[] মুঘল যুগের সময় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তুলা উৎপাদনকেন্দ্র ছিল বঙ্গদেশ বিশেষ করে  ঢাকা শহর ছিল নেতৃস্থানীয়। যার জন্যে মধ্য এশিয়ায় মসলিনকে 'ডাকা/দাকা' বলা হত।[] তখন বঙ্গদেশ থেকে তুলো এবং সিল্কের বিভিন্ন বস্ত্র ইউরোপ, ইন্দোনেশিয়া এবং জাপানে রপ্তানি হত।[] এশিয়া থেকে ডাচদের আমদানিকৃত ৫০% বস্ত্র ও প্রায় ৮০% সিল্ক যেত বঙ্গদেশ থেকে।[]

ষোড়শ শতকে মসলিন

[সম্পাদনা]

ষোড়শ শতাব্দীর প্রথম দিকে, টোমেস পাইরেস নামের একজন পর্তুগীজ ঔষধিপ্রস্তুতকারকের লেখনী অনুযায়ী বাংলার মসলিনগুলি থাইল্যান্ড ও চীনে বিক্রীত হত। মুসলিম বিশ্বের দেশগুলিতে মসলিন ছিল একটি অভিজাত বস্ত্র, এছাড়াও সারা মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতেও মসলিন রপ্তানি করা হত। উসমানীয় শাসনকালের সময় ষোড়শ শতাব্দী থেকে শুরু করে, মধ্যপ্রাচ্যে মসলিন রপ্তানির পরিমাণ অনেক বেড়ে যায়। অটোমানদের মধ্যে মসলিনের পাগড়ি বিশেষ খ্যাতি লাভ করে। ষোড়শ শতাব্দীতে পর্তুগীজরা পারস্য উপসাগরের মাধ্যমে ভারতীয় উপমহাদেশের সাথে বস্ত্রশিল্পের ব্যবসা শুরু করে।[]

সপ্তদশ শতকে মসলিন

[সম্পাদনা]

সতেরো শতকের প্রথম দিকে, ব্রিটিশ ও ডাচ ব্যবসায়ী লোহিত সাগরের মধ্য দিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশের অভিমুখে যাত্রা শুরু করে। একই সময়ে, ইরানের আর্মেনীয় ব্যবসায়ীরা কান্দাহার ও ইস্পাহানের মধ্য দিয়ে জমির পথে ভারতীয় উপমহাদেশে প্রবেশ করেন। তারা বাংলার মসলিনসহ অন্যান্য সুতোজাত দ্রব্যসামগ্রী সিরিয়ার আলেপ্পোতে বিক্রি করতেন। ইস্তাম্বুল বাজারের একটি সরকারী গুদামে ১৬৪০ সালের পুরোনো ২০ ধরনের মসলিন পাওয়া গেছে এবং সর্বোচ্চ মূল্য হিসেবে ১৬০০ সিলভার পেন্স ধরা ছিল। ধীরে ধীরে ব্যবসার প্রসার যত বাড়তে থাকে, ইউরোপীয় কোম্পানিগুলি ঢাকায় তাদের নিজস্ব কারখানা প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী হয়ে ওঠে। ১৬৬৩ খ্রিষ্টাব্দে ডাচরা ঢাকায় তাদের কারখানা স্থাপন করে, ১৬৬৯ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশরা এবং ১৬৮২ সালে ফ্রেঞ্চরা।

অষ্টাদশ শতকে মসলিন

[সম্পাদনা]

অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরুতে অস্টেন্ড কোম্পানি বাংলায় ব্যবসা করতে আসে। তারা এজেন্ট এবং তাদের নিজস্ব কর্মকর্তাদের মাধ্যমে বস্ত্র কেনা শুরু করে।ব্যবসায় লাভ করতে শুরু করলে কম্পানির লোকেরা ঢাকায় বসতি স্থাপন করতে শুরু করে।

পরিসংখ্যান অনুযায়ী ১৭৪৭ সালে ঢাকার বস্ত্রশিল্প পণ্য (প্রধানত মসলিন) এর বাণিজ্যের মুল্য ছিল প্রায় সাড়ে আঠাশ লক্ষ টাকা।[]

১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধের পর ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী বাংলা জয় করে এবং ১৭৬৫ সালে ব্রিটিশ বঙ্গ প্রেসিডেন্সি প্রতিষ্ঠিত হয়। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকীকরণের জন্য়ে বিদেশী পণ্য খোলার জন্য বাজারকে বাধ্য করতে শুরু করে, একই সময়ে ব্রিটেন দেশীয় পন্য নিষিদ্ধ করতে শুরু করে এবং বিভিন্ন সুরক্ষামূলক নীতিমালা প্রণয়ন করে। দেশজ পন্যের উপর উচ্চহারে শুল্ক চাপানো হয় এবং ভারতীয় সামগ্রীর ব্রিটেনে বিক্রয় প্রায় নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়। কাঁচাতুলা গুলি ব্রিটিশ কারখানায় কর বা ট্যারিফ ছাড়াই আমদানি করা হয়, এবং বস্ত্র তৈরীর পর চড়া শুল্ক সহ সেগুলি আবার বাংলায় বিক্রি করা হতে থাকে যা তাদের বস্ত্র তৈরিতে ব্যবহার করে। ব্রিটিশদের অর্থনৈতিক নীতি চালানোর ফলে বাংলায় ডি-ইনডাস্ট্রিয়ালাইজেশন ঘটে।[১০][১১][১২] ঔপনিবেশিকতার এই করাল গ্রাস বাংলাকে এক মহা দুর্ভিক্ষের মধ্যে ঠেলে দেয় যার ফলে বাঙালি জনগোষ্ঠীর এক তৃতীয়াংশের মৃত্যু ঘটে।[১৩]

১৭৮৭ থেকে ১৭৮৮র মধ্যে কিছু প্রাকৃতিক দুর্যোগ নেমে আসে বঙ্গদেশে, ভয়ঙ্কর বন্যা ও তার ফলে দুর্ভিক্ষ বাংলার জনজীবনকে একেবারে সন্ত্রস্ত করে তোলে। এই বিপর্যয়ের পরে দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের বেঁচে থাকার তাগিদে কৃষির দিকে জোর দেওয়া হতে থাকে। শস্য রপ্তানির উপর ট্যাক্স প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। ফলে মানুষ তুলো বোনা ছেড়ে চাষবাসের দিকে মনোযোগ দিতে শুরু করে।

১৭৪২ থেকে ১৭৮৭ সালের মধ্যে ব্রিটেনে শিল্প বিপ্লব শুরু হয় এবং স্থানীয়ভাবে তুলো উৎপাদন করা হতে থাকে। স্বাভাবিক ভাবেই ব্রিটেন থেকে শিল্পজাত বস্ত্রপণ্য আমদানি করার কারণে মসলিন শিল্প ধীরে ধীরে পতনের দিকে এগিয়ে যায়। এর উপরে মসলিনকে পুরোপুরি শেষ করে দেওয়ার জন্যে ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসক বাংলার তুলো রপ্তানির উপর ৭৫ শতাংশ শুল্ক প্রয়োগ করে।পরিশেষে বাংলায় মসলিন বাণিজ্যের পতন ঘটে.

বিগত কয়েক বছর ধরে, মসলিন আবার হ্যান্ডলুমের হাত ধরে বাজারে ফিরে আসছে [১৪]।ফুলিয়ার মসলিন শাড়ি আবার বিদেশে কদর লাভ করতে শুরু করেছে। ফুলের জামদানি প্যাট্যার্নের শাড়ি বোনার জন্যে মসলিন একটি নিখুঁত ব্যাকড্রপ গঠন করে।

পুনর্জন্ম

[সম্পাদনা]

‘বাংলাদেশের সোনালি ঐতিহ্য মসলিন সুতা তৈরির প্রযুক্তি ও মসলিন কাপড় পুনরুদ্ধার (প্রথম পর্যায়)’ প্রকল্পের আওতায় ছয় বছর গবেষণার পর ২০২০ সালে ছয়টি ঢাকাই মসলিন শাড়ি তৈরি করা হয়। আগামীতে এই শাড়ি সর্বসাধারণের জন্য বাজারে আনা সম্ভব হতে পারে। ২০২০ সালের ২৮ ডিসেম্বর ঢাকাই মসলিনকে জিআই ( ভৌগোলিক নির্দেশক) স্বত্বের অনুমোদন দেয়া হয়।[১৫]

আরও দেখুন

[সম্পাদনা]
  • From Muslin To Museum: The Rise and Fall of Bengal’s Textile Empire-1,2 & 3 

তথ্যসূত্র

[সম্পাদনা]
  1. Muslin 
  2. Ashmore, Sonia (২০১২)। Muslin (Sonia Ashmore), Page 11। V&A Publishing। আইএসবিএন 9781851777143। ১৬ আগস্ট ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৫ এপ্রিল ২০১৮ 
  3. Naushad, Naveed (১৫ ডিসেম্বর ২০১৫)। "The Muslin Story"। The Daily Star। সংগ্রহের তারিখ ৪ এপ্রিল ২০১৭A favourite of the Romans, muslin was sought by merchants of the Roman empire and subsequently reached other parts of Europe. 
  4. Lawrence B. Lesser. "Historical Perspective". A Country Study: Bangladesh (James Heitzman and Robert Worden, editors). Library of Congress Federal Research Division (September 1988). This article incorporates text from this source, which is in the public domain.About the Country Studies / Area Handbooks Program: Country Studies - Federal Research Division, Library of Congress
  5. Richard Maxwell Eaton (1996), The Rise of Islam and the Bengal Frontier, 1204-1760, page 202, University of California Press
  6. John F. Richards (1995), The Mughal Empire, page 202, Cambridge University Press
  7. Om Prakash, "Empire, Mughal", History of World Trade Since 1450, edited by John J. McCusker, vol. 1, Macmillan Reference USA, 2006, pp. 237-240, World History in Context, accessed 3 August 2017
  8. Ashmore, Sonia (২০১২)। Muslin (Sonia Ashmore), Page 12। V&A Publishing। পৃষ্ঠা 12। আইএসবিএন 9781851777143। ১৬ আগস্ট ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৫ এপ্রিল ২০১৮ 
  9. Sarker, Md. Fouad Hossain। "History of Muslin Fabrics of Dhaka"। Daffodil International University। সংগ্রহের তারিখ ২৪ জুলাই ২০১৬ 
  10. James Cypher (২০১৪)। The Process of Economic DevelopmentRoutledge 
  11. Junie T. Tong (2016), Finance and Society in 21st Century China: Chinese Culture Versus Western Markets, page 151, CRC Press
  12. Broadberry, Stephen; Gupta, Bishnupriya (২০০৫)। "Cotton textiles and the great divergence: Lancashire, India and shifting competitive advantage, 1600-1850" (পিডিএফ)International Institute of Social History। Department of Economics, University of Warwick। সংগ্রহের তারিখ ৫ ডিসেম্বর ২০১৬ 
  13. Kumar, Dharma and Meghnad Desai, eds. The Cambridge Economic History of India: Volume 2, c.1751-c.1970 (1983).
  14. Muslin, Sarees। "Muslin Silk Sarees"sareesofbengal.com। ৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৫ এপ্রিল ২০১৮ 
  15. ঢাকাই মসলিনের পুনর্জন্ম, প্রথম আলো, ৩১ ডিসেম্বর ২০২০

আরও পড়ুন

[সম্পাদনা]