বিষয়বস্তুতে চলুন

মুর্শিদাবাদী রেশম

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

মুর্শিদাবাদী রেশম পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলায় উৎপাদিত হয়। এই রেশম তুঁত গাছে পালিত তুঁত বা পলু পোকা থেকে উৎপাদিত হয়।

প্রাচীনকালে বঙ্গ বা বাংলা ছিল ভারতের প্রধান রেশম-বয়ন কেন্দ্র। মুর্শিদাবাদী রেশমের উৎপাদন ত্রয়োদশ শতকে শুরু হয়েছিল, এবং এই রেশমের প্রতি বৈদেশিক ব্যবসায়ীরা ১৭তম শতাব্দীর প্রথম দিকে আকৃষ্ট হয়েছিল। রেশম ছিল বঙ্গীয় অর্থনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পণ্যগুলির মধ্যে একটি, যা এই অঞ্চলের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করত।[]

"ওয়েস্ট বেঙ্গল ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব জুরিডিকাল সায়েন্সেস" (ডব্লিউবিএনইউজেএস) ২০২৩ সালের মে মাসে মুর্শিদাবাদী রেশম সহ পশ্চিমবঙ্গের ১১টি পণ্যের জিআই ট্যাগের জন্য আবেদন করে।[]

ইতিহাস

[সম্পাদনা]

রেশমের উৎপাদন সর্বপ্রথম চীনে শুরু হয়েছিল। মধ্যযুগে বঙ্গীয় অঞ্চলে রেশমের উৎপাদন শুরু হয়, যা সেই সময়ে বেঙ্গল সিল্ক বা বাংলার রেশম নামে পরিচিতি লাভ করেছিল।[] বেঙ্গল সিল্কের উৎপাদন ক্ষেত্র বর্তমানযুগের মুর্শিদাবাদ, মালদা ও রাজশাহী অঞ্চলে বিকশিত হয়েছিল। ইউরোপীয় বণিকেরা ১৭তম শতাব্দীতে মুর্শিদাবাদ, মালদা ও রাজশাহীতে কুঠি বা বাণিজ্যিক কেন্দ্র স্থাপন করেছিল, তাদের উদ্দেশ্য ছিল বাংলার রেশম ও রেশমজাত পণ্যসমূহ ইউরোপে রপ্তানি করা।[] উৎপাদন স্থলের ভিন্নতার কারণে বাংলার রেশম ধীরে ধীরে মুর্শিদাবাদী রেশম, রাজশাহী রেশমমালদা রেশম নামে পরিচিতি লাভ করতে শুরু করেছিল।[][]

বৈদেশিক ব্যবসায়ীরা ১৭তম শতাব্দীকের প্রথম দিকে মুর্শিদাবাদী রেশমের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। তারা বেঙ্গল সিল্ককে মুর্শিদাবাদ সিল্ক হিসাবে উল্লেখ করতে শুরু করেন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৬৫৮ খ্রিস্টাব্দে কাশিমবাজারে কুঠি স্থাপন করেছিল, তাদের মূল লক্ষ্য ছিল মুর্শিদাবাদ অঞ্চলে উৎপাদিত রেশম ইউরোপে রপ্তানি করা। পরবর্তী সময়ে, মুর্শিদাবাদ রেশমের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ডাচ, পর্তুগীজ ও ফরাসীরা কাশিমবাজারে কুঠি স্থাপন করেছিল।[][][][]

পলাশী যুদ্ধে বাংলার নবাবা পরাজিত হয়, পরবর্তীকালে বাংলার নিয়ন্ত্রণ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধিনে চলে যায়। কোম্পানি মুর্শিদাবাদ থেকে কাঁচামাল ব্রিটেনে রপ্তানি শুরু করে, ফলে মুর্শিদাবাদ রেশম সহ বাংলার রেশম শিল্প রুঘ্ন হতে শুরু করে। লোকসানের কারণে কারখানাগুলি ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে বন্ধ করা হয়েছিল। এই সময়ে মুর্শিদাবাদ রেশম শিল্প ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যায়।[][]

ভারতের স্বাধীনতার পরে, ইউনিয়ন ও রাজ্য সরকারের সহায়তায় মুর্শিদাবাদী রেশম বিকশিত হতে শুরু করে। বর্তমান সময়ে, মুর্শিদাবাদ জেলা হল পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে দ্বিতীয় ও ভারতের মধ্যে তৃতীয় বৃহত্তম রেশম উৎপাদনকারী জেলা।

উৎপাদন সমস্যা

[সম্পাদনা]

মুর্শিদাবাদী রেশম শিল্প একটি সমৃদ্ধ ঐতিহাসিক উত্তরাধিকার বহন করে, যদিও বর্তমানে একটি কঠিন পর্যায়ে মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বিপুল সংখ্যক রেশম চাষিদের পাশাপাশি তাঁতিরাও শিল্প ছেড়ে চলে যাচ্ছে। রেশম চাষি ও তাঁতিদের মোট সংখ্যা ২০০২ সালে ছিল যথাক্রমে ৩৮,০৪০ ও ২৫,৭৭৮, যা ২০১২ সালে ১৪,৫৯৩ ও ১৫,১৬০-এ নেমে আসে।[]

বিশেষজ্ঞদের মতে, রেশম কীট প্রজাতির অবক্ষয়, বিভিন্ন প্রশাসনিক ও সাংগঠনিক সমস্যা রেশম চাষের পতনের জন্য দায়ী। জলবায়ু পরিবর্তন, খরা ও বন্যার মতো পরিস্থিতির কারণে তুঁত উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে। একইভাবে, দরিদ্র কৃষকরা যারা ব্যাংক থেকে সহজে ঋণ নিতে ব্যর্থ হয় তারা কম পরিমাণে কাঁচা রেশম উৎপাদন করতে বাধ্য হয়। বৃহৎ শহরে আকর্ষণীয় চাকরির সুযোগ, ভাল ও সময়মত মজুরি এবং জীবনযাত্রার অন্যান্য সুযোগ চাষি ও তাঁতিদের রেশম উৎপাদন থেকে বিমুখ করেছে।[]

উৎপাদিত দ্রব্য

[সম্পাদনা]

মুর্শিদাবাদী রেশম থেকে মূলত শাড়ি তৈরি করা হয়। মুর্শিদাবাদী রেশম শাড়িতে ময়ূরকণ্ঠী নীল জমিন আর তার সোনালি পাড়, আঁচলে রঙিন ঝুমকো বা ঢালাও স্বর্ণালি জরির কারুকাজ, নির্ঝরা লতাপাতার আলংকারিক রূপটান এবং নিবিড় বুনন বা জরির দ্বারা তৈরি ফুল-পাখির চিত্র দেখা যায়।

বালুচরী
মুর্শিদাবাদ জেলার জিয়াগঞ্জের কাছে বালুচর নামের এক এলাকা থেকে উৎপত্তি।[][] মুর্শিদাবাদী রেশম দিয়ে বালুচরী শাড়ি তৈরি করা হয়, পরবর্তীতে তুলো থেকে তাঁতের বালুচরী, আবার বাঁশ, কলা ইত্যাদি গাছ থেকে পাওয়া সুতো থেকেও বালুচরী শাড়ি তৈরি করা হয়।
গরদ
মুর্শিদাবাদী রেশম থেকে তৈরি গরদের শাড়ির সুখ্যাতি রয়েছে। এই শাড়ি মূলত মুর্শিদাবাদ জেলার মির্জাপুরে উৎপাদিত হয়।[]

মুর্শিদাবাদী রেশম থেকে জামদানি শাড়িও তৈরির করা হয়। শাড়ি ছাড়াও অন্যান্য বস্ত্র উৎপাদনে মুর্শিদাবাদী রেশমের ব্যবহার দেখা যায়, যেমন শেওয়ানি।

তথ্যসূত্র

[সম্পাদনা]
  1. "Murshidabad Silk : The Story of Golden Threads"www.shoestringtravel.in (ইংরেজি ভাষায়)। ১০ নভেম্বর ২০১৯। সংগ্রহের তারিখ ১৬ আগস্ট ২০২৩ 
  2. এমডি আসলাম হোসেন (১৪ মে ২০২৩)। "মুর্শিদাবাদের সিল্ক, সুন্দরবনের মধু, বাংলার আরও ১১ পণ্যের GI ট্যাগের জন্য আবেদন"। হিন্দুস্তান টাইমস - বাংলা। হিন্দুস্তান টাইমস। সংগ্রহের তারিখ ১৬ আগস্ট ২০২৩ 
  3. R.k.datta (২০০৭)। Global Silk Industry: A Complete Source Book। APH Publishing। পৃষ্ঠা 16-17। আইএসবিএন 978-8131300879। সংগ্রহের তারিখ ১৬ আগস্ট ২০২৩ 
  4. Roy, Chandan; Dey, Arindam (২০১৮)। "Murshidabad Silk Industry in West Bengal: A Study of Its Glorious Past & Present Crisis"। SSRN Electronic Journal। Vol 59(2): 1–15। ডিওআই:10.2139/ssrn.3357589 
  5. "রেশম যুগের মুর্শিদাবাদ"www.banglanews24.com। ২ মে ২০১৭। সংগ্রহের তারিখ ১৬ আগস্ট ২০২৩ 
  6. "Rasham Krishi barta" (পিডিএফ)Rasham Krishi barta: 1–4। ২০১৬। সংগ্রহের তারিখ ১৬ আগস্ট ২০২৩ 
  7. "তেলঙ্গানা থেকে গুজরাত, ভারতের বিখ্যাত শাড়িগুলির উদ্ভাবন এই অঞ্চলগুলিতেই"Anandabazar। Anandabazar Patrika। ১৩ ডিসেম্বর ২০২২। সংগ্রহের তারিখ ১৬ আগস্ট ২০২৩ 
  8. Biman Hazra (১১ এপ্রিল ২০২২)। "বালুচরিতে এ বার কর্ণসুবর্ণের ধ্বংসাবশেষচিত্রও"Anandabazar। Mirzapur: Anandabazar Patrika। সংগ্রহের তারিখ ১৬ আগস্ট ২০২৩