স্টেলা ক্রামরিশ

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
ড.

স্টেলা ক্রামরিশ
স্টেলা ক্রামরিশ, ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দে ফিলাডেলফিয়া আর্ট মিউজিয়াম
জন্ম(১৮৯৬-০৫-২৯)২৯ মে ১৮৯৬
নিকলসবার্গ, অস্ট্রিয়া
মৃত্যু৩১ আগস্ট ১৯৯৩(1993-08-31) (বয়স ৯৭)
ফিলাডেলফিয়া, পেনসিলভানিয়া
নাগরিকত্বআমেরিকান
শিক্ষাভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়
পরিচিতির কারণভারতীয় শিল্পের শীর্ষস্থানীয় বিশেষজ্ঞ
দাম্পত্য সঙ্গীলাজলো নেমেনি (মৃ.১৯৫০)
পুরস্কারঅস্ট্রিয়ান ক্রস অফ অনার (বিজ্ঞান ও কলা)
দেশিকোত্তম
পদ্মভূষণ (১৯৮২)
বৈজ্ঞানিক কর্মজীবন
কর্মক্ষেত্রশিল্পের ইতিহাস
প্রতিষ্ঠানসমূহকলা ভবন, শান্তিনিকেতন
অভিসন্দর্ভের শিরোনামভারতে প্রারম্ভিক বৌদ্ধ ভাস্কর্যের সারাংশ (১৯১৯)
উচ্চশিক্ষায়তনিক উপদেষ্টাম্যাক্স ডভোরাক

ড. স্টেলা ক্রামরিশ (২৯ মে ১৮৯৬ - ৩১ আগস্ট ১৯৯৩) একজন অস্ট্রিয়া বংশোদ্ভূত মার্কিন শিল্প ইতিহাসবিদ ও কিউরেটর। বিংশ শতকের তিন দশকের বেশিরভাগ সময়ে ভারতীয় শিল্পের একজন শীর্ষস্থানীয় বিশেষজ্ঞ ছিলেন তিনি। তিন মহাদেশে ছয় দশকেরও বেশি সময় ধরে ভারতীয় শিল্পকলার ইতিহাস নিয়ে গবেষণা ও শিক্ষা প্রদান করে এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। শান্তিনিকেতনের কলা ভবনে, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে, লন্ডনের কোর্টউল্ড ইনস্টিটিউটে, পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা ছাড়াও ফিলাডেলফিয়া মিউজিয়াম অফ আর্ট-এর একজন বিশিষ্ট কিউরেটর ছিলেন। [১] ভারতবন্ধু হয়ে, শুধুমাত্র ভারতের শৈল্পিক ঐতিহ্য নয়, এর অন্তর্নিহিত দর্শন এবং বিশ্বের দৃষ্টিভঙ্গিতে নতুন করে ভারতবিদ্যার দ্যুতি ছড়িয়ে দিয়েছেন সর্বত্র। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে তাকে "দেশিকোত্তম" উপাধি এবং ভারত সরকারও ১৯৮২ খ্রিস্টাব্দে সর্বোচ্চ তৃতীয় বেসামরিক সম্মান পদ্মভূষণ প্রদান করে।[২]  

জন্ম ও শিক্ষাজীবন[সম্পাদনা]

স্টেলা ক্রামরিশ ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দের ২৯ মে অস্ট্রিয়ার নিকলসবার্গে অধুনা চেক প্রজাতন্ত্রের মিকুলভ-এ জন্মগ্রহণ করেন। [৩]শৈশবে অস্ট্রিয়ায় তিনি ব্যালে নৃত্যশিল্পের প্রশিক্ষণ নেন।ক্র্যামরিশের বয়ক্রম যখন দশ বছর, তখন তার মাতাপিতা ভিয়েনায় চলে যান। সেখানে তিনি হাতে পান শ্রীভগবদগীতার এক অনুবাদ। পড়ে মুগ্ধ হন এবং তার আগ্রহ বাড়ে ভারতীয় শিল্প ও সংস্কৃতি বিষয়ে পড়াশোনার। পরবর্তীতে তিনি ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে অধ্যাপক প্রফেসর ম্যাক্স ডভোরাক এবং জোসেফ স্ট্রজিগোভস্কির কাছে শিল্প ইতিহাস বিভাগে অধ্যয়ন করেন । তবে ভারতীয় শিল্প ও সংস্কৃতির উপর তার অধ্যয়নই বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছিল। এছাড়া আয়ত্ত করেন সংস্কৃত, দর্শন, সাহিত্য এবং নৃতত্ত্ব বিষয়ও। ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে অধ্যাপক ম্যাক্স ডভোরাক-এর অধীনে গবেষণার করে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন। গবেষণার বিষয় ছিল - "দ্য এসেন্স অফ আরলি বুদ্ধিষ্ট স্কাল্পচার ইন ইন্ডিয়া"।[৪]

ভারতে কর্মজীবন[সম্পাদনা]

১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে অক্সফোর্ডে তিনটি বক্তৃতা দেওয়ার জন্য স্টেলা ক্রামরিশ এক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি দলের হয়ে লন্ডনে আসেন।এক সভায় ভারতীয় মন্দিরের উপর বক্তব্য রাখছিলেন তিনি। সেখানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর উপস্থিত থেকে তার কথা শুনেছিলেন। তার বক্তব্যে ও ব্যক্তিত্বের কারণে কবিগুরু তাকে ভারতে আসার জন্য আমন্ত্রণ জানান। তিনি আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন এবং ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনায় নিযুক্ত হন। স্টেলা ক্রামরিশ ছিলেন একজন দক্ষ নৃত্যশিল্পী। শান্তিনিকেতনে অবস্থানকালে আশ্রমের শিশুদের 'মিউজিক্যাল ড্রিল' ও জার্মান ভাষা শিখিয়েছিলেন। স্টেলা শান্তিনিকেতনের সমস্ত উৎসব ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতেন। তিনি লিখেছেন -

"Living in the nearness of Dr Tagore makes me realise India in full intensity." 

[৫] তিনি ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভারতীয় শিল্পকলার অধ্যাপক নিযুক্ত হন এবং দীর্ঘ ছাব্বিশ বৎসর (১৯৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত) অধ্যাপনা করেন। বাংলার নকশি কাঁথা, টেরাকোটা, অলঙ্কার, লোকাচার ছিল তার বিশেষ আকর্ষণ। [২] যথাযথ স্থান পেয়েছে তার শৈল্পিক চর্চায়। ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে তার প্রথম মনোগ্রাফ প্রিন্সিপলস অফ ইন্ডিয়ান আর্ট জার্মান ভাষায় প্রকাশিত হয়েছিল এবং সমগ্র ইউরোপের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়েছিল। ১৯২০ এর দশকে ক্র্যামরিশ বক্তৃতা দেওয়ার জন্য ভিয়েনা যান। সেখানকার তার সহকর্মীদের বিভিন্ন প্রবন্ধের ইংরেজি অনুবাদ অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও তার যৌথভাবে সম্পাদিত " ইন্ডিয়ান সোসাইটি অফ ওরিয়েন্টাল আর্টের জার্নাল"-এ ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দ হতে প্রকাশিত হয়েছিল। ভারতীয় ভাস্কর্যের উপর রচিত তার প্রধান গ্রন্থ - "ইন্ডিয়ান স্কাল্পচার'" ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দেই অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস হতে প্রকাশিত হয়। বইটিতে ভারতীয় ভাস্কর্য গভীরভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে এবং বাস্তবে হ্যান্ডবুক হিসাবে ব্যবহৃত হয়।

১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ভারত ও পাকিস্তানের স্বাধীনতা লাভের পর তার স্বামী লাজলো নেমেনি পাকিস্তানের নতুন সরকারের অধীনে কাজ বেছে নেন এবং করাচিতে চলে যান। কিন্ত ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে এক সৈকতে গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়।

যুক্তরাষ্ট্রে কর্মজীবন[সম্পাদনা]

পাকিস্তানে স্বামীর মৃত্যুর পর স্টেলা ক্রামরিশ ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতবিদ ডব্লিউ নরম্যান ব্রাউনের আমন্ত্রণে বিশ্ববিদ্যালয়ে নবগঠিত দক্ষিণ এশিয়া আঞ্চলিক অধ্যয়ন বিভাগে যোগ দেন। ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে অবসর আগে পর্যন্ত তিনি দক্ষিণ এশীয় শিল্পকলার অধ্যাপক ছিলেন। এছাড়াও তিনি ১৯৬৪-১৯৮২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত নিউইয়র্কের চারুকলা ইনস্টিটিউটে ভারতীয় শিল্পের সহকারী অধ্যাপকও ছিলেন। তিনি ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ফিলাডেলফিয়া মিউজিয়াম অফ আর্ট-এ ভারতীয় শিল্পকলার কিউরেটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং আমৃত্যু কিউরেটর ইমেরিটাস ছিলেন।[৪] ফিলাডেলফিয়া মিউজিয়াম অফ আর্ট-এ কর্মজীবনে মেয়াদকালে, ক্র্যামরিশ ভারতীয় এবং হিমালয় শিল্পের অত্যাশ্চর্য প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিলেন, যেখানে তার লেখা ক্যাটালগ এবং বিষয়বস্তু সম্পর্কিত পাঠও পাশাপাশি স্থান পেয়েছিল। ফলে প্রদর্শনীতে ভারতীয় শিল্প ও সংস্কৃতির উল্লেখযোগ্য স্বীকৃতি লাভ করেছিল। ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দে প্রদর্শিত হয়েছিল - "অজানা ভারত: উপজাতি এবং গ্রামে আচার আর্ট" শিরোনামে প্রায় পাঁচশো ধর্মীয় ও ধর্মনিরপেক্ষ বস্তু প্রদর্শন করেছিল। বারো বছরের পরিকল্পনা, গবেষণা এবং আলোচনার পর, তিনি ১৯৮১ খ্রিস্টাব্দে আরেকটি যুগান্তকারী প্রদর্শনী, "শিবের প্রকাশ" এর ব্যবস্থা করেন যেখানে প্রায় ১৯৭ টি বস্তুর প্রদর্শনীর ব্যবস্থা হয়। উল্লেখযোগ্য এই যে এর আগে কখনও এগুলি ভারতছেড়ে কোথাও যায় নি।

ভারতীয় ভাস্কর্য ও শৈল্পিক ঐতিহ্যের উপর লেখা স্টেলা ক্রামরিশের বেশ কয়েকটি গ্রন্থ ইংরাজী ও জার্মান ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে।

ব্যালেরিনা, ডিজাইনার, অভিনেত্রী এবং সংগ্রাহক নাতাচা রামবোভারের বন্ধু ছিলেন তিনি। তার উল্লেখযোগ্য ছাত্ররা ছিলেন - সংস্কৃত সাহিত্যের পণ্ডিত ও শ্রীভগবদগীতার অনুবাদক এবং অ্যাসোসিয়েশন ফর এশিয়ার স্টাডিজের প্রাক্তন সভাপতি বারবারা স্টোলার মিলার এবং ভারতীয় ও ইসলামিক আর্টের শিল্পী ও লেখক ওয়েন ই.বেগলি।

১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে তার অবসরের পর পেনসিলভেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাউথ এশিয়া স্টাডিজ অ্যান্ড হিস্ট্রি অফ আর্টের ডব্লিউ নরম্যান ব্রাউন অধ্যাপক পদে মাইকেল ডব্লিউ মেইস্টার স্থলাভিষিক্ত হন।

পুরস্কার ও সম্মাননা[সম্পাদনা]

স্টেলা ক্রামরিশ অনেক কৃতিত্বের জন্য বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি পেয়েছেন। 

  • বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে ক্রামরিশকে দেশিকোত্তম উপাধি প্রদান করে।[৫]
  • পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৮১ খ্রিস্টাব্দ সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করে।
  • ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দে ফিলাডেলফিয়া মিউজিয়াম অফ আর্ট-এ অনুষ্ঠিত একটি অনুষ্ঠানে, ক্র্যামরিশকে বিজ্ঞান ও শিল্পের জন্য অস্ট্রিয়ান ক্রস অফ অনার দেওয়া হয়।
  • ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি "প্রাচ্য সভ্যতার বোঝার জন্য তাদের অবদানের জন্য চার্লস ল্যাং ফ্রিয়ার মেডেল পান।
  • ১৯৮২ খ্রিস্টাব্দে ভারতের শৈল্পিক ঐতিহ্য এবং এর অন্তর্নিহিত দর্শন বিশ্বের দরবারে উপস্থাপিত করার জন্য ভারত সরকার তাকে সাহিত্য ও শিক্ষায় তৃতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান পদ্মভূষণ প্রদান করে। [৬]

নির্বাচিত গ্রন্থপঞ্জি[সম্পাদনা]

  • গ্রুন্ডজুগে ডের ইন্ডিশেন কুনস্ট (প্রিন্সিপলস অফ ইন্ডিয়ান আর্টের উপর), আলফ্রেড ক্রোনার ভার্লাগ, (১৯২৪)।
  • দ্য বিষ্ণুধর্মোত্তরম: এ ট্রিটাইজ অন ইন্ডিয়ান পেন্টিং অ্যান্ড ইমেজ মেকিং, ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি প্রেস, (১৯২৮)।
  • ইন্ডিয়ান স্কাল্পচার: দ্য হেরিটেজ অফ ইন্ডিয়া সিরিজ- অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, (১৯৩৩)।
  • আননোন ইন্ডিয়া: রিচ্যুয়াল আর্ট ইন ট্রাইব অ্যান্ড ভিলেজ, ফিলাডেলফিয়া মিউজিয়াম অফ আর্ট, (১৯৬৮)।
  • দ্য প্রেজেন্স অফ সিবা - প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি প্রেস, (১৯৮১)।

জীবনাবসান[সম্পাদনা]

ভারতীয় শিল্পের ইতিহাসবিদ ভারতবন্ধু অধ্যাপক স্টেলা ক্র্যামরিশ ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দে ৩১শে আগস্ট, ফিলাডেলফিয়ার পেনসিলভানিয়াতে তার বাড়িতে ৯৭ বৎসর বয়সে পরলোক গমন করেন।[৩]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. Stoller Miller, Barbara (১৯৮৩)। Exploring India's Sacred Art. Selected Writings of Stella Kramrisch.। Philadelphia: University of Pennsylvania Press। পৃষ্ঠা 3–33। আইএসবিএন 0812211340 
  2. "ভারতবন্ধু - কলকাতার কড়চা"। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৫-২৯ 
  3. "Stella Kramrisch, Indian-Art Expert and Professor, 97", The New York Times. Retrieved 1 January 2015.
  4. Sozanski, Edward J., "Indian Art Expert S. Kramrisch Dies at 97", Philly.com. Retrieved 1 January 2015.
  5. "Stella Kramrisch(1896-1993)"। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৫-২৯ 
  6. "Padma Awards:Interactive Dashboard"। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৫-২৯ [স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]