শ্রীমধ্বাচার্য্য

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

শ্রীমধ্বাচার্য বায়ুর তৃতীয় অবতার রুপে প্রসিদ্ধ ৷ ত্রেতাযুগে হনুমানদ্বাপরযুগে ভীম রুপে আবির্ভূত হয়ে যিনি ভগবানের লীলা সহায়ক হয়েছিলেন, সেই ভগবৎ-সেবক বায়ুদেবই ভ্রান্ত মতবাদ ও শাস্ত্রের অপব্যাখ্যা নিরসনার্থে শ্রীমধ্বাচার্যরুপে অবতীর্ণ হন। মধ্ব = মধু + ব, মধু শব্দ আনন্দবাচী, ব-শব্দে জ্ঞান নির্দেশ করা হয়, তীর্থ অর্থও জ্ঞান ৷ তাই আচার্যের অপর নাম আনন্দতীর্থ ৷ এছাড়া তিনি অনুমানতীর্থ, পূর্ণপ্রজ্ঞ প্রভৃতি উপাধিও লাভ করেন।

শ্রীমধ্বাচার্য্য
উপাধিপূর্ণ প্রাজ্ঞ, জগদ্গুরু
ব্যক্তিগত তথ্য
জন্ম
বাসুদেব ভট্ট

১১৯৯ খ্রিস্টাব্দ
মৃত্যু১২৭৮ খ্রিষ্টাব্দ
ধর্মহিন্দু ধর্ম
জাতীয়তাভারতীয়
পিতামাতা
  • মধ্যগেহ ভট্ট (পিতা)
  • বেদবতী (মাতা)
দর্শনদ্বৈত বেদান্ত
ঊর্ধ্বতন পদ
গুরুশ্রীঅচ্যুতপ্রেক্ষ , ব্যাসদেব

প্রারম্ভিক জীবন[সম্পাদনা]

শ্রীমধ্বাচার্যের পিতা মধ্যগেহ ভট্ট ও মাতার নাম বেদবতী ৷ মধ্বাচার্যের বাল্য নাম ছিল বাসুদেব ৷ বাসুদেব বাল্যকালে অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন, যথাবয়সে উপনয় গ্রহণপূর্বক সমস্ত শাস্ত্র অধ্যয়ন শেষ করে বালক বাসুদেব একদা তার পিতাকে বললেন, “আমি অদ্বৈত-বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ খন্ডন করে জগতে বেদ প্রতিপাদ্য বৈষ্ণবসিদ্ধান্ত প্রচার করব ৷” তখন বাসুদেবের হাতে একটি লাঠি ছিল, ঐ দিকে লক্ষ্য করে বাসুদেবের কথার প্রতিত্তরে পিতা বললেন, “তুমি এখনও বালকমাত্র, তোমার দ্বারা যদি এসব খন্ডন সম্ভব হয়, তবে তোমার হাতের লাঠিটিও মহা-বৃক্ষরুপে পরিণত হওয়া অসম্ভব নয় ৷” একথা শুনে “ভগবানের ইচ্ছায় কোন কিছুই অসম্ভব নয়” এই বলে বাসুদেব লাঠিটি মাটির মধ্যে গেঁড়ে দিলেন এবং তৎক্ষণাৎ উহা মহা-বটবৃক্ষরুপে পরিণত হলো ৷ এই অলৌকিক ঘটনা দেখে বাসুদেব পিতা যার পর নাই বিস্মিত হলেন এবং বুঝতে পারলেন যে তার পুত্র ভগবানের আশীর্বাদপুষ্ট ৷

দীক্ষা ও পরবর্তী জীবন[সম্পাদনা]

আচার্য শ্রীমধ্ব অচ্যুতপ্রেক্ষ নামক এক গুরুর নিকট দীক্ষিত হয়ে জগতগুরু শঙ্করাচার্যের দশনামী সম্প্রদায়ের তীর্থ পরম্পরাতে সন্ন্যাসে প্রবিষ্ট হন ৷ মধ্বাচার্য অচ্যুতপ্রেক্ষের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন ৷ এরপর তিনি দ্বিগবিজয়ে বহির্গত হন এবং যুক্তি-তর্কবলে সমস্ত শঙ্করাচার্যের অদ্বৈত আর রামানুচার্যের বিশিষ্টাদ্বৈত মতের অনুসারী পণ্ডিতগণকে পরাস্ত করতে থাকেন ৷ আচার্য্য আনন্দতীর্থ শিষ্যগণের সহিত সর্বত্র বিষ্ণুর মহিমা প্রচারকালে একদা বাদরিকাশ্রমে গিয়ে উপস্থিত হন ৷ তারপর বদরিকাশ্রম থেকে ব্যাসাশ্রমে যান, সেখানে ব্যাসদেব সদাস্থিত হলেও স্বীয় যোগবলে সাধারণের নিকট অদৃশ্য থাকেন ৷ কিন্তু তিনি স্বেচ্ছায় মধ্বাচার্যকে দর্শন দেন, তথায় আচার্য মধ্ব ব্যাসদেবের নিকট শিষ্যরুপে অবস্থানপূর্বক স্বয়ং ব্যাসের মুখ থেকে শ্রুতির পরম অর্থ শ্রবণ করেন এবং ব্যাসদেবের অভিপ্রায় অনুযায়ী শাস্ত্রসিদ্ধান্ত প্রচারের উপদেশ লাভ করেন ৷ এরপর আচার্য আনন্দতীর্থ ব্যাসদেবের অভিপ্রেত অনুসারে বেদাদি শাস্ত্রের ওপর দ্বৈতপর ও বিষ্ণুর মাহাত্ম্য প্রতিপাদক ভাষ্য রচনা করেন৷ কথিত আছে মহর্ষি ব্যাসদেব তাঁকে তিনটি শালগ্রাম শিলা উপহার দেন এবং তিনি সুব্র‏‏হ্মণ্য, উদিপি ও মধ্যতল নামক স্থানের তিনটি মঠে ঐ শালগ্রাম শিলা প্রতিষ্ঠিত করেন। এর মধ্যে উদিপি নগর মধ্বচারীদের প্রধান তীর্থক্ষেত্র। এছাড়াও তিনি আটটি মন্দির নির্মাণ করেন। সেই আটটি মন্দিরে তিনি রাম-সীতা, লক্ষ্মণ ও সীতা, দ্বিভূজ, কালীয়মর্দন, চতুর্ভূজ, সুবিতল, সুকর, নৃসিংহ এবং বসমত্ম-বিতল এই আট প্রকার মূর্তি স্থাপন করেন।

রচিত গ্রন্থাবলি[সম্পাদনা]

  • ঋগ্-ভাষ্য
  • ঈশ-কেন-কঠ-মুন্ডুক-মান্ডুক্য-তৈত্তিরীয়-ঐতরেয়-প্রশ্ন-ছান্দোগ্য ও বৃহদারণ্যক উপনিষদ ভাষ্য
  • ব্রহ্মসূত্রভাষ্য, অনুভাষ্য বা অনুব্যাখ্যান ও অণুভাষ্য
  • গীতাভাষ্য ও গীতা তাৎপর্য নির্ণয়
  • মহাভারত তাৎপর্য নির্ণয়
  • ভাগবত তাৎপর্য নির্ণয়

এছাড়াও তিনি ভক্তিমূলক অনেক গ্রন্থাদিও লিখেছেন।

দার্শনিক সিদ্ধান্ত[সম্পাদনা]

দার্শনিক সিদ্ধান্তের দিক দিয়ে মধ্বাচার্য শঙ্করাচার্যের আর রামানুচার্যের প্রবল বিরোধী ৷ শঙ্করাচার্য অদ্বৈতবাদী আর রামানুচার্য বিশিষ্টাদ্বৈতবাদী কিন্তু মাধ্ববার্য দ্বৈতবাদী ৷ শঙ্করাচার্য ও রামানুচার্য বলেন জীব ও ব্রহ্ম এক বস্তু, অপরদিকে মধ্বাচার্য বলেন জীব ও ব্রহ্ম আলাদা ৷ শঙ্করাচার্য বলেন ব্রহ্ম সত্য জগৎ মিথ্যা ; মধ্বাচার্য বলেন জগৎ মিথ্যা নয়, বরং তোমাদের মিথ্যাবাদটাই মিথ্যা৷ শঙ্কর ও রামানুজ বলেন, জগতকে ‘প্রপঞ্চ’ বলা হয়, যার অর্থ সত্যের ন্যায় প্রতীয়মান হয় মাত্র, বাস্তবিক সত্য নয় ৷ মধ্বাচার্য বলে প্রপঞ্চ অর্থ উহা নয়, প্রপঞ্চ = প্রকৃষ্ট পঞ্চভেদ ৷ যথা— ১৷ ঈশ্বর ও জীবে ভেদ ২৷ ঈশ্বর ও জগতে ভেদ ৩৷ জীব ও জীবে ভেদ ৪৷ জীব ও জগতে ভেদ ৫৷ জড় ও জগতে ভেদ শঙ্করাচার্য আর রামানুচার্য ‘তত্ত্বমসি’ প্রভৃতি যেসকল শ্রুতিবাক্য দ্বারা জীব ও ব্রহ্মের অভেদ একত্ব নির্ণয় করেন, মধ্বাচার্য সেই সকল শ্রুতিই ব্যাখ্যা করে জীব-ব্রহ্মের ভেদ প্রতিপাদন করেছেন ৷ সর্বদর্শন সংগ্রহকার শ্রীমৎ সায়ণ-মাধব লিখেছেন— “আনন্দ তীর্থ শারীরক মীমাংসার যে ভাষ্য করিয়াছেন তাহাতে দৃষ্টিপাত করিলে জীব ও ঈশ্বরের পরস্পর যে ভেদ আছে তদ্বিষয়ে আর কোন সংশয়ই থাকে না। ঐ ভাষ্যে লিখিত হইয়াছে “স আত্মা তত্ত্বমসি শ্বেতকেতো,” এই শ্রুতির, জীব ও ঈশ্বরের পরস্পর ভেদ নাই এরূপ তাৎপর্য্য নহে। কিন্তু “তস্য ত্বং” অর্থাৎ “তাঁহার তুমি” এই ষষ্ঠী সমাস দ্বারা উহাতে “জীব, ঈশ্বরের সেবক” এই অর্থই বুঝাইবে। আর এরূপ যোজনা দ্বারা এমন অর্থও বুঝাইতে পারে যে জীব, ব্রহ্ম হইতে ভিন্ন। এই মতে দুই তত্ত্ব স্বতন্ত্র ও অস্বতন্ত্র। তন্মধ্যে ভগবান সর্ব্বদোষবিবর্জিত অশেষ সদগুণের আশ্রয় স্বরূপ বিষ্ণুই স্বতন্ত্রতত্ত্ব। এবং জীবগণ অস্বতন্ত্রতত্ত্ব অর্থাৎ ঈশ্বরায়ত্ত। এই রূপে সেব্যসেবক ভাবাবলম্বী ঈশ্বর জীবের পরস্পর ভেদও যুক্তিসিদ্ধ হইতেছে, যেমন রাজা ও ভৃত্যের পরস্পর ভেদ দৃষ্ট হইয়া থাকে।” (সর্বদর্শন-সংগ্রহ, ‘পূর্ণপ্রজ্ঞদর্শন’ নামক পরিচ্ছেদ) শ্রী আনন্দতীর্থ (মধ্বাচার্য) অদ্বৈত ও বিশিষ্টাদ্বৈত খন্ডনার্থে বিশেষত এই গ্রন্থগুলো লিখেন—

  • উপাধি খন্ডন
  • মায়াবাদ খন্ডন
  • প্রপঞ্চ-মিথ্যাত্বানুমান খন্ডন

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

১। Vaishnavaism Blogspot

২। Akashgangabairagi Blogspot