শান্তিপুর তাঁতশিল্প

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
লক্ষ্মী টেক্সটাইল তাঁত ওয়ার্কশপ – নতুন ফুলিয়াস্থিত শান্তিপুর তাঁতশিল্পের কারখানা – এর অভ্যন্তরীণ দৃশ্য।

শান্তিপুর তাঁত শিল্পাঞ্চল হল পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার একটি তাঁত কাপড় বয়ন শিল্প ক্ষেত্র। এটি ভারতের প্রথম সারির তাঁত শিল্পাঞ্চলগুলির মধ্যে অন্যতম। এই তাঁত শিল্পাঞ্চলটি সুতির শাড়ি উৎপাদনের জন্য জগৎ বিখ্যাত। এই শিল্পাঞ্চলের মূল দুটি কেন্দ্র হল শান্তিপুরফুলিয়া। শান্তিপুরে উৎপাদিত সুতির শাড়ির সুখ্যাতি রয়েছে, যা শান্তিপুরী শাড়ি নামে পরিচিত এবং ফুলিয়া টাঙ্গাইল-জামদানির জন্য সুপরিচিত।

শান্তিপুর তাঁত শিল্পাঞ্চলের সুপ্রাচীন ইতিহাস রয়েছে। শান্তিপুরে ১৫তম শতাব্দীর শুরুতেই তাঁত শিল্প গড়ে উঠেছিল। মুঘল ও নবাবি আমলে শান্তিপুর তাঁত শিল্পাঞ্চলের সমৃদ্ধি ঘটে। কিন্তু ব্রিটিশ ভারতে বাংলা তথা ভারতের অন্যান্য তাঁত শিল্পাঞ্চল কেন্দ্রের মত শান্তিপুরেও মন্দা দেখা দেয়। তবে স্বাধীনতা লাভের পরে শান্তিপুর শিল্পাঞ্চল পার্শ্ববর্তী ফুলিয়া পর্যন্ত প্রসারিত হয়।

বিংশ শতাব্দীর শেষ ও একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে যন্ত্রচালিত তাঁতের কারণে হস্তচালিত তাঁত নির্ভর শান্তিপুর শিল্পাঞ্চল হুমকির সম্মুখীন হয়। একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে ভারত সরকার ভারতের তাঁতশিল্পের উন্নয়নে "ন্যাশনাল হ্যান্ডলুম ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম" চালু করেছিল। এই কর্মসূচি শান্তিপুর তাঁত শিল্পাঞ্চলের শান্তিপুরফুলিয়ায় তাঁতশিল্পের উন্নয়ন ঘটিয়েছে। তাঁতের সংখ্যা ২০১০-এর দশকে শান্তিপুর কেন্দ্রের তুলনায় ফুলিয়া কেন্দ্রে অধিক বৃদ্ধি পেয়েছিল। ২০১৭ খ্রিস্টাব্দের তথ্য অনুযায়ী, শিল্পাঞ্চলে ৩২ হাজার তাঁত ও ৯৩ হাজার তাঁতি উৎপাদনে নিয়োজিত রয়েছে, যার মধ্যে প্রধান উৎপাদন কেন্দ্র শান্তিপুরে ২০ হাজার তাঁত ও ৬০ হাজার তাঁতি এবং ফুলিয়ায় ১২ হাজার তাঁত ও ৩৬ হাজার তাঁতি রয়েছে।

ইতিহাস[সম্পাদনা]

প্রারম্ভিক ইতিহাস: ১৭৫৭ পর্যন্ত[সম্পাদনা]

শান্তিপুরের উল্লেখ অষ্টম থেকে দশম শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে রচিত চর্যাপদ-এ পাওয়া যায়। গৌড়ের রাজা লক্ষ্মণ সেনের অনুরোধে ১২তম শতাব্দীতে ঢাকার ধামরাই থেকে বেশ কিছু তাঁতি, দর্জি ও ওস্তাদ এসে শান্তিপুরে বসতি স্থাপন করেন।

শান্তিপুরে তাঁতশিল্পের সূচনা ১৫তম প্রথম দশকের শুরুতেই ঘটেছিল। উপলব্ধ সবচেয়ে প্রাচীন তথ্যপ্রমাণ অনুযায়ী, গৌড়ের রাজা গণেশ দনুজাধর্মণদেবের শাসনামলে ১৪০৯ খ্রিস্টাব্দে শান্তিপুরে বয়ন কার্যক্রম শুরু হয়। অদ্বৈত আচার্য সিলেট থেকে এসে শান্তিপুরে বসবাস শুরু করেন, এর ফলে বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের অনেক তাঁতি ঢাকা, টাঙ্গাইল, বিক্রমপুর ও অন্যান্য এলাকা থেকে শান্তিপুরে এসেছিলেন। পূর্ববঙ্গে ১৬তম শতাব্দীর প্রথমার্ধে মগ ও আরাকান দস্যুদের দ্বারা সৃষ্ট ঝামেলার কারণে অনেক তাঁতি ঢাকা থেকে নদীয়া জেলার শান্তিপুরে স্থানান্তরিত হয়েছিল। পূর্ববঙ্গ থেকে তাঁতিদের আগমের কারণে শান্তিপুর ও পার্শ্ববর্তী এলাকা ধীরে ধীরে একটি প্রধান বস্ত্র বয়ন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠে এবং এর সমৃদ্ধি বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। তাঁতশিল্প প্রসারিত হয়েছিল। পূর্ববঙ্গ থেকে শান্তিপুরে স্থানান্তরের সময় অনেক তাঁতি তাদের জমিতে উৎপাদিত উন্নতমানের তুলার বীজ নিয়ে এসেছিলেন। পূর্ববঙ্গের উন্নত জাতের বীজ রোপণ ও বপনের যে তুলা উৎপাদিত হয়েছিল, তা শান্তিপুরের স্থানীয় তুলার থেকে অনেক উন্নতমানের ছিল। এই নতুন জাতের তুলা থেকে উৎপাদিত বস্ত্র মুলমুল নামে পরিচিত লাভ করে ছিল। শান্তিপুরে ১৫তম-১৬তম শতাব্দীতে ২৫০-৩০০ কাউন্ট সূক্ষ্ম সুতা ব্যবহার করে কাপড় বোনা হত। এই সূক্ষ্মতা মুঘল যুগে ১০০০ কাউন্ট সূক্ষ্ম সুতা ব্যবহারের উচ্চতায় পৌঁছেছিল। নদীয়ার রাজা রুদ্র রায়ের শাসনামলে (১৬৮৩-১৬৯৪ খ্রিস্টাব্দ) পর্যন্ত শাড়ি বুননে খ্যাতি লাভ করে ছিল। মুঘল সাম্রাজ্যের সময়কালে তাঁতশিল্প কেন্দ্রের উত্পাদনটি সুশৃঙ্খল ও সুসংগঠিত হয়েছিল, যা উৎকৃষ্ট পণ্য উৎপাদনের স্বীকৃতির দিকে পরিচালিত করেছিল। মুঘল যুগেই শান্তিপুর থেকে উৎপাদিত তাঁত পণ্য মধ্যপ্রাচ্যইউরোপে রপ্তানি হত।[১]

ইউরোপে পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে, বাংলা ১৭তম শতাব্দীর শেষ চতুর্থাংশ থেকে ভারতীয় উপমহাদেশের মধ্যে প্রাথমিক স্থান পৌঁছায়, ইংরেজ, ডাচ ও ফরাসি কোম্পানিগুলি রপ্তানির সঙ্গে যুক্ত ছিল। বাংলায় রপ্তানির প্রধান কেন্দ্রগুলি ছিল ঢাকা, চট্টগ্রাম, শান্তিপুর, মালদহ ইত্যাদি। বাংলার উৎকৃষ্ট মসলিন, মুলমুল, টাঙ্গাইল ছাড়াও শান্তিপুর ও পার্শ্ববর্তী এলাকার মহিলারা সূক্ষ্মভাবে সূচিকর্ম করত। ইউরোপের বাজারে বাংলার বস্ত্রের সমৃদ্ধি ও ক্রমবর্ধমান চাহিদার কারণ ছিল এর উৎপাদন খরচ কম। সস্তায় শ্রম পাওয়া যায় বলে শ্রম খরচ কম ছিল এবং এর ফলে উৎপাদন খরচ কম ছিল। ১৭তম শতাব্দীর শেষ পর্যায়ে এবং ১৮তম শতাব্দীর প্রথমার্ধে, সমগ্র ভারতে বাংলার বস্ত্র রপ্তানি করা হয়েছিল।

১৮তম শতাব্দীতে ঢাকাই মসলিন-এর পাশাপাশি শান্তিপুরেও মসলিন উৎপাদন করা হত। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের সময় ধুতি ও নকশা পাড় কাপড় সুখ্যতি অর্জন করেছিল। নবাবি আমলে ইউরোপের ব্যবসায়ীরা শান্তিপুরে উৎপাদিত মলমল – মসলিনের সবচেয়ে উৎকৃষ্ট প্রকার – ক্রয় করে ইউরোপে রপ্তানি করত। ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কলকাতার স্থানীয় বণিকদের মাধ্যমে শান্তিপুরে উৎপাদিত মলমল ক্রয় করত। সুশীল চৌধুরী তাঁর ফ্রম প্রসপেরিটি টু ডিক্লাইন: এইটিন্থ সেঞ্চুরি বেঙ্গল-এ উল্লেখ করেছেন ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ৪০ মিটার লম্বা ও ৩ মিটার দীর্ঘ মসলিন ১৬ টাকা দরে কলকাতার স্থানীয় বণিকদের থেকে ক্রয় করত। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পক্ষ থেকে নিযুক্ত পাঁচ শতাধিক কর্মচারী শান্তিপুরের কুঠিরপাড়ায় বাস করত, তাদের কাজ ছিল ছোট কারখানা ঘাই ও বড় কারখানা বানক-এর মাধ্যমে শান্তিপুরের তাঁত শিল্পীদের বোনা কাপড় সংগ্রহ এবং তা বিদেশে রপ্তানির ব্যবস্থা করা।

উপনিবেশিক ইতিহাস: ১৭৫৭–১৯৪৭[সম্পাদনা]

ঢাকাই মসলিনের মত উৎকৃষ্ট না হলেও শান্তিপুর জাতের মসলিনও বেশ উন্নত ছিল। রাজা কৃষ্ণ চন্দ্রের রাজত্বকালে রানাঘাটের মল্লিক যুবকদের একটি দল শান্তিপুর থেকে উন্নত মানের মসলিন সংগ্রহ করে ইউরোপের দেশগুলিতে রপ্তানি করত। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রতিনিধিরা ১৯তম শতাব্দীর শুরুতে শান্তিপুর তাঁতশিল্প ক্ষেত্র থেকে ১,৭০,০০০ পাউন্ড মূল্যের মসলিন সংগ্রহ করতেন। বাজারে শান্তিপুরে উৎপাদিত সূক্ষ্ম মানের সুতি কাপড়ের প্রচুর চাহিদা ছিল, এবং ব্রিটিশরা এই কাপড়টিকে মলমল হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছিল। এই সময়ে শান্তিপুরে ৪০ গজ লম্বা ও ২¼ গজ চওড়া অতিসূক্ষ্ম মলমল তৈরি হত, যা শুধুমাত্র কয়েকজন তাঁতি ভালভাবে তৈরি করতে সক্ষম ছিলেন, এবং সাধারণ মুলমুল সমস্ত তাঁতি দ্বারা তৈরি করা হত, যেগুলি ৪০ গজ লম্বা ও ২ গজ চওড়া ও ৪০ গজ লম্বা ও ২½ গজ চওড়া হত।[২]

১৭৭০-এর দুর্ভিক্ষে বাংলায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ অঞ্চলগুলির মধ্যে নদীয়া ছিল, যা শান্তিপুর সহ বাংলার তাঁত শিল্পকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছি। দুর্ভিক্ষে বিপুল সংখ্যক লোক মারা গিয়েছিল যার ফলে কৃষি কার্যক্রম ভেঙে পড়েছিল। এই দুর্ভিক্ষে কারণে শান্তিপুরের ২৫% তাঁতির মৃত্যু ঘটেছিল।

ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লব শুরু হওয়ায় তাঁতীদের কর্মসংস্থান হুমকির সম্মুখীন হয়। ইংল্যান্ড ও এর পার্লামেন্ট ১৭০০-এর দশ থেকেই শিল্প বিপ্লবের বৃদ্ধি রক্ষা করতে আগ্রহী ছিল। এই প্রচেষ্টা ১৭৯০-এর দশ থেকে বাস্তবায়িত হতে শুরু করে। কিন্তু ১৭৮০-এর দশ, ১৭৯০-এর দশ এবং এমনকি ১৮১০-১৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় যা প্রমাণ করে যে শান্তিপুরের বস্ত্র অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল। কুঠিতে উৎপাদিত কাপড় ব্যতীত কোম্পানিটি ১৭৯০-এর দশে বার্ষিক ১৫ লাখ টাকার কাপড় ক্রয় করত। নেপোলিয়নের অবরোধের কারণে ১৮০৯ খ্রিস্টাব্দে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়, ফলে সার্বিকভাবে বাংলা থেকে রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং শান্তিপুরের সূক্ষ্ম বস্ত্র রপ্তানিতে বিরূপ প্রভাব পড়ে। এমনকি যেসব মহিলারা তাদের জীবিকার জন্য বস্ত্র শিল্পের উপর নির্ভরশীল ছিলেন তারাও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন। চাহিদা না থাকায় "শান্তিপুর কুঠি" ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে বন্ধ করে দেওয়া হয়। কুঠি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর তাঁতি ও তাঁত কর্মীরা (নারী-পুরুষ উভয়েই) চরম আর্থিক সমস্যায় পড়েন। পরবর্তীতে ইংরেজ কোম্পানি তাঁতিদেরকে আরও সূক্ষ্ম কাপড় বুনতে অনুপ্রাণিত করেছিল, যার ফলে শান্তিপুরের তাঁতি ও তাঁত শিল্প সাময়িকভাবে আবারও প্রাধান্য পেয়েছিল। কাজের প্রতি গর্ববোধ ও অধিকার সচেতনতা শান্তিপুরের বস্ত্র শিল্পকে বাঁচিয়ে রেখেছিল। গবেষক দেবশ্রী মুখোপাধ্যায়, প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও শান্তিপুরের তাঁতিদের তাঁত শিল্প সঙ্গে যুক্ত থাকার বিষয়টিকে মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাপনের জন্য শ্রমিক শ্রেণীর চূড়ান্ত লড়াই হিসাবে উল্লেখ করেছেন। এটি জাতীয়তাবাদের জন্য প্রথম লড়াই যা স্বদেশী আন্দোলনের অনেক আগে শুরু হয়েছিল।

স্বদেশী আন্দোলন বা আইন অমান্য আন্দোলন শান্তিপুরে তাঁতিদের ভূমিকা ছিল অগ্রণী। বঙ্গভঙ্গের (১৯০৫) পরিপ্রেক্ষিতে সংগঠিত স্বদেশী আন্দোলনের সময় শান্তিপুরে প্রায় বারোশ তাঁত ছিল। ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দ ছিল শান্তিপুর তাঁত শিল্পের পুনরুজ্জীবনের সময়। তবে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করেছিল। শান্তিপুরের তাঁতশিল্পে ১৯২০-এর দশক থেকে বিরাট পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। দরগা দাস কাস্থ ১৯২০-১৯২৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ব্যারেল ডবি চালু করেন, যা থ্রো শাটলকে ফ্লাই শাটলে রূপান্তর করার সুবিধা প্রদান করেছিল। পরবর্তীতে দেবেন্দ্র নাথ মুখোপাধ্যায় জ্যাকোয়ার্ড মেশিন প্রবর্তন করেন এবং এটি বাজারে নতুন নকশার একটি বিস্তৃত ক্রস সেকশন সহজতর করে। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, যতীন্দ্র নাথ লোহোরি দ্বারা বিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকে প্রথম ১০০ হুক ক্ষমতার জ্যাকার্ড স্থাপন করা হয়েছিল কাপড়ে বৈচিত্র্য তৈরি করতে। অতীতে শান্তিপুর শাড়িগুলি সূক্ষ্ম এবং অভিন্ন বয়নপ্রণালীর জন্য খুব জনপ্রিয় ছিল।[১]

বাংলায় ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে কলের সুতো ও ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে বিলতি চিকন সুতোর ব্যবহার শুরু হয়েছিল, ফলে ধীরে ধীরে করে শান্তিপুরের হস্ত চালিত তাঁত শিল্পে মন্দা দেখা দিতে শুরু করেছিল। তাঁতিরা ব্যবসাটিকে অলাভজনক মনে করে অন্য পেশায় চলে যায়, ফলে শান্তিপুরের তাঁতশিল্পে তাঁতিদের সংখ্যা ধীরে ধীরে হ্রাস পেতে থাকে। বাংলার শিল্প অধিদপ্তর দ্বারা ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে পরিচালিত একটি সমীক্ষা অনুসারে, তৎকালীন শান্তিপুর শহরের মোট ২৭,০০০ ব্যক্তির মধ্যে ১০,০০০ জন তাঁত পরিবারের সদস্য ছিল।

স্বাধীন ভারত: ১৯৪৭-বর্তমান[সম্পাদনা]

ভারতবর্ষ ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজিত হয়েছিল; ভারতের এই বিভাজন বাংলাকে পশ্চিমবঙ্গপূর্ব পাকিস্তানে বিভাজিত করেছিল। ব্রিটিশ ভারতের বিভাজনের মাধ্যমে ভারতের স্বাধীনতা লাভের পরে, পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দু ধর্মাবলম্বী তাঁতিরা ভারতে শরণার্থী হয়েছে ছিল, যাদের একটা অংশ শান্তিপুর ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেছিল। অভিবাসনের প্রক্রিয়া ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে ভারত-পাক যুদ্ধে আরও তীব্র হয়, এবং ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌঁছেছিল। ১৬তম শতাব্দীতে পূর্ববঙ্গ থেকে আগত তাঁতিদের মতোই ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের পরে শরণার্থী তাঁতিরা শান্তিপুরের তাঁতশিল্প ও শিল্পাঞ্চলকে সমৃদ্ধ ও সম্প্রসারিত করতে বিরাট অবদান রেখেছিল।

১৯৮০-এর দশকের প্রথম দিকে (১৯৮০-৮৩) বেঙ্গল স্মল স্কেল এইডস ইন্ডাস্ট্রি অ্যাক্ট ছিল তাঁত শিল্পের বৃদ্ধির জন্য সরকারের সহায়ক সমর্থন। আইন অনুসারে, তাঁত কেনার জন্য ৫০% অনুদান ও ৫০% ঋণের আকারে সর্বাধিক ১০ হাজার টাকা আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়েছিল। পরবর্তীতে মহাজনদের অতিরিক্ত মুনাফা লাভের কর্মকাণ্ড তাঁতিদের উপার্জন হ্রাস করেছিল। আশির দশকের মাঝামাঝি এবং পরবর্তীতে নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়ে, মজুরি বৃদ্ধির জন্য শান্তিপুরে তাঁতিদের আন্দোলন হয়েছিল, কিন্তু এই আন্দোলন মহাজনদের দমনে ব্যর্থ হয়েছিল।[১] একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশক থেকে ভারত সরকার "ন্যাশনাল হ্যান্ডলুম ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম"-এর মাধ্যমে শান্তিপুর তাঁত শিল্পাঞ্চলের উন্নয়নে সচেষ্ট রয়েছে।

অবস্থান[সম্পাদনা]

শান্তিপুর তাঁতশিল্প কেন্দ্রটি পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার রাণাঘাট মহকুমার অধীনে অবস্থিত, যার একটি প্রাচীন সংস্কৃতি, ধর্ম ও ঐতিহ্যের স্থান এবং এর নিজস্ব গৌরব রয়েছে। তাঁতশিল্প কেন্দ্রের ভৌগোলিক স্থানাঙ্ক হল ২৩°১৫′ উত্তর ও ৮৮°২৬′ পূর্ব, যা কলকাতা থেকে প্রায় ৯০ কিলোমিটার (৫৬ মা) দূরে অবস্থিত। শিল্পাঞ্চলটি ভাগীরথী নদীর, গঙ্গার প্রধান দুটি শাখানদীর মধ্যে একটি, গাঙ্গেয় বদ্বীপে গড়ে উঠেছে। এটি শান্তিপুর পৌর এলাকা ও পার্শ্ববর্তী গ্রামীণ এলাকা সহ ২৫ বর্গমাইল এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে।

শিল্পাঞ্চলের ছোট ও বড় তাঁত কারখানাগুলি রাণাঘাট-শান্তিপুর-কৃষ্ণনগর রেলপথ ও ১২ নং জাতীয় সড়কের দুইপাশের গ্রামীণ ও পৌর এলাকায় ঘনীভূত হয়েছে। প্রধান উৎপাদন কেন্দ্র শান্তিপুর জেলার সদরদপ্তর থেকে ২০ কিলোমিটার (১২ মা) ও মহকুমা শহর থেকে ১৬ কিলোমিটার (৯.৯ মা) দূরে অবস্থিত।

কাঁচামাল[সম্পাদনা]

এই শিল্পাঞ্চলের প্রয়োজনীয় প্রধান কাঁচামাল হল সুতির সুতা, জরি ও সিল্ক সুতা। পশ্চিমবঙ্গে স্বল্প পরিমাণে তুলা চাষ ও সুতির সুতা উৎপাদন করা হয়, যা শান্তিপুর সহ রাজ্যের অন্যান্য শিল্পাঞ্চলের চাহিদা পুরনে অক্ষম। পশ্চিম ও দক্ষিণ ভারতে মূলত তুলা চাষ ও সুতির সুতা উৎপাদিত হয়, যা কলকাতার ব্যবসায়ী অথবা সরবরাহকারীদের মাধ্যমে শিল্পাঞ্চলে সরবরাহ করা হয়। এছাড়াও অন্যান্য ধরনের সুতা যেমন পলিয়েস্টার ফিলামেন্ট, সিল্ক (তুঁত, চাইনিজ, ব্যাঙ্গালোর), এবং সূক্ষ্ম পশমী সুতাও ব্যবহৃত হয়। পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলায় তুঁত রেশম ও মালদা জেলায় তসর রেশম উৎপাদন করা হয়; এই দুই জেলায় উৎপাদিত পণ্য শান্তিপুরের তাঁতশিল্পে প্রয়োজনীয় রেশমের যোগান দেয়। কিছু রেশম দক্ষিণ ভারতের থেকে স্রবারা সরবরাহ করা হয়, প্রধানত ব্যাঙ্গালোর রেশম। শান্তিপুরে (শহুরে এলাকা) ১০০ জনের বেশি সুতা ব্যবসায়ী বিভিন্ন ধরনের সুতা এবং অন্যান্য রাসায়নিক সরবরাহ করে। তাঁত শিল্পাঞ্চলটিকে কেন্দ্র করে ১০০ টিরও বেশি তাঁত প্রস্তুতকারক সংস্থা এবং তাঁত যন্ত্রের যন্ত্রাংশ সরবরাহকারী রয়েছে। তাঁত যন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান "মাকু" স্থানীয় কামারদের দ্বারা কামারশালায় তৈরি করা হয় ও সরবরার করা হয়।

উৎপাদিত পণ্য[সম্পাদনা]

এই তাঁত শিল্পটি সুতির বস্ত্র উৎপাদনের জন্য সুপ্রসিদ্ধ। শান্তিপুর, ফুলিয়া ও পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলিতে বিভিন্ন ধরনের শাড়ি, ধুতি, পোশাকের উপকরণ, উত্তরীয় ও ওড়না উৎপাদন করা হয়। অতীতে নকশা, সুতা ও রঙের ব্যবহারের ভিত্তিতে দশ ধরণের শাড়ি শান্তিপুররে উৎপাদিত হত, যাদের মধ্যে নীলাম্বরী ছিল সবচেয়ে বিখ্যাত। বর্তমানে শান্তিপুরে সাধারণ সুতির শাড়ি ও জামদানি শাড়ি উভয়ই উৎপাদিত হয়। শান্তিপুরে উৎপাদিত শাড়িগুলি শান্তিপুরী শাড়ি হিসাবে বাজারজাত করা হয়; এই শাড়ির ভৌগোলিক নির্দেশক স্বত্ব রয়েছে। এই শিল্পাঞ্চলে টাঙ্গাইল শাড়ি উৎপাদিত হয়, যা "বাংলার টাঙ্গাইল শাড়ি" শিরোনামে ভৌগোলিক নির্দেশক স্বত্ব অর্জন করেছে। পূর্বে বিভিন্ন ধরনের ওড়না শান্তিপুরে উৎপাদিত হত, যেমন চকমিলন, ভারী পাড় ওড়না ইত্যাদি। চকমিলন ওড়না ৩০০ কাউন্টের সুতায় বোনা হত। কিছু পণ্য রপ্তানির উদ্দেশ্যে উৎপাদন করা হয়, এই পণ্য বয়নে তাঁতিরা অধিক মজুরি পেয়ে থাকেন। এই রপ্তানিমুখী বয়ন প্রথম শুরু হয় এইচএইচইসি এবং তাদের একজন জাপানি গ্রাহক ও সুপরিচিত বস্ত্র নকশাকার মিঃ ইয়ুরগেন লাহলের উৎসাহে। রপ্তানিযোগ্য পণ্যের মধ্যে রয়েছে ওড়না, স্টোল, বিভিন্ন পোষাকের প্রয়োজনীয় সামগ্রী ইত্যাদি।

শাড়ি[সম্পাদনা]

শান্তিপুর তাঁত শিল্পাঞ্চলের অন্তর্গত নতুন ফুলিয়ায় হস্তচালিত তাঁতে দ্বারা একজন তাঁতি শাড়ি বুনছেন।

এই শিল্পাঞ্চলে সবচেয়ে বেশি উৎপাদিত পণ্য হল শাড়ি। শান্তিপুরী শাড়িগুলির প্রাথমিক বৈশিষ্ট্য ছিল তাদের সূক্ষ্ম বয়নবিন্যাস এবং সূক্ষ্মভাবে ও বিশদভাবে নকশা করা পাড়। এটি মসৃণ বয়নবিন্যাসের সঙ্গে নকশাকৃত, হালকা ওজন বিশিষ্ট এবং পরতে অত্যন্ত আরামদায়ক। সিল্ক বা জরির পাড় সূঁচ দিয়ে বোনা হয়। অতীতে প্রাথমিকভাবে কাঠকয়লা দিয়ে নকশাগুলো নরম সিল্কের বয়নবিন্যাসে চিহ্নিত করা হতো এবং তারপর সেই নকশাগুলো সরাসরি কাপড়ে সূঁচ দিয়ে বোনা হতো। নীলাম্বরী শাড়ি মিহি সুতোয় (১০০ কাউন্ট) বোনা হয়; শাড়ির পাড়ে রঙিন সুতোর দ্বারা আঁশ, চাঁদমালা, ভোমরা, রাজমহলের মতো বিভিন্ন নকশা তৈরি করা হয়। শতাব্দীপ্রাচীন শান্তিপুরী শাড়ি এই ঘরানা বাংলার মহিলাদের পছন্দের শাড়িগুলির মধ্যে অন্যতম। মিহি সুতির সুতোর সঙ্গে সিল্ক ও লিনেন মিশিয়ে শান্তিপুরি নকশাকেই অন্য ভাবে ব্যবহার করেও শাড়ি উৎপাদন করা হয়; এই শাড়ি দক্ষ ও অভিজ্ঞ তাঁতিরাই বুনতে সক্ষম।[৩]

টাঙ্গাইল শাড়ি ফুলিয়ার তাঁতিরা উৎপাদন করেন। এই শাড়ি শান্তিপুরী তাঁত শাড়ির সঙ্গে ঢাকা-টাঙ্গাইল শৈলীর সংমিশ্রণে সুতির সুতা (১০০ কাউন্ট), বিভিন্ন কাউন্টের রেশম সুতা (১৪/১৬-২০/২২ ডেনিয়ার), তসর সুতা এবং এছাড়াও কৃত্রিম ফিলামেন্ট সুতা ব্যবহার করে বোনা হয়। শান্তিপুর তাঁত শিল্পাঞ্চলের ফুলিয়ায় উৎপাদিত টাঙ্গাইল শাড়ি হাতে বোনা বুটি ও কাপড়ের পাতলা সূক্ষ্মতার জন্য বিখ্যাত। এই তাঁত শিল্পাঞ্চলের আরও একটি শাড়ি হল শান্তিপুরী জামদানি, যা পশ্চিমবঙ্গে বেশ জনপ্রিয়। সুতোর ব্যবহারের ভিত্তিতে তিন ধরেন জামদানি উৎপাদিত হয়, যথা - সুতির জামদানি, অর্ধ-রেশম জামদানি ও রেশম জামদানি।

ধুতি[সম্পাদনা]

এই শিল্পাঞ্চলে শাড়ির পরে সবচেয়ে সুপরিচিত পণ্য হল ধুতি, যা শান্তিপুরী ধুতি নামে বিখ্যাত। এই ধুতির চাহিদা বাংলা জুড়ে রয়েছে, কদর এক সময়ে ছিল বাংলার বাইরেও। শান্তিপুরী শাড়ির মতোই মিহি সুতোর চাপ বুনোট বা ঘন বুনোটের ধুতি বোনা হয়। শান্তিপুরের তাঁতিরা ১০০-১২০ কাউন্টের মিহি সুতোয় ধুতি বুনে থাকেন, তবে ১৮তম শতাব্দীতে ২৫০ থেকে ৩০০ কাউন্টের মিহি সুতোয় বোনা হত। শান্তিপুরী ধুতির অন্যান্য বৈশিষ্ট্য হল জলচুরি পাড়।[৪]

কর্মীবাহিনী[সম্পাদনা]

তাঁতি[সম্পাদনা]

দক্ষ তাঁতি
এই তাঁতিরা অন্য তাঁতিদের কাঁচামাল সরবরাহ, নকশা প্রদান ও তৃণমূল স্তরের তাঁতিদের মজুরি প্রদানের সামগ্রিক দায়িত্ব গ্রহণ করে; এবং উৎপাদিত পণ্য মহাজনদের সরবরাহ করে। তাঁতিদের উৎপাদনের একটি অংশ শান্তিপুরের স্থানীয় হাটেও বিক্রি হয়। ২০১৬ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসের তথ্য অনুযায়ী, শিল্পাঞ্চলে উত্পাদন কার্যক্রমে সক্রিয়ভাবে জড়িত প্রায় ৭০০ দক্ষ বা মাস্টার তাঁতি রয়েছে। আগে এই শ্রেণীর তাঁতিরা শুধুমাত্র বুননে নিয়োজিত ছিল। এটি অনুমান করা হয় যে মোট, এই মাস্টার তাঁতীদের অধীনে ১৬ হাজারের তাঁত রয়েছে এবং সমান সংখ্যক তাঁতি শ্রমিক হিসাবে কাজ করে। মডেল ইউনিটের আকার অনুযায়ী, মাস্টার তাঁতিদের অধীনে ৪ টি তাঁত থাকে। কিন্তু, বাস্তবে ১০-৬০ জন তাঁত বিশিষ্ট কারখানায় কর্মী তাঁতীদের জন্য মাত্র কয়েকজন মাস্টার আছে।
তাঁতি
সাধারণ তাঁতিরা দক্ষ বা মাস্টার তাঁতির অধীনে শাড়ি, ধুতি বা অন্যান্য পণ্য উৎপাদন করে। জ্যাকোয়ার্ড তাঁতে শাড়ি বুনতে সব তাঁতিদেরই ভালো বুনন দক্ষতা রয়েছে। শিল্পাঞ্চলে প্রায় ১১১ টি ভিন্ন ভিন্ন তাঁত সম্প্রদায় রয়েছে, যেমন "প্রামাণিক", "কাষ্ঠ", "দালাল", "খান" ইত্যাদি। তাঁতীদের অধিকাংশই তাঁতুওয়ে সম্প্রদায়ের অন্তর্গত। মহিলারা মূলত কোরা সুতো আলাদা করার মতো প্রস্তুতিমূলক কাজ করেন।

নকশাকার[সম্পাদনা]

পণ্যের -মূলত শাড়ি - নকশা তৈরি করেন। নকশাকারগণ তাঁদের নিজস্ব সৃজনশীলতা ও কল্পনাশক্তি দিয়ে নকশা তৈরির কাজ করেন। পণ্য উৎপাদনে তাঁদের প্রধান ভূমিকা হল মাস্টার তাঁতিদের জন্য নকশা তৈরি করা এবং জ্যাকোয়ার্ডের জন্য তাদের পাঞ্চ কার্ড সরবরাহ করা। ২০১৬ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসের তথ্য অনুযায়ী, শিল্পাঞ্চলে প্রায় ১০০ জনের বেশি নকশাকার রয়েছে।

রঞ্জনকার[সম্পাদনা]

রঞ্জনের কাজ মূলত ডাইং ইউনিটে করা হয়। রঞ্জিত সুতার পরিমাণের উপর ভিত্তি করে এই ইউনিটগুলিকে বড়, মাঝারি ও ছোট ইউনিটে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়। রঞ্জনকারেরা রঙ ও জলের মিশ্রণের সঙ্গে ফোটায়। তার পরে সুতা থেকে অতিরিক্ত জল ও রঙের মিশ্রণ আলাদা করে এবং রোদে শুকিয়ে নেয়। এর পরে সুতা মাস্টার তাঁতি বা ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রয় করা হয়। এখনে মোট সুতা বিক্রির ৬০% রঙিন সুতা আকারে, এবং বাকি ৪০% ধূসর আকারে হয়ে থাকে। সুতা ব্যবসায়ীরা রং করার জন্য বড় ও মাঝারি আকারে নিয়োগ করে, যেখানে ছোট আকারে ইউনিট মাস্টার তাঁতিদের জন্য কাজ করে। শিল্পাঞ্চলে বানিজ্যিক ভাবে ডাইংয়ের কাজ করছে প্রায় ৯০ টি ইউনিট।

বাণিজ্য[সম্পাদনা]

এই শিল্পাঞ্চলে উৎপাদিত পণ্যগুলি মূলত পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতের বাজারের চাহিদা পুরন করে থাকে। শান্তিপুর তাঁত শিল্পাঞ্চলের পণ্য সমূহ স্থানীয় হাটে বিক্রয় করা হয়। বঙ্গ, ঘোষ ও জগদ্ধাত্রী হল শান্তিপুরের তিনটি প্রধান হাট।[৫][৬] শিল্পাঞ্চলের ব্যবসায়ীদের দ্বারা গঠিত তাঁত বস্ত্র ব্যবসায়ী সমিতি-এর সঙ্গে ৭০০ জনেরও বেশি নিবন্ধিত ব্যবসায়ী যুক্ত রয়েছে, এবং তারাই বিপণন কার্যক্রম পরিচালনাকারী প্রধান ব্যক্তিবর্গ। স্থানীয় সমিতিগুলি কলকাতা সহ ভারতের বিভিন্ন শহরের ব্যবসায়ীদের কাছে পণ্য সরবরাহ করে। কিছু সমিতি বিভিন্ন বণিক রপ্তানিকারকের মাধ্যমে বিদেশে পণ্য সরবরাহ করে। শান্তিপুরে উৎপাদিত পণ্য যে দেশগুলিতে সবচেয়ে বেশি রপ্তানি করা হয় সেগুলি হল বাংলাদেশ, জাপান, ইতালি, থাইল্যান্ড ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া ও জার্মানি এবং উত্তর আমেরিকামধ্যপ্রাচ্যের দেশসমূহ। শান্তিপুরি শাড়ি বার্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ আনুমানিক ₹৪০০ কোটি। পশ্চিমবঙ্গে উৎপাদিত টাঙ্গাইল শাড়ির বার্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ ₹১,৫০০ কোটি; এই শাড়ির একটি বিরাট অংশ শিল্পাঞ্চলের ফুলিয়ায় উৎপাদিত হয়।

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. দাস et al. ২০১৬, পৃ. ২৭।
  2. "Cotton Weaving Industry of Nadia: 1773-1977 A Case Study of Santipur and Phulia" (পিডিএফ) (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ 
  3. বন্দ্যোপাধ্যায়, পিনাকী (১৬ এপ্রিল ২০১৮)। "লিনেন, সিল্কে নয়া সফর শান্তিপুরির"www.anandabazar.com। কলকাতা। এবিপি। সংগ্রহের তারিখ ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪শান্তিপুরি শাড়ি মানেই মিহি সুতোয় (১০০ কাউন্ট) বোনা নীলাম্বরী শাড়ি। আর সেই শাড়ির পাড়ে আঁশ, চাঁদমালা, ভোমরা, রাজমহলের মতো বিভিন্ন নকশার রঙিন সুতোর কাজ। শতাব্দীপ্রাচীন শান্তিপুরি শাড়ির এই ঘরানা বাংলার মহিলাদের পছন্দের শাড়িগুলির মধ্যে অন্যতম। ... বিশ্ববাংলার উদ্যোগে হাতে বোনা শান্তিপুরি শাড়িকে বাঁচাতে তখনই শুরু হয় নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা। বিভিন্ন মহলের পরামর্শ নিয়ে ঠিক হয় সাধারণ মিহি সুতির সুতোর সঙ্গে সিল্ক ও লিনেন মিশিয়ে শান্তিপুরি নকশাকেই অন্য ভাবে ব্যবহার করা হবে। আর সেই শাড়ি হাতে টানা মাকুর মাধ্যমে তাঁতেই বুনবেন শান্তিপুরের তাঁতিরা। 
  4. হালদার, সুস্মিত (৬ অক্টোবর ২০১৫)। "বোনার লোক কম, তবু বাজার শান্তিপুরী ধুতির"আনন্দবাজার পত্রিকা। শান্তিপুর। এবিপি। সংগ্রহের তারিখ ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪শান্তিপুরী ধুতির কদর এক সময়ে ছিল বাংলার বাইরেও। শান্তিপুরের শাড়ির মতোই মিহি সুতোর চাপ বুনোট বা ঘন বুনোটের ধুতির সুনাম ছিল ... অলীক কল্পনা বলে মনে হয়। 
  5. Mitra Chakraborty, Barnini (২৭ আগস্ট ২০২২)। "In pictures: Santipur Haat — a haven for sari buyers"www.telegraphindia.com (ইংরেজি ভাষায়)। ABP। সংগ্রহের তারিখ ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ 
  6. "বৃহস্পতিবার থেকে খুলছে শান্তিপুরে তাঁত কাপড়ের হাট"www.anandabazar.com। Shantipur। ABP। ৮ জুন ২০২১। সংগ্রহের তারিখ ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪তার পরই বঙ্গ, ঘোষ এবং জগদ্ধাত্রী- শান্তিপুরের তিনটি মূল হাট খোলার ছাড়পত্র দিয়েছে জেলাপ্রশাসন। 

গ্রন্থপঞ্জি[সম্পাদনা]