মুকুল দে

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
মুকুল দে
মুকুল দে ( একদম বামদিকে) সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, "কিও-সান" এবং অন্য এক জাপানি মহিলা,টমিটোড়া হারার বাসভবন সানকেই-এন ইয়োকোহামা, জাপান; ১ অগাস্ট ১৯১৬।
জন্ম
মুকুলচন্দ্র দে

(১৮৯৫-০৭-২৩)২৩ জুলাই ১৮৯৫
মৃত্যু১ মার্চ ১৯৮৯(1989-03-01) (বয়স ৯৩)
জাতীয়তাভারতীয়
পরিচিতির কারণনকশাকাটা
দাম্পত্য সঙ্গীবীণা দে (রায়)

মুকুলচন্দ্র দে (২৩ জুলাই ১৮৯৫ ― ১ মার্চ ১৯৮৯) ছিলেন একজন খ্যাতনামা বাঙালি চিত্রশিল্পী। কলকাতার গভর্নমেন্ট কলেজ অব আর্ট অ্যান্ড ক্র্যাফটের প্রথম ভারতীয় অধ্যক্ষ এবং ভারতীয় এচিং-এর জনক। [১]

তিনি পূর্ণশশী দেবী এবং পুলিশ অফিসার ও কবি কুুলচন্দ্র দের পাঁচ সন্তানের মধ্যে একজন।[২] তিনি শান্তিনিকেতনের ছাত্র ছিলেন এবং ভারতের শুষ্কপৃষ্ঠা-নকশার অগ্রদূত হিসেবে বিবেচিত। মুকুল দের সমগ্র পরিবার শিল্পী প্রতিভায় ভরা ছিল; তার ভাই মনীষী দে একজন সুপরিচিত চিত্রশিল্পী ছিলেন এবং তাদের দুই বোন- অন্নপুর্ণা এবং রানী চন্দ, ওনারাও কলা এবং কারুশিল্পে সুদক্ষ ছিলেন।[৩]

মুকুল দে বিবাহ করেন বীণা রায়কে, যিনি বেঙ্গলের (খানাকুল) অধিবাসী ছিলেন। তাদের একটি মাত্র কন্যা ছিল, নাম মঞ্জুরি। তারা তাকে আদর করে বুখুমা বলে ডাকত। এবং পরবর্তীতে তাদের কন্যা মঞ্জুরি বঙ্গ স্কুল অফ আর্টের মুখ্য চিত্রশিল্পী শান্তনু উকিলের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।[৪]

প্রাথমিক জীবন[সম্পাদনা]

মুকুল দে'র জন্ম অবিভক্ত বাংলার অধুনা বাংলাদেশের শ্রীধরখোলা গ্রামে হলেও শৈশব কেটেছে পিতার কর্মস্থল মেদিনীপুরে এবং শান্তিনিকেতনের ব্রহ্মচর্যাশ্রমে। এখানে ব্রহ্মচারী ওঙ্কারানন্দের কাছে তাঁর চিত্রাঙ্কনের হাতেখড়ি। তমলুকের হ্যামিলটন হাই স্কুলে পড়ার সময় ওই স্কুলের ছাত্র শহীদ ক্ষুদিরাম বসুর সঙ্গে তাঁর হৃদ্যতা ছিল। ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি শান্তিনিকেতনের ব্রহ্মচর্যাশ্রমে ভরতি হন। তিনি শৈশবে মা পূর্ণশশী দেবী আঁকা দেখে পাঁচ বৎসর বয়স থেকে আঁকতে শেখেন, শান্তিনিকেতনে নিজের খেয়ালেই ছবি আঁকতেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উৎসাহে কলকাতায় গিয়ে অবনীন্দ্রনাথকে ছবি দেখাতেন এবং তাঁর কাছে অনুশীলন করেন। অবনীন্দ্রনাথের নির্দেশে ১৯১১ খ্রিস্টাব্দ হতে ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে অসিতকুমার হালদার নন্দলাল বসুর কাছেও তাঁর চিত্রকলার অনুশীলন সম্পন্ন হয়। সেখানকার শিক্ষক উইলিয়াম পিয়ার্সনের সাহচর্য ও ভালোবাসা তাঁর শিল্পীজীবনকে সমৃদ্ধ করে। [১]

মুকুল দে প্রথম ভারতীয় শিল্পী ছিলেন যিনি একটি শিল্প হিসেবে মুদ্রণযন্ত্রের অধ্যয়ন করার উদ্দেশ্যে বিদেশে ভ্রমণ করেন।[৫] ১৯১৬ সালে,টোকিও ও ইয়োকোহামাতে,তিনি ইয়োকয়ামা তাইকান ও কানজান শিমোমুরার অধীন অধ্যয়ন করেন। ইয়োকোহামাতে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও মুকুল দে, জাপানি রেশম-ব্যবসায়ী তমিতারো হারার বিখ্যাত গেস্ট হাউস সানচেইনে বসবাস করতেন, এবং ক্লাসিক্যাল চীনদেশীয় ভাষা এবং নিহোঙ্গা স্টাইলের জাপানি পেইন্টিং অধ্যয়ন করার বিরল সুযোগ উপভোগ করেন, বিশেষ করে সেশু তয়ওর সেরা শিল্পকর্ম।

তিনি তার প্রথম প্রশিক্ষণ শান্তিনিকেতনে গ্রহণ করেন।১৯১৬ সালে তিনি জাপান থেকে আমেরিকা ভ্রমণ করেন, এবং শিকাগোতে জেমস ব্লানডিঙ স্লয়ান এবং বর্থা জ্যাকস এর অধীনে নকশার কৌশল শিখতে যান, আমেরিকান শিল্পী রই পারট্রিডজ এবং তার স্ত্রী ইমজেন কানিংহামের সৌজন্যে। মুকেল দে আহমেদ শিকাগো সোসাইটি অব এ্যাচার্সের আজীবন সদস্য ছিলেন।১৯১৭ সালে ভারতে ফিরে আসেন এবং নকশার তৈরি,একটি চমৎকার শিল্প হিসেবে মনোনিবেশ করেন। তিনি সমৃদ্ধ এবং বিখ্যাত পোর্ট্রেট অঙ্কন তৈরীর মাধ্যমকে সমর্থন করেন এবং এগুলি শিল্পচর্চায় পরিণত করেন।১৯২০ সালে আবার তিনি অধ্যয়নের উদ্দেশ্যে বিদেশে ভ্রমণ করেন,এই সময় ফ্রাঙ্ক শর্ট এবং মুইরহেড বোনের অধীনে নকশা এবং খোদাই শিখতে যান।তিনি লন্ডনে স্ল্যাড স্কুল অব ফাইন আর্ট এবং রয়্যাল কলেজ অব আর্ট উভয়তেই অধ্যয়ন করেন। স্ল্যাড স্কুল অফ আর্টে,তার অধ্যাপক ছিলেন হেনরি তঙ্কস।[৬]

কর্মজীবন[সম্পাদনা]

১৯২৪ সালে মুকুল দে, কলকাতার গভর্নমেন্ট স্কুল অফ আর্ট অ্যান্ড ক্র্যাফটের প্রথম ভারতীয় অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। যেহেতু তিনি ব্রিটিশদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত শিল্প প্রতিষ্ঠানে ভারতীয় পরিচয় প্রকাশ করার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলেন, তিনি দ্রুত কোম্পানী স্কুলের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত শিক্ষকদের প্রতিষ্ঠানের বাইরে নিক্ষেপ করেন।[৭] তাঁরই উদ্যোগে ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে সরকারি এই চারু ও কারুকলা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি সহশিক্ষামূলক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। ধাতুর পাত্রের উপর আঁক কেটে ছবির উপযুক্ত পরিলেখ তৈরি করে ছাপ নেওয়ার কৌশলে তিনি বিশেষ দক্ষ ছিলেন। তাঁকে ভারতীয় এচিং-এর জনক বলা হয়। ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে আঁকা তাঁর অসংখ্য ছবির মধ্যে চারটি প্রতিকৃতি ― আলবার্ট আইনস্টাইন, রবীন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথ ও গগনেন্দ্রনাথ ― স্মরণীয়। [৬]

রবীন্দ্র-সাহচর্য[সম্পাদনা]

শিল্পী মুকুল দে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঘনিষ্ঠ সাহচর্য লাভ করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ যাদের কাছে তার চিত্রাঙ্কনের কথা সর্বপ্রথম বলেছিরেন তাদের মধ্যে অন্যতম মুকুল দে। ১৯০৯ সালের এপ্রিল মাসে এক দুপুরবেলা মুকুল দে-কে ডেকে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ঘরে থাকা দেরাজ খুলে মোটা চামড়া বাঁধাই কালোখাতা বের করে দিলেন। তাতে ছিল বেশ কিছু ‘হেড ও ফিগার স্টাডি‌’ ও আলংকারিক নকশা। ১৯১৬ সালে রবীন্দ্রনাথ জাপান ভ্রমণ করেছিলেন। এই ভ্রমণে তাঁর সঙ্গে ছিলেন দুজন ভারত অনুরাগী উইলিয়াম উইনস্ট্যানলি পিয়ার্সন সিএফ এন্ড্রুজ এবং তরুণ শিল্পী মুকুলচন্দ্র দে। ১৯২৮ সালের আগষ্ট মাসের প্রায় পুরোটা সময় রবীন্দ্রনাথ গর্ভনমেন্ট আর্ট স্কুলের নবনিযুক্ত অধ্যক্ষ মুকুলচন্দ্র দে’র ২৮ চৌরঙ্গী রোড, কলকাতা’র বাসভবনে করেছিলেন। এ সময় তিনি ১২৬টি ছবি এঁকেছিলেন। মুকুল দে রবীন্দ্রনাথকে কলকাতায় চিত্রপ্রদর্শনী অনুষ্ঠানের বিষয়ে অনুরোধ করেছিলেন। ১৯৩১ সলের ৬ জুন দার্জিলিং থেকে অনুজ শিল্পী মুকুল চন্দ্র দে’কে লেখা পত্রে বীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভারতের মাটিতে তাঁর চিত্র প্রদর্শনী অনুষ্ঠানের বিষয়ে অনীহা প্রকাশ করেছিলেন। পরে মুকুল চন্দ্র দে’কে লেখা ১৮ জুনের পত্রেকলকাতায় চিত্র প্রদর্শনী অনুষ্ঠানের ব্যাপারে সম্মতি জ্ঞাপন করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এরই অনুবর্তীক্রমে মুকুল চন্দ্র দে’র উদ্যোগে কলকাতার গভর্নমেন্ট স্কুল অব্ আর্ট-এ ১৯৩২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি থেকে ৭ মার্চ পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিত্র প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এ উপলক্ষে একটি সচিত্র ক্যাটালগ প্রকাশ করা হয়েছিল। এছাড়া ১৯৩৫ সালের ২৭শে ডিসেম্বর তারিখে লেখা চিঠি থেকে প্রতীয়মান হয় রবীন্দ্রনাথ মুকুল চন্দ্র দে’র সঙ্গে ভারতের ‘জাতীয় শিল্পমন্দির’ স্থাপন প্রসঙ্গে পত্রালোচনা করেছিলেন। [৮]

প্রদর্শশালা[সম্পাদনা]

মুকুল দে এর কৃতকর্ম ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড অ্যালবার্ট মিউজিয়াম, লন্ডন, ইন্ডিয়ান মিউজআন,কলকাতা, দ্যা ন্যাশনাল গ্যালারী অফ মডার্ন আর্ট এনজিএমএ,মুম্বাই এবং দ্যা ন্যাশনাল গ্যালারী অফ আর্ট,নিউ দিল্লিতে সংগ্রহ রাখা আছে।তার সংরক্ষণাগার শান্তিনিকেতনে চিত্রেলখা নামক, তার প্রাক্তন গৃহে অবস্থিত।[৬]

পুরস্কার ও সম্মাননা[সম্পাদনা]

মুকুল দে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অবনীন্দ্রনাথ পুরস্কার, বিশ্বভারতীর গগন-অবনী পুরস্কার এবং রবীন্দ্রভারতীর সম্মানসূচক ডি.লিট.উপাধিতে সম্মানিত হয়েছিলেন। ১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দে ভারত সরকারের ললিতকলা অকাদেমির ফেলো নির্বাচিত হন।[১]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. অঞ্জলি বসু সম্পাদিত, সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান, দ্বিতীয় খণ্ড, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, জানুয়ারি ২০১৯ পৃষ্ঠা ৩১৭, আইএসবিএন ৯৭৮-৮১-৭৯৫৫-২৯২-৬
  2. The International Who's Who 1943–44. George Allen & Unwin, 8th edition, London, 1943, p. 197.
  3. Satyasri Ukil: "Manishi Dey: The Elusive Bohemian." art etc. news & views, February 2012 [১] ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২৮ এপ্রিল ২০১৮ তারিখে
  4. Satyasri Ukil: "Shantanu Ukil: Profile of the Painter." Mukul Dey Archives, undated - retrieved 03.Oct.2015 [২] ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ১৫ মার্চ ২০১৮ তারিখে
  5. Bhavna Kakar, Mark, Etch and Print, Art and Deal / Art Konsult, 2006
  6. "Mukul Dey Archives"। ৪ জানুয়ারি ২০০৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৪ মার্চ ২০১৮ 
  7. Partha Mitter, The Triumph of Modernism, Oxford University Press, 2007
  8. প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, “রবীন্দ্র বর্ষপঞ্জী”, ১৯৬২।

বহিঃসংযোগ[সম্পাদনা]