মহারাজা রুদ্রনারায়ণ রায়মুখুটি

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
মহারাজা রুদ্রনারায়ণ রায়মুখুটি (মুখোপাধ্যায়)
ভূরিশ্রেষ্ঠের মহারাজা
পূর্বসূরিশিবনারায়ণ রায়
উত্তরসূরিভবশঙ্করী
স্ত্রীভবশঙ্করী
বংশধরপ্রতাপনারায়ণ
পিতাশিবনারায়ণ রায়

 

মহারাজা রুদ্রনারায়ণ রায়মুখুটি ( বাংলা: মহারাজা রুদ্রনারায়ণ রায়মুখুটি )(১৬ শতক) ছিলেন বাঙ্গালার ভূরিশ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্যের সম্রাট এবং ষোড়শ শতকে পূর্ব ভারতের সবচেয়ে শক্তিশালী হিন্দু শাসক । তিনি তার রাজ্যকে সামরিকভাবে সুসংহত ও শক্তিশালী করেন এবং উত্তরে বর্ধমান থেকে দক্ষিণে উড়িষ্যা পর্যন্ত ভূরিশ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্য প্রসারিত করেন । তিনি ভূরিশ্রেষ্ঠ রাজ্য কে সেই সময়ের সবচেয়ে শক্তিশালী হিন্দু রাজ্যে রূপান্তরিত করেছিলেন । তিনি উড়িষ্যা সালতানাতের লোহানী পাঠান সুলতানদের সরাসরি বিরোধিতা শুরু করেন এবং কাররানী আফগানদের সম্মুখ যুদ্ধে পরাজিত করে পূর্ব ভারতে পাঠান শাসনের পতনের সামরিক ভিত্তি স্থাপন করেন ।

জীবনের প্রথমার্ধ[সম্পাদনা]

রুদ্রনারায়ণ এক ঋষিকুল ভরদ্বাজ গোত্রীয় রাঢ়ি ব্রাহ্মণ পরিবারে ভূরিশ্রেষ্ঠের বিখ্যাত রায়মুখুটি (মুখোপাধ্যায়) বংশে জন্মগ্রহণ করেন। [১] তিনি রাজা শিবনারায়ণ রায়ের একমাত্র সন্তান ছিলেন। [২] রুদ্রনারায়ণ একজন দক্ষ তরোয়ালবাজ ছিলেন। রাজপুত্র থাকাকালীন তিনি তাঁর বাবার রাজ্য বিষয় পরিচালনার ক্ষেত্রে সাহায্য করতেন। [৩] শিবনারায়ণ তাঁর যোগ্য উত্তরসূরির উপর রাজকীয় দায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন এবং আত্মিক কর্মে নিজেকে নিযুক্ত করেছিলেন।

রাজত্ব[সম্পাদনা]

তাঁর পিতার মৃত্যুর পরে তিনি ভূরিশ্রেষ্ঠের সিংহাসন গ্রহণ করেছিলেন। একজন শাসক হিসেবে তিনি প্রথমে পেন্দো এবং দোগাছিয়া রাজপরিবারের দুটি শাখাকে একত্রিত করেছিলেন। এরপর তিনি দক্ষিণ পশ্চিম বাংলাকে তাঁর নিয়ন্ত্রণকে আনার জন্য মনোনিবেশ করেছিলেন এবং এর বেশিরভাগ অংশকে ভূরিশ্রেষ্ঠের আওতায় এনেছিলেন। তাঁর রাজ্যের অধীনে হাওড়া, হুগলি, পূর্ব মেদিনীপুর, পশ্চিম মেদিনীপুরের প্রধান অংশ এবং বর্ধমানের দক্ষিণ পশ্চিম অংশ এবং উড়িষ্যার উত্তর অংশ অন্তর্ভুক্ত ছিল। [৪] তিনি নৌবাহিনীকে সংগঠিত করেছিলেন। দামোদর এবং রনে যুদ্ধ পারদর্শী বেশ কিছু লোক রাখেন। তিনি তমলুক, আমতা, উলুবেড়িয়া, খানাকুল, ছৌনাপুর এবং নস্করডাঙা থেকে সৈন্য সংগ্রহ করেছিলেন। [৫]

ত্রিবেণীর যুদ্ধ[সম্পাদনা]

নিজের অবস্থান সুসংহত করার পরে তিনি ওড়িশার উদীয়মান পাঠান সুলতানকে মোকাবিলার জন্য স্থানীয় সংঘবদ্ধকরণ করার দিকে মনোনিবেশ করেছিলেন এবং উড়িষ্যার গজপতি মুকুন্দদেবের সাথে যোগাযোগ করেছিলেন। তিনি কলিঙ্গ এর শাসক গজপতি মুকুন্দ দেবের সাথে জোট বেঁধেছিলেন। [৩] ১৫৬৫ সালে মুকুন্দদেব আকবরের আধিপত্য স্বীকার করেন [৬] এবং মুঘল বাদশাহের বিরুদ্ধে বিদ্রোহকারী গৌড়ের পাঠান সুলায়মান কররানিকে আক্রমণ করতে রাজি হন। ভূরিশ্রেষ্ঠ ও উড়িষ্যার সম্মিলিত বাহিনী ত্রিবেণীতে পাঠান বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করেছিল। এই যুদ্ধে ভূরিশ্রেষ্ঠ বাহিনীকে নেতৃত্ব দেন রাজা রুদ্রনারায়ণের ভাই ও সেনাপতি রাজীবলোচন রায় । তুমুল যুদ্ধ শুরু হয় এবং পাঠান বাহিনী পুরোপুরি নাস্তানাবুদ হয়। সম্মিলিত বাহিনী অসাধারণ বীরত্ব ও সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিল। তাঁরা পাঠান সেনাবাহিনীকে আক্ষরিক অর্থে ধ্বংস করেছিলেন। এই বিজয়ের কারণে মহারাজা রুদ্রনারায়ণ সপ্তগ্রামের নিয়ন্ত্রণ অর্জন করেছিলেন। [৪] [৭] তিনি গঙ্গার তীরে গজগিরিতে একটি ঘাটে ত্রিবেণীতে একটি মন্দির নির্মাণ করেছিলেন। [৮]

মুকুন্দদেবের উপর কালাপাহাড়ের আক্রমণ[সম্পাদনা]

ত্রিবেণীর যুদ্ধে পরাজয়ের পর সুলায়মান কররানি শান্তি বজায় রাখতে বাধ্য হন। [৯] তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে রুদ্রনারায়ণের অন্যতম শক্তি হল তার ভাই ও সেনাপতি রাজীবলোচন । তাকে নিজের দলে আনতে পারলে তার ভুরিশ্রেষ্ঠ জয় অনেক সোজা হয়ে যাবে। ১৫৬৮ তে তিনি কালাপাহাড়কে আফগান সেনার নেতৃত্ব দিয়ে উড়িষ্যা আক্রমণ করতে পাঠালেন। উড়িষ্যার রাজা মুকুন্দদেব শোচনীয়ভাবে পরাজিত হলেন । উড়িষ্যার প্রধান শহর ও ধর্মীয় স্থান কটক, যাজপুর, সম্বলপুর, কোনার্ক, একামরোক্ষেত্র, পুরী ইত্যাদি [১০] কেড়ে নেয়া হল। এক মতে শেষ পর্যন্ত কালাপাহাড় ওড়িশার সম্বলপুরে দেবী সমলেশ্বরীর দ্বারা নদীতে ডুবে মরেন। অন্যমতে তিনি মহারাজ কংসনারায়ণ'র পাঠানদের হারিয়ে গৌড় বিজয়ের সময় বারেন্দ্র সেনার দ্বারা নিহত হন ।

কতলু খানের সাথে দ্বন্দ্ব[সম্পাদনা]

কালপাহাড়ের কারণে গৌড়ের সুলতানের সাথে ভূরিশ্রেষ্ঠের সুসম্পর্ক নষ্ট হয়। সুলেমান কররানীর মৃত্যুর পরে দাউদ খান কররানী মুঘলদের বিরুদ্ধে সাহায্যের জন্য রুদ্রনারায়ণকে রাজি করাতে চেষ্টা করেন কিন্তু ব্যর্থ হন। তার পরে কতলু খান আরও একবার তাঁর কাছে সাহায্যের জন্য যোগাযোগ করেছিলেন। কিন্তু তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। [১১] এতে কতলু খান ভূরিশ্রেষ্ঠকে আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু ভূরিশ্রেষ্ঠ সেনা ও নৌবাহিনীর শক্তি দেখে ভয় পেয়ে সে পশ্চিম থেকে রাজ্য আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। আকবর যখন খবর পেল যে পাঠান সেনাবাহিনী বাংলার দিকে যাত্রা করছে তখন তিনি মান সিংহের পুত্র জগৎ সিংয়ের নেতৃত্বে ৫০০০ অশ্বারোহীর একটি সেনাদল প্রেরণ করেছিলেন। [৫] তিনি ভুরিশ্রেষ্ঠ ও বিষ্ণুপুরের কাছে একটি জোট তৈরির আমন্ত্রণ জানান।

কতলু খান প্রথমে মান্দারনের গড়নায়েককে ভয় দেখানোর চেষ্টা করে এবং তাকে নিজের পক্ষে করার চেষ্টা করে। কিন্ত ব্যর্থ হলে দুর্গ আক্রমণ করে। জেহানাবাদে আগত জগত সিং পশ্চিম থেকে কতলু খানকে আক্রমণ করেন। আর বিষ্ণুপুরের সৈন্যরা উত্তর থেকে এবং ভূরিশ্রেষ্ঠের সৈন্যরা পূর্ব থেকে আক্রমণ করেছিল। যুদ্ধে দুর্গের সেনাপতি এবং কতলু খান নিহত হন। এই যুদ্ধে গুরুতর আহত হয়েছিলেন জগৎ সিং। মহারাজা রুদ্রনারায়ণ তাকে পাঠান সেনাপতি ওসমান খানের হাত থেকে বাঁচিয়ে বিষ্ণুপুরে নিয়ে যান এবং তাঁর চিকিৎসা করেছিলেন। পাঠান সেনাপতি ওসমান খান যুদ্ধে হেরে তার বাহিনী নিয়ে ওড়িশায় পালিয়ে গেলেন। [৫]


 

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. Raybaghini o Bhurishrestha Rajkahini, Bhattacharya
  2. Bhattacharya, Raybaghini O Bhurishrestha Rajkahini, pp. xxiv
  3. Bhattacharya, Raybaghini O Bhurishrestha Rajkahini, pp. 91
  4. Bhattacharya, Raybaghini O Bhurishrestha Rajkahini, pp. 92
  5. Bhattacharya, Raybaghini O Bhurishrestha Rajkahini, pp. 117
  6. Pathak, Durga Prashad (১৯৮৯)। Palm leaf etchings of Orissa। Abhinav Publications। পৃষ্ঠা 4। সংগ্রহের তারিখ ১৯ আগস্ট ২০১০ 
  7. Chatterjee, Gouripada (১৯৮৭)। History of Bagree Rajya (Garhbeta)। Mittal Publications। পৃষ্ঠা 6। সংগ্রহের তারিখ ১৯ আগস্ট ২০১০ 
  8. Bhattacharya, Raybaghini O Bhurishrestha Rajkahini, pp. 96
  9. Bhattacharya, Raybaghini O Bhurishrestha Rajkahini, pp. 97
  10. Pathak, Durga Prashad (১৯৮৯)। Palm leaf etchings of Orissa। Abhinav Publications। পৃষ্ঠা 4। সংগ্রহের তারিখ ১৯ আগস্ট ২০১০ 
  11. Bhattacharya, Raybaghini O Bhurishrestha Rajkahini, pp. 116
মহারাজা রুদ্রনারায়ণ রায়মুখুটি
ভুরিশ্রেষ্ঠ রাজবংশ
শাসনতান্ত্রিক খেতাব
পূর্বসূরী
শিবনারায়ণ
মহারাজা রুদ্রনারায়ণ রায়মুখুটি(ভুরিশ্রেষ্ঠের মহারাজা) উত্তরসূরী
ভবশঙ্করী