বৈদ্যব্রাহ্মণ
বৈদ্যব্রাহ্মণ(Sanskrit: वैद्यब्राह्मण ) এর বৈদ্য এবং বেদ একই শব্দমূল বিদ ধাতু থেকে উৎপন্ন যার অর্থ জ্ঞান এবং বৈদ্য অর্থ বেদজ্ঞানী ,ঋগ্বেদে বৈদ্য শব্দের অর্থ "বেদজ্জাতঃ" বা বেদ চর্চাকারী জাত ।এ সম্বন্ধিয় ঋক টি হলো "বেদজ্জাতঃ বৈদ্যঃ স্যাৎ"।বৈদিক ব্রাহ্মণরা গুরুশিষ্য পরম্পরায় বেদ শ্রবণ করে ধারণ করতেন এবং বৈদ্য হতেন।কিন্তু বৈদিক যুগের পর আয়ুর্বেদী বৈদ্য ছাড়া অন্য বেদশাখার বৈদ্য ব্রাহ্মণরা পৌরাণিক দেবদেবীর পৌরহিত্য করতে থাকে এবং বৈদ্যত্ব হারায়।
আরেকটি মতানুসারে, ঋক বেদের সময়কালে বঙ্গ-বিহারের উত্তরাঞ্চল ও নেপালের দক্ষিনাঞ্চল নিয়ে বিদেহ রাজ্য গঠিত ছিল;বিদেহ রাজ্যের অধিবাসীদের বৈদহ এবং ব্রাহ্মণদের বলা হত বৈদহব্রাহ্মণ>বৈদ্যব্রাহ্মণ এই ব্রাহ্মণদের বৈশিষ্ট্য ছিল এরা বৈদিক যজ্ঞ করতেন এবং পৌরাণিক দেবদেবীর পূজা কিংবা পৌরহিত্যকে অবৈদিক/অবৈধ পেশা মনে করতেন।তারা বৈদিক চিকিৎসাবৃত্তিকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন,একারণে বৈদ্য শব্দের আক্ষরিক অর্থ " বৈদিক জ্ঞানসম্পন্ন " হলেও আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক বোঝাতেই এই শব্দটির ব্যবহার হতে থাকে। বৈদ্যব্রাহ্মণদের ত্রিজ বলা হয়ে থাকে।ত্রিজভূক্তি নামে বিদেহ রাজ্যের একটি ভূক্তি ছিল।
মূলত বৈদিক ব্রাহ্মণদের যে শাখা আধ্যাত্মিক ভারতীয় চিকিৎসা শাস্ত্র তথা উপবেদ " আয়ুর্বেদ'" অনুশীলন করতেন সেই সম্প্রদায়ের বেদজ্ঞানীগণ বৈদ্য ব্রাহ্মণ[১] [২][৩] হিসেবে পরিচত।শাস্ত্রানুসারে ব্রাহ্মণকুলজাত ব্যক্তিগণ বিপ্র (অর্থাৎ জ্ঞানী) এবং দ্বিজ অভিহিত হয়ে থাকেন (অর্থাৎ দু'বার জাত), ব্রহ্মান্ড পুরাণ অনুসারে দ্বিজত্ত প্রাপ্তির পর যাঁরা চৌদ্দ শাস্ত্র অধ্যয়নে ব্রতী হতেন এবং পুনরায় উপনীত হয়ে বেদের উপবেদ রূপে আয়ুর্বেদ অধ্যয়ন করতেন তাঁদের 'বৈদ্যব্রাহ্মণ বা ত্রিজ[৪] নামে অবিহিত করা হত।[৫] মহাভারতের উদ্যোগপর্বে বলা হয়েছে, ‘‘ প্রাণী অপ্রাণীর মধ্যে প্রাণীরা শ্রেষ্ঠ, প্রাণীদের মধ্যে বুদ্ধিমানরা শ্রেষ্ঠ, বুদ্ধিমানদিগের মধ্যে মানুষ শ্রেষ্ঠ, মানুষদিগের মধ্যে ব্রাহ্মণরা শ্রেষ্ঠ, ব্রাহ্মণগণের মধ্যে বৈদ্যরা শ্রেষ্ঠ, বৈদ্যগণের মধ্যে যাদের বুদ্ধি পরিণত হয়ে সাধনার অভিমুখে চালিত হয়েছে, তাঁরা শ্রেষ্ঠ। ’’ ফণিভূষণ আচার্যের ‘শব্দসন্ধান’-এ বৈদ্যের ব্যাখ্যা, ‘‘যিনি সর্ববিদ্যায় পারদর্শী: বৈদ্য, যিনি সকল বেদে দক্ষ: বৈদ্য এবং যিনি চিকিৎসাশাস্ত্রে কুশল: বৈদ্য।’’
প্রচলিত একটি মতে দেবাসুরের সমুদ্র মন্থনকালে ধন্বন্তরীর জন্ম হয় এবং বৈদ্যরা তার উত্তরপুরুষ। অন্য মতে ধন্বন্তরীর জন্ম হয় জনৈক মুনির বৈদিক মন্ত্র জপের মাধ্যমে তাই তিনি বৈদ্য নামে পরিচিত হন। [৬]
পেশাদারী ইতিহাস[সম্পাদনা]
প্রাচীণকালে সকল শ্রেণীর ব্রাহ্মণ বৈদ্য হতে পারত।কালক্রমে পেশাগত কারণে বৈদ্যদের একটি স্বতন্ত্র সমাজ গড়ে ওঠে এবং নিজেদের মধ্যে আয়ুর্বেদ,অথর্ববেদ ছাড়াও গুপ্তবিদ্যা বা স্বতন্ত্র দক্ষতাসম্পন্ন চিকিৎসাবিদ্যার প্রসার লাভ করে এবং বংশানুক্রমিক আলাদা একটি সম্প্রদায়ের সূচনা হয়।এ কারণে অন্য পেশার ব্রাহ্মণরা চাইলেও আর বৈদ্যদের সমকক্ষ পেশাদারী হতে পারত না।প্রাচীণ ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থা চিকিৎসা ক্ষেত্রে বৈদ্যদের উপর নির্ভরশীল ছিল।প্রবীণ অনুশীলনকারী বা শিক্ষকদের সম্মানের চিহ্ন হিসাবে বৈদ্যরাজ ("চিকিৎসক-রাজা") বলা হত। কিছু অনুশীলনকারী যাদের গ্রন্থগুলির সম্পূর্ণ জ্ঞান ছিল এবং অনুশীলনে দক্ষ ছিলেন তারা প্রানাচার্য নামে পরিচিত ছিলেন। ভারতের কিছু রাজপরিবারের ব্যক্তিগত বৈদ্য ছিল এবং তাদের রাজবৈদ্য ("রাজার চিকিত্সক") হিসাবে উল্লেখ করা হত।মুসলিম শাসনামলে ইউনানী, ইংরেজ উপনিবেশিক কালে হোমোপ্যাথিক এবং অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসা ব্যবস্থার আবির্ভাব হলে বৈদ্যব্রাহ্মণ শ্রেণির প্রভাব কমে যায় এবং বৈদ্যদেরকে প্রচুর পরিমাণে নিজ পেশা পরিবর্তন করে অন্যান্য আধুনিক পেশায় নিয়োজিত হতে দেখা যায়।
শ্রেণি বিভাগ[সম্পাদনা]
প্রাচীনকালে যেহেতু সকল শ্রেণীর ব্রাহ্মণ বৈদ্য হতে পারত তাই বৈদ্যদের মাঝে শ্রেনীবিভাগও অনেক কিন্তু সকলে মিলে "বৈদ্যব্রাহ্মণ" নামে একটি সম্প্রদায়ে সমবেত হয়।[৭] কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বৈদ্যব্রাহ্মণ শ্রেণি:
- শাকদ্বীপি বৈদ্যব্রাহ্মণ: শাকদ্বীপি ব্রাহ্মণ বলতে শাকদ্বীপ (পাশ্চাত্য) হতে আগত ব্রাহ্মণ। এই ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের প্রায় পুরোটাই বৈদ্য অর্থাৎ আয়ুর্বেদ চর্চাকারী।
- সারস্বত বৈদ্যব্রাহ্মণ:পুরো ভারতবর্ষে এই সারস্বত বৈদ্য শ্রেণি বিদ্যমান। [৭]
- গৌড় সারস্বত বৈদ্যব্রাহ্মণ: বাংলাদেশ,পশ্চিমবঙ্গ,কর্ণাটক,কেরালায় সাধারণত এই শ্রেণি দেখা যায়।[৭]
- পাঞ্জাবি সারস্বত বৈদ্যব্রাহ্মণ: পাঞ্জাবে স্বারস্বত ব্রাহ্মণদের মাঝে এই বৈদ্যশ্রেণি বিদ্যমান।এরা ময়হাল ব্রাহ্মণ হিসেবেও পরিচিত। [৮]
- রাঢ়ী বৈদ্যব্রাহ্মণ:বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে দেখা যায়।[৭]
- বরেন্দ্র বৈদ্যব্রাহ্মণ: বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে দেখা যায়।[৭]
- পুষ্পক বৈদ্যব্রাহ্মণ: কেরালায় এ বৈদ্যব্রাহ্মণ শ্রেনি অষ্টবৈদ্য নামে পরিচিত।[৯][১০][১১]
- উৎকল বৈদ্যব্রাহ্মণ: এদের আদি নিবাস উড়িষ্যায় হলেও বাঙলায়ও এই বৈদ্যব্রাহ্মণ দেখা যায়।
বৈদ্যব্রাহ্মণ পদবী[সম্পাদনা]
- সেন : সেনগুপ্ত, সেনশর্মা,সেন চৌধুরী, সেন লাল
- গুপ্ত: সেনগুপ্ত, দাশগুপ্ত, দত্তগুপ্ত, গুপ্তশর্মা, ধরগুপ্ত, করগুপ্ত।
- শর্মা : সেনশর্মা, গুপ্তশর্মা, দাশশর্মা, ধরশর্মা , করশর্মা, দেবশর্মা
- আচার্য : সেন আচার্য, গুপ্ত আচার্য
- মল্লিক (উপাধি)
- মজুমদার(উপাধি)
আচার অনুষ্ঠান[সম্পাদনা]
বৈদ্যরা বৈদিক ব্রাহ্মণ হওয়ায় বৈদিক আচারকে প্রাধান্য দিয়ে পৌরাণিক বিভিন্ন দেবদেবীর পূজাকে গ্রহন করেনি এবং পৌরহিত্যও করেনি।বৈদ্য রাজারা বিভিন্ন বৈদিক যজ্ঞের আয়োজন করতেন এবং এসব যজ্ঞে বৈদ্যরা ঋত্বিকের ভূমিকা পালন করতেন। উল্লেখযোগ্য কিছু যজ্ঞ
- রাজসূয় যজ্ঞ
- অশ্বমেধ যজ্ঞ
- পুত্রেষ্টি যজ্ঞ
- সর্প যজ্ঞ
- বৈদ্যনাথ(শিব) পূজা
- অশ্বিনীকুমার পূজা
- চন্দন: চন্দন বৈদ্যদের একটি সামাজিক অনুষ্ঠান। বিবাহ ও দত্তকগ্রহণ প্রভৃতি মাঙ্গলিক উৎসবে এটি অনুষ্ঠিত হয় । চন্দন উপলক্ষে সমস্ত বৈদ্য সন্তান কে নিমন্ত্ৰণ করতে হয়। নির্দিষ্ট দিবসে নিমন্ত্রিত ব্যক্তিগণ সমবেত হলে, এক সভামণ্ডপে তারা সমাসীন হন । সভার সর্বপ্রধান স্থানে সমাজপতি এবং তঁহার উভয় পাশ্বে অরবিন্দ, বিকৰ্ত্তন এবং প্রভাকর বংশীয় বৈদ্যগণ উপবেশন করেন। তৎপর অস্তান্ত বংশীয় কুলীনগণ, অষ্টঘর শ্রেণীস্থ বৈদ্যগণ এবং অপরাপর বংশীয় বৈদ্য-সন্তান ক্রমন্বয়ে উপবিষ্ট হলে, কৰ্ম্মকৰ্ত্তা ঐ সভাস্থলে আসন পরিগ্রহ করেন। অতঃপর জনৈক কুলাচাৰ্য্য চন্দনদ্বারা কৰ্ম্মকৰ্ত্তার ললাটে তিলক প্রদান করেন এবং তৎপর সমাজপতি, তার উভয়পাশে উপবিষ্ট কুলীন সন্তানগণের ও অন্যান্য উপস্থিত ব্যক্তিগণের কপালে ক্রমান্বয়ে তিলক প্রদান করে কাৰ্য্যশেষ করেন । এই অনুষ্ঠান উপলক্ষে যে সমস্ত ব্যক্তি আগমন করেন, তারা বংশ মর্য্যাদায় কৰ্ম্মকৰ্ত্তা।[১২]
বৈদিক অর্চনা ছাড়া সাধারণত পৌরাণিক পূজাঅর্চণায় বৈদ্যদের অনীহার কারণে তারা ঋগবেদীয় আয়ুর্বেদ চর্চায় ঝুঁকে পরে এবং পেশাদারি চিকিৎসক জাতিতে পরিণত হয়।
তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]
- ↑ "বৈদ্যব্রাহ্মণ লেখকঃশ্যামাচরণ সেনশর্মা"। bangiyasahityaparishat.org। সংগ্রহের তারিখ ২১ জুন ২০২০।
- ↑ সেনশর্মা, ত্রিভঙ্গমোহন (১০ মার্চ ২০১১)। "কুলদর্পণ"। Wikipedia। ২৬ জুন ২০২০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১০ নভেম্বর ২০১৯।
- ↑ Bose, Nirmal Kumar (১৯৯৪)। Structure of Hindu Society। Orient BlackSwan। পৃষ্ঠা 163। আইএসবিএন 978-8-12500-855-2।
- ↑ Education in Ancient India By Hartmut Scharfe https://books.google.com.bd/books?id=GMyiDwAAQBAJ&pg=PA263&lpg=PA263&dq=Trija+Thrise+born&source=bl&ots=q-cweeBNRR&sig=ACfU3U1z7hVjcAYduTYoeENPTu68Lv3pog&hl=bn&sa=X&ved=2ahUKEwjN7_L2na_sAhXFeisKHaTwCQoQ6AEwBHoECAYQAQ#v=onepage&q=Trija%20Thrise%20born&f=false
- ↑ Brahmanda-Puranam: inspired, inwardly stirred, wise, learned, etc.
- ↑ "উৎপত্তি"
- ↑ ক খ গ ঘ ঙ সেনশর্মা, ত্রিভঙ্গমোহন (১০ মার্চ ২০১১)। "বৈদ্যব্রাহ্মণ কুলপঞ্জিকা"। Wikipedia। ২৬ জুন ২০২০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১০ নভেম্বর ২০১৯।
- ↑ Dutta, Anil (১০ মার্চ ২০১১)। "Vaidya as Punjabi Saraswat Brahmin"। Wikipedia। সংগ্রহের তারিখ ১০ নভেম্বর ২০১৯।
- ↑ Indudharan Menon, Annamma Spudich (অক্টোবর ২০১০)। "The Ashtavaidya physicians of Kerala: A tradition in transition"। Journal of Ayurveda and Integrative Medicine। 1 (4): 245–50। ডিওআই:10.4103/0975-9476.74424। পিএমআইডি 21731370। পিএমসি 3117315
। সংগ্রহের তারিখ ১০ নভেম্বর ২০১৬।
- ↑ V. T. Yadugiri (২৫ আগস্ট ২০১০)। "The Ashtavaidya medical tradition of Kerala" (PDF)। Current Science। 99 (4)। সংগ্রহের তারিখ ১০ নভেম্বর ২০১৬।
- ↑ P. U. Leela (জানুয়ারি ২০১৩)। "Healers in the context of culture: The ashtavaidya tradition of Kerala, South India."। Ancient Science of Life। 32 (S9): S9। ডিওআই:10.4103/0257-7941.123821। পিএমসি 4147565
।
- ↑ https://bn.m.wikisource.org/wiki/%E0%A6%AA%E0%A6%BE%E0%A6%A4%E0%A6%BE:%E0%A6%AE%E0%A6%B9%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%9C_%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%9C%E0%A6%AC%E0%A6%B2%E0%A7%8D%E0%A6%B2%E0%A6%AD_%E0%A6%B8%E0%A7%87%E0%A6%A8_%E0%A6%93_%E0%A6%A4%E0%A7%8E%E0%A6%B8%E0%A6%AE%E0%A6%95%E0%A6%BE%E0%A6%B2%E0%A6%AC%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A7%80_%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%99%E0%A7%8D%E0%A6%97%E0%A6%B2%E0%A6%BE%E0%A6%B0_%E0%A6%87%E0%A6%A4%E0%A6%BF%E0%A6%B9%E0%A6%BE%E0%A6%B8%E0%A7%87%E0%A6%B0_%E0%A6%B8%E0%A7%8D%E0%A6%A5%E0%A7%82%E0%A6%B2_%E0%A6%B8%E0%A7%8D%E0%A6%A5%E0%A7%82%E0%A6%B2_%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%AC%E0%A6%B0%E0%A6%A3.djvu/%E0%A7%AF%E0%A7%AE