বিষয়বস্তুতে চলুন

কিতাব আল মানাজির

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
(বুক অব অপটিক্স থেকে পুনর্নির্দেশিত)
আল হাইসামের বুক অব অপটিক্স এর ১৫৭২ সালের মুদ্রিত সংস্করণের প্রচ্ছদ।[]
লেখকআল হাইসাম
মূল শিরোনামكتاب المناظر
কিতাব আল মানাজির
ভাষাArabic
প্রকাশিত১০১১ থেকে ১০২১

কিতাব আল মানাজির (আরবি: كتاب المناظر; লাতিন: De Aspectibus বা Perspectiva; ইতালীয়: Deli Aspecti; বাংলা: আলোকবিজ্ঞানের বই) মধ্যযুগীয় আরব পণ্ডিত ইবনে আল-হাইসামের আলোকবিজ্ঞান এবং অন্যান্য বিষয়ের উপর রচিত সাত খণ্ডের একটি গ্রন্থ। ইবনে আল হাইসাম (৯৬৫- আনু. ১০৪০ খ্রি.) পশ্চিমে আলহাজেন বা আলহাসেন নামে পরিচিত।

ল্যাটিন অপটিকা থিসোরাসের প্রথম পৃষ্ঠায় আলহাজেনের বুক অব অপটিক্স থেকে নেয়া রংধনু, জাহাজে আগুন দেওয়ার জন্য পরাবৃত্তাকার আয়নার[] ব্যবহার, পানিতে প্রতিসরণের ফলে বিকৃত প্রতিবিম্বের সৃষ্টি এবং অন্যান্য আলোকীয় ক্রিয়ার চিত্র।

বুক অব অপটিক্স বইতে আলহাজেন তৎকালীন সময়ে ব্যাপকভাবে প্রচলিত চোখ থেকে আলো নির্গমন তত্ত্বের (যেমনটি ইউক্লিড তার অপটিকা গ্রন্থে লিখেছেন) বিরুদ্ধে পরীক্ষামূলক যুক্তি উপস্থাপন করে আধুনিক প্রত্যক্ষণ তত্ত্ব প্রস্তাব করেন। এটি বর্তমানে স্বীকৃত যে দৃষ্টির অনুভূতি চোখে আলোর প্রবেশের মাধ্যমে সৃষ্ট।[]:৬০–৬৭[] [][] বইটি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির আদিমতম ব্যবহার, ক্যামেরা অবস্কিউরার বর্ণনা এবং আলহাজেনের বিলিয়ার্ড সমস্যার বর্ণনার জন্যও বিখ্যাত। ১৩শ শতক থেকে ১৭শ শতকে ইউরোপে আলোকবিজ্ঞান, পদার্থবিদ্যা এবং গণিতের বিকাশকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছিল আল হাইসামের কিতাব আল মানজির তথা বুক অব অপটিক্স।[]

প্রত্যক্ষণ বা দৃষ্টির তত্ত্ব

[সম্পাদনা]

বুক অব অপটিক্স রচিত হওয়ার পূর্বে, দৃষ্টির দুটি তত্ত্ব বিদ্যমান ছিল। গণিতবিদ ইউক্লিড এবং টলেমি এক্সট্রামিশন বা নির্গমন তত্ত্ব প্রস্তাব করেছিলেন। তারা দৃঢ়ভাবে মনে করতেন যে চোখ থেকে বিশেষ ধরণের বিকিরণ নির্গত হওয়ায় বস্তু দেখা যায়। চোখ থেকে বিকিরিত রশ্মি কোনো বস্তু পর্যন্ত পৌঁছলে এর সাহায্যে বস্তুটির রঙ, আকৃতি এবং আকার দৃষ্টিগোচর হয়। পক্ষান্তরে অ্যারিস্টটল এবং গ্যালেনের অনুসারীদের ইন্ট্রোমিশন তত্ত্বের যুক্তি ছিল যে দৃষ্টির অনুভূতি বাহ্যিক কোনো বিষয় বা এজেন্ট দ্বারা সৃষ্ট, যা বস্তু বা পরিবেশ থেকে চোখে আসে।

যেহেতু বস্তু সকল দিকে সরল রেখায় আলো বিকিরণ করে, তাই অবশ্যই চোখের বাইরের পৃষ্ঠেও এই আলো আঘাত করে। এই ধারণাটি আল-হাইসাম এবং তার পূর্বসূরীদের জন্য একটি সমস্যা উপস্থাপন করেছিল: যদি এমনটাই ঘটে থাকে তাহলে বস্তুর প্রতিটি বিন্দু থেকে চোখের আসা ভিন্ন ভিন্ন আলোকরশ্মি একসাথে একটি অস্পষ্ট চিত্র সৃষ্টি করবে। আল-হাইসাম প্রতিসরণের ধারণা ব্যবহার করে এই সমস্যার সমাধান করেছিলেন। তিনি যুক্তি দিয়েছিলে, যদিও আলোকিত বস্তুটি চোখে অসীম সংখ্যক আলোর রশ্মি পাঠায়, তবু এই রেখাগুলির মধ্যে শুধুমাত্র একটিই চোখের উপর সোজাসুজি লম্বভাবে পড়ে: অন্যান্য রশ্মিগুলি লম্ব নয় এমন কোণে চোখে আপতিত হয়। আল-হাইথামের মতে, এই রশ্মিগুলো প্রতিসরিত হয়ে বেঁকে যায় ও দুর্বল হয়ে পড়ে। তিনি বিশ্বাস করতেন যে ঐ একটি আলোকরশ্মি ব্যতীত অন্য যেসব রশ্মি চোখে তীর্যকভাবে আঘাত করে তার সাথে দৃষ্টিশক্তির সম্পর্ক নেই।[]:৩১৫–৩১৬

আলো ও বর্ণ বিষয়ক তত্ত্ব

[সম্পাদনা]

বুক অব অপটিক্সে, আল-হাইসাম প্রাথমিক এবং গৌণ আলোর অস্তিত্ব অনুমান করেন, প্রাথমিক আলো শক্তিশালী বা তীব্র। বইটিতে বর্ণনা করা হয়েছে কীভাবে সবচেয়ে পরিচিত প্রকারের আলো স্বপ্রভ বস্তু (যার নিজস্ব আলো আছে) থেকে আসে এবং কীভাবে নিজস্ব আলো না থাকলেও (অর্থাৎ নিষ্প্রভ হওয়া সত্ত্বেও) দৈবক্রমে কিছু কিছু বস্তু স্বপ্রভ বস্তু থেকে আলো গ্রহণ করে এবং নির্গত করে। ইবনে আল-হাইথামের মতে, প্রাথমিক আলো স্বপ্রভ বস্তু থেকেই আসে এবং গৌণ আলো হল দৈবক্রমে (কোনো নিষ্প্রভ) বস্তু থেকে আসা আলো।[]:৩১৭ প্রাথমিক আলোক উৎস থাকলেই নিষ্প্রভ বস্তু থেকে আলো আসা সম্ভব। প্রাথমিক এবং গৌণ উভয় আলোই সরলরেখায় ভ্রমণ করে। তিনি আরও লিখেছেন, স্বচ্ছতা বস্তুর ধর্ম যা তার মধ্য দিয়ে আলোর যাওয়া-আসা নিয়ন্ত্রণ করে, যেমনটি বাতাস এবং পানির ক্ষেত্রে ঘটে; যদিও কোনো বস্তু সম্পূর্ণরূপে আলো পরিবহণ করতে পারে না বা সম্পূর্ণ স্বচ্ছ হতে পারে না। অস্বচ্ছ বস্তু হলো সেসব বস্তু যেগুলির মধ্য দিয়ে আলো সরাসরি যেতে পারে না, যদিও অস্বচ্ছতার মাত্রা রয়েছে যার উপর নির্ভর করে কতটা আলো বস্তুর মধ্য দিয়ে যেতে পারবে। তার মতে, অস্বচ্ছ বস্তুর উপর আলো আপতিত হয়ে ঠিকরিয়ে গিয়ে গৌণ আলো হিসেবে বিকিরিত হয়ে ঐ বস্তুটি আলোকিত বস্তুতে পরিণত হতে পারে। আবার আলো আংশিকভাবে স্বচ্ছ বস্তুর মধ্য দিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে প্রতিসরণ ঘটে এবং উভয় ক্ষেত্রেই আলো সরলরেখায় ভ্রমণ করে। তাছাড়া আলো আয়নার মতো মসৃণ বস্তুকে আঘাত করেও প্রতিফলিত হতে পারে।

আল-হাইসাম অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা উপস্থাপন করেন যা আলো এবং এর সঞ্চালন সম্পর্কে তার তত্ত্বকে সমর্থন করে। তিনি আরও লিখেছেন যে রঙ অনেকটা আলোর মতোই, আলোর স্বরূপের একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য যা বস্তুর প্রতিটি বিন্দু থেকে সরল রেখায় ভ্রমণ করে। পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে তিনি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে, বাতাস ছাড়া রঙের অস্তিত্ব থাকতে পারে না।[]

চোখের শারীরবৃত্ত ও দর্শন কৌশল

[সম্পাদনা]
ইবনুল হাইসামের মতে মানুষের চোখের গঠন। অপটিক স্নায়ুর মিলিতবিন্দু বা অপটিক কায়াজমার চিত্রণটি লক্ষণীয়। — তার কিতাব আল মানাজির এর পাণ্ডুলিপির অনুলিপি। (এমএস ফাতিহ ৩২১২, ভলিউম ১, ফোলিও ৮১বি, সুলায়মানি মসজিদ লাইব্রেরি, ইস্তাম্বুল)

যেহেতু বস্তু থেকে সব দিকেই সরল রেখায় আলোর বিকিরণ ঘটে, তাই চোখের বাইরের পৃষ্ঠেও এই আলো আপতিত হয়। এই ধারণাটি আল-হাইসাম এবং তার পূর্বসূরীদের জন্য একটি সমস্যা তৈরি করেছিল: যদি এমনটাই হয়, তাহলে বস্তুর প্রতিটি বিন্দু থেকে চোখে আসা অসংখ্য আলোকরশ্মির কারণে একটি অস্পষ্ট চিত্র সৃষ্টি হওয়ার কথা। আল-হাইসাম প্রতিসরণের ধারণা ব্যবহার করে এই সমস্যার সমাধান করেছিলেন। তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন যে, যদিও বস্তুটি চোখে অসীম সংখ্যক আলোর রশ্মি পাঠায়, তবুও এই রেখাগুলির মধ্যে শুধুমাত্র একটিই চোখের উপর লম্বভাবে পড়ে: অন্যান্য রশ্মিগুলি লম্ব নয় এমন কোণে চোখে আপতিত হয়। আল-হাইসামের মতে, এই রশ্মিগুলো প্রতিসরিত এবং দুর্বল হয়ে পড়ে। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, একটি রশ্মি ব্যতীত অন্য সব রশ্মি যা চোখে তীর্যকভাবে আপতিত হয় তার সাথে দৃষ্টিশক্তির সম্পর্ক নেই।[]:৩১৫–৩১৬

আল-হাইসামের চোখের গঠনের বর্ণনায় দেখা যায়, চক্ষুর অভ্যন্তরের স্ফটিকের ন্যায় একটি হিউমার বা তরলজাতীয় অংশ (বর্তমানে যা চোখের লেন্স হিসাবে পরিচিত) বস্তু থেকে আলোক রশ্মি গ্রহণ করে এবং আলোকরশ্মি একটি কাল্পনিক শঙ্কু (কোণক) গঠন করে, কোণকটির শীর্ষ থাকে স্ফটিক বা লেন্সে এবং এর নিচের তলে বস্তুর বিম্ব তৈরি হয়। চোখের অন্যান্য অংশগুলি হলো স্ফটিকের (লেন্সের) সামনে থাকা জলীয় তরল (অ্যাকুয়াস হিউমার) ও পিছনে থাকা কাঁচের ন্যায় স্বচ্ছ তরল (ভিট্রিয়াস হিউমার)। এগুলি, তবে, স্ফটিক হাস্যরসের মতো দৃষ্টিভঙ্গিতে একটি ভূমিকা পালন করে না। স্ফটিক হাস্যরস একটি অপটিক স্নায়ুর মাধ্যমে মস্তিষ্কে যে চিত্রটি উপলব্ধি করে তা প্রেরণ করে। []

খণ্ডসমূহ

[সম্পাদনা]
  • প্রথম খণ্ড আল হাইসামের আলো, বর্ণ ও দৃষ্টি সম্পর্কিত তত্ত্ব উপস্থাপন করে।[]
  • দ্বিতীয় খণ্ডে হাইসাম দৃষ্টিগত প্রত্যক্ষণ আলোচনা করেন।[]
  • তৃতীয় ও চতুর্থ খণ্ডে আল হাইসামের দৃষ্টিজনিত ত্রুটি সম্পর্কে ধারণাগুলো উপস্থাপিত হয়েছে।[]
  • পঞ্চম ও ষষ্ঠ খণ্ডে আল হাইসাম আলোর প্রতিফলন সংক্রান্ত পরীক্ষামূলক প্রমাণ দেন।[]
  • সপ্তম খণ্ডে প্রতিসরণের ধারণা আলোচিত হয়েছে।[]

প্রভাব

[সম্পাদনা]

বুক অব অপটিক্স টলেমির অপটিক্স গ্রন্থটি দ্বারা সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হয়েছিল, যেখানে চোখের অঙ্গসংস্থানিক ও শারীরবৃত্তীয় বিবরণ গ্যালেনের বর্ণনার উপর ভিত্তি করে লিখিত হয়েছিল।[]

বুক অব অপটিক্স গ্রন্থটি ১২শ শতাব্দীর শেষে (বা ১৩শ শতকের শুরুতে) একজন অজানা পণ্ডিত ল্যাটিন ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন। []:২০৯–২১০[] মধ্যযুগে রচনাটি বিজ্ঞানের জগতে বেশ প্রভাবশালী ছিল।[]:৮৬. ১৫৭২ সালে ফ্রেডরিখ রিজনার তার Opticae thesaurus নামক সংকলনের অংশ হিসেবে বইটি মুদ্রণ করেন। এতে ভুলক্রমে আলহাজেনের নামে প্রচলিত গোধূলির উপর একটি বই, সেইসাথে ভিটেলোর লেখা আলোকবিজ্ঞানের একটি রচনাও অন্তর্ভুক্ত ছিল।

আরও দেখুন

[সম্পাদনা]

ইংরেজি অনুবাদ

[সম্পাদনা]

তথ্যসূত্র

[সম্পাদনা]

সূত্র

[সম্পাদনা]
  1. Friedrich Risner, publ. 1572. Opticae Thesaurus: Alhazeni Arabis Libri Septem Nunc Primum Editi, Eiusdem Liber De Crepusculis Et Nubium Asensionibus . Item Vitellonis Thuringopoloni Libri X. e-rara link. See Sabra, the authorship of Liber de crepusculis
  2. D. C. Lindberg (1976), Theories of Vision from al-Kindi to Kepler, Chicago, Univ. of Chicago Press আইএসবিএন ০-২২৬-৪৮২৩৪-০
  3. Alhacen (২০০১)। Alhacen's Theory of Visual Perception: A Critical Edition, with English Translation and Commentary, of the First Three Books of Alhacen's "De Aspectibus", the Medieval Latin Version of Ibn al-Haytham's "Kitāb al-Manāẓir"। Vol. 1: Introduction and Latin text; Vol. 2: English translation। Philadelphia: American Philosophical Societyআইএসবিএন 0-87169-914-1ওসিএলসি 47168716 
  4. (Smith 2001)
  5. Lindberg, David C. (১৯৯২)। The Beginnings of Western Science। The University of Chicago Press। আইএসবিএন 9780226482316 
  6. "Complete Dictionary of Scientific Biography"Ibn Al-Haytham, Abū ʿAlī Al-Ḥasan Ibn Al-Ḥasan। Gale Virtual Reference Library। 
  7. Crombie, A. C. (১৯৭১), Robert Grosseteste and the Origins of Experimental Science, 1100–1700, Oxford: Clarendon Press, পৃষ্ঠা 147 
  1. পরাবৃত্তাকার আয়না প্রকৃতপক্ষে অবতল দর্পণের ন্যায়, তবে আদর্শ পরাবৃত্তের অনুরূপ হওয়ায় এটি অধিক দক্ষতার সাথে সমান্তরাল আলোকরশ্মিকে একটি বিন্দুতে কেন্দ্রীভূত করতে পারে, অপরদিকে গোলীয় অবতল দর্পণ আলোকরশ্মিকে একটি বিন্দুর পরিবর্তে বিস্তৃত ক্ষুদ্র একটি স্থানজুড়ে কেন্দ্রীভূত করে।
  2. "এবং এই [ক্যামেরা অবস্কিউরার পরীক্ষাটি] যে কোনো সময় করা যায়।" প্রথম খণ্ড [৬.৮৬] স্মিথ ২০০১, পৃ ৩৭৯
  3. স্মিথ-এর (২০০১) বুক অব অপটিক্স দ্বিতীয় খণ্ডের [৩.৫২] থেকে [৩.৬৬] এর সারাংশ। পৃ. ৪৪৪ এ আলহাজেনের বর্ণ বিষয়ক পরীক্ষা দেখুন; পৃ. ৩৪৩-৩৯৩ এ দেখুন আলহাজেনের চক্ষু শারীরবিদ্যার পরীক্ষণ।