বিগলনকারী চক্র

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
লাইটিক চক্র ও লাইসোজেনিক চক্রের মধ্যে তুলনা

লাইটিক বা বিগলনকারী চক্র ভাইরাস প্রজননের দুটি চক্রের মধ্যে একটি (ব্যাকটেরিয়াল ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়াফেজ উল্লেখ করে)। অন্য চক্রটি হল লাইসোজেনিক চক্র। লাইটিক চক্রের মাধ্যমে সংক্রামিত কোষ এবং এর ঝিল্লি ধ্বংস হয়ে যায়। যেসব ব্যাকটেরিওফাজ শুধুমাত্র লাইটিক চক্র ব্যবহার করে তাদের ভিরুলেন্ট ফাজ বলা হয়। লাইটিক চক্রকে সাধারণত ব্যাকটেরিওফাজের "প্রজনন চক্র" হিসাবেও উল্লেখ করা হয়।

লাইটিক চক্রে ভাইরাসের ডিএনএ ব্যাকটেরিয়া কোষের মধ্যে একটি পৃথক মুক্ত ভাসমান অণু হিসাবে বিদ্যমান থাকে এবং হোস্ট ব্যাকটেরিয়ার ডিএনএ থেকে পৃথকভাবে প্রতিলিপি তৈরি করে। অপরদিকে লাইসোজেনিক চক্রে ভাইরাসের ডিএনএ হোস্ট ডিএনএর মধ্যে অবস্থান করে। এটিই লাইটিক এবং লাইসোজেনিক (ব্যাকটেরিও)ফাজ চক্রের মধ্যে মূল পার্থক্য। উভয় ক্ষেত্রেই ভাইরাস/ফাজ হোস্ট ডিএনএ এর যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে নিজের ডিএনএ এর প্রতিলিপি তৈরি করে।

বর্ণনা[সম্পাদনা]

লাইটিক চক্র একটি ছয় ধাপবিশিষ্ট চক্র। এর ছয়টি পর্যায় হল: সংযুক্তি, অনুপ্রবেশ, প্রতিলিপি, জৈব সংশ্লেষণ, পরিপক্কতা এবং ভাঙন।

  1. সংযুক্তি - ফাজটি তার ডিএনএ কোষে প্রবেশ করার জন্য হোস্ট কোষের পৃষ্ঠের সাথে নিজেকে সংযুক্ত করে
  2. অনুপ্রবেশ - ফাজ কোষের ঝিল্লি ভেদ করে হোস্ট কোষে তার ডিএনএ প্রবেশ করায়
  3. ট্রান্সক্রিপশন - হোস্ট কোষের ডিএনএ কার্যক্ষমতা হারায় এবং ফাজের জৈবসংশ্লেষণ শুরু করার জন্য কোষকে নির্দেশ দেয়া হয়
  4. জৈবসংশ্লেষণ - ফাজ ডিএনএ কোষের ভিতরে প্রতিলিপি তৈরি করে। ফলে নতুন ফাজ ডিএনএ এবং প্রোটিন সংশ্লেষণ শুরু হয়
  5. পরিপক্কতা - প্রতিলিপিকৃত উপাদান সম্পূর্ণরূপে গঠিত ভাইরাসের ফাজগুলিতে একত্রিত হয় (প্রত্যেকটি একটি মাথা, একটি লেজ এবং লেজের তন্তু দিয়ে গঠিত)
  6. ভাঙ্গন - কোষের প্রাচীর বা ঝিল্লি ফেটে যায়, বিচ্ছিন্ন হয় এবং ভাইরাসটি বাইরে মুক্ত হয়

সংযুক্তি এবং অনুপ্রবেশ[সম্পাদনা]

হোস্ট কোষকে সংক্রামিত করার জন্য ভাইরাসটিকে প্রথমে প্লাজমা ঝিল্লি এবং (যদি উপস্থিত থাকে) কোষের প্রাচীরের মাধ্যমে কোষে তার নিজস্ব নিউক্লিক অ্যাসিড প্রবেশ করাতে হবে। ভাইরাসটি নিজেকে কোষের পৃষ্ঠের একটি রিসেপ্টরের সাথে সংযুক্ত করে বা সাধারণ যান্ত্রিক শক্তি দ্বারা তা করে। সংযুক্তি ইলেক্ট্রোস্ট্যাটিক মিথষ্ক্রিয়ার কারণে হয়। এই ধাপটি পিএইচ এবং আয়নের উপস্থিতি দ্বারা প্রভাবিত হয়। তারপর ভাইরাসটি তার জেনেটিক উপাদান (হয় একক- বা ডাবল-স্ট্র্যান্ডেড আরএনএ বা ডিএনএ) কোষে প্রবেশ করায়। কিছু ভাইরাসে এই জেনেটিক উপাদান বৃত্তাকার হয় যা একটি ব্যাকটেরিয়াল প্লাজমিডের মতো হয়। এই পর্যায়ে কোষটি সংক্রমিত হয় এবং রোগ প্রতিরোধক ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যবস্তু হতে পারে। এটি বেশিরভাগ কোষের পৃষ্ঠের রিসেপ্টরের সাথে সংযুক্ত হয়।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] ব্যাকটিরিওফাজ সংক্রমণের সূচনার সময় ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলির ক্রম, শোষণ (সংযুক্তি) থেকে ডিএনএ প্রবেশ করানোর মাধ্যমে ভিরিয়ন থেকে হোস্ট কোষে অনুপ্রবেশ করে।

প্রতিলিপি তৈরি এবং জৈব সংশ্লেষণ[সম্পাদনা]

ট্রান্সক্রিপশন এবং জৈব সংশ্লেষণ পর্যায়ে ভাইরাস কোষের প্রতিলিপি এবং ট্রান্সলেশন প্রক্রিয়া হাইজ্যাক করে এবং তাদের ব্যবহার করে আরো ভাইরাস তৈরি করে। ভাইরাসের নিউক্লিক অ্যাসিড হোস্ট কোষের বিপাকীয় যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে বিপুল পরিমাণ ভাইরাসের প্রয়োজনীয় উপাদান তৈরি করে।

ডিএনএ ভাইরাসের ক্ষেত্রে ডিএনএ নিজেকে মেসেঞ্জার আরএনএ (এমআরএনএ) অণুতে প্রতিলিপি করে যা পরে কোষের রাইবোসোমকে নির্দেশ দেয়। ট্রান্সলেশন করা প্রথম পলিপেপটাইডগুলির মধ্যে একটি হোস্টের ডিএনএ ধ্বংস করে। রেট্রোভাইরাসে (যা একটি আরএনএ স্ট্র্যান্ড প্রবেশ করায়) রিভার্স ট্রান্সক্রিপ্টেস নামক একটি অনন্য এনজাইম ভাইরাসের আরএনএকে ডিএনএ-তে প্রতিলিপি করে, যা পুনরায় আরএনএ-তে প্রতিলিপি করা হয়। ভাইরাসের ডিএনএ একবার নিয়ন্ত্রণ নিলে এটি হোস্ট কোষের যন্ত্রপাতিকে ভাইরাসের ডিএনএ, প্রোটিন সংশ্লেষণ করতে প্ররোচিত করে এবং ভাইরাসের সংখ্যাবৃদ্ধি শুরু করে।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]

জৈব সংশ্লেষণ (যেমন টি৪) এমআরএনএ উৎপাদনের তিনটি পর্যায় দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় এবং তারপরে প্রোটিন উৎপাদন হয়।[১]

প্রাথমিক পর্যায়ে
আরএনএ পলিমারেজ এনজাইম হোস্টের ট্রান্সক্রিপশন প্রক্রিয়া পরিবর্তন করে। অন্যান্য পরিবর্তনের মধ্যে টি৪ ভাইরাস একটি অ্যান্টি-সিগমা ফ্যাক্টর তৈরি করে যা হোস্টের সিগমা ফ্যাক্টরকে পরিবর্তন করে। এর ফলে হোস্ট প্রোমোটররা আর নিজস্ব প্রোটিনকে চিনতে পারে না কিন্তু টি৪ এর প্রোটিনকে চিনতে পারে। প্রোটিন সংশ্লেষণের জন্য শাইন-ডালগারনো পরবর্তী জিএজিজি (GAGG) প্রাথমিক জিন ট্রান্সলেশনে প্রাধান্য পায়।[২]
মধ্য পর্যায়
ভাইরাস নিউক্লিক অ্যাসিড (ভাইরাসের প্রকারের উপর নির্ভর করে ডিএনএ বা আরএনএ) তৈরি।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]
শেষ পর্যায়
মাথা এবং লেজের জন্য গাঠনিক প্রোটিন তৈরি।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]

পরিপক্কতা এবং ভাঙন[সম্পাদনা]

প্রাথমিক সংক্রমণের প্রায় ২৫ মিনিট পরে আনুমানিক ২০০টি নতুন ভাইরাস (ভাইরাস দেহ) গঠিত হয়। পর্যাপ্ত পরিমানে ভিরিয়ন পরিপক্ক এবং জমা হয়ে গেলে বিশেষ ভাইরাল প্রোটিন কোষের দেয়াল দ্রবীভূত করে। উচ্চ অভ্যন্তরীণ অসমোটিক চাপের (পানির চাপ) কারণে কোষটি ফেটে যায় (অর্থাৎ এটি লাইসিস হয়) যা কোষ প্রাচীর দ্বারা আর সীমাবদ্ধ করা যায় না। এটি আশেপাশের পরিবেশে নতুন ভিরিয়নগুলিকে ছেড়ে দেয় যেখানে তারা অন্যান্য কোষগুলিকে সংক্রামিত করতে পারে এবং আরেকটি লাইটিক চক্র শুরু করে। যে ফাজ হোস্টের ভাঙ্গন ঘটায় তাকে লাইটিক বা ভাইরুলেন্ট ফাজ বলে।

জিন নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত বায়োকেমিস্ট্রি[সম্পাদনা]

ফাজ জিনোমে তিন শ্রেণীর জিন রয়েছে যা লাইটিক বা লাইসোজেনিক চক্রের উদ্ভব হবে কিনা তা নিয়ন্ত্রণ করে। প্রথম শ্রেণী হল তাৎক্ষণিক প্রারম্ভিক জিন, দ্বিতীয়টি বিলম্বিত প্রারম্ভিক জিন এবং তৃতীয়টি শেষ জিন। নিম্নলিখিতটি ই. কোলাই এর নাতিশীতোষ্ণ ল্যাম্বডা ফাজকে ভালোভাব পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে পাওয়া যায়।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]

  1. তাৎক্ষণিক প্রাথমিক জিন: এই জিনগুলি হোস্ট আরএনএ পলিমারেজ দ্বারা স্বীকৃত প্রবর্তকদের থেকে প্রকাশ করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে ক্রো, সিII, এবং এন. সিII। এরা হল ট্রান্সক্রিপশন ফ্যাক্টর যা প্রধান লাইসোজেনিক রিপ্রেসার জিন সিI এর প্রকাশকে উদ্দীপিত করে। ক্রো হল সিI এক্সপ্রেশনের জন্য দমনকারী একটি জিন। লাইসিস-লাইসোজেনি সিদ্ধান্তটি মূলত ক্রো এবং সিII-এর মধ্যে প্রতিযোগিতার দ্বারা প্রভাবিত হয়। যার মাধ্যমে পর্যাপ্ত সিI দমনকারী জিন তৈরি হবে কিনা তা নির্ধারণ করা হয়। সিI প্রাথমিক প্রবর্তক জিন দমন করে এবং সংক্রমণটি লাইসোজেনিক পথে যায়। এন হল একটি অ্যান্টি-টার্মিনেশন ফ্যাক্টর যা বিলম্বিত প্রারম্ভিক জিনের প্রতিলিপির জন্য প্রয়োজন।
  2. বিলম্বিত প্রারম্ভিক জিন: এর মধ্যে রয়েছে প্রতিলিপিকরণ জিন ও, পি এবং কিউ। এরা সমস্ত শেষের জিনের প্রতিলিপির জন্য দায়ী অ্যান্টি-টার্মিনেটরকে এনকোড করে।
  3. শেষ জিন:

লাইটিক পথ বেছে নেওয়া হলে সংক্রমণের প্রায় ৬-৮ মিনিট পরে শেষ ট্রান্সক্রিপশনের কিউ-মধ্যস্থতা চালু হয়। একক শেষ প্রবর্তক জিন থেকে ২৫টিরও বেশি জিনের প্রকাশ করা হয়, যার ফলে চারটি সমান্তরাল জৈব সংশ্লেষণ পথ তৈরি হয়। তিনটি পথ হল ভিরিওনের তিনটি উপাদান তৈরির জন্য: ডিএনএ-যুক্ত মাথা, লেজ এবং লেজের তন্তু। ভাইরাসগুলি এই উপাদানগুলি দ্বারা স্ব-একত্রিত হয়। প্রথম ভিরিয়ন সংক্রমণের প্রায় ২০ মিনিট পর তৈরি হয়। চতুর্থ পথটি হলো ভাঙ্গনের জন্য। ল্যাম্বডা ফাজে ৫টি প্রোটিন ভাঙ্গনের সাথে জড়িত: জিন এস থেকে হোলিন এবং অ্যান্টিহোলিন, জিন আর থেকে এন্ডোলাইসিন এবং আরজেড এবং আরজেড ১ জিন থেকে স্প্যানিন প্রোটিন তৈরি হয়। বন্য-প্রকার ল্যাম্বডা ফাজে, প্রায় ৫০মিনিট পর ভাঙ্গন ঘটে ও প্রায় ১০০টি সম্পূর্ণ ভিরিয়নকে মুক্ত করে। লাইসিসের সময়কাল হোলিন এবং অ্যান্টিহোলিন প্রোটিন দ্বারা নির্ধারিত হয়। সংক্ষিপ্তভাবে হোলিন প্রোটিন সাইটোপ্লাজমিক ঝিল্লিতে জমা হয় যতক্ষণ না হঠাৎ করে মাইক্রন-স্কেল গর্ত তৈরি হয়, যা ভাঙ্গনের উদ্দীপনা যোগায়। এন্ডোলাইসিন আর পেরিপ্লাজমে মুক্তি পায়, যেখানে এটি পেপ্টিডোগ্লাইকানকে আক্রমণ করে। স্প্যানিন প্রোটিন আরজেড এবং আরজেড ১ যথাক্রমে সাইটোপ্লাজমিক এবং বাইরের ঝিল্লিতে জমা হয় এবং পেপটিডোগ্লাইকানের মাধ্যমে পেরিপ্লাজমে বিস্তৃত একটি জটিল গঠন তৈরি করে। যখন এন্ডোলাইসিন পেপটিডোগ্লাইকানকে ক্ষয় করে তখন স্প্যানিন কমপ্লেক্সগুলি মুক্ত হয় এবং বাইরের ঝিল্লির ব্যাঘাত ঘটায়। এন্ডোলাইসিন দ্বারা পেপটিডোগ্লাইক্যানের ভাঙ্গন এবং স্প্যানিন কমপ্লেক্স দ্বারা বাইরের ঝিল্লির ব্যাঘাত উভয়ই ল্যাম্বডা ফাজের ভাঙনের জন্য প্রয়োজনীয়।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]

ভাঙ্গনে বাধা: টি৪-এর মতো ফাজে দুটি জিন থাকে। এরা হল- আরI এবং আরIII। সংক্রামিত কোষটি অন্য টি৪ (বা ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত) ভিরিয়ন দ্বারা অতি-সংক্রমণের মধ্য দিয়ে গেলে টি৪ এর হোলিনকে বাধা দেয় । বারবার অতি-সংক্রমণের কারণে টি৪ দ্বারা সংক্রমণ কয়েক ঘন্টা ধরে ভাঙ্গন ছাড়াই চলতে পারে। এর ফলে ভাইরাসগুলি হোস্টের মধ্যে স্বাভাবিকের চেয়ে ১০গুণ বেশি মাত্রায় জমা হতে পারে।

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. Madigan M, Martinko J (editors) (২০০৬)। Brock Biology of Microorganisms (11th সংস্করণ)। Prentice Hall। আইএসবিএন 978-0-13-144329-7 
  2. Malys N (২০১২)। "Shine-Dalgarno sequence of bacteriophage T4: GAGG prevails in early genes"। Molecular Biology Reports39 (1): 33–9। এসটুসিআইডি 17854788ডিওআই:10.1007/s11033-011-0707-4পিএমআইডি 21533668