বিষয়বস্তুতে চলুন

বাংলায় মারাঠা আক্রমণ (১৭৪৯–১৭৫১)

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
বাংলায় মারাঠা আক্রমণ (১৭৪৯–১৭৫১)
মূল যুদ্ধ: বর্গির হাঙ্গামা
তারিখজুন ১৭৪৯ – মে ১৭৫১
অবস্থান
ফলাফল

সামরিক অচলাবস্থা[][]
মারাঠা রাজনৈতিক বিজয়[]

অধিকৃত
এলাকার
পরিবর্তন
কটক থেকে সুবর্ণরেখা নদী পর্যন্ত অঞ্চল (উড়িষ্যা ও দক্ষিণ মেদিনীপুর) মীর হাবিবের শাসনাধীন হয়
বিবাদমান পক্ষ
বাংলা মারাঠা সাম্রাজ্য
সেনাধিপতি ও নেতৃত্ব প্রদানকারী
আলীবর্দী খান
মীর জাফর
মির্জা ইসমাইল
আতাউল্লাহ খান
রায় দুর্লভ
আব্দুস সুবহান আত্মসমর্পণকারী
সৈয়দ আহমদ খান
সিরাজউদ্দৌলা
খাজা আব্দুল হাদি
রঘুজী ভোঁসলে
জানুজী ভোঁসলে
সাবাজী ভোঁসলে
মীর হাবিব
শক্তি
অজ্ঞাত অজ্ঞাত
হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতি
অজ্ঞাত অজ্ঞাত
চুক্তি অনুযায়ী মীর হাবিব বাংলার নবাবের অধীনে বর্ধিত উড়িষ্যার শাসনকর্তা ছিলেন, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে উড়িষ্যার ওপর বাংলার নবাবের কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না। উড়িষ্যায় মারাঠা সৈন্য মোতায়েন ছিল এবং কার্যত উড়িষ্যা মারাঠাদের নাগপুর রাজ্যের একটি প্রদেশে পরিণত হয়।

বাংলায় মারাঠা আক্রমণ (১৭৪৯–১৭৫১) বলতে মারাঠা সাম্রাজ্য কর্তৃক ১৭৪৯ সাল থেকে ১৭৫১ সাল পর্যন্ত বাংলায় পরিচালিত আক্রমণকে বোঝানো হয়। তীব্র সংঘর্ষের পর বাংলার নবাব আলীবর্দী খান মারাঠাদেরকে বাংলা থেকে বিতাড়িত করতে সক্ষম হন, কিন্তু উড়িষ্যা মারাঠাদের দখলে থেকে যায়[]। বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ সমস্যার মুখোমুখি হয়ে আলীবর্দী শেষ পর্যন্ত ১৭৫১ সালের মে মাসে মারাঠাদের সঙ্গে সন্ধি স্বাক্ষর করেন[]। সন্ধি অনুযায়ী, মীর হাবিব নবাবের অধীনে উড়িষ্যার শাসনকর্তা নিযুক্ত হন এবং নবাব মারাঠাদেরকে বার্ষিক ১২ লক্ষ টাকা হারে চৌথ প্রদান করতে স্বীকৃত হন[]। বিনিময়ে মারাঠারা আর বাংলা আক্রমণ না করার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়[]

পটভূমি

[সম্পাদনা]

মারাঠাদের উড়িষ্যা দখল

[সম্পাদনা]

১৭৪৯ সালের জুনে আলীবর্দীর কটক থেকে প্রত্যাবর্তনের মাত্র এক সপ্তাহ পর মীর হাবিবের নেতৃত্বে মারাঠারা আবার উড়িষ্যা আক্রমণ করে[][]। তারা উড়িষ্যার প্রাদেশিক শাসনকর্তা আব্দুস সালামকে পরাজিত ও বন্দি করে উড়িষ্যা দখল করে নেয়[][]। উড়িষ্যা পুনর্দখল করে ১৭৫০ সালের ফেব্রুয়ারিতে মারাঠা বাহিনী আবার বাংলায় হানা দিতে আরম্ভ করে।

মারাঠাদের বাংলা আক্রমণ

[সম্পাদনা]

১৭৫০ সালের ফেব্রুয়ারিতে মারাঠা বাহিনী আবার বাংলায় হানা দিতে আরম্ভ করে। বৃদ্ধ নবাব আলীবর্দী উড়িষ্যা থেকে বাংলায় মারাঠা আক্রমণের পথ রুদ্ধ করার জন্য মেদিনীপুরে ফিরে আসেন[][]

মারাঠাদের মুর্শিদাবাদ আক্রমণের প্রচেষ্টা

[সম্পাদনা]

১৭৫০ সালের ৬ মার্চ মীর হাবিব সসৈন্যে মুর্শিদাবাদের নিকটে পৌঁছেন এবং এর আশেপাশে লুটতরাজ চালান[][]। ফলে আলীবর্দী দ্রুত মেদিনীপুর থেকে বর্ধমানে চলে আসেন। মারাঠা আক্রমণকারীরা জঙ্গলের মধ্য দিয়ে পশ্চাৎপসরণ করে এবং ১৭৫০ সালের এপ্রিলে নবাব সীমান্ত পাহারা দেয়ার জন্য মেদিনীপুরে ফিরে আসেন[][]। এ অভিযানে নবাবের দৌহিত্র সিরাজউদ্দৌলা অংশগ্রহণ করেন[]

নবাবের সামরিক বাহিনীতে দুর্নীতি

[সম্পাদনা]

মারাঠাদের আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য নবাব মেদিনীপুরে বেশ কয়েকটি সামরিক ঘাঁটি নির্মাণ করেন। এই সময়ে নবাবের প্রধান সেনাপতি মীর জাফরের বিভিন্ন দুর্নীতির তথ্য প্রকাশ পায়[]। নবাব মীর জাফরকে তীব্রভাবে ভর্ৎসনা করেন, কিন্তু তাকে পদচ্যুত করেননি। অবশ্য মীর জাফর যেন আর দুর্নীতি করতে না পারেন, সেজন্য নবাব প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। এসময় সহকারী প্রধান সেনাপতি ছিলেন মীর জাফরের ভাই মির্জা ইসমাইল। নবাব তাকে পদচ্যুত করেন এবং মীর জাফরের ওপর নজরদারি করার জন্য তার বিশ্বস্ত খাজা আব্দুল হাদিকে সহকারী প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত করেন[]

সিরাজের হঠকারিতা

[সম্পাদনা]

এসময় আরেকটি ঘটনার কারণে নবাবকে মারাঠাদের বিরুদ্ধে অভিযান স্থগিত রাখতে হয়। নবাবের প্রিয় দৌহিত্র সিরাজউদ্দৌলা তার পিতার পুরাতন কর্মচারী মেহেদি নিসার খানের কুমন্ত্রণায় তার প্রতি নবাবের স্নেহের বিষয়ে সন্দিহান হয়ে পড়েন এবং বিহারের আজিমাবাদে নিজ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে মুর্শিদাবাদ ত্যাগ করেন[]। নবাব সিরাজের নিরাপত্তার জন্য উদ্বিগ্ন হন। তিনি মীর জাফর ও রায় দুর্লভের ওপর মারাঠাদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার ভার দিয়ে মেদিনীপুর থেকে মুর্শিদাবাদে পৌঁছেন এবং বিহারের দিকে রওয়ানা হন।

সিরাজ আজিমাবাদ দখলের চেষ্টা করেন, কিন্তু আলীবর্দীর অনুগত আজিমাবাদের শাসনকর্তা রাজা জানকীরাম তাকে প্রতিরোধ করেন[]। ১৭৫০ সালের জুনে আলীবর্দী আজিমাবাদের নিকটে পৌঁছালে সিরাজের সঙ্গে তার ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটে[]। সিরাজ অনুতপ্ত হয়ে মাতামহের কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করেন।

নবাবের অসুস্থতা

[সম্পাদনা]

আজিমাবাদ থেকে ফেরার পথে নবাব গুরুতরভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। চিকিৎসার ফলে তিনি কিছুটা আরোগ্যলাভ করেন, কিন্তু দুর্বলতা থেকে যায়[]

মারাঠাদের বিরুদ্ধে অভিযান

[সম্পাদনা]

এদিকে মীর জাফররায় দুর্লভ মারাঠাদের বিরুদ্ধে অগ্রসর হয়ে তাদের কোনোরকম প্রতিরোধ না করে নিশ্চেষ্টভাবে কালক্ষেপণ করছিলেন[][]। এ পরিস্থিতিতে অসুস্থতা সত্ত্বেও বৃদ্ধ নবাব মারাঠাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেন। তার আগমনের সংবাদ পেয়েই মারাঠা সৈন্যরা পালাতে থাকে। নবাব তাদেরকে মেদিনীপুর, বর্ধমানবীরভূম থেকে বিতাড়িত করেন[][] এবং ১৭৫১ সালের ফেব্রুয়ারিতে কাটোয়া পুনর্দখল করে সেখানে অবস্থান করতে থাকেন[]

সন্ধি এবং যুদ্ধের অবসান

[সম্পাদনা]

রঘুজী ভোঁসলেমীর হাবিব এই বছরগুলোতে অনুর্বর উড়িষ্যা প্রদেশ থেকে কিছুই পাননি এবং বাংলায় তাদের আক্রমণসমূহ সবসময়ই আলীবর্দীর সতর্কতা ও বলিষ্ঠতার জন্য ব্যর্থ হয়েছে[]। এজন্য তারা মীর জাফরের মধ্যস্থতায় আলীবর্দীর সঙ্গে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরের প্রস্তাব করেন। নিজের বার্ধক্য ও অসুস্থতা, সৈন্যদের ক্লান্তি ও সেনাপতিদের পরিশ্রম-বিমুখতা এবং সর্বোপরি বাংলার জনসাধারণে জান-মালের নিরাপত্তা বিধানের জন্য নবাব এতে সম্মত হন[][]। কয়েকদিন আলোচনার পর ১৭৫১ সালের মে মাসে নবাব ও মারাঠাদের মধ্যে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়[]

এই চুক্তির ফলাফল ছিল নিম্নরূপ[]:

  • মীর হাবিব নবাব আলীবর্দীর অধীনে উড়িষ্যা প্রদেশের প্রাদেশিক শাসনকর্তা নিযুক্ত হন। উড়িষ্যার উদ্বৃত্ত রাজস্ব থেকে মীর হাবিব তার মারাঠা সৈন্যদের বেতন দেবেন বলে স্থির হয়।
  • বাংলার অন্যান্য ভূখণ্ডের জন্য নবাব রঘুজীকে বার্ষিক ১২ লক্ষ টাকা চৌথ দিতে রাজি হন।
  • রঘুজী আর কখনো বাংলা আক্রমণ করবেন না বলে প্রতিশ্রুতি দেন।
  • বালেশ্বরের নিকটে সুবর্ণরেখা নদী বাংলা ও উড়িষ্যার সীমান্ত হিসেবে নির্ধারিত হয়। এর ফলে দক্ষিণ মেদিনীপুর উড়িষ্যার সঙ্গে যুক্ত হয়।

এই চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে দীর্ঘ ৯ বছরব্যাপী বাংলায় মারাঠা আক্রমণের অবসান ঘটে[][]

আরো দেখুন

[সম্পাদনা]

তথ্যসূত্র

[সম্পাদনা]
  1. ড. মুহম্মদ আব্দুর রহিম, (বাংলাদেশের ইতিহাস), আলীবর্দী ও মারাঠা আক্রমণ, পৃ. ২৯৩–২৯৯
  2. মোহাম্মদ শাহ (২০১২)। "মারাঠা হামলা"ইসলাম, সিরাজুল; মিয়া, সাজাহান; খানম, মাহফুজা; আহমেদ, সাব্বীর। বাংলাপিডিয়া: বাংলাদেশের জাতীয় বিশ্বকোষ (২য় সংস্করণ)। ঢাকা, বাংলাদেশ: বাংলাপিডিয়া ট্রাস্ট, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটিআইএসবিএন 9843205901ওএল 30677644Mওসিএলসি 883871743 
  3. Jaswant Lal Mehta। "Advanced Study in the History of Modern India 1707-1813"