রায় দুর্লভ

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
রায় দুর্লভরাম
উড়িষ্যার নায়েব নাযিম
কাজের মেয়াদ
১৭৪৫[১] – ১৭৪৫[১]
উত্তরসূরীআব্দুস সালাম[১]
রায় দুর্লভরাম
আনুগত্যবাংলা
সেবা/শাখাসেনাবাহিনী
যুদ্ধ/সংগ্রামবর্গির হাঙ্গামা পলাশীর যুদ্ধ

রায় দূর্লভরাম, সংক্ষেপে রায় দুর্লভ, ছিলেন বাংলার নবাবী শাসনামলের একজন কর্মকর্তা। তিনি নবাব আলীবর্দী খানের অধীনে উড়িষ্যার প্রাদেশিক শাসনকর্তা পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন[২]বাংলায় মারাঠা আক্রমণকালে তিনি বাংলার নবাবের পক্ষে মারাঠাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। পলাশীর যুদ্ধের সময় তিনি নবাব সিরাজউদ্দৌলার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে ইংরেজদের সহযোগিতা করেন এবং যুদ্ধে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকেন। বাংলার ইতিহাসে তিনি একজন বিশ্বাসঘাতক হিসেবে চিহ্নিত[২]

পরিচিতি[সম্পাদনা]

রায় দুর্লভ ছিলেন নবাব আলীবর্দী খানের বিশ্বস্ত অমাত্য রাজা জানকীরামের ছেলে।

প্রাথমিক কর্মজীবন[সম্পাদনা]

১৭৪১ সালে আলীবর্দী খান উড়িষ্যার বিদ্রোহী শাসনকর্তা দ্বিতীয় মুর্শিদ কুলি খানকে পরাজিত করে উড়িষ্যার ওপর নিয়ন্ত্রণ পুন:প্রতিষ্ঠিত করেন। তিনি শেখ মাসুম পানিপথীকে উড়িষ্যার নতুন প্রাদেশিক শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। রায় দুর্লভ তাঁর অধীনে উড়িষ্যার পেশকার পদ লাভ করেন[২]। পরবর্তীতে তিনি উড়িষ্যার দিউয়ান পদে উন্নীত হন।

উড়িষ্যার প্রাদেশিক শাসনকর্তার পদপ্রাপ্তি এবং বন্দিত্ব[সম্পাদনা]

১৭৪৫ সালে রায় দুর্লভ উড়িষ্যার প্রাদেশিক শাসনকর্তা (নায়েব নাজিম) নিযুক্ত হন[২]। একই বছর নাগপুর রাজ্যের মারাঠা মহারাজা রঘুজী ভোঁসলে উড়িষ্যা আক্রমণ করেন। তিনি রায় দুর্লভকে যুদ্ধে পরাজিত করেন এবং রায় দুর্লভ মারাঠাদের হাতে বন্দি হন। ৩ লক্ষ টাকা মুক্তিপণ প্রদান করে তিনি মুক্তিলাভ করেন[২] এবং মুর্শিদাবাদে প্রত্যাবর্তন করেন।

সামরিক জীবন[সম্পাদনা]

মারাঠাদের হাত থেকে মুক্তি পেয়ে রায় দুর্লভ মুর্শিদাবাদে ফিরে এসে রাজা রামনারায়ণের মুৎসুদ্দি পদে নিডুক্ত হয়েছিলেন। তিনি নবাব আলীবর্দীর আনুকূল্য লাভ করেন এবং নবাবের সৈন্যবাহিনীর সেনানায়কের পদমর্যাদা লাভ করেন। মারাঠাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তিনি অংশগ্রহণ করেন। কিন্তু বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয় দিতে পারেন নি। ১৭৫০ সালে নবাব আলীবর্দী গুরুতরভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ায় মীর জাফর ও রায় দুর্লভের ওপর মারাঠা হানাদারদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার ভার ন্যস্ত করেছিলেন। কিন্তু তাঁরা মারাঠাদের বিরুদ্ধে অগ্রসর হয়ে নিশ্চেষ্টভাবে সময় অতিবাহিত করেন[২] এবং অবশেষে বৃদ্ধ নবাবকেই অভিযান পরিচালনা করতে হয়। ১৭৫১ সালের মে মাসে একটি শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে বাংলায় মারাঠা আক্রমণের অবসান ঘটে[২]

নবাব সিরাজউদ্দৌলার আমল[সম্পাদনা]

নবাব আলীবর্দীর মৃত্যুর পর তাঁর দৌহিত্র সিরাজউদ্দৌলা নবাব হন। কিন্তু তাঁর সঙ্গে রায় দুর্লভের সম্পর্ক ভালো ছিল না। ফলে নবাব তাঁকে পদোন্নতি প্রদান করেন নি। এতে রায় দুর্লভ নবাবের ওপর বিশেষভাবে ক্ষুদ্ধ হন এবং নবাবের অন্যান্য বিশ্বাসঘাতক অমাত্যদের সঙ্গে একজোট হয়ে ইংরেজদের সঙ্গে গোপন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন।

কলকাতার যুদ্ধ[সম্পাদনা]

১৭৫৬ সালের ২০ জুন নবাব সিরাজউদ্দৌলা ইংরেজদের পরাজিত করে কলকাতা দখল করে নেন এবং সেখান থেকে ইংরেজদের বিতাড়িত করেন। কিন্তু রায় দুর্লভ, মানিক চাঁদসহ নবাবের বিশ্বাসঘাতী কর্মকর্তারা ইংরেজদের গোপনে সহযোগিতা করতে থাকেন। ফলে নবাব ইংরেজদের সমূলে উচ্ছেদ করতে ব্যর্থ হন[২]

নবাবের বিরুদ্ধ ষড়যন্ত্র[সম্পাদনা]

১৭৫৭ সালে প্রথমদিকে ইংরেজদের সঙ্গে মীর জাফরের গোপন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এতে নবাববের অন্যান্য বিশ্বাসঘাতক অমাত্যদের সঙ্গে রায় দুর্লভও জড়িত ছিলেন[২]

চন্দননগরের যুদ্ধ[সম্পাদনা]

এসময় ইউরোপে চলমান সপ্তবর্ষব্যাপী যুদ্ধের প্রতিক্রিয়ায় ভারতেও ইংরেজ ও ফরাসিদের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। ইংরেজরা বাংলায় ফরাসিদের ঘাঁটি চন্দননগর আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেয়। নবাব ইংরেজরা চন্দননগর আক্রমণ করলে ফরাসিদের সাহায্য করার জন্য তাঁর সেনানায়কদের নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু নবাবের সৈন্যাধ্যক্ষ নন্দ কুমার, রায় দুর্লভ ও মানিক চাঁদ নবাবের নির্দেশ অমান্য করেন এবং ফরাসিদের সহযোগিতা করা থেকে বিরত থাকেন[২]

পলাশীর যুদ্ধ[সম্পাদনা]

১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর প্রান্তরে নবাব সিরাজউদ্দৌলার সঙ্গে ইংরেজদের যুদ্ধ হয়। নবাবের সৈন্যসংখ্যা ছিল ইংরেজদের চেয়ে ১৬ গুণ বেশি। কিন্তু রায় দুর্লভ, মীর জাফর, ইয়ার লুৎফ খান, খাদিম হোসেন প্রমুখ বিশ্বাসঘাতক সেনানায়কেরা তাঁদের নিজ নিজ সৈন্যবাহিনীসহ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত থাকেন[২]। তা সত্ত্বেও মীর মদন ও মোহন লালের নেতৃত্বে নবাবের অনুগত সৈন্যরা ইংরেজদের বিপর্যয়ের সম্মুখীন করে। এমন সময় মীর মদন নিহত হলে নবাব মনোবল হারিয়ে ফেলেন এবং মীর জাফরকে ডেকে পাঠান। বিশ্বাসঘাতক মীর জাফর ও রায় দুর্লভ নবাবকে সেদিনের মতো যুদ্ধ বন্ধ করার পরামর্শ দেন[২]। নবাবের সৈন্যরা যুদ্ধ বন্ধ করে প্রত্যাবর্তনকালে ইংরেজরা তাদের আক্রমণ করে পরাজিত করে। মীর জাফর, রায় দুর্লভ ও অন্যান্য বিশ্বাসঘাতক সেনাপতিরা ইংরেজদের সঙ্গে যোগ দেন। পরবর্তীতে নবাব বন্দি হন এবং তাঁকে হত্যা করা হয়।

মীর জাফরের শাসনামল ও জীবনাবসান[সম্পাদনা]

নবাব সিরাজউদ্দৌলার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করলে রায় দুর্লভকে পদোন্নতির প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল। কিন্তু মীর জাফর নবাব হওয়ার পর তাঁর পুত্র মিরন রায় দুর্লভের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ আনয়ন করেন এবং তাঁকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। ইংরেজদের হস্তক্ষেপে তিনি রক্ষা পান এবং কলকাতায় পালিয়ে যান[২]। নিঃস্ব ও সর্বস্বান্ত অবস্থায় তাঁর বাকি জীবন অতিবাহিত হয়।

আরো দেখুন[সম্পাদনা]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. ড. মুহম্মদ আব্দুর রহিম. "মারাঠা আক্রমণ". বাংলাদেশের ইতিহাস. পৃ. ২৯৩–২৯৯.
  2. বাংলাদেশের ইতিহাস (ড. মুহম্মদ আব্দুর রহিম), পৃ. ২৯৩-৩১০