পাচামামা

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
(পচামামা থেকে পুনর্নির্দেশিত)
পাচামামা
পৃথিবী, জীবন, ফসল, কৃষি, শস্য, উর্বরতা
১৬১৩ সালে হুয়ান ডে সান্তা ক্রুজ পাচাকুতি ইয়ামকি সালকামেহুয়ার মতে কোস্কোর কুইরিকাঞ্চায় সূর্য মন্দিরে রক্ষিত চিত্রে পাচামামার বিশ্বরূপ দর্শন
অন্যান্য নামমামা পাচা, বিশ্বমাতা, রাণী পাচামামা
অঞ্চলইনকা ধর্ম
জাতিগত গোষ্ঠীইনকা জাতি
সঙ্গীপাচা কামাক
সন্তানসন্ততিইন্তি
মামা কিল্লা

পচামামা বা পাচামামা (স্পেনীয়: Pachamama) আন্দিজ পর্বতমালায় অবস্থানকারী আদিবাসী জনগোষ্ঠীর দেবীবিশেষ। এছাড়াও তিনি পৃথিবী/সময়ের মাতারূপেও পরিচিতি পেয়ে আসছেন।[১] ইনকাদের পৌরাণিক উপাখ্যানে পাচামামা উর্বরতার দেবীরূপেও পরিচিত। ইনকাদের বিশ্বাস, তিনি বৃক্ষ ও চাষাবাদ নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন, পর্বতমালা অবস্থান করে সবকিছু দেখেন ও ভূমিকম্প সৃষ্টি করেন। এছাড়াও তিনি চিরজাগ্রত ও স্বাধীন দেবী।[১]

নিজস্ব স্বত্ত্বা ও পৃথিবীর জীবনধারাকে পরিচালিত করতে সৃষ্টিশীল শক্তির অধিকারীনি পাচামামা। তার অবস্থান পবিত্র শিলায়, বা কিংবদন্তি গাছের গোড়ায় এবং তার শৈল্পিক মনোজাগতিক চিত্রকলা প্রাপ্তবয়স্কা নারী হিসেবে চাষকৃত গোলআলু ও কোকা পাতায় বহমান।[২]

কেচুয়া সংস্কৃতিতে ঈশ্বরের বিশ্বরূপ দর্শনে চারটি ধারা - পানি, পৃথিবী, সূর্যচাঁদে পাচামামাকে তাদের প্রধান উৎপত্তিস্থলরূপে দাবী করা হয়েছে।[২] আধ্যাত্মিক নেতারা তার মাহাত্ম্য প্রদর্শনে লামা, কাই (গিনিপিগ) উৎসর্গ করেন ও বিভিন্নভাবে তাকে কল্পনায় এনে পোশাক পুড়িয়ে ফেলেন।[৩] স্পেনের অধিগ্রহণের পর তাদেরকে জোরপূর্বক রোমান ক্যাথলিক ধর্মালম্বীতে নিয়ে আসা হয়। প্রধান চরিত্র কুমারী মেরি সকলকে একীকরণে নিয়ে আসেন যা অনেক আদিবাসী জনগোষ্ঠীর কাছে পাচামামারূপে বিবেচিত।[৪] প্রাক-হিস্পানিক সংস্কৃতিতে পাচামামাকে প্রায়শঃই ক্রুদ্ধ দেবীরূপে তার মহিমা প্রকাশে উৎসর্গগুলোকে সংরক্ষণকারীরূপে উল্লেখ করা হয়েছে। আন্দিজ সংস্কৃতি থেকে গড়ে উঠা আধুনিক দেশগুলোয় পাচামামা অদ্যাবধি দয়ালু, দাত্রী[৫] হিসেবে রয়েছেন।

স্থানীয়ভাবে তাকে প্রকৃতি মাতারূপে চিত্রিত করা হয়েছে। ফলে, অনেক দক্ষিণ আমেরিকান বিশ্বাস করেন যে, ‘সমস্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে যখন লোকেরা প্রকৃতির কাছ থেকে মাত্রাতিরিক্ত কিছু নিয়ে থাকে; কেননা, তাঁরা পাচামামার কাছ থেকে অতিরিক্ত কিছু নিয়েছে।’[৬]

উৎপত্তি রহস্য[সম্পাদনা]

সচরাচর পাচামামাকে অনুবাদ করলে অর্থ দাঁড়ায় পৃথিবী মাতা। কিন্তু আইমারাকেচুয়া ভাষায় সাহিত্যগত অনুবাদের মাধ্যমে এর অর্থ দাঁড়ায় ‘বিশ্ব মাতা’। আধুনিক স্পেনীয় বা ইংরেজি ভাষায় এর সমার্থক উচ্চারণ নেই। তবে, তামিল ভাষায় ডেসকাব্রিমিয়েন্তো ওয়াই ডে লা কনকুইস্তা: ক্রনিস্তাস কুই রেফাইরেন ডে কাল্তোস টেলুরাইকোস: পেদ্রো সাঞ্চো ডে লা হোজ (১৫৩৪); মিগুয়েল ডে এস্তেত (১৫৩৪); পেদ্রো পিজারো (১৫৭১) ‘মামা’ = মাতা / ‘পাচা’ = সবুজ/ভূমি; (পাচা : পাচাই (তামিল ভাষায়) তামিলদের মাতা দেবী পাচাইনায়াকি আম্মা ও পরবর্তীতে আধুনিক অর্থ সমগ্র বিশ্বমণ্ডল বা মহাবিশ্বরূপে বৈশ্বিকভাবে পরিচিতি ঘটানো হয়।[৭]

ইনকা দেবীকে বিভিন্নভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে পাচামামা নামে ডাকা হয়। তার অন্য নামগুলো হচ্ছে - মামা পাচা, লা পাচামামা ও পৃথিবী মাতা। লা পাচামামা, পাচামামা থেকে পৃথক অর্থ বহন করে। লা আন্তঃসম্পর্কের ন্যায় গুরুত্ব বহন করছে যাতে দেবী প্রকৃতিতুল্য। অন্যদিকে, ‘লা’-বিহীন পাচামামায় কেবলমাত্র দেবী হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটানো হয়েছে।

আধুনিক আনুষ্ঠানিকতা[সম্পাদনা]

পাচামামা ও ইন্তিকে সর্বাপেক্ষা দয়ালু দেবীরূপে বিশ্বাস করা হয়ে থাকে। তারা আন্দীয় পর্বতমালার বিভিন্ন অংশ অবস্থান করে থাকেন। সাবেক ইনকা সাম্রাজ্যে (বর্তমানের - বলিভিয়া, ইকুয়েডর, চিলি, পেরুআর্জেন্টিনার উত্তরাংশ) তিনি ‘তোয়ান্তিনসুয়ো’ নামে পরিচিত ছিলেন। আন্দীয় জনগোষ্ঠীর কাছে পাচামামা ‘আদর্শ মাতা’রূপে পরিচিত। এছাড়াও, সচরাচর লোকেরা তাঁকে স্মরণ করে ও তাঁর সম্মানার্থে স্বাক্ষাৎপর্ব বা উৎসবাদিতে নাম উচ্চারণ করে থাকেন। কিছু অঞ্চলে তাঁকে স্মরণপূর্বক স্বল্প পরিমাণে দক্ষিণ ও মধ্য আমেরিকায় উৎপাদিত ভূট্টা বা আখের তৈরী মদ চিচা মেঝেতে রাখার পর বাকীটুকু পান করা হয়। এ স্মরণকে ‘চালা’ নামে ডাকা হয় ও দিনের প্রায় সময়ই ডাকা হয়। পাচামামার স্মরণে বিশেষ ধর্মীয় দিন উদ্‌যাপন করা হয় যা ‘মার্তেস ডে চালা’ বা ‘চালা মঙ্গলবার’ নামে পরিচিত। কিছু ক্ষেত্রে উৎসব আয়োজকেরা ঐতিহ্যবাহী পাদ্রীদের সহায়তা নিয়ে থাকেন। তারা আইমারা ভাষায় ইয়াতিরি নামে পরিচিত। তারা দেবীর ভাগ্য বা সদিচ্ছাকে ফিরিয়ে আনতে প্রাচীন পন্থায় মন্ত্রোচ্চারণ করে থাকেন। গিনিপিগ বা লামা পুড়িয়ে তাকে উৎসর্গ করেন।

ঘরোয়া আনুষ্ঠানিকতা[সম্পাদনা]

পুরো বছর জুড়েই পাচামামার সম্মানার্থে অনুষ্ঠান পালন করা হয়ে থাকে। তবে, বীজবপন মৌসুমের পূর্বে আগস্ট মাসে বিশেষভাবে স্মরণ করা হয়।[২] এর কারণ হলো আগস্ট শীতকালের শীতলতম মাস ও আন্দিজ পর্বতমালার দক্ষিণাংশের জনগণ গুরুতর অসুস্থতার আশঙ্কা অনুভব করেন।[২] তাই আগস্ট মাসকে ‘কঠিনতম মাস’ হিসেবে বেছে নেয়া হয়েছে।[২] এ সময়কে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য আন্দেজীয়রা বিশ্বাস করে যে, প্রকৃতির সহায়তায় তারা বেশ ভালো সময় কাটাবে ও তাদের শস্যাদি, গবাদিপশু স্বাস্থ্যবান এবং সুরক্ষিত থাকবে।[২] এর পাশাপাশি পরিবারগুলো গাছপালা, কাঠ ও অন্যান্য সামগ্রী পুড়ে ফেলে। তারা ভাবে যে, দুষ্ট আত্মাও এ সময়ে ক্ষতি করতে পারে।[২] এছাড়াও সৌভাগ্যের কথা চিন্তা করে জনগণ দক্ষিণ আমেরিকার ক্যাফেইন সমৃদ্ধ দুধালো উষ্ণ পানীয় মেট পান করে থাকে।[২]

১ আগস্টের পূর্ব রাত্রে পরিবারগুলো পাচামামার সম্মানার্থে সারা রাত ধরে রান্না-বান্নায় ব্যস্ত থাকে।[২] এরপর ঐ খাবারগুলো জমিতে গর্ত খুড়ে পুঁতে রাখে।[২] কোন কারণে মাটি বেশ আরামে কাটা হলে তারা ভাবে যে বছরটি তাদের বেশ ভালোভাবেই কাটবে। এর ব্যতয় ঘটলে বছরটি তাদের সৌভাগ্যের কারণ হবে না।[২] পাচামামাকে এক থালাভর্তি খাবার দেয়ার পরই অতিথিদেরকে খাদ্য প্রদান করা হয়।[২] অতিরিক্ত খাবারগুলো মাঠের একপাশে ফেলে দেয়া হয় ও পাচামামার উদ্দেশ্যে আবারও প্রার্থনা করা হয়।[২]

রবিবাসরীয় সমাবেশ[সম্পাদনা]

পচামামা উৎসবের প্রধান আকর্ষণ হচ্ছে রবিবাসরীয় সমাবেশ। উৎসব আয়োজক পরিচালনা কমিটির সদস্যরা সম্প্রদায়ের সর্বাপেক্ষা বয়স্কা নারীকে খুঁজে বের করে আনেন ও তাকে ‘বর্ষসেরা পচামামা রাণী’রূপে মনোনীত করেন।[২] ১৯৪৯ সালে সর্বপ্রথম এই নির্বাচন প্রক্রিয়ার প্রবর্তন ঘটানো হয়। আদিবাসী মহিলা বিশেষ করে জ্যেষ্ঠা মহিলাকে সচরাচর শ্রদ্ধার চোখে দেখা হয়। তিনি বিজ্ঞতা, জীবন, উর্বরতা ও পুণঃজন্মের জীবন্ত প্রতীকরূপে পরিচিতি পান। গুচোজেরারা নির্বাচিত পচামামা রাণীকে উন্মুক্ত জায়গায় তাদের ঘোড়া দিয়ে ঘিরে রাখে ও রবিবাসরীয় সমাবেশে অভিবাদন প্রদান করে। এ উৎসবের রবিবাসরীয় সমাবেশকে চূড়ান্ত মুহুর্তরূপে বিবেচনা করা হয়।[২]

নতুন যুগের প্রার্থনা[সম্পাদনা]

সাম্প্রতিককালে শ্বেতাঙ্গ ও আন্দীয় মেস্তিজো জনগোষ্ঠী একত্রে নতুন যুগের চর্চা করছে। সাপ্তাহিকভাবে আনুষ্ঠানিকতা সহকারে দেবীর পূজার জন্য তারা রবিবারকে বেছে নিয়েছে। কেচুয়ায় পাচামামার কাছ থেকে শক্তি লাভের উদ্দেশ্যে এমনটি করা হয়। স্পেনীয় ভাষায় এ সম্পর্কে কিছু তথ্যাদি রয়েছে।[৮] মন্দিরের অভ্যন্তরে বৃহদাকৃতির পাত্রে বড় একটি পাথর রাখা হয়েছে যা নতুন যুগের সাথে সম্পৃক্ত দলের প্রতিনিধিত্ব করছে ও তাদের বিশ্বাস বিরাজমান থাকে। পাথরটির ডানদিকে একটি বাটিতে কাদা রাখা আছে যা পাচামামার উপস্থিতি বিদ্যমান; কেননা তিনি পৃথিবী মাতা হিসেবে মর্যাদা পাচ্ছেন।[৮] পাচামামাকে ঘিরে অনেক অনুষ্ঠান জড়িত। খ্রিস্টান ধর্মের সাথে যুক্ত থেকে অনেক পরিবারই পাচামামারও পূজো দিয়ে থাকেন।[৯] অনেক সময় কুমারী কান্ডেলারিয়ার সাথে পাচামামাকে যুক্ত করা হয়।[১০] কিছু ট্রাভেল এজেন্সী কুচুয়া ইন্ডিয়ান অনুষ্ঠান চর্চায় জড়িত আন্দীয় সম্প্রদায়কে নতুন যুগীয় উদিত আন্দোলনকে চিত্রিত করছেন যা পর্যটকদের ইনকা স্থানগুলো পরিদর্শনে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা চালাচ্ছে। মাচু পিচু ও কোস্কো’র ন্যায় পর্যটন আকর্ষণ কেন্দ্রগুলো পরিদর্শনের পর তাদেরকে পাচামামার আনুষ্ঠানিকতা দেখার জন্য আমন্ত্রণ জানান।[৬] পর্যটন শিল্পে পাচামামাকে যুক্ত করে পর্যটকদের মাঝে এর গুরুত্বতা বৃদ্ধির চেষ্টা করা হয়।

রাজনৈতিক প্রভাব[সম্পাদনা]

পাচামামার অসম্ভব জনপ্রিয়তার বিষয়ের ন্যায় বিশ্বাসবোধ পেরুর জাতীয় পর্যায়ে গল্পতুল্য।, পেরুর সাবেক রাষ্ট্রপতি আলেজান্দ্রো তলেদো ২৮ জুলাই, ২০০১ তারিখে প্রতীকিরূপে আনুষ্ঠানিকভাবে মাচু পিচুতে কেচুয়া ধর্মীয় পাচামামার প্রার্থনা অনুষ্ঠানে অংশ নেন।[৬] এছাড়াও, কিছু আন্দীয় বুদ্ধিজীবীরাও পাচামামার বিশ্বাসবোধে আচ্ছন্ন বলে দাবী করা হয়।

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. Dransart, Penny. (1992) "Pachamama: The Inka Earth Mother of the Long Sweeping Garment." Dress and Gender: Making and Meaning. Ed. Ruth Barnes and Joanne B. Eicher. New York/Oxford: Berg. 145-63. Print.
  2. Matthews-Salazar, Patricia. (2006) "Becoming All Indian: Gauchos, Pachamama Queens, and Tourists in the Remaking of an Andean Festival." Festivals, Toursism and Social Change: Remaking Worlds. Ed. David Picard and Mike Robinson. N.p.: Channel View Publications. 71-81. Print.
  3. Murra, John V. (১৯৬২)। "Cloth and Its Functions in the Inca State"American Anthropologist64 (4)। পৃষ্ঠা 714। ডিওআই:10.1525/aa.1962.64.4.02a00020 
  4. Merlino, Rodolfo y Mario Rabey (১৯৯২)। "Resistencia y hegemonía: Cultos locales y religión centralizada en los Andes del Sur"। Allpanchis (স্পেনীয় ভাষায়) (40)। পৃষ্ঠা 173–200। 
  5. Molinie, Antoinette (২০০৪)। "The Resurrection of the Inca: The Role of Indian Representations in the Invention of the Peruvian Nation"। History and Anthropology15 (3)। পৃষ্ঠা 233–250। ডিওআই:10.1080/0275720042000257467 
  6. Hill, Michael (২০০৮)। "Inca of the Blood, Inca of the Soul"। Journal of the American Academy of Religion76 (2)। পৃষ্ঠা 251–279। ডিওআই:10.1093/jaarel/lfn007 
  7. Lira, Jorge A (১৯৪৪)। Diccionario Kkechuwa - Español (স্পেনীয় ভাষায়)। Tucumán, Argentina 
  8. Hill, Michael D. (২০১০)। "Myth, Globalization, and Mestizaje in New Age Andean Religion"Ethnohistory57 (2)। পৃষ্ঠা 263–289। ডিওআই:10.1215/00141801-2009-063 
  9. Merlino, Rodolfo y Mario Rabey (১৯৮৩)। "Pastores del Altiplano Andino Meridional: Religiosidad, Territorio y Equilibrio Ecológico"। Allpanchis (স্পেনীয় ভাষায়) (21)। Cusco, Perú। পৃষ্ঠা 149–171। 
  10. Manuel Paredes Izaguirre। "COSMOVISION Y RELIGIOSIDAD EN LA FESTIVIDAD" (স্পেনীয় ভাষায়)। ২০১০-০৮-২৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১০-০২-১৫ 

আরও দেখুন[সম্পাদনা]

বহিঃসংযোগ[সম্পাদনা]