নাসরীয় মারিস্তান

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
নাসরীয় মারিস্তান
Maristán de Granada
একটি নাসরীয় মারিস্তানের সম্মুখভাগের অঙ্কন, ১৯ শতক।
মানচিত্র
ভৌগোলিক অবস্থান
অবস্থানগ্রানাডা, আন্দালুস, গ্রানাডা, স্পেন
সংস্থা
তহবিলসরকারি হাসপাতাল
ধরনবিমারিস্তান
পৃষ্ঠপোষকনসরি রাজবংশ
পরিষেবা
মানদণ্ডইসলামি চিকিৎসাব্যবস্থা
ইতিহাস
চালু১৩৬৭
বন্ধ১৪৯২
ভাঙন১৫০২

নাসরীয় মারিস্তান বা গ্রানাডার মারিস্তান ( স্পেনীয়: Maristán de Granada ) স্পেনের গ্রানাডায় একটি বিমারিস্তান (হাসপাতাল) ছিল। এটি ১৪ শতকে নাসরি রাজবংশের আমলে নির্মিত হয়েছিল এবং ১৯ শতকে তা ভেঙে ফেলা হয়েছিল। এটি ১৪ শতাব্দীতে সুলতান মোহাম্মদ পঞ্চম কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, যিনি অসুস্থ দরিদ্র মুসলিমদের চিকিৎসার জন্য একটি হাসপাতাল হিসাবে এটি প্রতিষ্ঠা করেন; তবে এটি একটি মানসিক হাসপাতাল হিসাবেও কাজ করেছিলো, যা গ্রানাডার মরিস্কো হাসপাতালের সাথে একত্রে নির্মিত হয়েছিল। এর পর ১৫শ শতকে এখানে টাকশাল অবস্থিত ছিল এবং পরবর্তীকালে এর ব্যবহারের পরিবর্তনের সাথে সম্পর্কিত অসংখ্য সংস্কার করা হয়েছিল।

১৮শ শতকে মারিস্তানটি একটি মদের গুদামে পরিণত হয়, যখন ১৯শ শতকে তা একটি কারাগার ও একটি বাসস্থান হিসাবে কাজ করেছিল। এরপর প্রত্নতাত্ত্বিক হস্তক্ষেপের ফলে অনন্য ভবনটি পরবর্তীতে পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হয়।

ইতিহাস[সম্পাদনা]

২০১৫ সালে বিমারিস্তানটির ধ্বংসাবশেষ।

মারিস্তান বা বিমারিস্তান ছিল তৎকালীন ইসলামী বিশ্বে প্রচলিত একটি ঐতিহাসিক হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা, যা ১২ ও ১৪ শতকে শতকের দিকে মরক্কো ও আন্দালুসে ছড়িয়ে পড়ে; তবে এটি আরও পূর্বে ইসলামি বিশ্বের একাধিক জায়গায় উদ্ভূত হয়েছিল।[১][২][৩] গ্রানাডার মারিস্তানটি মরক্কোতে মারিনিউনদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত অনুরূপ প্রতিষ্ঠানের দ্বারা অনুপ্রাণিত বা প্রভাবিত হতে পারে বলে ধারণা করা হয়। যেমন, ১৩ শতকের সিদি ফেজ মারিস্তান মারিনিউনরা তৈরি করেছিল এবং তা দেখে সম্ভবত নসরি শাসকরা অনুরূপ একটি প্রতিষ্ঠান তৈরি করে। [১][৩] এটি ১৩৬৫ সালে নাসরীয় সুলতান মুহাম্মদ পঞ্চম দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং এর দুই বছর পর ১৩৬৭ সালে এটির নির্মাণ শেষ হয়।[৩][৪][৫][৬] এটি হাম্মাম আল-ইয়াওজা (আজ আল বানুয়েলো নামে পরিচিত ) নামে পরিচিত ১১শ শতাব্দীর একটি সার্বজনীন স্নানাগারের কাছে দারো নদীর উত্তর তীরে নিম্ন আলবাইসিন কোয়ার্টারে অবস্থিত ছিল।[৩][৪]

এই অঞ্চলের অন্যান্য মারিস্তানের মত এ মারিস্তানটিও মানসিক রোগের চিকিৎসা করানোর জন্য বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ছিল।[৩][৬] যদিও এর মূল চিকিৎসা অন্য একাধিক রোগ-সংশ্লিষ্ট ছিল; তবে এ মারিস্তানটি ধীরে ধীরে মানসিকভাবে অসুস্থ ব্যক্তিবর্গের আশ্রয় হিসেবে বিশেষায়িত হয়ে ওঠে।[৭] এটি ছিল ইউরোপের প্রথম দিকের হাসপাতালগুলির একটি, যারা মানসিকভাবে অসুস্থদের যত্ন নিত।[১] খ্রিস্টান স্পেনে তুলনামূলক প্রতিষ্ঠানগুলি কেবলমাত্র ১৫ শতাব্দীর গোড়ার দিকে আওয়ার লেডি মেরি অফ দ্য ইনোসেন্টস হাসপাতাল নামে একটি হাসপাতালের ভিত্তি স্থাপনের সাথে সাথে উপস্থিত হওয়া শুরু করে। ভ্যালেন্সিয়ায় ইউরোপের প্রথম বিশুদ্ধ মানসিক হাসপাতাল ছিল।[১][৭]

মারিস্তানটির পাথর দিয়ে তৈরি সিংহ আকৃতির ঝর্ণাগুলির মধ্যে একটি (ডানদিকে) বর্তমান আল-হামরা জাদুঘরে প্রদর্শিত হচ্ছে।

১৪৯২ সালে গ্রানাডা ও স্পেনে মুসলিম শাসন বিলুপ্ত হওয়ার পর ভবনটি অন্য কাজে ব্যবহারের জন্য ভিন্ন ভবনে রূপান্তরিত হয়। ১৫০২ সালে,[৮] এটি একটি টাকশাল (কাসা দে লা মোনেদা ) হয়ে উঠেছিল।[৩][৭] পরবর্তীতে ১৮শ শতাব্দী পর্যন্ত তা মার্সেডারীয় খ্রিস্টান ভিক্ষুকদের দেওয়া হয়েছিল, যখন তারা একে একটি মদ্য কারখানায় পরিণত করেছিল। অবশেষে, এটি পরিত্যক্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত একটি ভাড়াবাড়ি হিসাবে কাজ করেছিল।[৮]

১৯ শতকের মধ্যে ভবনটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় এবং অবশেষে ১৮৪৩ সালে তা প্রায় সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করা হয়। অবশিষ্টাংশ ১৯৭৪ সালে আবারো ধ্বংস করা হয় এবং[৩] ধ্বংসের পর মারিস্তানের পাথরের তৈরি সিংহ আকৃতির ঝর্ণাগুলিকে নিকটবর্তী আলহাম্বরার পার্টাল প্রাসাদে স্থানান্তরিত করা হয়, যেখানে তা পুনরুদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত কয়েক দশক ধরে পড়ে ছিল। পরবর্তীতে এগুলিকে আলহাম্রা যাদুঘরে স্থানান্তরিত হয়, যেখানে সেগুলি বর্তমান মারিস্তানটির মূল ভিত্তি শিলালিপিসহ প্রদর্শিত হয়।[৪][৯]

স্থাপত্য[সম্পাদনা]

১৯ শতকের পরিকল্পনায় ভবনটির বিন্যাস ও আকৃতি এবং ফ্রান্সিসকো এনরিকেজ ফেরার ও জুলেস গেইল হাবাউডের তৈরি অঙ্কন সেইসাথে আধুনিক প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানের জন্য তাদের সাধুবাদ জানানো যায়।[৪] এর অনেক উপাদানের সাথে নাসরি-যুগের ক্যারাভান সেরাইয়ের মিল ছিল, যা আজ কোরাল দেল কার্বন নামে পরিচিত।[৩]

কাঠামোটির একটি আয়তক্ষেত্রাকার মেঝে বানানোর পরিকল্পনা ছিল, যার পরিমাপ ৩৮ বাই ২৬.৫ মিটার এবং এটি ইটের তৈরি ও প্লাস্টার দিয়ে আবৃত ছিল।[৪] চারপাশে অবস্থিত চারটি দীর্ঘ আয়তক্ষেত্রাকার একটি হলসহ একটি কেন্দ্রীয় আঙিনা নিয়ে গঠিত, যা বাঁকা হয়ে অনেকগুলি ছোট কক্ষে বিভক্ত ছিল এবং চারটি বর্গাকার হল কোণায় একটি সিঁড়িসহ একই রকম ব্যবস্থায় দ্বিতীয় তলায় উঠেছে। এর উঠোনটির পরিমাপ ২৬ বাই ১৫ মিটার এবং তা একটি পোর্টিকো বা গ্যালারি দ্বারা বেষ্টিত ছিল।[৪] উঠোনটির কেন্দ্রে একটি লম্বা আয়তাকার পুল ছিল, যার লম্বা দুই পাশে দুটি সিংহ আকৃতির পাথরের তৈরি ঝর্ণা ছিল। যদিও এর কেন্দ্রীয় পুলগুলি তৎকালীন মুর স্থাপত্যের একটি নিয়মিত বৈশিষ্ট্য ছিল, তবে পুলে নেমে যাওয়া সিঁড়ির উপস্থিতি থেকে বোঝা যায়, এটি ভৈষজ স্নানের জন্য সম্ভবত ব্যবহৃত হতে পারে।[৪] ভবন খনন করে প্রাপ্ত টুকরোগুলি পরীক্ষা করে জানা যায় যে, বিল্ডিংয়ের অভ্যন্তরটি একসময় টাইলওয়ার্ক, খোদাই করা স্টুকো ও মার্বেল দিয়ে সজ্জিত ছিল।[৪] পাথরের সিংহটি–যা বর্তমানে আলহামরা জাদুঘরে রাখা হয়েছে–[৯] গাঢ় রঙের মার্বেল দিয়ে তৈরি এবং সিংহের বাস্তবসম্মত চিত্রের পরিবর্তে একটি শোভনীয় চিত্র উপস্থাপন করা হয়েছে।[৩]

ভবনটির বাইরের অংশে একটি সুসজ্জিত প্রবেশদ্বার পোর্টালসহ একটি প্রতিসাম্য সম্মুখভাগ ছিল।[৩][৪] সেখানে যুগল কাঠের দরজার উপরে আলংকারিক সংমিশ্রণ ছিল; নীচে ইট দিয়ে খোদাই করা জ্যামিতিক অলঙ্করণে আচ্ছাদিত একটি চৌকাঠ ছিল, যার উপরে একটি সূক্ষ্ম হর্সশু খিলান আকৃতির কুলুঙ্গি ছিল।[৪] খিলানযুক্ত কুলুঙ্গিটি ফিরোজা পটভূমিতে সোনার আঁকা আরবি অক্ষরসহ পাথরে খোদাই করা ভবনের দীর্ঘ ভিত্তি শিলালিপিতে ভরা ছিল।[৩][৪] এই শিলালিপির পাথরের প্যানেলটি আজও আলহামরা জাদুঘরে রাখা আছে।[৩][১০]

আধুনিক পুনরুদ্ধার[সম্পাদনা]

কয়েক দশক ধরে পরিত্যক্ত থাকার পর ২০২০ সালে মারিস্তানের দেহাবশেষ পুনরুদ্ধার করার জন্য একটি বড় প্রকল্প শুরু হয়েছিল; যদিও সে বছর কোভিড-১৯ এর বৈশ্বিক মহামারীর কারণে প্রাথমিকভাবে প্রকল্পটি বিলম্বিত হয়।[১১][১২] ইউরোপীয় আঞ্চলিক উন্নয়ন তহবিল থেকে ১.৩ মিলিয়ন ইউরো বিনিয়োগ করে প্রকল্পটি আংশিকভাবে অর্থায়ন করা হয়।[৮] কাজের প্রথম ধাপে মারিস্তানের দক্ষিণ গ্যালারিকে একীভূত করা এবং তা পুনরুদ্ধার করার পরিকল্পনা করা হয়, যা ধ্বংস থেকে বেঁচে যাওয়া মূল ভবনের একমাত্র অংশ ছিল। এই প্রথম ধাপটি ২০২২ সালে সম্পন্ন হয়েছিল এবং ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাস থেকে স্থানটি এখন দর্শক ও পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত।[৮] ২০২৩ সালের মার্চ পর্যন্ত প্রকল্পের দ্বিতীয় ধাপের একটি পরিকল্পনা করা হয়েছিল, যার লক্ষ্য ছিল বাকি ভবনটি পুনরুদ্ধার করা এবং এতে আরো ব্যববহারযোগ্য প্রবেশদ্বার যোগ করা।[১৩]

কাজের প্রাথমিক পর্যায়ে খনন করার সময় বেশ কিছু বিষয় আবিষ্কার করা হয়েছিল। তার মধ্যে, আঙ্গিনার নীচে নাসরীয় মারিস্তানের ১১ শতাব্দীর একটি কূপ আবিষ্কৃত হয়েছিল।[১৪] নাসরীয়-পরবর্তী সময় থেকে, ষোড়শ শতাব্দীর টাকশালের অন্তর্গত গলিত চুল্লি এবং একটি শীতল পুকুরও উদ্ধার করা হয়। দর্শনার্থীদের দেখার জন্য পুনরুদ্ধার করা জিনিসগুলি ভবনের নিচে একত্র করা হয়েছে।[১৫]

আরও দেখুন[সম্পাদনা]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. Perez, Jesus; Girón-Irueste, Fernando (২০১৩)। "The Lions of Granada Maristan": 152–153। ডিওআই:10.1176/appi.ajp.2012.12081066পিএমআইডি 23377635 
  2. Moussaoui, Driss; Glick, Ira D. (২০১৫)। "The Maristan "Sidi Fredj" in Fez, Morocco": 838–839। ডিওআই:10.1176/appi.ajp.2015.15010051পিএমআইডি 26324302 
  3. "Qantara - Maristan of Granada/ Foundation Stone/ Fountain heads in the shape of lions"www.qantara-med.org। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-১২-১৭ 
  4. "Maristan at Granada"Archnet। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-১২-১৭ 
  5. "The MARISTAN. Building and use as a hospital in the Nasrid Era"Patronato de la Alhambra y Generalife (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-১২-১৭ 
  6. Imamuddīn, S.M. (১৯৭৮)। "Maristan (Hospitals) in Medieval Spain": 45–55। জেস্টোর 20847059পিএমআইডি 11614662 
  7. Perez, Jesus; Baldessarini, Ross (২০১২)। "Origins of Psychiatric Hospitalization in Medieval Spain": 419–430। ডিওআই:10.1007/s11126-012-9212-8পিএমআইডি 22350131 
  8. Pérez, Manuel Mateo (৮ জানুয়ারি ২০২৩)। "Granada recupera el edificio emblemático del Maristán y cierra el círculo de sus grandes monumentos nazaríes"ELMUNDO (স্পেনীয় ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০৫-১১ 
  9. "The Maristán Lions"Patronato de la Alhambra y Generalife (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-১২-১৭ 
  10. "The foundation stone of Granada's maristan"Patronato de la Alhambra y Generalife (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-১২-১৭ 
  11. Cappa, Gonzalo (৭ মার্চ ২০২২)। "El primer hospital de Al-Ándalus vuelve a la vida: el Maristán de Granada recupera su esplendor"elconfidencial.com (স্পেনীয় ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০৫-১১ 
  12. "La recuperación del pabellón sur del Maristán de Granada continúa de cara al inicio de 2022"Europa Press (স্পেনীয় ভাষায়)। ৮ ডিসেম্বর ২০২১। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০৫-১১ 
  13. "La Alhambra licita la redacción del proyecto que recuperará al completo el Maristán de Granada"Granada Hoy (স্পেনীয় ভাষায়)। ৩০ মার্চ ২০২৩। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০৫-১১ 
  14. "Las obras del Maristán sacan a la luz un pozo anterior al hospital nazarí"elDiario.es (স্পেনীয় ভাষায়)। ৪ জানুয়ারি ২০২১। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০৫-১১ 
  15. Ubago, Laura (২২ নভেম্বর ২০২১)। "Finaliza la restauración del Maristán"Agencia Albaicín (স্পেনীয় ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০৫-১১