ধর্মকীর্তি

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
ধর্মকীর্তি

ধর্মকীর্তি (জীবনকাল-সপ্তম শতাব্দী) ভারতের একজন বিখ্যাত বৌদ্ধ দার্শনিক ছিলেন। প্রখ্যাত ভারতবিদ ফিওদর শ্কেরবাৎস্কি ধর্মকীর্তিকে ইমানুয়েল কান্টের সঙ্গে তুলনা করে[n ১] ভারতের কান্ট বলে অভিহিত করেন।

সংক্ষিপ্ত জীবনী[সম্পাদনা]

ধর্মকীর্তি সপ্তম শতাব্দীতে চোল রাজ্যের তিরুমলৈ নামক গ্রামের এক ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম কোরূনন্দ ছিল বলে বিভিন্ন তিব্বতী গ্রন্থ থেকে জানা যায়। শৈশব থেকে তিনি বেদ ও অন্যান্য বৈদিক শাস্ত্র সম্বন্ধে অধ্যয়ন করেন। কিন্তু নাগার্জুন, বসুবন্ধু, দিঙনাগ প্রভৃতি বৌদ্ধ পন্ডিতদের দর্শন পাঠ করে তিনি অত্যন্ত প্রভাবিত হয়ে পড়ায় ব্রাহ্মণগণ তাকে পরিত্যাগ করেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে তিনি নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাত্রা করে বিহারের প্রধান ধর্মপালের নিকট শিষ্যত্ব লাভ করেন। এই সময় দিঙনাগের শিষ্য পরম্পরার ঈশ্বরসেন নামক নৈয়ায়িকের নিকট তিনি ন্যায়শাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। শিক্ষালাভের শেষে তিনি আত্মজীবনী ও বিভিন্ন গ্রন্থ রচনা করেন।[২]:২৩৬, ২৩৭

সময়কাল[সম্পাদনা]

চৈনিক পরিব্রাজক ই-চিং তার গ্রন্থে ধর্মপালের উল্লেখ করেছেন, সেই কারণে ধর্মকীর্তি ৬৭৯ খ্রিষ্টাব্দের পূর্বেকার মানুষ ছিলেন বলে মনে করা হয়। কিন্তু হিউয়েন সাঙ তার গ্রন্থে ধর্মকীর্তির কোন রকম উল্লেখ করেননি। সেই থেকে অনুমান করা হয়, যে হিউয়েন সাঙ যখন নামলন্দায় বসবাস করেছিলেন, ততদিনে ধর্মকীর্তির মৃত্যু ঘটে গেছিল। যাই হোক না কেন, ধর্মপাল খ্রিষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীর মানুষ ছিলেন বলে বিশ্লেষণ করা যায়।[২]:২৩৭

রচনা[সম্পাদনা]

ধর্মকীর্তি বৌদ্ধ প্রমাণশাস্ত্রের ওপর প্রমাণবার্তিক, প্রমাণবিনিশ্চয়, ন্যায়বিন্দু, হেতুবিন্দু, সম্বন্ধ পরীক্ষা, বাদন্যায়, সন্তানান্তর সিদ্ধি নামক তার সাতটি মূল গ্রন্থে মোট ৪,৩১৪১/২ টি শ্লোক রচনা করেন। এছাড়া তিনি প্রমাণবার্তিক গ্রন্থের প্রথম পরিচ্ছেদ এবং সম্বন্ধ পরীক্ষার ওপর লেখা তার দুইটি টীকাভাষ্যে মোট ৩,৬৪৭টি শ্লোক গদ্যাকারে রচনা করেন।[২]:২৩৭-২৩৯

গ্রন্থের নাম শ্লোক সংখ্যা রচনাশৈলী টীকা
টীকাকার ভাষায় উপলবব্ধ পরিচ্ছেদের ওপর টীকা শ্লোক
প্রমাণবার্তিক ১,৪৫৪১/২ পদ্য
দেবেন্দ্রবুদ্ধি তিব্বতী ২-৪ ৮,৭৪৮
শাক্যবুদ্ধি তিব্বতী ২-৪ ১৭,০৪৬
প্রজ্ঞাকরগুপ্ত সংস্কৃত, তিব্বতী ২-৪ ১৬,২৭৬
জয়ানন্দ তিব্বতী ২-৪ ১৮,১৪৮
যমারি তিব্বতী ২-৪ ২৬,৫৫২
রবিগুপ্ত তিব্বতী ২-৪ ৭,৫৫২
মনোরথনন্দী সংস্কৃত ১-৪ ৮,০০০
ধর্মকীর্তি সংস্কৃত, তিব্বতী ৩,৫০০
শঙ্করানন্দ তিব্বতী ৭,৫৭৮
কর্ণকগোমী সংস্কৃত ১০,০০০
প্রমাণবিনিশ্চয় ১,৩৪০ গদ্য-পদ্য
ধর্মোত্তর তিব্বতী ১-৩ ১২,৪৬৩
জ্ঞানশ্রী তিব্বতী ৩,২৭১
ন্যায়বিন্দু ১৭৭ গদ্য
বিনীতদেব তিব্বতী ১-৩ ১,০৩০
ধর্মোত্তর সংস্কৃত, তিব্বতী ১-৩ ১,৪৭৭
দুর্বেকমিশ্র সংস্কৃত ১-৩
কমলশীল তিব্বতী ২২১
জিনমিত্র তিব্বতী ৩১
হেতুবিন্দু ৪৪৪ গদ্য
বিনীতদেব তিব্বতী ১-৪ ২,২৬৮
অর্চট সংস্কৃত, তিব্বতী ১-৪ ১,৭৬৮
দুর্বেকমিশ্র তিব্বতী ১-৪ ১,৭৬৮
সম্বন্ধ পরীক্ষা ২৯ গদ্য-পদ্য
ধর্মকীর্তি তিব্বতী ১৪৭
বিনীতদেব তিব্বতী ৫৪৮
শঙ্করানন্দ তিব্বতী ৩৮৪
বাদন্যায় ৭৯৮ পদ্য
বিনীতদেব তিব্বতী ৬০৯
শান্তরক্ষিত সংস্কৃত, তিব্বতী ২,৯০০
সন্তান্তর সিদ্ধি ৭২ পদ্য
বিনীতদেব তিব্বতী ৪৭৪

দর্শন[সম্পাদনা]

ধর্মকীর্তি অসঙ্গের যোগাচার দার্শনিক সম্প্রদায়ের সমর্থক ছিলেন, কিন্তু তিনি দিঙনাগের মতো শুদ্ধ যোগাচারী ছিলেন না। তিনি সৌত্রান্তিক সম্প্রদায়ের মতো বাহ্য জগতের প্রবাহরূপী ক্ষণিক বাস্তবদাকে স্বীকার করেও তিনি যোগাচারীদের মতো বিজ্ঞানকে (=ভাব) মূল বলে মানতেন বলে তিনি ছিলেন মূলত স্বতন্ত্র যোগাচারী বা সৌত্রান্তিক যোগাচারী দার্শনিক মতের সমর্থক। ঙ্গাগ-দ্বাং-দ্পাল-ল্দান (ওয়াইলি: ngag dbang dpal ldan) নামক এক তিব্বতী ব্যাখ্যাকারের মতে প্রজ্ঞাকরগুপ্ত, শান্তরক্ষিত, কমলশীল সূর্যগুপ্ত, জেতারি প্রভৃতি ভারতীয় বৌদ্ধরা ধর্মকীর্তিকে মধ্যমক দর্শনের স্মর্থক বলে উল্লেখ করেছেন।[n ২] স্বাতন্ত্রিক বস্তুবাদী হয়েও ধর্মকীর্তি দুঃখের আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা দিয়ে দুঃখের কারণকে জন্মান্তরবাদে নিহিত বলেছিলেন।

পাদটীকা[সম্পাদনা]

  1. The fundamental difference between the Kantian Thing-in-Itself and Dharmakirti's 'Own essence' consists in the clear identification of the latter with a single point instant of reality which corresponds to a moment of sensation".[১]:২০১
  2. Ngawang Palden in the Sautrantika chapter of his Explanation of the Conventional and the Ultimate in the Four Systems of Tenets (Grub mtha' bzhi'i lugs kyi kun rdzob dang don dam pa'i don rnam par bshad pa legs bshad dpyid kyi dpal mo'i glu dbyangs, New Delhi: Guru Deva, 1972, 39.5–39.6) says that some such as Prajñakaragupta, Suryagupta, Shantarakshita, Kamalashila, and Jetari interpret Dharmakirti’s Commentary on [Dignaga’s] Compendium of Valid Cognition (Tshad ma rnam 'grel, Pramanavarttika) as a Madhyamika treatise."[৩]</ref>

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. Fyodor Stcherbatsky Buddhist Logic (1932), vol I
  2. রাহুল সাংকৃত্যায়ন, দর্শন দিগদর্শন, দ্বিতীয় খণ্ড, অনুবাদ: ছন্দা চট্টোপাধ্যায়, সম্পাদনা: তারাপদ মুখোপাধ্যায়, প্রকাশক: শিবব্রত গঙ্গোপাধ্যায়, চিরায়ত প্রকাশনী প্রাইভেট লিমিটেড, ১২, বঙ্কিম চ্যাটার্জী স্ট্রীট, কলকাতা-৭৩, প্রথম প্রকাশ: সেপ্টেম্বর ১৯৮৮
  3. Dependent-Arising and Emptiness: A Tibetan Buddhist Interpretation of Madhyamika Philosophy Emphasizing the Compatibility of Emptiness and Conventional Phenomena Napper, Elizabeth. Boston: Wisdom Publications. p. 685, note 142

আরো পড়ুন[সম্পাদনা]