বিষয়বস্তুতে চলুন

জিঞ্জিরা প্রাসাদ

জিঞ্জিরা প্রাসাদ
বুড়িগঙ্গা নদীর ওপারে অবস্থিত জিঞ্জিরা প্রাসাদ, ২০১৬
ধরনপ্রাসাদ
অবস্থানজিঞ্জিরা, কেরানীগঞ্জ, বাংলাদেশ
নিকটবর্তী শহরঢাকা
স্থানাঙ্ক২৩°৪২′২৯″ উত্তর ৯০°২৩′৪৭″ পূর্ব / ২৩.৭০৮০৬° উত্তর ৯০.৩৯৬৩৯° পূর্ব / 23.70806; 90.39639
অঞ্চলকয়েক একর জমির ওপর নির্মিত
নির্মিত১৬৮৯–১৬৯৭ খ্রিস্টাব্দ (১৭শ শতাব্দীর শেষ ভাগ)
নির্মাতাইবরাহিম খান ফতেহ জঙ্গ
নির্মাণের কারণইব্রাহিম খান II
স্থাপত্যশৈলীমুগল স্থাপত্য
পরিচালকবর্গবাংলাদেশ সরকার (সংরক্ষণের উদ্যোগ ২০১৮ থেকে)
অবৈধ উপাধি
প্রাতিষ্ঠানিক নামজিঞ্জিরা প্রাসাদ
ধরনঐতিহাসিক নিদর্শন
মনোনীত২০১৮ (সংস্কার উদ্যোগ)
জিঞ্জিরা প্রাসাদ বাংলাদেশ-এ অবস্থিত
জিঞ্জিরা প্রাসাদ
বাংলাদেশের মধ্যে অবস্থান

জিনজিরা প্রাসাদ বা জিঞ্জিরা প্রাসাদ বাংলাদেশের ঢাকা জেলার কেরানীগঞ্জে বুড়িগঙ্গা নদীর দক্ষিণ তীরে অবস্থিত একটি ঐতিহাসিক মুঘল প্রাসাদ। ১৭শ শতকের শেষভাগে মুঘল সুবেদার ইব্রাহিম খান ফতেহ জঙ্গ এটি নির্মাণ করেন। একসময় এটি অবকাশযাপন ও প্রমোদনিবাস হিসেবে ব্যবহৃত হতো। “জিনজিরা” শব্দটি এসেছে আরবি “জাজিরা” থেকে, যার অর্থ দ্বীপ।[][]

ইতিহাস

[সম্পাদনা]

১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধের পরে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতনের সময় তার স্ত্রী লুৎফুন্নেসা, মা আমেনা বেগম, খালা ঘসেটি বেগম, কন্যা উম্মে জোহরা এবং আরও অনেক নারী সদস্যকে এই প্রাসাদে বন্দি রাখা হয়। মীরজাফরের পুত্র মীরনের নির্দেশে ১৭৬০ সালে ঘসেটি ও আমেনা বেগমকে নৌকায় করে ধলেশ্বরী নদীর সঙ্গমস্থলে ডুবিয়ে হত্যা করা হয়।[] ব্রিটিশ সেনাপতি রবার্ট ক্লাইভের হস্তক্ষেপে সিরাজের স্ত্রী ও কন্যা রক্ষা পান এবং পরে মুর্শিদাবাদে প্রেরিত হন। সিরাজ পতনের বহু বছর পরে, ১৭৯০ সালে লুৎফুন্নেসার মৃত্যু হয়।[] []

ঐতিহাসিক গুরুত্ব

[সম্পাদনা]

প্রাসাদটি শুধু বিনোদন বা অবকাশযাপন কেন্দ্র ছিল না, মুঘল আমলের বহু রাজনৈতিক ও পারিবারিক নাটকীয় ঘটনার কেন্দ্রবিন্দুও ছিল। পলাশীর যুদ্ধোত্তর সময়ে নবাব পরিবার ও স্বজনদের বন্দিত্ব ও হত্যার মর্মান্তিক ইতিহাস, এখানে গড়ে উঠেছে।[] এছাড়া, মুঘল আমলের প্রশাসক ও ক্ষমতাচ্যুত রাজন্যবর্গের কারাবাস ও নির্বাসনস্থল হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। ইতিহাসবিদ জেমস টেইলর তাঁর ‘টপোগ্রাফি অব ঢাকা’ গ্রন্থে ইব্রাহিম খানকে জিনজিরা প্রাসাদের নির্মাতা হিসেবে উল্লেখ করেছেন।[]

ঘসেটি বেগমের জীবনযাপন

[সম্পাদনা]

ঘসেটি বেগম ছিলেন নবাব সিরাজউদ্দৌলার খালা এবং বাংলার ইতিহাসে এক বিতর্কিত, অথচ গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। পলাশীর যুদ্ধে সিরাজউদ্দৌলার পতনের পেছনে ষড়যন্ত্রকারীদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। কিন্তু যুদ্ধের পরপরই, নিজেও ষড়যন্ত্রের শিকার হন এবং জীবনের শেষ দিনগুলো কেটেছে ঢাকার কেরানীগঞ্জের ঐতিহাসিক জিনজিরা প্রাসাদে বন্দি অবস্থায়।[]

১৭৫৭ সালের শেষে সিরাজউদ্দৌলার মা, স্ত্রী, কন্যা ও ঘসেটি বেগমসহ পরিবারের নারী সদস্যদের জিনজিরা প্রাসাদে আনা হয়। বন্দি অবস্থায় তারা বাইরে বের হতে পারতেন না এবং নানা শারীরিক ও মানসিক কষ্টে দিন কাটাতেন। ১৭৬০ সালে, মীরজাফরের ছেলে মীরনের নির্দেশে, ঘসেটি বেগম ও আমিনা বেগমকে নদীতে ডুবিয়ে হত্যা করা হয় বলে বাংলাপিডিয়া ও ইতিহাসবিদদের মতে জানা যায়। ঘসেটি বেগমের প্রকৃত নাম ছিল মেহের-উন-নিসা বেগম। তিনি নবাব আলীবর্দী খানের বড় মেয়ে এবং ঢাকার নায়েবে নাজিম নওয়াজিস মুহাম্মদ শাহমাত জং-এর স্ত্রী ছিলেন। তিনি রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত প্রভাবশালী ছিলেন এবং রাজস্ব ও প্রশাসনিক কাজে সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন।[]

স্থাপত্যশৈলী ও অবকাঠামো

[সম্পাদনা]

জিনজিরা প্রাসাদ নির্মাণশৈলীতে মুঘল রীতির প্রতিফলন লক্ষণীয়। প্রাসাদের পশ্চিমাংশে দুটি সমান্তরাল গম্বুজ, মাঝে ঢাকনাবিহীন একটি গম্বুজ এবং পূর্ব দিকে দোচালা কুঁড়েঘরের আদলে ছাদ রয়েছে। পূর্বাংশে ছাদ থেকে সিঁড়ি নিচে নেমে গেছে। একসময় আশেপাশে জলরাশি ও দেশীয় গাছপালা ছিল। প্রাসাদ ঘিরে ছিল খাল ও প্রাচীর। স্থানীয়দের মতে, লালবাগ দুর্গের সঙ্গে বুড়িগঙ্গার তলদেশে সুড়ঙ্গ ছিল, যদিও এ ব্যাপারে কোনো ঐতিহাসিক প্রমাণ নেই।[]

বর্তমান অবস্থা

[সম্পাদনা]

বর্তমানে জিনজিরা এলাকাটি ঘনবসতিপূর্ণ। প্রাসাদের প্রবেশ তোরণ, কিছু গম্বুজ ও কক্ষ এখনো টিকে আছে। আশেপাশে আধুনিক দোকান, বাড়িঘর ও ভবন গড়ে ওঠায় ঐতিহ্য হারাতে বসেছে। প্রাসাদের কিছু অংশ আবর্জনা ও অব্যবস্থাপনার কারণে ধ্বংসপ্রায়। ২০১৮ সালে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় এটি সংরক্ষণের উদ্যোগ গ্রহণ করে, তবে কার্যকর রক্ষণাবেক্ষণ এখনো যথেষ্ট নয়।[][]

মালিকানা

[সম্পাদনা]

ব্রিটিশ আমলে হাজী অজিউল্যাহ প্রাসাদসহ এই জমি কিনে নেন। উত্তরসূরি জাহানারা বেগম ও তার পরিবার এখন এর মালিক ও দেখাশোনা করেন।[]

পর্যটন ও সাধারণ তথ্য

[সম্পাদনা]

প্রাসাদটি সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত। প্রবেশমূল্য নেই, তবে স্বেচ্ছা অনুদান নেওয়া হয়। শীতকালে (অক্টোবর-মার্চ) ঘুরে দেখার জন্য আদর্শ সময় বলে পর্যটন-বিষয়ক অনেক ব্লগে উল্লেখ আছে।[]

তথ্যসূত্র

[সম্পাদনা]
  1. 1 2 3 মুয়ায্‌যম হুসায়ন খান। "জিনজিরা প্রাসাদ"বাংলাপিডিয়া
  2. 1 2 3 4 জিঞ্জিরা প্রাসাদ: হারানো দিনের গল্প, প্রথম আলো।
  3. বিষাদময় ইতিহাসের স্মৃতিবিজড়িত স্থান ‘জিনজিরা প্রাসাদ’, দৈনিক সংগ্রাম।
  4. জিনজিরা প্রাসাদ, ঢাকা জেলা প্রশাসন।
  5. 1 2 3 "ঘসেটি বেগম: পলাশীর যুদ্ধের অন্যতম ষড়যন্ত্রকারী ও নবাব সিরাজউদ্দৌলার খালার শেষ দিনগুলো কেটেছিল ঢাকার যে প্রাসাদে"BBC News বাংলা। সংগ্রহের তারিখ ৭ জুলাই ২০২৫
  6. জিনজিরা প্রাসাদ সংরক্ষণে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগ, ইনকিলাব।
  7. Jinjira Palace: Our history in ruins, দ্য ডেইলি স্টার।

বহিঃসংযোগ

[সম্পাদনা]