জিঞ্জিরা প্রাসাদ

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

জিনজিরা প্রাসাদ একটি ঐতিহাসিক পুরাকীর্তি যা বাংলাদেশের ঢাকা শহরের বুড়িগঙ্গা নদীর ওপারে কয়েক শ’ গজ দূরে অবস্থান। সিরাজদ্দৌলার স্ত্রী লুৎফুন্নেসা এবং তার শিশুকন্যাকে মীরজাফর পুত্র মীরনের নির্দেশে ঢাকায় বন্দী করে রাখা হয়েছিল।[১] সিরাজের পতনের পূর্ব পর্যন্ত ষড়যন্ত্রকারীরা ঘষেটি বেগমকে ব্যবহার করলেও সিরাজের পতনের পর আর তাকে কোনো সুযোগই দেয়া হয়নি। এ সময় তারা তাদের মা শরফুন্নেছা, সিরাজের মা আমেনা, খালা ঘষেটি বেগম, সিরাজের স্ত্রী লুৎফুন্নেছা ও তার শিশুকন্যা সবাইকে ঢাকার জিঞ্জিরা প্রাসাদে বন্দী করে রাখা হয়। ঢাকার বর্তমান কেরানীগঞ্জের জিঞ্জিরা প্রাসাদে তারা বেশ কিছুদিন বন্দী জীবন যাপন করার পর মীরনের নির্দেশে ঘষেটি বেগম ও আমেনা বেগমকে নৌকায় করে নদীতে ডুবিয়ে মারা হয়।[২] ক্লাইভের হস্তক্ষেপের ফলে শরফুন্নেছা, সিরাজের স্ত্রী লুৎফুন্নেছা এবং তার শিশুকন্যা রক্ষা পান এবং পরবর্তীতে তাদেরকে মুর্শিদাবাদে আনা হয়। ইংরেজ কোম্পানি সরকার কর্তৃক প্রদত্ত সামান্য বৃত্তির ওপর নির্ভর করে তাদেরকে জীবন ধারণ করতে হয়। সিরাজের মৃত্যুর দীর্ঘ ৩৪ বছর পর লুৎফুন্নেছা ১৭৯০ সালে মৃত্যুবরণ করেন।

নির্মাণশৈলী[সম্পাদনা]

এ প্রাসাদটির নির্মাণশৈলী বড় কাটরার আদলে হলেও কক্ষ ও আয়তন অনেক কম। পশ্চিমাংশে দু’টি সমান্তরাল গম্বুজ, মাঝ বরাবর ঢাকনাবিহীন অন্য একটি গম্বুজ ও পূর্বাংশ দোচালা কুঁড়েঘরের আদলে পুরো প্রাসাদের ছাদ। প্রাসাদের পূর্বাংশে ছাদ থেকে একটি সিঁড়ি নিচে নেমে গেছে। স্খানীয়রা এ প্রাসাদকে হাবেলী নগেরা বা হাওলি নগেরা বলে। [৩] এ প্রাসাদের তিনটি বিশেষ অংশ আজো আংশিক টিকে আছে­ তাহলো­ প্রবেশ তোরণ, পৃথক দু’টি স্খানে দু’টি পৃথক প্রাসাদ, একটি দেখতে ফাঁসির মঞ্চ ও অজ্ঞাত অন্যটি প্রমোদাগার।কয়েক একর জমির ওপর এ প্রাসাদ নির্মাণ করা হয়েছিল অবকাশ যাপন ও চিত্তবিনোদনের প্রান্তনিবাস হিসেবে। চার দিকে সুনীল জলরাশির মাঝখানে একখণ্ড দ্বীপ ভূমি জিনজিরা। নারিকেল-সুপারি, আম-কাঁঠালসহ দেশীয় গাছগাছালির সবুজের সমারোহে ফুলে ফুলে শোভিত অপূর্ব কারুকার্যখচিত মোগল স্খাপত্যশৈলীর অনুপম নিদর্শন জিনজিরা প্রাসাদ।স্থানীয়দের মতে মোগল আমলে লালবাগ দুর্গের সঙ্গে জিঞ্জিরা প্রাসাদের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষার জন্য বুড়িগঙ্গার তলদেশ দিয়ে একটি সুড়ঙ্গ পথ তৈরি করা হয়েছিল। এপথে মোগল সেনাপতি ও কর্মকর্তারা আসা-যাওয়া করত। লালবাগ দুর্গেও এমন একটি সুড়ঙ্গ পথ রয়েছে বলে জনশ্রুতি রয়েছে। বলা হয়ে থাকে এই সুড়ঙ্গ পথে যে একবার যায় সে আর ফিরে আসে না। তবে ইতিহাসে এ সম্পর্কে জোরালোভাবে কিছু বলা নেই।

অতীত ইতিহাস[সম্পাদনা]

সোয়ারীঘাট সংলগ্ন বড় কাটরা প্রাসাদ বরাবর বুড়িগঙ্গন, ওপারে জিনজিরা। জিনজিরা-জাজিরার অপভ্রংশ, যার অর্থ আইল্যান্ড বা দ্বীপ। এ দ্বীপে ১৬৮৯-১৬৯৭ খ্রিস্টাব্দে জিনজিরা প্রাসাদ ‘নওঘরা’ নির্মাণ করেছিলেন তৎকালীন সুবেদার নওয়াব ইব্রাহিম খাঁ[৪] আজ থেকে প্রায় ৪০০ বছর আগে শহর থেকে জিনজিরার মধ্যে চলাচলের জন্য একটি কাঠের পুল ছিল। পলাশীর যুদ্ধে সর্বস্বান্ত সিরাজদ্দৌলার পরিবার পরিজনকে জরাজীর্ণ জিনজিরা প্রাসাদে প্রেরণ করা হয়েছিল। আর সেই সাথে নবাব আলিবর্দী খাঁর দুই কন্যা­ঘসেটি বেগম ও আমেনা বেগমকেও আনা হয়। তারা দু’জনই পিতার রাজত্বকালে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।অবশেষে এক দিন পরিচারিকাদের সাথে একই নৌকায় তাকে ঢাকায় পাঠানো হয়। সে দিন বুড়িগঙ্গার তীরের জিনজিরা প্রাসাদে বন্দীদের নিয়ে রক্ষীদল উপস্খিত হয়েছিল। উল্লেখ্য, নবাব আলিবর্দী খাঁ ও তার পরিবার আগেই এখানে স্খান লাভ করেছিল। এভাবে পরাজিত নবাবের পরিবার-পরিজন জিনজিরা প্রাসাদে আশ্রয় গ্রহণ করেন। তার পর মীরজাফরের পুত্র মীরনের চক্রান্তে ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দের গ্রীষ্মের কোনো এক সন্ধ্যায় সিরাজ পরিবার জিনজিরা প্রাসাদ থেকে নেমে বুড়িগঙ্গা নদীর বুকে এক নৌকায় আরোহণ করে।[৩] নৌকা যখন বুড়িগঙ্গাধলেশ্বরীর সঙ্গমমূলে ঢাকাকে পেছনে রেখে এগিয়ে যাচ্ছিল তখন মীরননিযুক্ত ঘাতক বাকির খান নৌকার ছিদ্রস্খান খুলে দিয়ে নৌকাটি ডুবিয়ে দেয়।কিছু বুঝে ওঠার আগেই সবাই তলিয়ে যান বুড়িগঙ্গায়।

বর্তমান অবস্থা[সম্পাদনা]

একদা এটা ছিল নির্জন গ্রাম­ যার নাম হাওলি বা হাবেলী। বর্তমানে ঘিঞ্জি বসতি। ছোট গলিপথে একটু এগোতে একটা প্রবেশ তোরণ।তোরণের দুই পাশে স্খায়ী ভবন নির্মাণ করে আবাস গড়ে তোলা হয়েছে। চার দিকে দোকানপাট, ঘরবাড়ি, অট্টালিকা প্রবেশ অনেক কষ্টসাধ্য। প্রাসাদটির পূর্বাংশ তিনতলা সমান, দেখতে অনেকটা ফাঁসির মঞ্চ বা সিঁড়িঘর বলে মনে হয়। মাঝ বরাবর প্রকাণ্ড প্রাসাদ তোরণ। মোগল স্খাপত্যের অপূর্ব কারুকার্যখচিত তোরণ প্রাসাদকে দুই ভাগ করে অপর প্রান্তে খোলা চত্বরে মিশেছে। প্রাসাদ তোরণের পূর্বাংশেই ছিল সুড়ঙ্গপথ। ব্রিটিশ-পাকিস্তান আমল থেকে দেখে এলেও আধকার প্রকোষ্ঠে কেউ ঢুকতে সাহস করত না এই সুড়ক পথে। পশ্চিমাংশের অìধকার কুঠরি ময়লা আবর্জনায় পূর্ণ অব্যবহৃত। এ প্রাসাদটির নির্মাণশৈলী বড়কাটরার আদলে হলেও কক্ষ ও আয়তন অনেক কম।

২০১৮ সালে সরকার এটি সংস্কারের উদ্যগ নেয়।[৫]

সর্বশেষ মালিকানা[সম্পাদনা]

পুরো প্রাসাদ ও এর আশপাশ মালিকি ও তত্ত্বাবধায়ক পরিবারের পূর্বপুরুষ হাজী অজিউল্যাহ ব্রিটিশ আমলে ১৪ শতক জমি সাফ কবলা মূলে খরিদসূত্রে মালিক। ওয়ারিশসূত্রে বর্তমান মালিক ও পরিবার প্রধান জাহানারা বেগম (জাহারা) ৬২। হাজী অজিউল্যাহ তার শ্বশুর।

ইতিহাসবিদদের চোখে জিনজিরা প্রাসাদ[সম্পাদনা]

প্রখ্যাত ব্রিটিশ লেখক জেমস টেইলর তার ‘টপোগ্রাফি অব ঢাকা’ গ্রন্থে নবাব ইব্রাহিম খাঁকে জিঞ্জিরা প্রাসাদের নির্মাতা বলে উল্লেখ করেছেন।[৩] প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ড. মুনতাসির মামুন বলেন, জিঞ্জিরা প্রাসাদের সঙ্গে অষ্টাদশ শতাব্দীর বাংলার ইতিহাসের এক বিষাদময় স্মৃতি জড়িত। নবাব সিরাজউদ্দৌলার মা, স্ত্রী ও শিশু কন্যা এক সময় এই জিঞ্জিরা প্রাসাদে বন্দি ছিলেন। উমি চাঁদ, জগত শেঠ এবং রায় দুর্লভদের পরামর্শে প্রাসাদ থেকে মুর্শিদাবাদ নিয়ে যাবার ছল করে নওয়াজিস মহীয়সী ঘসেটি বেগম, নবাব সিরাজের মা আমিনা বেগম, নওয়াজিসের উত্তরাধিকারী একরাম উদ্দৌলার শিশুপুত্র মুরাদউদ্দৌলা, নবাব বেগম এবং শিশু কন্যাকে ধলেশ্বরীর বুকে ৭০ জন অনুচরসহ ডুবিয়ে হত্যা করা হয়। হুসেন কুলি ও সরফরাজের বংশধরগণ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে দেওয়ানী ভার অর্পণ করার পর বন্দিদশায় জিঞ্জিরা প্রাসাদেই অবস্থান করছিলেন। ইতিহাসবিদ নাজির হোসেনের কিংবদন্তি ঢাকা গ্রন্থে বলা হয়, নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরিবারকে দীর্ঘ ৮ বছর জিঞ্জিরা প্রাসাদে বন্দি করে রাখা হয়। মোগল শাসকদের অনেককে এই দুর্গে নির্বাসন দেয়া হয়েছিল।

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. "জিনজিরা প্রাসাদ"ঢাকা জেলা। ২০২০-০৭-১৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৭-১৭ 
  2. "বিষাদময় ইতিহাসের স্মৃতিবিজড়িত স্থান 'জিনজিরা প্রাসাদ'"The Daily Sangram। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৭-১৭ 
  3. মুয়ায্‌যম হুসায়ন খান। "জিনজিরা প্রাসাদ"বাংলাপিডিয়া 
  4. "জিঞ্জিরা প্রাসাদ: হারানো দিনের গল্প"প্রথম আলো। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৭-১৭ 
  5. সংবাদদাতা, কেরানীগঞ্জ (ঢাকা) উপজেলা। "জিনজিরা প্রাসাদ সংরক্ষণে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগ"DailyInqilabOnline (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৭-১৭ 

বহিঃসংযোগ[সম্পাদনা]