চিজের ইতিহাস

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
তিজ তৈরির দৃশ্য; তাসিনুম আস-সিহ্হা (Tacuinum sanitatis Casanatensis) বা স্বাস্থ্য পঞ্জিকা (১৪শ শতাব্দী)

চিজ উৎপাদন ৭০০০ বছর পূর্বের রেকর্ডকৃত ইতিহাসের জানান দেয় অর্থাৎ বর্তমান হতে ৭০০০ বছর পূর্বেও চিজ উৎপাদনের নজির রয়েছে ইতিহাসে।[১][২][৩] মানুষ সম্ভবত কোনো দুর্ঘটনার মাধ্যমে বা কাকতালীয়ভাবে চিজ এবং অন্যান্য দুগ্ধজাত খাবারগুলো তৈরি করে ফেলেছিল। এটা হতে পারে জাবরকাটা পশুর পাকস্থলী দিয়ে তৈরি থলেতে দুধ সংরক্ষণ এবং পরিবহণের ফলস্বরূপ যেহেতু সেসব পশুর দম্বলের (রেনেটের) সহজাত পরিবহন দুধ জমে যেতে সাহায্য করে। চিজ তৈরির উদ্ভব কোথায় তার কোনো সঠিক ও চূড়ান্ত প্রমাণ নেই, সম্ভবত ইউরোপ বা মধ্য এশিয়া, মধ্য প্রাচ্য বা সাহারা অঞ্চলে এটির উৎপত্তি হয়ে থাকতে পারে।

প্রারম্ভিক উৎস[সম্পাদনা]

চিজ তৈরির প্রথম দিকের প্রমাণসমূহ সাত হাজার বছরেরও বেশি পুরানো কাদামাটির চালুনিতে (হোলড মৃৎশিল্প) পাওয়া যায়, উদাহরণস্বরূপ পোল্যান্ডের কুজাভি[৪] এবং ক্রোয়েশিয়ার ডালমাটিয়ান উপকূলে প্রাপ্ত, পরবর্তীতে শুকনো অবশেষের রাসায়নিক বিশ্লেষণ থেকে জানা যায় যে এটি চিজ ছিল।[১][২][৩] সুইজারল্যান্ডের ন্যুচেটেল লেকের উর্নফিল্ডের বস্তিগুলোতেও (গাদা-বাসস্থান) হোলড মৃৎশিল্পের সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল এবং এগুলো চিজ তৈরির চালুনি বা ঝাঁজরি হিসেবে ব্যবহৃত হতো বলে অনুমান করা হয়[৫], এগুলো আনুমানিক ৬০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ সময়কালের (৮০০০ বছর পূর্বেকার)।[৬]

চিজের প্রথম লিখিত প্রমাণ (GA.UAR) হলো খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দের প্রথম দিকে তৃতীয় উর রাজত্বকালীন সুমেরীয় কিউনিফর্ম লিখনসমূহ।[৭] প্রথম দিকের চিজগুলি টক ও নোনতা ছিলো যা দেহাতি কুটির চিজ বা বর্তমান কালের ফেটা চিজের মতো একইরকম প্রায়। ব্রোঞ্জ যুগের শেষের দিকে মিনোয়ান-মাইসেনিয়ান ক্রিটে, লিনিয়ার বি ট্যাবলেটগুলিতে চিজ উদ্ভাবন লিপিবদ্ধ করেছে (লিনিয়ার বিতে মাইসেনিয়ান গ্রীক: 𐀶𐀫, tu-ro; গ্রিক উত্তর: τυρός)[৮][৯] পশুপালক ও রাখালরা।[১০]

আরব কিংবদন্তিতে একজন আরব ব্যবসায়ীকে চিজ আবিষ্কারক হিসাবে চিহ্নিত করূ হয় যিনি দুধ সংরক্ষণের জন্য এই পদ্ধতিটি ব্যবহার করেছিলেন।[১১][১২] তবে সুমেরীয়দের মধ্যে ইতিমধ্যেই চিজ সুপরিচিত ছিল।[১৩]

প্রাচীন মিশর, গ্রীস ও রোম[সম্পাদনা]

চিজের একটি বিপণী

মিশরে চিজ তৈরির প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণগুলো প্রায় ৫০০০ বছর পূর্বের। ২০১৮ সালে, কায়রো বিশ্ববিদ্যালয় এবং কাতানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতাত্ত্বিকগণ মিশর থেকে প্রাচীনতম চিজ আবিষ্কারের কথা জানিয়েছেন। সাক্কারার নেক্রোপলিসে আবিষ্কৃত চিজটি প্রায় ৩২০০ বছরের পুরোনো।[১৪] এর আগে মিশরের একটি সমাধিতে পাওয়া খ্রিস্টপূর্ব ২৯০০ অব্দের দিককার শেষকৃত্যের খাবারে চিজের উপস্থিতি শনাক্ত করা হয়েছিলো।[১৫] মিশরীয় চিজ তৈরির দৃশ্যমান প্রমাণাদি খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ অব্দ সময়কার মিশরীয় সমাধির মুরালগুলিতে পাওয়া গেছে।[১৬]

হেলেনিক পুরাণের প্রাথমিক স্তরে চিজ তৈরির বিষয়টি ইউরোপে পরিচিত ছিল। [১৭] প্লিনি দ্য এলডারের মতে, প্রাচীন রোম যুগের শুরুতে চিজ একটি রুচিশীল উদ্যোগে পরিণত হয়েছিল। [১৮] প্রাচীন রোম যুগে, মূল্যবান বিদেশি চিজ সামাজিক অভিজাতদের স্বাদ মেটাতে রোমে রপ্তানি করা হতে।

প্রাচীন গ্রিক পুরাণে আরিস্টিয়াসকে চিজ আবিষ্কারের জন্য কৃতিত্ব দেয়। হোমারের ওডিসিতে (খ্রিস্টপূর্ব ৮ম শতাব্দীর শেষের দিকে) বর্ণনা করা হয়েছে যে কাইক্লোপ্স মেষ ও ছাগলের দুধ এবং চিজ উৎপাদন ও সংরক্ষণ করে:

এপিকুরোস তার পৃষ্ঠপোষককে লেখা একটি চিঠিতে শক্ত চিজের একটি চাকা জন্য অনুরোধ জানিয়েছিলো যাতে তিনি যখন ইচ্ছে ইচ্ছামত খেতে পারেন। প্লিনি রোমান ঐতিহ্যে নথিভুক্ত করেছিলেন যে খাদ্যবিষয়ে জরথুস্ত্র চিজের উপরে নির্ভর করত।[২০]

রোমান সময়ে চিজ একটি সাধারণ খাদ্যসামগ্রী এবং চিজ তৈরি একটি পরিপক্ব শিল্প ছিল। কোলামেলার ডি রে রুস্তিকাতে (আনুমানিক ৬৫ খ্রিস্টাব্দ) দম্বল (রেনেট) জমাট বাঁধা, দই তৈরি, লবণে জারিত করা এবং সুপক্ব করা সহ চিজ তৈরির প্রক্রিয়াগুলো বিশদভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। প্লিনি দ্য এলডারের প্রাকৃতিক ইতিহাস (আনুমানিক ৭৭ খ্রিস্টাব্দ) গ্রন্থে প্রাচীন সাম্রাজ্যের রোমানদের দ্বারা উপভোগ্য চিজের বৈচিত্র্য বিবরণে দুইটি অধ্যায় (XI, ৯৬-৯৭) নিবেদিত করেছেন। তিনি বলেছিলেন যে সেরা মানের চিজগুলি নেমেসের নিকটবর্তী পাগি থেকে এসেছিল এবং এগুলি লোজেরগেভাউ্দান হিসাবে পরিচিতি পেয়েছিল এবং এগুলো খেতে টাটকা ছিলো।

এশিয়া[সম্পাদনা]

চীনের শিনচিয়াঙের তাকলামাকান মরুভূমিতে খ্রিস্টপূর্ব ১৬১৫ সাল থেকে সংরক্ষণ করা চীজ পাওয়া গেছে।[২১]


বর্তমানে সাধারণত দক্ষিণ এশিয়ার বেশিরভাগ অঞ্চলে স্থানীয়ভাবে চিজ তৈরি হয়, যা পনির বা চিজের মতোই অন্য কোনো আকারে পাওয়া যায়। চীনের ইউন্নান শহরের রুবিঙ অনেকটা চিজের মতোই। মূলধারার চীনা সংস্কৃতি দুগ্ধকেন্দ্রিক নয়, তবে ইউন্নানসহ অন্য কয়েকটি প্রান্তিক বা বিচ্ছিন্ন অঞ্চলে চিজের বেশ শক্তিশালী ঐতিহ্য রয়েছে। বিভিন্ন ধরনের তিব্বতি চিজ রয়েছে।

আমেরিকা[সম্পাদনা]

বিজয়ীদের দেওয়া প্রতিবেদন হতে দেখা যায় যে ইনকা এবং অন্যান্য আন্দীয় সংস্কৃতিতে লামার দুধ থেকে চিজ তৈরির প্রচলন ছিলো।[২২] তবে কিছু গবেষণা এইসব সংস্কৃতিতে দুধ আহরণের কোনও উল্লেখযোগ্য প্রমাণ খুঁজে পেতে ব্যর্থ হয়েছে।[২৩]

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ইউরোপীয় উপনিবেশকরণের পর থেকে উত্তর এবং দক্ষিণ আমেরিকা উভয় জায়গাতেই স্থানীয়ভাবে চিজের বিকাশ হয়েছিল। ইউরোপের চেয়ে যুক্তরাষ্ট্রে হস্তনির্মিত এবং/অথবা স্থানীয় চিজের পরিবর্তে কারখানায় যান্ত্রিকভাবে উৎপাদিত চিজ বেশ সাধারণ হয়ে উঠেছে। সম্প্রতি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আরও বেশি লোক খামারি (বা খামারজাত) এবং কারিকরি চিজ তৈরি করছে।[২৪]

রোমান-উত্তর ইউরোপ[সম্পাদনা]

প্রাথমিকভাবে বেশিরভাগ চিজই মধ্যযুগে নথিভুক্ত করা হয়েছিল। চেডার নথিভুক্ত করা হয়েছিল ১৫০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে, পার্মেসান তৈরি হয়েছিল ১৫৯৭ খ্রিস্টাব্দে, গেডা ১৬৯৭ খ্রিস্টাব্দে এবং ক্যামেম্বার্ট ১৭৯১ খ্রিস্টাব্দে।[২৫]

আধুনিক[সম্পাদনা]

ইউরোপীয় সংস্কৃতির পাশাপাশি চিজের আধুনিক প্রসার হওয়া অবধি এটি ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকাতে খুব বেশি ব্যবহৃত হয়েছিল। তবে উপ-সাহারান আফ্রিকা, এশিয়ার বাকী অংশ এবং প্রাক-উপনিবেশিকরণ আমেরিকায় এটির কথা খুব কমই শোনা গিয়েছিল। যদিও ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য এবং আমেরিকার বাইরের স্থানীয় রান্নাবান্নায় চিজের ব্যবহার এখনও তেমন একটা লক্ষ্য করা যায় না। বেশিরভাগ চিজই ইউরোপীয় এবং ইউরো-মার্কিন সাম্রাজ্য ও সংস্কৃতির প্রসারের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. "Evidence of 7,200-year-old cheese making found on the Dalmatian Coast" 
  2. "Hints of 7,200-Year-Old Cheese Create a Scientific Stink"। ২০১৮-০৯-০৫। 
  3. McClure, Sarah B.; Magill, Clayton; Podrug, Emil; Moore, Andrew M. T.; Harper, Thomas K.; Culleton, Brendan J.; Kennett, Douglas J.; Freeman, Katherine H. (২০১৮)। "Fatty acid specific δ13C values reveal earliest Mediterranean cheese production 7,200 years ago"PLOS ONE13 (9): e0202807। ডিওআই:10.1371/journal.pone.0202807পিএমআইডি 30183735পিএমসি 6124750অবাধে প্রবেশযোগ্য 
  4. Salque M, Bogucki PI, Pyzel J, Sobkowiak-Tabaka I, Grygiel R, ও অন্যান্য (২০১২)। "Earliest evidence for cheese making in the sixth millennium bc in northern Europe"। Nature। Nature Publishing Group। 493 (7433): 522–525। ডিওআই:10.1038/nature11698পিএমআইডি 23235824 
  5. Toussaint-Samat 2009:103.
  6. "dev.mualphatheta.org/cheese_and_culture_a_history_of_cheese_and_its_place_in_western_civilization.pdf" (পিডিএফ)। ৬ মে ২০১৯ তারিখে মূল (পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০ আগস্ট ২০২০ 
  7. In NBC 11196 (5 NT 24, dated Shu-Sin 6), the 'abra's of Dumuzi, Ninkasi, and I'kur receive butter and cheese from the 'abra of Inanna, according to W.W. Hallo, "The House of Ur-Meme", Journal of Near Eastern Studies, 1972; a Sumerian/Akkadian bilingual lexicon of ca 1900 BC lists twenty kinds of cheese.
  8. "The Linear B word tu-ro"Palaeolexicon. Word study tool for ancient languages 
  9. τυρός. Liddell, Henry George; Scott, Robert; পারসিয়াস প্রজেক্টে এ গ্রিক–ইংলিশ লেক্সিকন.
  10. Michael Ventris and John Chadwick, Documents in Mycenaean Greek, 2nd ed. (Cambridge University Press) 1973:572, 588; implications of modern pre-industrial Cretan pastoralists and cheese production for interpreting the archaeological record, are discussed by H. Blitzer, "Pastoral Life in the Mountains of Crete", 1990 ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৫ তারিখে.
  11. Ridgwell, Jenny; Ridgway, Judy (১৯৬৮)। Food Around the World। Oxford University Press। আইএসবিএন 0-19-832728-5 
  12. Reich, Vicky (জানুয়ারি ২০০২)। "Cheese"Moscow Food Co-op। মে ৩০, ২০১২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ডিসেম্বর ১১, ২০১২ 
  13. Carmona, Salvador; Ezzamel, Mahmoud (২০০৭)। "Accounting and accountability in ancient civilizations: Mesopotamia and ancient Egypt"Accounting and Accountability। Emeral Group Publishing। 20 (2)। ডিওআই:10.2139/ssrn.1016353। ৬ জুলাই ২০১৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৯ ডিসেম্বর ২০১২In the Old Sumerian period, cheese delivery quotas of herdsmen in charge were recorded, using jars with standardized liquid capacity as measures (the traditional graining measures), in contrast to archaic times when cheese was counted in discrete units 
  14. "Ancient Egypt: Cheese discovered in 3,200-year-old tomb"। সংগ্রহের তারিখ আগস্ট ২০, ২০১৮ 
  15. Walter Bryan Emery: A Funerary Repast in an Egyptian Tomb of the Archaic Period. Nederlands instituut voor het Nabije Oosten, Leiden 1962
  16. History of Cheese. [১] ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২১ জুলাই ২০১৭ তারিখে accessed 2007/06/10
  17. The archaic myth of the culture-hero Aristaeus, who introduced bee-keeping and cheese-making before wine was known in Greece.
  18. "The History Of Cheese: From An Ancient Nomad's Horseback To Today's Luxury Cheese Cart"The Nibble। Lifestyle Direct, Inc.। সংগ্রহের তারিখ ২০০৯-১০-১৫ 
  19. Samuel Butler's translation.
  20. Pliny's Natural History, iii .85.
  21. "Oldest Cheese Found"। সংগ্রহের তারিখ ফেব্রুয়ারি ২৫, ২০১৫ 
  22. https://www.dairymoos.com/milk-in-pre-columbian-america/
  23. Gade, Daniel W. (১৯৯৯)। Nature and Culture in the Andesআইএসবিএন 9780299161248 
  24. Heather Paxson (২০১৩), The Life of Cheese Crafting Food and Value in America, University of California Press, পৃষ্ঠা 56–59, আইএসবিএন 978-0-52-027018-3 
  25. Smith, John H. (১৯৯৫)। Cheesemaking in Scotland - A History। The Scottish Dairy Association। আইএসবিএন 0-9525323-0-1