খোট্টা জনগোষ্ঠী
খোট্টা জনগোষ্ঠী হলো ভারতের পশ্চিমবঙ্গে বসবাসকারী একটি ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী। এরা সবাই মূলত মুসলিম এবং পশ্চিমবঙ্গে বাস করে।
ভৌগোলিক বিস্তৃতি
[সম্পাদনা]খোট্টা মুসলিমেরা মূলত মালদহ জেলার কালিয়াচক ১ ও ২, হরিশ্চন্দ্রপুর, রতুয়া এবং মানিকচক ব্লকে এবং মুর্শিদাবাদ জেলার ফরাক্কা, সামশেরগঞ্জ, সুতি ১ ও ২ এবং রঘুনাথগঞ্জ ব্লকে বাস করে।[১] এছাড়া পশ্চিমবঙ্গের বীরভূমের মুরারই, দুবরাজপুর, খয়রাশোল এবং রাজনগর ব্লকের কয়েকটি এলাকায় বাস করে।[২] হুগলির খানাকুল এবং পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার কিছু অংশে ও বাংলাদেশের চট্টগ্রাম জেলার আনোয়ারা উপজেলার কিছু এলাকায় এরা বিক্ষিপ্তভাবে বসবাস করে।[২][৩]
ইতিহাস
[সম্পাদনা]নবাব আলিবর্দীর শাসনামলে বিহার প্রদেশ থেকে আগত কিছু পাঠান মুসলিম পরিবারের দিকে খোট্টা মুসলিমরা তাদের উৎপত্তি সম্পর্কিত করে। তাদের মধ্যে প্রচলিত পদবিগুলি হলো প্রধানত খাঁ বা খান, পাঠান, মীর, মির্জা ইত্যাদি। এছাড়া শেখ, মল্লিক প্রভৃতি পদবীও বর্তমান।[২]
সংস্কৃতি
[সম্পাদনা]খোট্টা মুুসলিম সম্প্রদায়ের লোকজন সাধারণত কোনো একটি পাড়া বা গ্রামে সংঘবদ্ধভাবে বসবাস করে। সেখানে কয়েকটি পরিবার মিলে গড়ে তোলে 'সমাজ' বা 'দশ'। সমাজের প্রধানকে বলা হয় 'সরদার'। এছাড়া সমাজে 'মড়াল' ও 'ছড়িদার' নামে দুটি পদ থাকে। এই সমাজ বা দশের লোকেরা জন্ম, বিবাহ ও মৃত্যুসংক্রান্ত যাবতীয় অনুষ্ঠানাদি সম্পন্ন করার দায়িত্বে থাকে। এছাড়া এই দশের লোকেরা পারিবারিক ও জমিজমাসংক্রান্ত বিবাদের বিচারকার্যও সম্পন্ন করে।
এদের লোক সংগীতের ধারা, বিবাহের রীতিনীতি ও সামাজিক আচার অনুষ্ঠানের ধরনে রয়েছে নিজস্বতা। এরা সাধারণত নিজ সম্প্রদায়ের মধ্যে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়। এদের মহিলারা বিয়ের সময় সমস্বরে খোট্টা ভাষায় 'গীদ' (গীত) নামক বিশেষ সুরেলা গাথা গায়। এছাড়া এদের রয়েছে বিশেষ ধরনের খাদ্যাভাস যেমন 'গুড়ভত্তা', 'কড়োকা গিল্লাভাত', 'চিনাকা গিল্লাভাত', 'পালো', 'ঠাকুয়া', 'অদার্সা', 'চিতুয়া' ইত্যাদি।[১]
ভাষা
[সম্পাদনা]খোট্টা মুসলিমরা নিজেদের মধ্যে ও বাড়িতে খোট্টা ভাষায় কথা বলে। এই ভাষাটি হলো হিন্দি-উর্দু বা হিন্দুস্তানি ভাষার একটি বিবর্তিত আঞ্চলিক রূপ। খোট্টাভাষী মানুষদের পূর্বপুরুষগণ প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বাংলায় বসবাস করার ফলে এই ভাষাটি বাংলা ভাষার দ্বারাও প্রভাবিত হয়েছে। বর্তমানে ভাষাটি কেবলমাত্র একটি আন্তঃসম্প্রদায়গত কথোপকথনের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এঁরা প্রায় সকলেই দ্বিভাষিক এবং আশপাশের বাঙালিদের সঙ্গে বাংলা ভাষায় কথা বলে। এছাড়া খোট্টা ভাষা অনেকটা হিন্দির মতো উচ্চারিত হয় বলে এঁরা হিন্দি ভাষাও অনায়াসে বলতে পারে। খোট্টা ভাষার কোনও লিখিত রূপ না থাকায় বাংলা ভাষাই হলো এদের লেখাপড়ার একমাত্র মাধ্যম। [২][৪][৫]
বর্তমান পরিস্থিতি
[সম্পাদনা]খোট্টা মুসলিম জনগোষ্ঠীর মোট জনসংখ্যা পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে প্রায় ১০ লক্ষ। এদের ঐতিহ্যবাহী পেশা হলো চাষাবাদ। তবে বর্তমানে জীবিকা নির্বাহের জন্য তাদের ক্ষুদ্র কৃষক, ভূমি মজুর, দিনমজুর ও অভিবাসী মজুর হিসেবেও কাজ করতে হয়। এরা এখন ভারত সরকার কর্তৃক ওবিসি সংরক্ষণের আওতাভুক্ত।[১]
পশ্চিমবঙ্গের মালদা জেলার দক্ষিণ ও পশ্চিমাংশ এবং মুর্শিদাবাদ ও বীরভূম জেলার উত্তরাংশের অনেক পাড়া ও গ্রামে এখনও হাজার হাজার খোট্টাভাষী পরিবার বসবাস করে।
বর্তমানে এরা বাংলা মাধ্যমে লেখাপড়া ও অন্যান্য কার্যক্রম সম্পন্ন করে এবং আশপাশের অন্যান্য বাঙালি মুসলিম জনগোষ্ঠীর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়। ফলে এদের শিক্ষা-সংস্কৃতি ও সামাজিক রীতিনীতিতে বাঙালিয়ানার প্রভাব ষোলআনা। যার কারণে এদের পূর্বপুরুষদের অনুসৃত ভাষা-সংস্কৃতি ও রীতিনীতিগুলি অধুনা অনেকটা বিলুপ্তপ্রায়।
আরো দেখুন
[সম্পাদনা]তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ ক খ গ "West Bengal Commission for Backward Classes Report on Khotta Muslim" (পিডিএফ)। wbcdc.gov.in। সংগ্রহের তারিখ ০১/০৬/২০২০। এখানে তারিখের মান পরীক্ষা করুন:
|সংগ্রহের-তারিখ=
(সাহায্য)[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ] - ↑ ক খ গ ঘ "মাতৃভাষা 'খোট্টা'কে আগলে রেখেছেন ওঁরা"। anandabazar.com। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৬-০১।
- ↑ "তাঁরা আছেন আনোয়ারায় | কালের কণ্ঠ"। Kalerkantho। ২০১৬-০১-২৯। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৩-৩১।
- ↑ "Khotta Language Linguistic and Grammatical Identification"। academia.edu। সংগ্রহের তারিখ ০১/০৬/২০২০। এখানে তারিখের মান পরীক্ষা করুন:
|সংগ্রহের-তারিখ=
(সাহায্য) - ↑ চৌধুরী, পতিত পবন (২০১৩)। "মালদহ জেলার খোট্টাভাষা : ভাষাতাত্ত্বিক পর্যবেক্ষণ"। University of North Bengal। সংগ্রহের তারিখ ০১/০৬/২০২০। এখানে তারিখের মান পরীক্ষা করুন:
|সংগ্রহের-তারিখ=
(সাহায্য)