কালীউত্তু

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
কালীউত্তু
কলমকভাল, ভেল্লায়ানি দেবী মন্দিরে কালিউত্তুর অনুষ্ঠানের একটি অংশ
স্থানীয় নামমালয়ালম: കാളിയൂട്ട്
ধরনআচার-অনুষ্ঠান
উৎসকেরালা, ভারত

কালীউত্তু বা কালী নাটকম (আক্ষরিক অর্থে দেবী কালীর নাটক) ভারতের দক্ষিণ কেরালার তিরুবনন্তপুরমের কোল্লাম জেলায় জনপ্রিয় একটি আচার-অনুষ্ঠান সম্পন্ন পরিবেশন শিল্পকলা। এটি একটি লোকশিল্প যা ভদ্রকালী এবং অসুর দারিকার যুদ্ধের সাথে সম্পর্কিত।

কথিত আছে যে, ত্রিবাঙ্কুরের মহারাজা, যিনি কায়ামকুলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়লাভ করেছিলেন, তিনি তিরুবনন্তপুরম জেলার সরকারাদেবী মন্দিরে কালীউত্তু শুরু করেছিলেন।

সাধারণ বর্ণনা[সম্পাদনা]

পারানাতে নামেও পরিচিত কালীউত্তু একটি লোকশিল্পের রূপ যা মূলত কেরালার তিরুবনন্তপুরম এবং কোল্লাম জেলায় জনপ্রিয়।[১] এখানে কালী মন্দিরগুলি মুদিপুরা নামে পরিচিত। মুদিপুরা নামের অর্থ হল সেই জায়গা যেখানে ভদ্রকালীর কেশ (মুদি হল চুলের মালয়ালম রূপ এবং পুর মানে ঘর) রাখা আছে।[২] কালীউত্তুর প্রধান মন্দিরগুলি হল তিরুবনন্তপুরমের কাছে ভেল্লায়ানি দেবী মন্দির এবং চিরায়িংকিঝুর কাছে সরকারা দেবী মন্দির[১] ইলাম্বা এবং আত্তিংগালের মতো অঞ্চলেও কালীউত্তু পালিত হয়, তবে স্থানীয় বৈচিত্র্য সহ।[১] ভেল্লায়ানি মন্দিরের কালীউত্তু উৎসব কেরালার সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদী উৎসব।[৩] এই উৎসবটি ৭০ দিন ধরে চলে এবং তিন বছরে একবার অনুষ্ঠিত হয়।[৩]

'ভাথি' নামে পরিচিত মুদিপুরার পূজারীরা কালীউত্তুতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ভাথি ভদ্রকালীর পোশাকে কলমকাবল অনুষ্ঠান করেন, যা মূল কালীউত্তু অনুষ্ঠানের আগে সম্পাদিত হয়। কলমকাবলআনিয়ারা কেতাল (পোশাক পরিধান) -এর পর আসল অনুষ্ঠান শুরু হয়।

কালীউত্তুর আচারিক গান ভদ্রকালীতোত্তম ৪৮ দিনে গাওয়া হয়, তবে উৎসব কতদিন চলবে তার ওপর নির্ভর করে এই সময়ের কমবেশি হয়।[২] মন্দিরের অভ্যন্তরে প্রধান দেবতার বিপরীতে রাখা প্যাণ্ডেলে বসে গানটি গাওয়া হয়। গানের সাথে ব্যবহৃত প্রধান যন্ত্রটি হলো কুঝিথালাম বা চিনকি।[২]

এই শিল্প রূপে নাটকীয় এবং আচার-অনুষ্ঠানপূর্ণ উপাদান একত্রিত হয়, যার ফলে সমগ্র গ্রাম এর সম্পাদনে অংশ নেয়।[২]

ইতিহাস[সম্পাদনা]

কথিত আছে যে ত্রিবাঙ্কুরের মহারাজা মার্তণ্ডবর্মা এবং তাঁর সহকারী রামায়ণ, কায়ামকুলম রাজ্যের সাথে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে ফেরার পথে শর্করাদেবী মন্দিরের সামনে বেদীতে বিশ্রাম নিয়েছিলেন।[১] তিনি যুদ্ধে বিজয়ের জন্য দেবীর কাছে প্রার্থনা করেছিলেন এবং বিজয়ী হলে মন্দিরের সামনে কালীউত্তু করার প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। কথিত আছে যে মার্তণ্ডবর্মা পরবর্তী যুদ্ধে বিজয়ী হন এবং সরকারা মন্দিরে কালীউত্তু শুরু করেন।[১] এটাও বলা হয় যে মার্তণ্ডবর্মার মা, উমায়মা রানী পোনারা পরিবারকে এই আচার পালনের কর্তৃত্ব দিয়েছিলেন।[৪] প্রথম কালীউত্তু ১৭৪৯ খ্রিস্টাব্দে পরিবেশিত হয়েছিল।[৪]

আরেকটি যুক্তি আছে যে কালীউত্তু একটি প্রাচীন প্রথা ছিল এবং রাজা মার্তণ্ডবর্মা বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া এই প্রাচীন রীতিটি পুনরায় চালু করেছিলেন।[৫]

আচার-অনুষ্ঠান[সম্পাদনা]

উচাবালি আচার, ভেল্লায়ানি দেবী মন্দিরে কালীউত্তুর একটি অংশ

রাজকীয় শাসনকালে, থেভারা প্রজারা প্রাসাদে পূজার আচার পালন করত। তারা মালয়ালম মাস কুম্ভের (ফেব্রুয়ারি/মার্চ) তৃতীয় বা শেষ শুক্রবার সরকারা দেবী মন্দিরে আসত এবং পোনারা পরিবারের বরিষ্ঠ সদস্যকে একটি চিরকুট দিত।[৪][৫] এখন চিরকুট দেওয়া হয় মেলশান্তি (প্রধান পুরোহিত)-র তত্ত্বাবধানে।[৫]

কালীউত্তুর জন্য চিরকুট লেখার পর সামাজিক রীতিনীতিকে ঠাট্টা করে বিভিন্ন গল্প নিয়ে নয় দিন ধরে নাটক মঞ্চস্থ হয়।[৫] প্রতি দিন সময় যোগ করে করে, অনুষ্ঠানটি নবম দিন বা শেষ দিনের ভোর পর্যন্ত স্থায়ী হয়।[৪] ভাথিরা উচাবলি নামে পরিচিত একটি অনুষ্ঠান করেন। উচাবলি অনুষ্ঠানের সময়, দারিকার প্রেরিত সৈন্য বলিদানের স্থলে বিঘ্ন ঘটায় এবং তারপরে কালীর বর্শা দিয়ে সৈনিককে বিদ্ধ করে।[২] মৃত সৈনিককে মাদুরে মুড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। এর মাধ্যমে শেষ হয় উচাবলি। ভদ্রকালিয়মা নামক এই সম্পূর্ণ অনুষ্ঠানটি সকাল ১২.৩০ টা থেকে ৩.৩০ এর মধ্যে অনুষ্ঠিত হয়।

মন্দিরের দক্ষিণ পাশে, তুল্লালপুরা নামে পরিচিত একটি এলাকার কাছে, কাভালমাদম নামে একটি প্যাণ্ডেল তৈরি করা হয়। কিছু মন্দিরে এই প্যাণ্ডেলটি পল্লীকামাদম নামে পরিচিত।[১] প্রথম দিন, মন্দিরে নিয়মিত পুজোর পর, দেবীকে মন্দির থেকে কাভালমাদমের একটি প্রদীপে আবাহন করা হয়। রাজার প্রতিনিধি এবং ইটুভেটিল পিল্লামারের প্রতিনিধি দেবী মূর্তিকে দুপাশে স্থাপন করে। রাজা এবং পিল্লাইমার বসার পরে, আচারের প্রথম অংশ শুরু হয়, যার নাম ভেল্লাত্তম[১] জনশ্রুতি আছে যে ভেল্লাত্তম নৃত্যটি ভগবান শিবের দৈত্যরা পরিবেশন করেছিল, দেবীর বিজয় কামনা করার জন্য।[২]

তৃতীয় দিনে, নারদ চরিত্রটি মাঠে প্রবেশ করে। তার কথোপকথন থেকে বোঝা যায় যে নারদ শিবের নির্দেশ অনুসারে স্থানীয় সংবাদ ও স্থান পর্যবেক্ষণের জন্য এসেছে। লোকনাট্যের মতোই এর প্রশ্নোত্তর পদ্ধতি রয়েছে।[১]

চতুর্থ দিনে, আচারের অংশ হিসাবে, এলাকার রক্ষক কাভালুত নায়ার মাঠে প্রবেশ করে। জনশ্রুতি আছে যে, ভগবান শিব নন্দীকেসনকে তত্ত্বাবধানের জন্য কালিউত্তু এলাকায় পাঠিয়েছিলেন। কাভালুত নায়ার, একজন দেশপ্রেমিক, কিছু সামাজিক সমালোচনা করেন। তিনি সেই সময়ে নায়ার সম্প্রদায়ের বহুবিবাহের কঠোর সমালোচনা করেন।[১] পঞ্চম দিনে, ব্রাহ্মণ্যবাদে পরিপূর্ণ ওলামবল্লী ও উগ্রামবল্লীর চরিত্ররা উপস্থিত হয়।[১]

ষষ্ঠ দিনে, নানায়ার এবং কান্তার নামে পরিচিত কানিয়ার এবং কুরুপ্প চরিত্রগুলি আসে। বিশ্বাস করা হয় তারা ঐশ্বরিক ঋষি এবং শিবের নির্দেশ অনুসারে এসেছে। তাদের দায়িত্ব হল এলাকার সমস্যার সমাধান করা।[১] পুলায়ার পুরাপ্পাড় অনুষ্ঠান হল ৭ম দিনের আচার। সাতজন পুলায়ার এবং প্রভু সহ এতে আটটি চরিত্র রয়েছে। এতে ভুমিকা পালন করে পানিকর বর্ণের মানুষ।[১] পুলায়ার পুরাপ্পাড় অনুষ্ঠানের কিংবদন্তি হল ভদ্রকালী কিভাবে পুলায়া মহিলার ছদ্মবেশ ধারণ করেছিলেন এবং ভিলওয়ামঙ্গলম স্বামীয়ারের ভয়ে বন থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময় পুলায়ারদের সাথে বিনোদন করেছিলেন।[১] এটি হল বিল্বমঙ্গলম স্বামীর স্মরণে একটি অনুষ্ঠান, যিনি শর্করাদেবীকে অধিষ্ঠিত করেছিলেন।[১] কালীউত্তুর গুরু কন্টিপানিকারাচনের চরিত্রটিও এই দিনে আসে।[১] অষ্টমীর দিন ভদ্রকালী ও দুর্গা দারিকার সন্ধানে যাত্রা করেন। ভদ্রকালী উত্তরে এবং দুর্গা দক্ষিণে ভ্রমণ করেন। ভদ্রকালী এবং দুর্গা, বিশেষ পোশাকে সজ্জিত হয়ে প্রতিটি বাড়িতে প্রবেশ করেন। পরিবারগুলি উল্লাস প্রকাশ করে ও মোমবাতি জ্বালিয়ে তাঁদের স্বাগত জানায়।[১] দেবীরা দারিকাকে খুঁজে না পেয়ে ফিরে আসেন।[৫]

কালীউত্তুর প্রধান অংশ, দারিকার হত্যাকাণ্ড নবম দিনে বিকেল ৫টায় শুরু হয়।[১] এই অনুষ্ঠানটি পারানাতে নামে পরিচিত। নামটি দারিকার সাথে বায়বীয় যুদ্ধ বা উড্ডয়ন (পারাক্কাল হল উড়ন্ত শব্দের মালয়লী রূপান্তর) থেকে এসেছে।[২] আকাশে যুদ্ধের পর নীলাথিল পোরু (অর্থাৎ মাটিতে যুদ্ধ) শুরু হয়।[৬] এটি এমন একটি দৃশ্য যা ভয়ানক যুদ্ধের অনুভূতি তৈরি করে। সাতটি যুদ্ধের শেষে, কালী দারিকাকে হত্যা করেন এবং প্রতীকীভাবে দারিকার মাথা কেটে দেন।[২][৬] দারিকা নিগ্রহ, দারিকার হত্যা প্রতীকীভাবে কলার গুচ্ছ কেটে সঞ্চালিত হয়।[৭]

আরাত্তু (পবিত্র স্নান) -র পরে, দেবীর মূল মন্দিরে ফিরে আসার মাধ্যমে অনুষ্ঠানটি শেষ হয়।[২]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. B., Ravi kumar। "ശാർക്കര കാളിയൂട്ട്"Deshabhimani (মালায়ালাম ভাষায়)। ২০২৩-০৩-২০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০৩-২০ 
  2. "കാളിയൂട്ട് - അനുഷ്ഠാന കല| Kaliyoottu - ritual art form"www.keralaculture.org (মালায়ালাম ভাষায়)। Department of Culture, Kerala state। ২০২৩-০৩-২০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০৩-২০ 
  3. Kanjirathil, Renjith (১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩)। "തങ്കത്തിരുമുടിയിൽ ദേവി പുറത്തെഴുന്നെള്ളി: കേരളത്തിലെ ഏറ്റവും ദൈർഘ്യമേറിയ ഉത്സവമായ വെള്ളായണി കാളിയൂട്ടിനു തുടക്കമായി."Janam TV। ২০ মার্চ ২০২৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০ মার্চ ২০২৩ 
  4. T, Sasi Mohan। "Spirituality enlightenes human beings and life"malayalam.webdunia.com। ২০২৩-০৩-২০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০৩-২০ 
  5. "ശാര്‍ക്കര മഹാകാളിക്ക് കാളിയൂട്ട്"Janmabhumi (মালায়ালাম ভাষায়)। ২০২৩-০৩-২০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০৩-২০ 
  6. "പള്ളിയറ കാളിയൂട്ട് : ദാരികനെ നിഗ്രഹിച്ച് ദേവി മടങ്ങി: മനം നിറഞ്ഞ് ഭക്തരും"Mathrubhumi (ইংরেজি ভাষায়)। ২০২৩-০৩-২০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০৩-২০ 
  7. "ശാര്‍ക്കര കാളിയൂട്ട് സമാപിച്ചു; ഭക്തിസാന്ദ്രമായി നിലത്തില്‍പോര് | Madhyamam"www.madhyamam.com (মালায়ালাম ভাষায়)। Madhyamam। ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৪। ২০ মার্চ ২০২৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০ মার্চ ২০২৩ 

টেমপ্লেট:Culture of Kerala