কলম

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

লেখনের তিনটি মূল উপকরণঃ "কালি কলম মন লেখে তিন জন" যার মধ্যে দ্বিতীয়টি হচ্ছে 'যার মাধ্যমে লেখা হয়' অর্থাৎ লেখন তলে লেখা ফুটে তোলার জন্য যেসকল উপকরণ ব্যবহৃত হয়। কলম এই দ্বিতীয় উপকরণের প্রধান সদস্য।

একটি বলপয়েন্ট কলম

কলম বা লেখনী প্রধানত লেখালেখির কাজে ব্যবহৃত একটি উপকরণ। কলম দিয়ে কাগজ বা কোন পৃষ্ঠতলের উপরে কালি লেপনের কাজ করা হয়। বেশ কয়েক রকমের কলমের মধ্যে বলপয়েন্ট কলম, ঝর্ণা কলম (ফাউন্টেন পেন), ফেল্ট-টিপ কলম, জেল কলম, পালকের কলম (কুইল), খাগের কলম ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। কলমের ইতিহাস প্রায় ৫ হাজার বছরের পুরানো। ধারণা করা হয়, প্রাচীন মিশরীয়রা সর্বপ্রথম কলম ব্যবহার শুরু করে। সে সময় অবশ্য আজকের মত মসৃণ কোন কাগজ ছিল না। সে সময় লেখালেখি করা হত বিভিন্ন গাছের পাতা, বাকল এবং পশুর চামড়ার উপর। কলম হিসেবে তারা ব্যবহার করত নলখাগড়া, শর বা বেণু, বাঁশের কঞ্চি অথবা ফাঁপা খন্ড। এসব খন্ড কলমের মতো করে কেটে সূচালো করা হত। সূচালো অংশটি কালির মধ্যে চুবিয়ে লেখা হত। কালি বিভিন্ন গাছের রস এবং বিভিন্ন রকম প্রাকৃতিক উপাদান দ্বারা প্রস্তুত করা হত ।

কলমের প্রকার[সম্পাদনা]

আধুনিক কলম[সম্পাদনা]

জেল কলম দিয়ে লেখা একটি অক্ষর এবং জেল কলমের নিবের ডগা

কলমের আধুনিক প্রকারভেদগুলো প্রধানত কলমের নিবের উপরে ভিত্তি করে করা হয়েছে।

একটি বিলাসিতার বলপয়েন্ট কলম
  • বলপয়েন্ট কলম - এই কলমের ডগায় বা নিবে ০.৭-১.২ মি.মি. আকারের পিতল, স্টীল বা টাংস্টেন কার্বাইডের তৈরি একটি ছোট্ট শক্ত বল বা গোলক থাকে যা কলমের ভেতরে থাকা কালিকে কাগজ বা যার উপরে লেখা হচ্ছে তাতে মাখাতে সাহায্য করে[১]। বলপয়েন্ট কলমে যে কালি ব্যবহার করা হয় তা একটু ঘন প্রকৃতির এবং তা কাগজের সংস্পর্শে আসতে না আসতেই শুকিয়ে যায়। এই নির্ভরযোগ্য কলমগুলির দামও খুব কম। ফলে সহজেই নিত্যদিনের লেখালেখির কাজে বলপয়েন্ট কলম সবচেয়ে জনপ্রিয় উপকরণ হয়ে উঠেছে।
  • রোলারবল বা জেল কলম - এই কলমের ডগায়ও বলপয়েন্ট কলমের মত বল থাকে। কিন্তু এই কলমের কালি বলপয়েন্ট কলমের কালির চেয়ে পাতলা বা কম ঘন। এই কম ঘন কালি সহজেই কাগজ শুষে নিতে পারে, এবং কলমও অনেক মসৃণভাবে চলতে পারে। বলপয়েন্ট কলমের সুবিধা এবং ঝর্ণা কলমের কালির ভাবটাকে একত্রিত করার উদ্দেশ্যে জেল কলমের সূত্রপাত হয়েছিল। জেল কালি বিভিন্ন রঙের হয়, এমনকি ধাতব পেইন্ট ও ঝিকিমিকি রঙেরও জেল কালি পাওয়া যায়।
অসহায় ও দুঃস্থ মহিলাদের হাতের তৈরি কাঠের কলমদানী
ঝর্ণা কলম বা ফাউন্টেন পেন
  • ঝর্ণা কলম - এই কলমে পানি ভিত্তিক তরল কালি দিয়ে নিবের সাহায্যে লেখা হয়। কলমের ভেতরে কালিদানিতে থাকা কালি কৈশিক পরিচলন প্রক্রিয়ায় এবং অভিকর্ষের সাহায্যে নিবের মাধ্যমে বাইরে আসে। এই নিবে কোন নড়নক্ষম অংশ থাকে না, একটা চিকন ফাটল দিয়ে কালি বেরিয়ে আসে। ভেতরের কালিদানিতে কালি শেষ হয়ে গেলে দোয়াত থেকে আবার কালি ভরা যায়। অনেকে মনে করেন ফাউন্টেন পেনের বাংলা তরজমা ঝর্ণা কলম নামটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দিয়েছেন।
  • ফেল্ট-টিপ কলম বা মার্কার কলম - এই কলমে আঁশ জাতীয় পদার্থের তৈরি স্পঞ্জের মত ডগা থাকে। সবচেয়ে ছোট এবং চিকন ডগার মার্কার কলম দিয়ে কাগজের উপরে লেখা হয়। মাঝারি আকারের ডগা সমৃদ্ধ মার্কারগুলো বাচ্চাদের আঁকাআঁকির জন্য ব্যবহৃত হয়। বড় আকারের ডগার মার্কারগুলো অন্য মাধ্যমে (যেমন কার্ডবোর্ডের বাক্স বা হোয়াইটবোর্ডে) লেখার কাজে ব্যবহার হয়। উজ্জ্বল এবং স্বচ্ছ কালিসহ চওড়া ডগার মার্কার লেখা দাগানোর কাজে ব্যবহার করা হয়। এদেরকে "হাইলাইটার"ও বলা হয়। বাচ্চাদের জন্য বা হোয়াইটবোর্ডে লেখার জন্য যে মার্কারগুলো তৈরি করা হয়, সেগুলোর কালি সাধারণত অস্থায়ী ধরনের হয়। কিছু মার্কার যেগুলো প্যাকেজিং এবং চালানের বাক্সের গায়ে লেখার কাজে ব্যবহার করা হয় তাদের কালি হয় স্থায়ী।

প্রাচীন কলম[সম্পাদনা]

পালকের কলম বা কুইল ও কালির দোয়াত
পালকের কলম
  • নিব কলম - সাধারণত কাঠের হাতলের সাথে একটি ধাতব নিব লাগিয়ে এই কলম তৈরি করা হয়। নিবটি ঝর্ণা কলমের নিবের মতই, তবে এই কলমে কোন কালি জমা রাখার উপযোগী কালিদানি নেই এবং লেখার সময়ে বারবার এটিকে কালিতে চুবিয়ে নিতে হয়। ঝর্ণা কলমের তুলনায় এই কলমে সুবিধা হল এই কলমে ঘন কালি (যেমন পিগমেন্ট) এবং ধাতব কালি ব্যবহার করা যায় যা ঝর্ণা কলমে জমে গিয়ে আটকে যায় অথবা মরিচা ধরে যায়। নিব কলম এখন প্রধানত অলংকরণ, চারুলিপি এবং কমিকস আঁকার কাজে ব্যবহার হয়।
  • কালির কলম - পূর্ব এশিয়ার লিপিবিদরা ঐতিহ্যগতভাবে এ ধরনের কলম ব্যবহার করতেন। এদেরকে ব্রাশ বা বুরুশও বলা হয়। কলমের মূল দেহটি সাধারণত বাঁশ দিয়ে তৈরি করা হত। এছাড়াও বিশেষ ক্ষেত্রে কিছু দুর্লভ উপকরণ যেমন - লাল চন্দন গাছ, কাচ, হাতির দাঁত, সোনা, রূপা প্রভৃতিও ব্যবহার করা হত। কলমের শীর্ষভাগটি বিভিন্ন ধরনের প্রাণীর (যেমনঃ বেজি, শুকর, বাঘ, মোরগ) পাখা ও লোম হতে তৈরি করা হত।এককালে চীন এবং জাপান উভয় স্থানেই নতুন জন্ম নেওয়া শিশুর চুল দিয়ে এ ধরনের কলম তৈরি করার রেওয়াজ ছিল, যাদেরকে সারা জীবনের জন্য স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে দেখা হত।
  • কুইল বা পালকের কলম - সাধারণত রাজহাঁস বা বড়সড় পাখির পালকেরতৈরি কলমকে কুইল (quill) বলে। ডিপ কলম, ঝর্ণা কলম ইত্যাদি আসার আগে কুইল ব্যবহৃত হত। পালকের ফাঁপা অংশ কালিদানি হিসেবে কাজ করত এবং কৈশিক পরিচলন প্রক্রিয়ায় কালির পরিচলন হত। মধ্যযুগে পার্চমেন্ট বা চামড়ার কাগজের উপরে কুইল দিয়ে লেখা হত। পালকের কলম বা কুইল এসে খাগের কলমকে প্রতিস্থাপিত করেছিল।
  • খাগের কলম - খাগ বা নলখাগড়া, বাঁশ ইত্যাদির একদিক সরু করে কেটে মাথাটা সূক্ষভাবে চিরে এই কলম তৈরি করা হত। এর যান্ত্রিক প্রক্রিয়া কুইলের মত।
  • স্টাইলাস বা ব্রোঞ্জের শলাকা- ব্রোঞ্জের শলাকার পোশাকি নাম স্টাইলাস। স্বয়ং জুলিয়াস সিজার এই কলমটি ব্যবহার করতেন যার দ্বারা তিনি কাসকাকে আঘাত করেছিলেন।
ওয়াটারম্যান কোমপানীর কলম

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. "How does a ballpoint pen work?"Engineering। HowStuffWorks। ১৯৯৮–২০০৭। সংগ্রহের তারিখ ২০০৭-১১-১৬ 

বহিঃসংযোগ[সম্পাদনা]