বিষয়বস্তুতে চলুন

উপসর্গ (ব্যাকরণ)

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
(উপসর্গ থেকে পুনর্নির্দেশিত)

উপসর্গ (বা আদ্যপ্রত্যয়[]) হলো কোনো ভাষায় ব্যবহৃত কিছু অব্যয়সূচক শব্দাংশ যাদের নিজস্ব কোনো অর্থ নেই, কিন্তু অর্থের দ্যোতনা তৈরির ক্ষমতা আছে।[] উপসর্গগুলো শব্দ, শব্দমূল বা শব্দ কাণ্ডের শুরুতে বসে নতুন অর্থবহ শব্দ তৈরি করে (শব্দাংশের শুরুতে বসে না)।[][] উপসর্গ যুক্ত হলে কোনো শব্দের বিপরীত শব্দ তৈরি হয় অথবা অর্থের উৎকর্ষ বা সংকোচন হয়। এক কথায় বলা যায় – "শব্দ গঠনে অর্থের দিক থেকে বৈচিত্র্য আনা-ই উপসর্গের কাজ।"[](p১৮০) উপসর্গ সম্পর্কিত আলোচনা ব্যাকরণের রূপতত্ত্বের অন্তর্ভুক্ত।[]

ব্যুৎপত্তি ও সংজ্ঞার্থ

[সম্পাদনা]

উপসর্গ শব্দটির রূপতত্ত্বগত বিশ্লেষণ হলো উপ + √সৃজ্‌ + অ। উপসর্গ কথাটির মূল অর্থ "উপসৃষ্ট"। "যেসব অর্থহীন অব্যয় পদ নামবাচক বা কৃদান্ত শব্দের পূর্বে যুক্ত হয়ে নতুন শব্দ গঠন করে এবং অর্থের পরির্বতন সাধন করে, এগুলোকে উপসর্গ বলে।"[][]

ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে,[]

“সংস্কৃতিতে কতকগুলি অব্যয় আছে যেগুলি ধাতুর পূর্বে যুক্ত হইয়া ধাতুর অর্থের পরিবর্তন ঘটায়, ধাতুর নূতন অর্থের সৃষ্ট করে। সংস্কৃত ব্যাকরণে ধাতুর পূর্বে প্রযুক্ত এইরূপ অব্যয়কে বলা হইয়াছে উপসর্গ।”

ড. মুহাম্মদ এনামুল হকের মতে,[]

“যেসব অব্যয় শব্দ কৃদান্ত বা নামপদের পূর্বে বসে শব্দগুলোর অর্থের সংকোচন, সম্প্রসারণ বা অন্য কোন পরিবর্তন সাধন করে, ঐ সব অব্যয় শব্দকে বাংলা ভাষায় উপসর্গ বলে।”

অশোক মুখোপাধ্যায়ের মতে,[]

“বাংলা ভাষায় কিছু অব্যয় আছে যারা ধাতু বা শব্দের আগে যুক্ত হয়ে তাদের অর্থ বদল করে দেয়। এদেরই বলা হয় উপসর্গ।”

ড. রামেশ্বর শ'-এর মতে,[]

“শব্দ বা ধাতুর আদিতে যা যোগ হয় তাকে বলে উপসর্গ।”

উপসর্গ ও অনুসর্গ

[সম্পাদনা]

অনুসর্গ হলো কিছু অব্যয়সূচক শব্দ যেগুলো কখনো স্বাধীন পদরূপে, আবার কখনো শব্দ বিভক্তির মতো বাক্যে ব্যবহৃত হয়ে বাক্যের অর্থ প্রকাশে সাহায্য করে।[] উপসর্গ ও অনুসর্গের মাঝে পার্থক্য রয়েছে। উপসর্গ ধাতু বা নাম-প্রকৃতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে একটি শব্দের মতো আচরণ করলেও অনুসর্গ পূর্বের পদ থেকে পৃথকভাবে আশ্রিত হিসাবে অবস্থান করে।[] ‘প্রতি' ও 'অতি' – উপসর্গ দুটি ব্যতীত আর কোনো উপসর্গের স্বতন্ত্র প্রয়োগ নেই, কিন্তু সকল অনুসর্গের স্বতন্ত্র প্রয়োগ আছে।

উপসর্গ ধাতু বা নাম-প্রকৃতির আগে বসে সেই ধাতু বা নাম-প্রকৃতির অর্থ-পরিবর্তন ঘটিয়ে নতুন শব্দ গঠন করে।[] এটি মূলত নামশব্দ ও কৃদন্ত শব্দের পূর্বে যুক্ত হয়।[](p১৮০) অন্যদিকে, অনুসর্গ বিশেষ্যসর্বনাম পদের পরে বসে শব্দ বিভক্তির কাজ করে।[]

সমাস হিসেবে উপসর্গ

[সম্পাদনা]

"[উপসর্গকে] এক ধরনের সমাসও বলা চলে। এ ধরনের সমাস গঠনে পূর্বপদে/শব্দে আদ্যপ্রত্যয় ও পরপদে/শব্দে বিশেষ্য থাকে এবং অর্থের দিক থেকে পূর্বশব্দের অর্থই প্রধান হয়। যেহেতু উপসর্গও এক ধরনের আদ্যপ্রত্যয়, তাই উপসর্গযোগে গঠিত সব শব্দই সাধারণত আদ্যপ্রত্যয় সমাস।"[](p১৭৯)

উপসর্গের অর্থদ্যোতকতা

[সম্পাদনা]

"উপসর্গের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো, উপসর্গের অর্থবাচকতা নেই, কিন্তু অর্থ দ্যোতকতা আছে। উপসর্গগুলো প্রত্যেকটি এক একটি শব্দাংশ বা শব্দখণ্ড। এদের নিজেদের কোনো অর্থ নেই বা পৃথকভাবে ব্যবহার হয় না। কেবল ধাতু বা শব্দের পূর্বে যুক্ত হলেই এরা শব্দগঠন করে এবং অর্থের বৈচিত্র্য সাধন করে। উপসর্গ যখন শব্দ গঠন করে তখন গঠিত শব্দের মাধ্যমে মূল ধাতু বা শব্দের অর্থের পরিবর্তন সংকোচন, সম্প্রসারণ বা অর্থের পূর্ণতা সাধন করে।"[](p১৮০)

বাংলা উপসর্গ

[সম্পাদনা]

বাংলা ভাষায় অর্ধশতাধিক উপসর্গ রয়েছে।[] এই উপসর্গগুলোকে সাধারণত তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে:

  • তৎসম (সংস্কৃত) উপসর্গ: এ ধরনের উপসর্গ সংস্কৃত শব্দের আগে বসে। বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত তৎসম উপসর্গ ২০টি, যথা: অতি-, অধি-, অনু-, অপ-, অপি-, অব-, অভি-, আ-, উপ-, উত্‌-, দুর্‌-, নি- নির্‌-/নির-, পরা-, পরি-, প্র-, প্রতি-, বি-, সু-সম্‌-[][]
  • খাঁটি বাংলা উপসর্গ: এ ধরনের উপসর্গ বাংলা শব্দের আগে বসে। বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত খাঁটি বাংলা উপসর্গ ২১টি, যথা: অ-, অঘা-, অজ-, অনা-, আ-, আড়্‌-, আন-, আব-, ইতি-, উন্‌-, কদ-, কু-, নি-, পাতি-, বি-, ভর-, রাম-, স-, সা-, সু-হা-[]

উল্লেখ্য, আ-, নি-, বি-, সু- — এই চারটি উপসর্গ সংস্কৃত ও বাংলা উভয় ভাষাতে ব্যবহৃত হয়। ব্যবহারের উপর নির্ভর করে নির্ধারণ করা হয় এরা খাঁটি বাংলা না সংস্কৃত উপসর্গ।[][] যে শব্দটির পূর্বে উপসর্গ যুক্ত হয় সে শব্দটি বাংলা হলে উপসগর্গটি বাংলা হয়; একইভাবে শব্দ বা ধাতুটি সংস্কৃত হলে উপসর্গটি তৎসম হয়।[](p১৮১)

  • বিদেশি উপসর্গ:
    • ফারসি উপসর্গ: কম-, কার-, দর-, না-, নিম-, ফি-, ব-, বে-, বর-, বদ-;
    • আরবি উপসর্গ: আম-, খাস-, খয়ের-, গর্-:', বাজে-, লা-;
    • উর্দু-হিন্দি উপসর্গ: হর-, হরেক;
    • ইংরেজি উপসর্গ: ফুল-, সাব-, হাফ-, হেড-

উপসর্গে হাইফেন

[সম্পাদনা]

উপসর্গে কখনো কখনো হাইফেন ব্যবহার করা হয়, বিশেষ করে যখন হাইফেনবিহীন বানান অন্য কোনো শব্দের অনুরূপ হয়ে যায় অথবা যখন উপসর্গ যোগ করলে সাধিত শব্দটি ভুল ব্যাখ্যাযোগ্য, অস্পষ্ট বা একরকম "আজব" বলে মনে হয় (উদাহরণস্বরূপ, যেভাবে ‘ঐ’ দ্বারা যেন বর্ণ না বোঝায় তাই বিভ্রান্তি এড়াতে বাক্যে ‘ওই’ ব্যবহার করা হয়)। যাইহোক, শব্দগঠনে সাধারণত হাইফেনহীন পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়, বিশেষ করে তখন, যখন সাধিত শব্দটি বিভিন্ন প্রসঙ্গে ব্যাপক ব্যবহারের মাধ্যমে তুলনামূলকভাবে পরিচিত বা জনপ্রিয় হয়ে উঠে। প্রচলিত নিয়মে হাইফেনের অভাবে কোনো সাধিত শব্দের অর্থের স্পষ্টতা বিঘ্নিত না হওয়া পর্যন্ত উপসর্গের পর হাইফেন দেওয়া হয় না।

সাধারণত বিদেশি উপসর্গের ক্ষেত্রে, স্বরধ্বনি দ্বারা শুরু হওয়া শব্দ ও উপসর্গকে পৃথক করে বোঝাতে বা অর্থের ভুল উচ্চারণ রোধে উপসর্গের পর হাইফেন ব্যবহার করা যেতে পারে, যেমন- ইংরেজি subunit (সাবিউনিট) এর পরিবর্তে sub-unit (সাব-ইউনিট)। কোনো শব্দ অধিক প্রচলিত হয়ে গেলে হাইফেন ব্যবহৃত হয় না, যেমন হেড-মাস্টার এর পরিবর্তে হেডমাস্টার। সাধারণত বর্তমানে উপসর্গযোগে শব্দ গঠনে ‌হাইপেন ব্যবহার করা হয় না | কিন্তু করলে কোন সমস্যা নেই |

আরও দেখুন

[সম্পাদনা]

তথ্যসূত্র

[সম্পাদনা]
  1. 1 2 3 4 "উপসর্গ - সামগ্রিক আলোচনা"টার্গেট বাংলা
  2. 1 2 3 বাংলা ভাষার ব্যাকরণ ও নির্মিতি, ২০২১ শিক্ষাবর্ষ, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড, ঢাকা, বাংলাদেশ
  3. 1 2 "উপসর্গ | বাংলা ব‍্যকরণ | এইচএসসি"edpdu.com
  4. উইলসন ২০১১, পৃ. ১৫২–১৫৩।
  5. 1 2 3 4 5 মামুদ, হায়াৎ; আমীন, মোহাম্মদ (২০২৪)। প্রমিত বাংলা ব্যাকরণ ও নির্মিতি: একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি। খণ্ড ১ম খণ্ড। পুথিনিলয়।
  6. 1 2 3 4 5 6 হাসান, মাহমুদুল; সুলতানা, মেহরিন (২০১৯)। ভাষা মঞ্জুরী - বাংলা ব্যাকরণ ও নির্মিতি। খণ্ড সপ্তম শ্রেণি। ৩৮/২-খ, তাজমহল মার্কেট (৩য় তলা) বাংলাবাজার, ঢাকা: গ্রন্থপুঞ্জি প্রকাশনী। পৃ. ১৫২।{{বই উদ্ধৃতি}}: উদ্ধৃতি শৈলী রক্ষণাবেক্ষণ: অবস্থান (লিঙ্ক)
  7. ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, মধ্য বাঙ্গালা ব্যাকরণ ও রচনা, বাক্‌‌ সাহিত্য প্রাইভেট লিমিটেড, ১৯৮১, কলিকাতা।
  8. 1 2 3 4 বাংলা ভাষার ব্যাকরণ, নবম-দশম শ্রেণি, ২০১৬ শিক্ষাবর্ষ, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড, ঢাকা, বাংলাদেশ

গ্রন্থপঞ্জি

[সম্পাদনা]