উত্তরপাড়া পাবলিক লাইব্রেরী

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

উত্তরপাড়া জয়কৃষ্ণ পাবলিক লাইব্রেরি পশ্চিমবঙ্গের একটি জেলা গ্রন্থাগার। এই লাইব্রেরীটি এশিয়ার প্রথম পাবলিক লাইব্রেরীগুলির মধ্যে একটি। হুগলি নদীর তীরে একটি ছোট্ট শহর উত্তরপাড়াতে এই গ্রন্থাগারটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বাবু জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ের (১৮০৮-১৮৮৮) পৃষ্ঠপোষকতায়। ১৮৫২ সালে এই গ্রন্থাগারটি জনসাধারণের জন্য উম্মুক্ত করে দেওয়া হয়। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার বর্তমানে গ্রন্থাগারটিকে একটি 'গ্রূপ এ' গ্রন্থাগার ঘোষণা করেছে। এই লাইব্রেরীটিকে একটি জাতীয় হেরিটেজ ঘোষণা করার প্রচেষ্টা চলছে।

ঠিকানা[সম্পাদনা]

২৬২, জিটি রোড, পোস্ট- উত্তরপাড়া, জেলা.- হুগলী, সাব ডিভিশন- শ্রীরামপুর, রাজ্য.- পশ্চিমবঙ্গ

উত্তরপাড়া জয়কৃষ্ণ পাবলিক লাইব্রেরি

ইতিহাস[সম্পাদনা]

শ্রী জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়[সম্পাদনা]

জয়কৃষ্ণ মুখার্জ্জী একজন বাঙালী জমিদার এবং সমাজ সংস্কারক ছিলেন। ১৮০৮ সালে উত্তরপাড়ায় একজন কেরানীর পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বাবার নাম জগনমোহন মুখার্জ্জী। পৈত্রিক ব্যবসাসূত্রে জয়কৃষ্ণ ছেলেবেলাতেই(৮ বছর বয়সে) বাবার সাথে মীরাট চলে যান। সেখানে একটি রেজিমেন্টাল স্কুলে ভর্তি হন। পড়াশোনা শেষ করে ১৮৩০সালে হুগলী রাজস্ববিভাগের হিসাবরক্ষক কেরানী হিসেবে নিযুক্ত হন। বন্যার কারণে তখন চাষবাসের মন্দা দেখা দেওয়ায় এস্টেটগুলি একের পর এক বিক্রি হয়ে যাচ্ছিল, জয়কৃষ্ণ মুখার্জ্জী এই এস্টেটগুলিকে কিনে নেন। ধীরে ধীরে ওনার সম্পত্তির পরিমাণ বাড়তে বাড়তে দ্বারকানাথ ঠাকুরের সমউচ্চতায় পৌঁছায়। এমনকি তখন দ্বারকানাথ ঠাকুর ১৮৩৮ সালে যে জমিদারদের সংঘ পত্তন করেছিলেন, জয়কৃষ্ণ মুখার্জ্জী সেই সংঘের এক গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন।

জয়কৃষ্ণ মুখার্জ্জী জাতীয়তাবাদী এবং উৎসাহী সমাজ সংস্কারক ছিলেন। ১৮৫১ সালের কলেরা মহামারীর পর তাঁর অক্লান্ত প্রচেষ্টা এবং পরিশ্রমের পর উত্তরপাড়া পৌরসভা তৈরী হয়।

উত্তরপাড়ায় ছেলে ও মেয়েদের জন্য অনেক স্কুল তৈরী করেন তিনি। উত্তরপাড়া কলেজ প্রতিষ্ঠাতেও তাঁর ভূমিকা অনস্বীকার্য।

কলকাতার জন বেথুন কলেজের প্রতিষ্ঠার জন্য়ে তিনি ১০০০০ টাকা দান করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারের জন্যেও ৫০০০ টাকা দান করেন।

নিজের জমিদারীতে অনেকগুলি কৃষি সংস্কার পরিচালনার পাশাপাশি তিনি সামাজিক এবং রাজনৈতিকভাবেও সক্রিয় ছিলেন। তিনি বিধবা বিবাহ চালু করার জন্য ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের আবেদনের প্রথম স্বাক্ষরকারী ছিলেন।

তিনি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসেরও সদস্য ছিলেন, দ্বিতীয় ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের (১৮৮৬ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত) তাঁর ভাষণে তিনি সভাপতি হিসেবে দাদাভাই নওরোজিকে মনোনীত করেন। অ্যালান অক্টোভিয়ান হিউম জয়কৃষ্ণ মুখার্জ্জীকে "বাঙালী রক্ষণশীলদের নেস্টর" বলে বর্ণনা করেছেন।[১]

গ্রন্থাগার[সম্পাদনা]

১৮৫২ সালের ১৫ এপ্রিল, জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতের প্রথম(এবং সম্ভবত এশিয়াতেও) বিনামূল্যে জনসাধারনের জন্যে গ্রন্থাগার খুলে দেন। উত্তরপাড়া পাবলিক লাইব্রেরি নামে পরিচিত এই গ্রন্থাগারটি মূলত জয়কৃষ্ণ মুখার্জ্জীর ব্যক্তিগত সংগ্রহ নিয়ে তৈরী হয়। ১৮৫১ সালের শেষদিক পর্যন্ত এটি শুধুমাত্র গবেষকদের জন্য খোলা থাকতো। জনসাধারণের শিক্ষার প্রসার এবং বাংলায় বৃত্তি প্রদান বৃদ্ধির জন্যে জয়কৃষ্ণ কিছু একটা করতে চেয়েছিলেন। তার উপর দ্বারকানাথ ঠাকুরের প্রভাব এবং ১৮৫০ সালের ব্রিটেনে পাবলিক লাইব্রেরি অ্যাক্ট তাঁর এই ইচ্ছেকে আরো অনমনীয় করে তোলে। ১৮৫৪ সালের আগস্ট মাসে তিনি উত্তরপাড়াতে একটি পাবলিক লাইব্রেরির জন্য বর্ধমানের বিভাগীয় কমিশনারের কাছে একটি প্রস্তাব পেশ করেন। ৫০০০টাকা তিনি এই লাইব্রেরীতে দান করতে ইচ্ছুক ছিলেন। প্রস্তাবটি অনুমোদিত হয় নি। জয়কৃষ্ণ তখন নিজেই পুরো লাইব্রেরীটির খরচ বহন করেন। হুগলি নদীর তীরে এই গ্রন্থাগারের নির্মাণকাজ শুরু হয় ১৮৫৬ সালে। ৮৫০০০ টাকা খরচ করে এক একর জমির উপরে লাইব্রেরীটি তৈরী হয়। প্রাথমিকভাবে ৭ জন কর্মী নিয়োগ করা হয়েছিল।একজন গ্রন্থাগারিক, একজন সহকারী গ্রন্থাগারিক, একজন ক্লার্ক, দুইজন মালি, এক ঝাড়ুদার এবং এক দারোয়ান। তিনি উত্তরপাড়ার নাগরিকদের একটি গ্রূপকে লাইব্রেরির দেখাশোনা করার কাজে নিয়োগ করেন।[২]

শুরুতে, গ্রন্থাগারটিতে প্রায় ৩০০০ বই এবং অনেকগুলি পত্রিকা ছিল, প্রায় সবগুলিই জয়কৃষ্ণের ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে। তিনি আরো বিভিন্ন জায়গা থেকে আরও বই ও সাময়িকপত্র সংগ্রহ করেন। তিনি দাতব্য দেবদত্ত ট্রাস্টের(জয়কৃষ্ণের পিতা দ্বারা প্রতিষ্ঠিত) থেকে কিনেছিলেন কিছু বই, বাংলা হরকর গ্রন্থাগার থেকে কিছু বিরল সংগ্রহ কিনেছিলেন এবং চীনে বাজারে গিয়ে কিছু পুরোনো বই সংগ্রহ করেন। ১৮৬৫ সালের মধ্যে গ্রন্থাগারটিতে ইংরেজিতে ১২০০০ বই এবং বাংলা ও সংস্কৃত ভাষায় ২৫০০ টি বই ছিল। এখনো পর্যন্ত, গ্রন্থাগারে ৪৫০০০ পুরানো এবং বিরল বই (১৭শতক থেকে ১৯ শতকের), ৬৫০০০ নতুন বই (উভয় বাংলা এবং ইংরেজি); ২৫০০ পুরাতন সাময়িকী; ২০০০০ নতুন (এবং বাধাঁনো) সাময়িকী, এবং ৪৫ পাণ্ডূলিপি স্যার উইলিয়াম হান্টার বলেছিলেন, "a unique storehouse of local literature alike in English and vernacular tongues" (এটি " ইংরেজি এবং স্থানীয় ভাষাতে লেখা স্থানীয় সাহিত্যের এক অনন্য ভাণ্ডার।")[৩]

ইংরেজি ও বাংলা সাহিত্যের কিছু অমুল্য সম্পদ লাইব্রেরীটিতে রক্ষিত আছে। পুরনো দিনের পত্রিকা যেমন "দিকদর্শন", "সংবাদ রসরাজ", "সোমপ্রকাশ", "তত্ত্ববোধিনী", "ক্যালকাটা মান্থলি জার্নাল(Calcutta Monthly Journal)" এবং "বেঙ্গল ক্রনিকল(Bengal Chronicle)" এরকম কিছু উল্লেখযোগ্য পত্রিকা এই লাইব্রেরীতে আপন মহিমায় বিদ্যমান। উনিশ শতকের ছাপাখানার অগ্রদূতদের লেখা বিশেষত, উইলিয়াম কেরী, মার্শম্যান, ওয়ার্ড, হ্যালাডে, রামমোহন ইত্যাদি এই লাইব্রেরীতে এখনো সযত্নে সংরক্ষিত। এছাড়া সংস্কৃত বাইবেল, কেমিস্ট্রির ডিকশনারী, দেবনাগরী লিপিতে সংস্কৃত ব্যাকরন, ম্যাক্স মুলারের লেখা রোমান চিঠি, ওয়েস্টমিনস্টারের রিপোর্ট(১৬৫৮), পার্লামেন্টের রিপোর্ট(১৬৪৯), ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চার্টার, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রচারপত্র(১৮১২), সাধারন নির্দেশাবলী রিপোর্ট(১৮৩৯) ইত্যাদি অমুল্য ঐতিহাসিক প্রমাণাদি এই লাইব্রেরীতে বর্তমান। এছাড়াও ভূর্জপত্রে, কদলীপত্রে এবং হাতেবানানো কাগজে সংস্কৃতে লেখা দুষ্প্রাপ্য ২০০র ও বেশি পাণ্ডূলিপি রক্ষিত আছে যেগুলি বারাণসী, কাশ্মীর, তিব্বতের বৌদ্ধমঠ থেকে সংগ্রহ করে আনা। রেভারেণ্ড জেমস লং-এর লেখা স্বদেশীয় বইয়ের তালিকার বেশিরভাগ বইই এই লাইব্রেরীর অন্তর্ভুক্ত। [৪]

বিখ্যাত অতিথি[সম্পাদনা]

উত্তরপাড়া জয়কৃষ্ণ লাইব্রেরি শুধু বইয়ের স্তূপ ছিল না। বিভিন্ন বিখ্যাত ব্যক্তির মিলনস্থল ছিল এই স্থানটি। তাঁরা আসতেন, থাকতেন, পড়তেন, নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনা চলত, বইয়ের জ্ঞান মানুষের মাথায় মাথায় ঘুরত। ১৮৬৬ সালে বিদ্যাসাগর এই লাইব্রেরীতে এসেছিলেন বিখ্যাত শিক্ষাবিদ মেরি কারপেন্টারকে সঙ্গে নিয়ে। কিছুকাল পরে যখন তাঁর বই "Six months in India" প্রকাশিত হয়, সেখানে এই লাইব্রেরীর একটি সুন্দর বর্ণনা পাওয়া যায়। মিস কারপেন্টারের ভাষায়, "বাড়িটির নিচের তলায় ছিল গ্রন্থাগার, এবং উপরের তলার ঘরগুলি বিখ্যাত ও শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিদের(ভিজিটর) থাকার জন্যে এবং সভাসমিতি করার জন্যে রাখা হয়েছিল।(the lower storey of the building contains the library, and the upper rooms are reserved to accommodate respectable visitors, as well as to hold public meetings ….)[৫]" এই বিখ্যাত এবং শ্রদ্ধেয় ভিজিটরদের মধ্যে কিছু নাম পাওয়া যায়, যেমন, মাইকেল মধুসূদন দত্ত(১৮৬৯ এবং ১৮৭৩ সালে পরিবার সহ দু মাস কাটিয়ে গেছেন), স্যার উইলিয়াম উইলসন হান্টার, জন এইচ এস কানিংহাম, রেভারেন্ড জেমস লং, স্যার আর্থার ওয়েলেসলী, স্যার আ্যসলী ইডেন, স্যার এডুইন আর্ণল্ড, স্যার রিভারস থম্পসন, মারকুইস অব ডাফরিন এবং আভা ডাফরিন, সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জ্জী, কেশবচন্দ্র সেন, বিপিন পাল, ১৯০৯ সালে স্বামী বিবেকানন্দ। বিপ্লবী শ্রী অরবিন্দ তাঁর বিখ্যাত "উত্তরপাড়ার ভাষণ" এই লাইব্রেরীর মাঠে দাঁড়িয়েই দিয়েছিলেন।[৬]

১৮৮৮ সালের পরবর্তীকালীন অবস্থা[সম্পাদনা]

জয়কৃষ্ণ মুখার্জ্জীর ইচ্ছা ছিল তাঁর মৃত্যুর পর লাইব্রেরীটি একটি নাগরিকদের গ্রূপ দ্বারা পরিচালিত হোক। ১৮৮৮ সালে জয়কৃষ্ণ মুখার্জ্জীর দেহাবসানের পর এই লাইব্রেরীটি অনেক আর্থিক এবং আইনি জটিলতায় জড়িয়ে পড়ে। এই অমুল্য পুঁথিরাজি এবং ঐতিহাসিক স্মৃতিবিজড়িত দালানটি সংস্কারের অভাবে ধুঁকতে থাকে। ১৯১১ সালে লাইব্রেরীটির ব্যাবস্থাপক সমিতি কিছু মনোযোগ আকর্ষণ করার চেষ্টা করে কিন্তু ব্যার্থ হয়। ১৯৫৩ সালে আবার আরো একবার চেষ্টা করা হলে সেটিও ব্যর্থ হয়।

১৯৫৪ সালে ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় (তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী) লাইব্রেরীটির ব্যাবস্থাপক সমিতির সাথে কিছু আলাপ আলোচনা করেন এবং কিছু আশ্বাস দেন। শেষমেষ ১৯৫৮ সালে এই লাইব্রেরীটি 'স্থানীয় গ্রন্থাগার' হিসেবে স্বীকৃত হয় এবং বাৎসরিক ৬৪০০০টাকা রক্ষণাবেক্ষণের জন্যে বরাদ্দ হয়। আবার ১৯৬৩সালে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী শ্রী প্রফুল্লচন্দ্র সেনের কাছে এই লাইব্রেরীটিকে যথাযোগ্য মর্যাদা দানের জন্যে দরবার করা হয়। ১৯৬৪ সালের ১৫ই জুন উত্তরপাড়া পাবলিক লাইব্রেরি সরকারী হাতে স্থানান্তর করা হয়। ২০০৬সালে শ্রীমতি প্রতিভা পাটিল(তৎকালীন রাজস্থানের গভর্নর এবং ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি) লাইব্রেরীটির দেড়শত বছর উদ্যাপনে অংশগ্রহণ করেন। উনি বইগুলির সংরক্ষণের জন্যে ১০লক্ষ টাকা প্রদান করেন।

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. Mukherjee, Sibnarayan (১৯১২)। Jaikrisna Mukharji: An Appreciation। The Art Press, Calcutta: Sibnarayan Mukherjee। 
  2. Mary Carpenter (২০০৯)। "Native Public Library: An Appraisal"। Prabuddha Chottopadhyay। Ekti Alokprobaho: Unish theke Ekush Shatak। Uttarpara, Hooghly: Uttarpara Jaykrishna Public Library। পৃষ্ঠা 17। 
  3. Sibnarayan Mukherjee (২০০৯)। "Jaikrishna Mukharji: An Appreciation"। Prabuddha Chottopadhyay। Ekti Alokprobaho: Unish theke Ekush Shatak। Uttarpara, Hooghly: Uttarpara Jaykrishna Public Library। পৃষ্ঠা 354। 
  4. Kuntal Chattopadhyay (২০০৯)। "Uttarpara Jaykrishna Public Library: Past, Present and Looking Beyond"। Prabuddha Chottopadhyay। Ekti Alokprobaho: Unish theke Ekush Shatak। Uttarpara, Hooghly: Uttarpara Jaykrishna Public Library। পৃষ্ঠা 70–71। 
  5. Carpenter, Mary (১৮৬৮)। Six Months in India। London: Longmans, Green and Co। 
  6. "Uttarpara Jaykrishna Public Library"। SAIOC। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৭-৩০ 

বহিঃসংযোগ[সম্পাদনা]