অজিত রায় (সাহিত্যিক)

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
অজিত রায়
জন্ম(১৯৬২-০৭-১৫)১৫ জুলাই ১৯৬২
সিএফআরআই কলোনি, ধানবাদ ঝাড়খণ্ড ভারত
মৃত্যু২০ ডিসেম্বর ২০২১(2021-12-20) (বয়স ৫৯)
ধানবাদ ঝাড়খণ্ড ভারত
পেশাঔপন্যাসিক
ভাষাবাংলা
জাতীয়তাভারতীয়
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানরাঁচি বিশ্ববিদ্যালয়
সময়কাল(১৯৮৩-২০১৯)
উল্লেখযোগ্য রচনাবলিযোজন ভাইরাস
ধানবাদ ইতিবৃত্ত
দাম্পত্যসঙ্গীপ্রেরণা রায় (স্ত্রী)(মৃ.২০০০)
সন্তানস্নেহা (কন্যা)

অজিত রায় (১৫ জুলাই ১৯৬২ - ২০ ডিসেম্বর ২০২১) ছিলেন একজন ভারতীয় বাঙালি লেখক, প্রাবন্ধিক, গল্পকার ও ঔপন্যাসিক। তিনি বাংলা সাহিত্যের এক ব্যতিক্রমী সাহিত্যিক ছিলেন। [১] বাংলাগদ্যের চলমান ধারার সম্পূর্ণ পৃথক ও ব্যতিক্রমী গদ্যপ্রযুক্তির প্রবর্তক ছিলেন তিনি।[২] তবে কলকাতার তথাকথিত কবি-লেখকেরা তাকে তেমনভাবে গ্রহণ করতে পারেন নি। তার চল্লিশ বৎসরের সাহিত্য সাধনায় কোন স্বীকৃতিও মেলে নি।[৩]

জন্ম ও প্রারম্ভিক জীবন[সম্পাদনা]

অজিত রায়ের জন্ম ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দের ১৫ জুলাই ভারতের বিহার রাজ্যের অধুনা ঝাড়খণ্ডের ধানবাদ শহরের সিএফআরআই কলোনিতে। বিদ্যালয়ের পাঠ স্থানীয় ভাঁওরা স্কুলে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক হন ঝরিয়া রাজ কলেজ থেকে। ধানবাদের পি কে রায় মেমোরিয়াল কলেজ হতে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে রাঁচি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণীর স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনের পর আইন নিয়েও পড়াশোনা করেন। [৪][২]

কর্মজীবন ও সাহিত্যকর্ম[সম্পাদনা]

পড়াশোনা শেষে অজিত রায় ধানবাদের এক বেসরকারি কয়লা মার্চেন্টের অফিসে অ্যাকাউন্ট্যান্টের চাকরি নেন। চাকরির পাশাপাশি লেখালেখিও করতে থাকেন। অবশ্য স্কুলে পড়ার সময় থেকেই তিনি কবিতা লেখা শুরু করেন এবং সিএফসি কলোনির প্রতিবেশীদের সহায়তায় অনন্যা নামে এক পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। তার কবিতার বই অকবিতা প্রকাশিত হয় ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দে তারই নাম দেওয়া ধানবাদের প্রকাশন সংস্থা 'অথচ' থেকে। কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হওয়ার পর আটের দশকের সম্ভাবনাময় তরুণ কবি হিসাবে পরিচিতি লাভ করেন। কিন্তু বিভিন্ন নামি দামি পত্রপত্রিকায় তার অসংখ্য কবিতা প্রকাশে পর তিনি কবিতা থেকে সম্পূর্ণ সরে গিয়ে গতানুগতিক সাহিত্যের ভাষা থেকে বেরিয়ে বহুমাত্রিক চরিত্র এবং স্বীয় বৈশিষ্ট্যের স্বতন্ত্র স্বকীয়তায় বাংলা গদ্য সাহিত্যে আশ্রয় নেন। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় নিষ্ঠার সাথে লিখতে থাকেন – ‘তাঁইশ’, ‘মাস্টার’, ‘একটি গরুর গল্প’, ‘কৌরব’, ‘সংবিত্তি’, ‘অনার্য সাহিত্য’, ‘শিলাদিত্য’, ‘পরাভব’, ‘অরন্তুদ’, ‘সন্ধিজীবক’, ‘গোধূলি মন’, ‘কয়লা সোনা, সোনাম্যাডাম ও কালাসোনা’, ‘মায়ের শ্রাদ্ধ’র মতো অসংখ্য ছোট গল্প। তার প্রথম উপন্যাস দোগলা চরিত প্রকাশিত হয় ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দে। প্রথম দিকের লেখায় কিছু সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের প্রভাব ছিল। পরে নিবিড় পড়াশোনায় অভিমুখ পরিবর্তিত হয়। ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয় দ্বিতীয় উপন্যাস এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না। উপন্যাসটি হিন্দিতে এক জার্নালিস্ট কী মৌত নামে অনুবাদ করেন তিনি নিজে এবং ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দে এলাহাবাদ থেকে প্রকাশিত হয়। ১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দের ২৩ জুন তার লেখা ‘ধানবাদ ইতিবৃত্ত’ প্রকাশিত হলে জন-উল্লাস, সাধুবাদ, সম্বর্ধনা ইত্যাদির মাঝে তুমুল উত্তেজনায়, ধানবাদ শহরে কসমোপলিশ রিঅ্যাকশন, কমিউন্যাল ফিলিং ছড়ানোর চেষ্টা, রাজনৈতিক আর মাফিয়া তল্লাটে তুমুল হৈচৈ, উড়ো ফোন আর হুমকিসহ প্রবল আলোড়ন সৃষ্টি হয় এবং তার আঁচ এসে পড়ে অজিত রায়ের ব্যক্তিগত জীবনে। তিনি কর্মচ্যুত হন ১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দেরই ৩০ জুন। [৫] তারপর অবশ্য তিনি আর কোথাও চাকুরির চেষ্টা না করে পুরোপুরি সাহিত্যকর্মে লিপ্ত হন। উপন্যাস থেকে শুরু করে কবিতা, ছোট গল্প, আত্মজীবনী, প্রবন্ধ, চিত্রনাট্য, গবেষণাধর্মী রচনা, সম্পাদনা এবং অনুবাদ সাহিত্যে ভাষার রহস্যকে নতুন করে চিনতে শিখিয়েছেন পাঠককূলকে। বহুবিধ সাহিত্যতাত্ত্বিক প্রকল্পে সর্বদা অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছেন। ১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত তার নতুন শৈলীতে ডায়াসপোরিক ভাষা প্রযুক্তির অসাধারণ উপন্যাস যোজন ভাইরাস বিশাল গণ-পুরস্কারে ভূষিত হয়। আঠাশটি উপন্যাসসহ কমপক্ষে তার ৫৭ টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। তবে কলকাতার তথাকথিত কবি-লেখকেরা তাকে তেমনভাবে গ্রহণ করতে পারেন নি, কেননা তিনি যা জানতেন, দেখতেন বা উপলব্ধি করতেন— তাই- ই তিনি লিখতেন। [৪]বাংলা হিন্দি এবং ইংরেজিতে নিপুণ অভিজ্ঞতা থাকার কারণে দীর্ঘ চল্লিশ বৎসর তিনটি ভাষাতেই সাহিত্য সাধনায় লিপ্ত ছিলেন। দুই ব্যতিক্রমী ভাবনা ও ভাষা নিয়ে তিনি ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে ধানবাদে আমৃত্যু সম্পাদনা করেন ‘শহর’ পত্রিকা।

সাক্ষরতা আন্দোলন[সম্পাদনা]

১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দেই তার পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা হয় তৎকালীন ধানবাদ স্বাক্ষরতা আন্দোলনের সচিব কাশীনাথ চট্টোপাধ্যায় এর সঙ্গে। অজিত রায় স্বাক্ষরতা আন্দোলনের উপর একাধিক গদ্য রচনা করেন। ভারত জ্ঞান বিজ্ঞান সমিতির সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। কাশীনাথ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জন্ম বার্ষিকীতে কার্মাটারে যেতেন। দুমকার ভারত সেবাশ্রম সংঘের অনাথ শিশু স্কুলে সময় কাটাতেন।

ব্যক্তিগত জীবন ও জীবনাবসান[সম্পাদনা]

স্নাতকোত্তর স্তরে পড়ার সময় তার পরিচয় হয় গিরিডির ঝাড়খণ্ডী তরুণী প্রেরণার সঙ্গে। তাকেই বিবাহ করেন। তাদের একমাত্র কন্যা স্নেহা। ১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দে ধানবাদ ইতিবৃত্ত লেখার পর তার জীবনে যে সামাজিক আলোড়ন সৃষ্টি হয়, তাতে তার জীবনে ঘটে যায় অনর্থ। অভাবনীয় দুঃখ, অসহায়তা আর আর্থিক অস্বচ্ছলতায় তাদের পারিবারিক জীবন সুখের ছিল না। তার স্ত্রী প্রেরণা ২০২০ খ্রিস্টাব্দের রাঁচিতে মারা যান। নিঃসঙ্গ অজিত রায় ২০২১ খ্রিস্টাব্দের ২০ ডিসেম্বর ধানবাদে প্রয়াত হন।[৪]

রচনাসমূহ[সম্পাদনা]

কবিতাগ্রন্থ-
  • অকবিতা (১৯৮৩), অথচ প্রকাশন, ধানবাদ
  • অহংকারী আটজন (১৯৮৬)
  • ধানবাদের বাংলা কবিতা সম্পাদনা (২০০৮), শহর পাবলিকেশন, ধানবাদ
উপন্যাস-
  • দোগলা চরিত (১৯৮৮)
  • এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না (১৯৯২)
  • কৌরব ও পাপারাৎজি (১৯৯৭), কৌরব প্রকাশনী, জামশেদপুর
  • যোজন ভাইরাস (১৯৯৮), শহর পাবলিকেশন, ধানবাদ
  • পাতিনা ওয়সিস (১৯৯৯) বইমেলা,শহর পাবলিকেশন, ধানবাদ
  • ম্যাওড়া জোন (২০০২), বইমেলা, শহর পাবলিকেশন, ধানবাদ
  • মায়ামঘর (২০০১) শহর পাবলিকেশন, ধানবাদ
  • কারগিল হাসিলের দিনগুলি (২০০০) শহর পাবলিকেশন, ধানবাদ
  • মাফিয়া, চিত্রনাট্য (২০০১) ,শহর পাবলিকেশন, ধানবাদ
  • জোখিম কোরকাপ (২০০৪), শহর পাবলিকেশন, ধানবাদ
  • পাগলনামা (২০০৫), বইমেলা, শহর পাবলিকেশন, ধানবাদ
  • ধানকাঠের তয়খানা (২০০৫), শহর পাবলিকেশন, ধানবাদ
  • নভাক যামিনী (২০০৬), শহর পাবলিকেশন, ধানবাদ
  • রত্নিসুখের একক উপপাদ্য (২০০৮), শহর পাবলিকেশন, ধানবাদ
  • ঘামলাঘাট (২০০৯), শহর পাবলিকেশন, ধানবাদ
  • নিরুজের রক্ততৃষা (২০১৫), শহর পাবলিকেশন, ধানবাদ
  • রূপকথা মগলা (২০১৬) , শহর পাবলিকেশন, ধানবাদ
  • খানাখারাব (২০১৭), শহর পাবলিকেশন, ধানবাদ
  • যাতনাভূমি (২০১৭), সমান্তরাল প্রকাশন, কলকাতা
  • হিরণ্যরেতাঃ (২০১৯) , গোরুচণ্ডা৯, কলকাতা
  • নির্জিত প্রেমের কুহর (২০১৯), হারাকিরি, আগরতলা, ত্রিপুরা
  • দামুচণ্ডালের কালিখপুরাণ (২০১৯), শহর পাবলিকেশন, ধানবাদ
গবেষণামূলক ইতিহাস-
  • ধানবাদ ইতিবৃত্ত (১৯৯৬), ফার্মা কে এল এম প্রা লি কলকাতাISBN=81-7102-064-X
  • ঝাড়খণ্ডে নেতাজী সুভাষচন্দ্র ইতিহাস গবেষণা, (২০০১), শহর পাবলিকেশন, ধানবাদ
  • হাংরি জেনারেশন: গেরো-ফাঁসগেরো (২০০৫)
  • বাংলা স্যাং: সমুচয় ঠিকুজিকুষ্ঠি (২০১২) শহর পাবলিকেশন, ধানবাদ
অন্যান্য-
  • দ্রাক্ষাপ্লেটে জোনারদানা আত্মজীবনী (২০০১)
  • যৌনতার নবমুক্তি (২০০৩) -প্রবন্ধ সংকলন,
  • ছোটলোকের শব্দলোক (২০০৫),* ছোটলোকের শব্দলোক (২০০৫)
  • ধানবাদের বিশিষ্ট বাঙালি (তিন খণ্ড), জীবনীকোষ, (২০০৭), শহর পাবলিকেশন, ধানবাদ
  • জুভেনিলিয়া জুনুন বাল্যস্মৃতি-কথা, (২০১৭),শহর পাবলিকেশন, ধানবাদ
অনুবাদ-
  • দাস কাহিনী (২০০০) রমেশচন্দ্র শাহ'র 'কিস্সা গুলাম-এর বাংলা অনুবাদ ,ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট
হিন্দিতে রচিত-
  • শহীদ গুরুদাস চটর্জী কী মার্মিক দাস্তান (২০১২) ,শহর পাবলিকেশন, ধানবাদ
  • ধনবাদ কা ইতিহাস (২০১৩), শহর পাবলিকেশন, ধানবাদ
  • ঝাড়খণ্ড কা ইতিহাস (২০১৫), শহর পাবলিকেশন, ধানবাদ
ইংরাজীতে-
  • ইনফরমেটিভ ধানবাদ, ধানবাদের স্ট্যাটিস্টিক্যাল হ্যান্ডবুক, (১৯৮৮)[৫]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. "উপন্যাসের জন্য চাকরি খুইয়েছেন অজিত রায়, হতে হয়েছে ঘরছাড়াও"। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-১০-০১ 
  2. রায়, অজিত (২০১৪, বাংলাদেশ সংস্করণ)। যোজন ভাইরাস। আলোকায়ন, বাংলাবাজার ঢাকা। আইএসবিএন 978-9849040378  এখানে তারিখের মান পরীক্ষা করুন: |তারিখ= (সাহায্য);
  3. "সম্পাদক সমীপেষু- কলকাতা কেন্দ্র"। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-১০-০১ 
  4. "জিতেন্দ্রিয় সাহিত্যিক অজিত রায়"। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-১০-০১ 
  5. "অজিত রায়"। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-১০-০১