আব্বাস ইবনে আলী
আব্বাস ইবনে আলী ইবনে আবু তালিব (৬৪৭ - ৬৮০ খ্রিস্টাব্দ) ছিলেন আলী ইবনে আবু তালিবের পুত্র, যিনি সুন্নি ইসলামের চতুর্থ খলিফা এবং শিয়া ইসলামের প্রথম ইমাম। তার মা ছিলেন ফাতিমা বিনতে হিজাম, তিনি উম্মে আল-বানিন (অর্থ: পুত্রের মা) নামেও পরিচিত ছিলেন। উমাইয়া খলিফা ইয়াজিদ ইবনে মুয়াবিয়ার (শাসনকাল ৬৮০ - ৬৮৩ খ্রিস্টাব্দ) সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ১০ মহররম ৬১ হিজরিতে, অর্থাৎ ১০ অক্টোবর, ৬৮০ খ্রিস্টাব্দে কারবালার যুদ্ধে আব্বাস তার ভাই হোসাইন ইবনে আলীর পতাকাবাহক হিসাবে যুদ্ধ করেছিলেন। ইসলামের নবী মুহাম্মদের (সা:) অবরুদ্ধ পরিবারের অসহ্য তৃষ্ণা মেটাতে ফোরাত নদী থেকে পানি আনার চেষ্টা করায় তাকে হত্যা করা হয়। আব্বাস তার পিতা আলীর সাহসিকতা উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিলেন।[১] ইমাম হোসাইন ইবনে আলীর প্রতি তার বিশ্বাস এবং দৃঢ়তার জন্য শিয়া ধর্মবিশ্বাসে তিনি খুবই প্রশংসিত। তারা আব্বাসকে সাহস ও আত্মত্যাগের চূড়ান্ত দৃষ্টান্ত হিসাবে বিবেচনা করে। কারবালায় আব্বাসের মাজার রয়েছে। তার মাজারের কাছাকাছি ইমাম হোসাইনের মাজার অবস্থিত।
উপাধি
[সম্পাদনা]আব্বাস ইবনে আলীর একটা উপাধি হলো আবুল ফজল বা গুণের বাবা। [২]তাকে বলা হয় কামার আল হাশেম বা হাশেমীয় গোত্রের চাঁদ। তিনি সবসময় লম্বা এবং সুদর্শন হিসেবে প্রশংসিত হন [৩] আব্বাসকে তার পিতা আলী ইবনে আবু তালিবের সাহসিকতা এবং বীরত্বের উত্তরাধিকারী বলে উল্লেখ করা হয়।[১] [৩] তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে বিজয় পতাকা বহন করতেন।[৩] আব্বাসকে ফার্সি ভাষায় শের-ই গাজী (অর্থ: যোদ্ধা-সিংহ) এবং শের-ই আওজান (অর্থ: বীর সিংহ) হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়।[২] কারবালার যুদ্ধে তার ভূমিকার জন্য তিনি আলমদার (অর্থ: পতাকা বাহক), আল-সাক্কা (পানি বাহক) এবং আবু আল-কিরবা (কিরবা অর্থ জল-চর্ম) নামেও পরিচিত। অবরুদ্ধ হোসাইন পরিবারের অসহ্য তৃষ্ণা মেটাতে ফোরাত নদী থেকে পানি আনার জন্য তার প্রচেষ্টার জন্য আবু আল কিরবা উপাধি দেয়া হয়।[৩] [২] জে. ক্যালমার্ড আব্বাস এবং মুহাম্মাদ ইবনে আল-হানাফিয়ার মধ্যে একটি সমান্তরাল তুলনা বিশ্লেষণ করেন। তিনি বলেন তারা দুইজন যুদ্ধক্ষেত্রে একইধরনের ভূমিকা রাখতেন।[৩]
জন্ম ও শৈশব
[সম্পাদনা]আব্বাস ইবনে আলীর জন্ম মদিনায়। তার বাবার নাম আলী ইবনে আবু তালিব এবং মায়ের নাম ফাতিমা বিনতে হিজাম ইবনে খালিদ ইবনে রাবিয়া। তিনি বনু কিলাব গোত্রের একজন মহিলা ছিলেন।[২] আব্বাসের তিনজন ভাই ছিল, যাদের নাম আবদুল্লাহ, জাফর এবং উসমান।[৩] ফলশ্রুতিতে আব্বাসের মা ফাতিমা উম্মুল বানিন (অর্থ: পুত্রদের মা[২]) নামে পরিচিত হন। আব্বাসের ভাইয়েরা সবাই কারবালার যুদ্ধে নিহত হন।[৩] কিছু সূত্র তাকে আলী ইবনে আবু তালিবের অপর পূত্রের সাথে নাম আলাদা করতে আব্বাস আল আকবার (বড় আব্বাস) বলে উল্লেখ করেছে। অপরজনকে আব্বাস আল আসগর (অর্থ: ছোট আব্বাস) বলে সম্বোধন করা হয়।[২] আব্বাসের জন্ম তারিখ বিতর্কিত। সুন্নি ঐতিহাসিক ইবনে সা'দ (মৃত্যু-৮৪৫) এর মতে, ৬৬১ খ্রিস্টাব্দে যখন আলীকে হত্যা করা হয় তখনও তিনি বয়ঃসন্ধিকালে পৌঁছাননি। যদিও অন্যেরা লিখেছেন যে, সেই সময় আব্বাসের বয়স ছিল চৌত্রিশ বছর। শিয়া পন্ডিত বাহর আল-উলুম (মৃত্যু: ১৭৯৭ খ্রিস্টাব্দ) ৪ শাবান, ২৬ হিজরি বা ১৫ মে, ৬৪৭ খ্রিস্টাব্দে আব্বাসের জন্ম হয়েছে বলে বর্ণনা করেছেন।[২] স্বাভাবিকভাবেই, আব্বাস সম্পর্কে সূত্রে যা পাওয়া যায় তার বেশিরভাগই কারবালার যুদ্ধের সাথে সম্পর্কিত।[২]
কারবালার যুদ্ধ এবং মৃত্যু (৬৮০ খ্রিস্টাব্দ)
[সম্পাদনা]ইয়াজিদের সিংহাসনে আরোহণ
[সম্পাদনা]আলী ইবনে আবু তালিবের জ্যেষ্ঠ পুত্র হাসানের সাথে পূর্বের চুক্তি লঙ্ঘন করে[৪] ৬৭৬ খ্রিস্টাব্দে মুয়াবিয়া (রাজত্ব: ৬৬১-৬৮০ খ্রিস্টাব্দ) তার উত্তরসূরি হিসেবে ইয়াজিদকে (রাজত্ব: ৬৮০-৬৮৩ খ্রিস্টাব্দ) নির্বাচিত করেন।[৫] ইয়াজিদকে প্রায়শই মুসলিম ইতিহাসবিদরা এমন একজন শাসক হিসেবে উপস্থাপন করেন, যিনি প্রকাশ্যে ইসলামের রীতিনীতি লঙ্ঘন করতেনন।[৬] [৭] [৮] শাসক হিসেবে তার মনোনয়ন প্রকৃতপক্ষে সেই সময়ে ইসলামের নবী মুহাম্মদের কিছু বিশিষ্ট সাহাবীর ছেলেদের দ্বারা প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়েছিল, যাদে মধ্যে হুসাইন ইবনে আলী অন্যতম।[৯][১০] ৬৮০ খ্রিস্টাব্দে মুয়াবিয়ার মৃত্যু এবং ইয়াজিদের সিংহাসনে আরোহণের পর বলপ্রয়োগের মাধ্যমে হুসাইনের শাসকের প্রতি আনুগত্যের অঙ্গীকার নিশ্চিত করার নির্দেশ দেয়া হয়। ফলে ইয়াজিদ ও হুসাইনের সংঘর্ষ অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে। ইয়াজিদকে খলিফা হিসেবে স্বীকৃতি না দেওয়ার জন্য হুসাইন নানাবিধ পন্থা অবলম্বন করেন।[১১] এই সময় কুফা নগরী থেকে তার কাছে শত শত চিঠি আসতে থাকে। কুফাবাসীরা তাকে মদীনা ছেড়ে কুফায় যেতে বলেন যেন, তিনি তাদের শাসক হতে পারেন। হুসাইন অবিলম্বে মক্কায় চলে যান। তার সাথে আব্বাসসহ কয়েকজন আত্মীয়ও ছিলেন। পরবর্তীতে তারা কুফার উদ্দেশ্যে রওনা হন।[২]
কারবালার পথে যাত্রা
[সম্পাদনা]কুফাবাসীদের কাছ থেকে সমর্থনের চিঠি পাওয়ার পর, হুসাইন তার চাচাতো ভাই মুসলিম ইবনে আকিলকে দূত হিসেবে কুফায় প্রেরণ করেন। এরপর তিনি নিজে ৮ বা ১০ জিলহজ্ব (১০ বা ১২ সেপ্টেম্বর, ৬৮০ খ্রিস্টাব্দ) তারিখে মক্কার উদ্দেশ্যে মদিনা ত্যাগ করেন। তার এই যাত্রায় কিছু সঙ্গী এবং পরিবারের প্রায় সকল সদস্যদের সাথে নিয়েছিলেন।[১১] বিশিষ্ট শিয়া পন্ডিত আল-মুফিদ (মৃত্যু: ১০২২ খ্রিস্টাব্দ) এর লেখা জীবনীমূলক গ্রন্থ আল-ইরশাদে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ইয়াজিদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে লড়াই করার উদ্দেশ্য ছিলো হুসেইন ইবনে আলির, যদিও তা তে প্রাণহানির মতো ঘটনা ঘটেও। [১২] [১৩] হুসাইন একই ধরনের কথা তার বৈমাত্রেয় ভাই ইবনে হানাফিয়ার জন্য লিখে গিয়েছিলেন। তিনি লিখেছিলেন ইয়াজিদের "দুর্নীতি বা নিপীড়ন" খোঁজার জন্য তিনি কুফায় যাচ্ছেন না, বরং "সঠিক কাজের আদেশ দিতে এবং অন্যায় কাজকে নিষেধ করতে" যাচ্ছেন।[১৪] পথিমধ্যে তার ছোট কাফেলা ইয়াজিদের বাহিনী দ্বারা বাধাপ্রাপ্র হয়। তারা কারবালার মরুভূমিতে ২ মহররম, ৬১ হিজরি (২ অক্টোবর, ৬৮০ খ্রিস্টাব্দ) ফোরাত নদী থেকে খানিকটা দূরে তাবু ফেলতে বাধ্য হন।[১৪] কুফাবাসীদের প্রতিশ্রুতি কুফানের বাস্তবায়িত হয়নি, কারণ তারা বরাবরই বিশ্বাসঘাতকতা করতো। তাছাড়া কুফার নতুন গভর্নর উবাদুল্লাহ ইবনে জিয়াদ (মৃত্যু-৬৮৬ খ্রিস্টাব্দ) হুসাইনের দূত মুসলিম ইবনে আকিলকে হত্যা ফেলে এবং কুফার গোত্র প্রধানদের ভয় দেখায়।[১১]
পানীয় জলের সংকট
[সম্পাদনা]৭ মহররম, ৬১ হিজরি তারিখে[১৫] ইবনে জিয়াদের নির্দেশে উমাইয়া সেনাপতি উমর ইবনে সা'দ (মৃত্যু: ৬৮৬ খ্রিস্টাব্দ) ফোরাত নদীতে হুসাইনের প্রবেশাধিকার বন্ধ করে দেয়।[১৬][১১] আব্বাস এবং তার প্রায় পঞ্চাশজন সঙ্গীরা মিলে তবুও এক রাতের অভিযানে হুসাইনের শিবিরে কিছু পানি আনতে সক্ষম হয়েছিলেন।[১১] এই সফল প্রচেষ্টা সত্ত্বেও, ইসলামপন্থী ইতিহাসবিদ এল. ভেকিয়া ভ্যাগলিয়ারি (মৃত্য: ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দ) মনে করেন যে, তারা তিন দিন ধরে তীব্র পিপাসায় ভুগছিলেন।[১৭] অন্যান্য বিশেষজ্ঞদের মধ্যে ডি. পিনাল্ট একইভাবে লিখেছেন যে, অবরোধের সময় থেকেই তারা তৃষ্ণা ও ক্ষুধায় ভুগছিলেন।[১৮] অন্যদের মতোই এ. হামদারের মতামত কাছাকাছি।[১৯] তিনি বলেন, কারবালাতে একটি উষ্ণ মরু জলবায়ু রয়েছে।[২০][২১]
সমঝোতার চেষ্টা
[সম্পাদনা]ইবনে সা'দকে ইবনে জিয়াদ নির্দেশ দিয়েছিলেন যেন তিনি ইয়াজিদের প্রতি হুসাইনের আনুগত্যের অঙ্গীকার না করানো পর্যন্ত তাদের ছেড়ে না দেন।[১৬] কিন্তু হুসাইন ইয়াজিদের কাছে নতি স্বীকার করেননি।[১১][১৭] রক্তপাত এড়ানোর জন্য ইবনে সা'দের হুসাইনের সাথে ইবনে জিয়াদের সাথে আলোচনা চলতে থাকে। আলোচনা ফলপ্রসূ হয়নি।[১৭][১১] অবশেষে ইবনে সা'দকে হুসাইন ও তার সমর্থকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ও হত্যা করার নির্দেশ দেন, যতক্ষণ না তারা ইয়াজিদের প্রতি আনুগত্যের প্রতিশ্রুতি প্রদান করেন। এই সিদ্ধান্তের কারণে তাদের ভাগ্য পরবর্তীকালে করুণভাবে নির্ধারিত হয়।[১১]
নিরাপদ পলায়ন প্রস্তাব
[সম্পাদনা]আব্বাস ইবনে আলী মাতৃবংশের দিক দিয়ে বনু কিলাব গোত্রীয় ছিলেন। অপরদিকে উমাইয়া সেনাপতি সিমার ইবনে যিলজাওশান আল-আমিরিও ছিলেন একই গোত্রের সদস্য। সে ইবনে জিয়াদের কাছ থেকে আব্বাস ও তার তিন ভাইয়ের জন্য যুদ্ধক্ষেত্র থেকে নিরাপদ পলায়নে সুরক্ষাপত্রের জন্য আবেদন এবং তা লাভ করে। প্রাচীন ইতিহাসবিদ আবু মিখনাফ (মৃত্যু: ৭৭৩-৭৭৪ খ্রিস্টাব্দ) এর মতে, ইবনে জিয়াদের সুরক্ষার চিঠি আব্বাস এবং তার ভাইদের কাছে পাঠানো হয়েছিল, তারা তা প্রত্যাখ্যান করেছিল। আব্বাস বলেছিল,
সুমাইয়ার পুত্র (অর্থাৎ ইবনে জিয়াদ) সুরক্ষার যে প্রস্তাব করেছে, তার চেয়ে আল্লাহর সুরক্ষা উত্তম।
সিমার আশুরার আগের দিন সন্ধ্যায় আব্বাস ও তার ভাইদের কাছে আবারও একই প্রস্তাব প্রেরণ করে। কিন্তু তারা বিরোধিতা করেছিলেন এবং হুসাইনের প্রতি তাদের পূর্ণ সমর্থনের অঙ্গীকার করেছিলেন। [২]
৯ মহররম
[সম্পাদনা]৯ই মহররম, ৬১ হিজরিতে ইবনে সা'দ আসরের নামাযের পর হুসাইনের তাবুতে আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেয়। উমাইয়া সৈন্যবাহিনী কাছে আসার সাথে সাথে হুসাইন আব্বাস এবং কিছু সঙ্গীকে প্রেরণ করেন, যারা ইবনে সা'দকে পরের দিন পর্যন্ত সংঘর্ষ বিলম্বিত করতে বলে।[২][১১] হুসাইন সেদিন সন্ধ্যায় তাবুর সমস্ত প্রদীপ এবং মশাল নিভিয়ে ফেলার আদেশ প্রদান করেন। এরপর তিনি তার অনুসারীদের সামনে একটি বক্তব্য দিয়ে বলেন যে, তারা যেন এই আঁধারেই সবাই পালিয়ে যায়। তারা যেন কেউ হুসাইনের জন্য নিজেদের মূল্যবান প্রাণ বিসর্জন না দেয়। তখন আব্বাসই প্রথম তার সমর্থন পূণরায় ঘোষণা করে বলেন যে, তিনি জীবন বা মৃত্যু উভয় ক্ষেত্রেই তার ভাইকে অনুসরণ করবেন।[২][১১] উপস্থিত প্রায় সকলেই শেষ অবধি হুসাইনের সাথে অবস্থান করেন। কেউ পালিয়ে যায় নি।[১১][২১][২২] হোসাইন এবং তার সঙ্গীরা সেই রাতটি নামাজ পড়ে এবং কুরআন পাঠ করে কাটিয়েছিলেন।[২৩] এমনই বর্ণনা করেছেম শিয়া আইনবিদ সাইয়েদ ইবনে তাউস (মৃত্যু; ১২৬৬ খ্রিস্টাব্দ)।[২৪] এই রাতে জয়নাব বিনতে আলী তার সৎ ভাই আব্বাসকে তাদের পিতার ইচ্ছার কথা মনে করিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন যে, তার পিতার কথা অনুযায়ী তারা যেন কারবালায় উপস্থিত থাকে এবং আলী যেমন মুহাম্মদের সাথে থাকতো, তারাও যেন তার মতো হুসাইনের সাথে থাকে।[২৫] আব্বাস তার বোনের কথাটি স্বীকার করে এবং শপথ করে। ইবনে তাউসের মতে, আব্বাস ৯ মহররমের রাতে পানি আনার ব্যর্থ অভিযানে নিহত হয়েছিলেন।[৩][২৪] যদিও অধিকাংশ ইতিহাসবিদগণের মতে তারা মৃত্যু হয়েছিল পরের দিন অর্থাৎ ১০ মহররম আশুরার দিন।[৩]
আশুরা বা ১০ই মহররম
[সম্পাদনা]আশুরার দিন সকালে (১০ মুহাররম), হুসাইন তার সমর্থকদের, প্রায় বাহাত্তর জন লোককে সংগঠিত করেছিলেন[২] এবং আব্বাসকে তার পতাকা ধারক হিসাবে মনোনীত করেছিলেন, যা সঙ্গীদের মধ্যে তার বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানের ইঙ্গিত দেয়।[২] হুসাইন তখন শত্রুদের সাথে কথা বলেন এবং তাদের জিজ্ঞাসা করেন কেন তারা মুহাম্মদের নাতিকে হত্যা করা বৈধ বলে মনে করে।[১৭] উমাইয়া সেনাপতি আল-হুর ইবনে ইয়াজিদ আল-তামিমি তার এই বক্তৃতার পরেই হুসাইনের বিপক্ষ থেকে সরে আসেন।[২৬] উমাইয়া সেনারা তখন হুসাইনের শিবিরে তীর বর্ষণ শুরু করে।[১৭] এভাবে যুদ্ধ শুরু হয়, যা সকাল থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত চলতে থাকে। দিনব্যাপী কখনো এতে দ্বৈত যুদ্ধ, সংঘর্ষ, হামলা এবং পশ্চাদপসরণের ঘটনা ঘটে।[১১] একবার আব্বাস একদল সাহাবীকে উদ্ধার করতে সাহায্য করেন, যারা শত্রুদের ঘোড়সওয়ার দ্বারা পরিবেষ্টিত ছিল।[২] তবে বিকেলের মধ্যেই সবাই মারা যান এবং বনু হাশিম গোত্রের অধিকাংশ সদস্যকে হত্যা করা হয়।[২৭]
মৃত্যু
[সম্পাদনা]সুন্নি ঐতিহাসিক আল-তাবারি (মৃত্যু: ৯২৩) এবং আল-বালাধুরি (মৃত্যু: ৮৯২) আব্বাসের মৃত্যুর বিবরণ সম্পর্কে তাদের গ্রন্থে তেমন কিছু লিখেন নি।[৩][১৭] ভেকিয়া ভ্যাগলিয়ারি অবশ্য যুক্তি দেন যে, তার মৃত্যু সম্পর্কে অবশ্যই বিদ্যমান ইতিহাস রয়েছে এবং যেগুলি আল-মুফিদ বর্ণনা করেছিলেন।[১৭]যুদ্ধের চূড়ান্ত দিনে আব্বাস এবং হুসাইন যখন ফোরাত নদীতে পৌঁছানোর চেষ্টা করেছিলেন, তখন তারা পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। আব্বাস শেষ অবধি বীরত্বের সাথে যুদ্ধ চালিয়ে যান।[৩][১৭] অন্য আরেকটি সুপরিচিত বিবরণ প্রদান করেছেন শিয়া পন্ডিত সাইয়েদ ইবনে তাউস এবং আরও অনেকে। তাদের মতে হুসাইনের তাবুতে পিপাসার্ত শিশুদের কান্নার শব্দ শুনে[২৮]আব্বাস আশুরার প্রাক্কালে ফোরাতের দিকে রওয়ানা হন এবং চামড়ার তৈরি পানির পাত্র পানি দিয়ে পরিপূর্ণ করতে সক্ষম হন। কিন্তু হোসাইনের শিবির থেকে দূরে নদীর তীরে তিনি শত্রু দ্বারা অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন।[২] একাকী যুদ্ধ করতে যেয়ে তার উভয় হাত তীরের আঘাতে কেটে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তারপর তাকে হত্যা করা হয়।[৩]হুসাইনের শেষ যোদ্ধার পতন হলে, উমাইয়া সেনাবাহিনী নি:সঙ্গ ইমামের উপর একসাথে হামলা করে। তিনি শেষ পর্যন্ত বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করেছিলেন। সূফী পণ্ডিত এইচ. কাশেফি (মৃত্যু-১৫০৪) তার লিখিত গ্রন্থ রওজাত আল-শোহাদাতে যে বিবরণ দিয়েছেন তাতে কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। তার মতে আব্বাস ছিলেন কারবালা যুদ্ধের ৬৮তম নিহত যোদ্ধা।[৩] তিনি মোহাম্মদ ইবনে আলী, আলী আল-আকবর এবং আলী আল-আসগরের আগে নিহত হন।[২১]আল ইরশাদ গ্রন্থে আব্বাসের খুনী হিসেবে জায়েদ ইবনে ভারকা হানাফী এবং হাকিম ইবনে আল-তোফায়েল সান'আনির নাম উল্লেখ রয়েছে। আবু মিখনাফ তার মাকতাল গ্রন্থে আরও বলেন যে, আব্বাস নিহত হলে তার ভাই হুসাইন ফুঁপিয়ে কাঁদছিলেন।[২৯] মাকাতিল আল তালিবিয়িন গ্রন্থে ইতিহাসবিদ আবু আল-ফারাজ আল-ইসফাহানি (মৃত্যু: ৯৬৭) বলেন, আব্বাসের হত্যাকারী প্রতি রাতে নিজেকে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবার স্বপ্ন দেখতো। সুফি শিয়া মতবাদের ইমাম আলী ইবনে আল-হুসাইন (মৃত্যু: ৭১৩) এবং জাফর আস সাদিক (মৃত্যু: ৭৬৫ হুসাউকে রক্ষা করার জন্য আব্বাসের বিশ্বাস এবং দৃঢ়তার জন্য উচ্চ প্রশংসা করেন।[২]
বিশ্বাসযোগ্যতা
[সম্পাদনা]আল-মুফিদসহ অন্যান্যরা যুক্তি দেখান যে, হুসাইন ও তাঁর সঙ্গীদের থেকে কিছুটা দূরে আব্বাসের কবরস্থান রয়েছে। এটি আলি ইবনে আল-হুসাইন থেকে প্রাপ্ত আব্বাসের মৃত্যু সম্পর্কিত আরেকটি প্রতিবেদনের সাথেও সামঞ্জস্যপূর্ণ। এই বিবরণের সমর্থনে, ইসলাম বিশেষজ্ঞ এ. বাহরামিয়ান এবং তাঁর সহলেখক উল্লেখ করেন যে, তীর্থযাত্রীদের জন্য প্রচলিত প্রার্থনাগুলিতে আব্বাসের পানি আনার অভিজান এবং তাঁর হাত কেটে ফেলার কথা উল্লেখ রয়েছে। এই দুইজন লেখক আরও জানান যে, পরবর্তীতে আব্বাস আল-সাক্কা (আক্ষ. 'পানিবাহক') এবং আবু আল-কিরবা (পানির মশক নামে পরিচিত হন।[২]
মৃত্যুর পর
[সম্পাদনা]যুদ্ধের পর, কিছু উমাইয়া সৈন্য আব্বাসের পোশাক খুলে নেয়,[২][২২] এভাবে তাঁর মরদেহের অসম্মান করা হয়।[৩০] হুসাইন ও তাঁর অন্যান্য সঙ্গীদের মতোই, আব্বাসের মাথাও কেটে দামেস্কে ইয়াজিদের কাছে পাঠানো হয়।[৩] আব্বাসের ক্ষেত্রে এই কাজটি করেছিল হারমালা ইবনে কাহিল আল-আসাদি।[২]
সমাধি
[সম্পাদনা]কাছাকাছি আল-গাদিরিয়া গ্রামের বনু আসাদ গোত্রের কিছু লোক আব্বাসকে সমাহিত করেন, ঠিক যেখানে তিনি শহীদ হয়েছিলেন। পরবর্তীতে তাঁর কবরের উপর একটি সমাধিসৌধ নির্মাণ করা হয়।[১৭][৩১] আব্বাসের সমাধিতে এখন একটি সোনালী গম্বুজ রয়েছে এবং এটি হুসাইনের মাজারের উত্তর-পূর্বে অবস্থিত। উভয় সমাধি কারবালা শহরে একটি টিলার উপর নির্মিত,[৩] যা তীর্থযাত্রীদের গন্তব্য এবং ধর্মীয় শিক্ষার কেন্দ্র হিসেবে পরিণত হয়েছে।[৩১] জিয়ারতকারীদের জন্য বিশেষ দোয়া ও রীতিনীতি রয়েছে এবং আব্বাসের দরগাহ প্রাঙ্গণে বেশ কয়েকজন মুসলিম ব্যক্তিত্ব সমাহিত আছেন।[৩] অন্যত্রও আব্বাসের সাথে সম্পর্কিত আরও কিছু দরগাহ রয়েছে, যার মধ্যে তেহরান-এর কাছে একটি প্রাচীন দরগাহ অন্তর্ভুক্ত, যা স্থানীয়রা আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাসের সমাধি বলে মনে করেন।[২]
বংশধরগণ
[সম্পাদনা]আব্বাসের একজন ছোট ছেলে ছিল, যার নাম উবাইদুল্লাহ। তার মা ছিলেন লুবাবা বিনতে উবাইদুল্লাহ, যিনি আব্বাস ইবনে আব্দুল মুত্তালিব-এর নাতনি ছিলেন। এই ছেলেটিকে সম্ভবত কারবালার যুদ্ধের পর বন্দি করা হয়েছিল এবং আব্বাসের বংশধারা তার মাধ্যমেই চলে আসে। বিশেষ করে, আব্বাসের বংশধরদের রচিত কবিতাগুলি আব্বাসীয় যুগের লেখক আল-সুলি (মৃত্যু: ৯৪৬ বা ৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ) রচিত আল-আওরাক গ্রন্থের একটি অধ্যায়ে সংকলিত আছে। তাঁর এক বংশধর ছিলেন আব্বাস ইবনে আল-হাসান আল-আলাবি, যিনি আব্বাসীয় খলিফা হারুন উর রশিদ (রাজত্ব: ৭৮৬-৮০৯) এবং আল-মামুন (রাজত্ব: ৮১৩-৮৩৩)-এর শাসনকালে একজন বিখ্যাত কবি ও পণ্ডিত হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। নবম শতাব্দীতে ইরাক ও বাহরাইন-এ জানজ বিদ্রোহ শুরু করেছিলেন আলি ইবনে মুহাম্মদ সাহিব আল-জানজ, যিনি নিজেকে আব্বাসের বংশধর বলে দাবি করতেন।[২] তবে কিছু ঐতিহাসিক এই দাবির বিরোধিতা করেছেন।[৩২]
শিয়া ইসলামে তাৎপর্য
[সম্পাদনা]শিয়া ইসলামে আব্বাসকে সাহসিকতা, বীরত্ব, ভালোবাসা, আন্তরিকতা এবং আত্মত্যাগের চূড়ান্ত আদর্শ হিসেবে গণ্য করা হয়। শিয়ারা আব্বাসের কাছে তাওয়াসসুল এর দোয়া করেন। এভাবে শিয়াদের কাছে আব্বাস দুঃখ ও কষ্ট লাঘবের দোয়ার সাথে সম্পর্কিত। তাঁর নামে গুরুত্বপূর্ণ শপথ করা হয় এবং শিয়ারা আব্বাসের নামে করা মানত (নজর) পূরণের অংশ হিসেবে দান-সদকা বিতরণ করেন।[২]
মহররমের আচার অনুষ্ঠান
[সম্পাদনা]তাসুআ (৯ মহররম) শিয়ারা আব্বাসের জন্য শোক দিবস হিসেবে পালন করে।[২] আব্বাসের স্মরণে তাজিয়া বানিয়েও স্মরণ করা হয়, যেখানে দেখানো হয় তিনি আহলে বাইতের পানিবাহী এবং হুসাইনের পতাকা বহনকারী ছিলেন।[৩] আব্বাসের মৃত্যু শোকের প্রাচীনতম অনুষ্ঠানগুলির মধ্যে এটি অন্যতম, যা বছরের পর বছর ধরে নিয়মিতভাবে পালন করা হয়।[২] অনেকের মতে, মহররমের মিছিলে সবুজ পতাকার উপরের অংশে একটি ধাতব হাত সজ্জিত থাকে, যা আব্বাসের কাটা হাতকে প্রতিনিধিত্ব করে এবং বিস্তৃত আঙুলগুলি আহলে বাইতের প্রতিনিধিত্ব করে।[৩][২] এগুলোতে বিভিন্ন ধরনের দোয়া খোদাই করা থাকে।[৩] তার নামে দান-খয়রাতের জন্য খাবার এবং পানি বিতরণ করা হয়।[৩] পশ্চিম ভারত থেকে জাভা দ্বীপ পর্যন্ত সুন্নিরা এবং এমনকি হিন্দুরাও সাধারণত শিয়া মহররমের আচার-অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে।[৩]
শিল্পকলা
[সম্পাদনা]আব্বাস ইবনে আলি মুসলিম শিল্পকলায়, বিশেষ করে শিয়া মতাদর্শীয় শিল্পে ব্যাপকভাবে স্থান পেয়েছেন। তাঁর সম্পর্কে অসংখ্য কবিতা লেখা হয়েছে। তাঁর প্রতিকৃতি ঐতিহাসিকভাবে বিভিন্ন ধর্মীয় স্থাপনায় দেখা যায়, বিশেষ করে দেয়াল চিত্র এবং টাইলসের উপর। এইসব শিল্পকলায় তাকে মশক হাতে পানি বহন করতে দেখা যায়। আব্বাসকে ধর্মীয় চিত্রকলায় প্রায়ই একটি সাদা ঘোড়ার ওপর বসা অবস্থায় চিত্রিত করা হয়, যেখানে তিনি হুসাইনের পতাকা ধরে শত্রুদের সাথে লড়াই করছেন অথবা একটি পানির মশক ধরে আছেন এবং আহলে বাইতের নারীরা ও শিশুরা তাঁকে ঘিরে রয়েছে।[২]
বেকতাশি ত্বরিকায় গুরুত্ব
[সম্পাদনা]বেকতাসি হলো মূলত আলবেনিয়াভিত্তিক একটি সুফি সম্প্রদায়, যারা মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে বসবাস করে। তাদের ঐতিহ্য অনুযায়ী, আব্বাস ইবনে আলি বারবার জাতিদের থেকে আলবেনিয়াকে রক্ষা করতে একটি সাদা ঘোড়ায় চড়ে আলবেনিয়ায় গিয়েছিলেন এবং তিনি প্রতি বছর পাঁচ দিনের জন্য (২০–২৫ আগস্ট) আলবেনিয়ার মাউন্ট টোমর এ ফিরে আসেন। এই সময় তার স্মরণে পশু উৎসর্গ করা হয় এবং আব্বাসকে সম্মান জানানো হয়। এই পাঁচ দিন, বেকতাশি তীর্থযাত্রীরা আব্বাস আলি তুরবে পরিদর্শন করেন, যা একটি সমাধি। তারা এটিকে আব্বাসের দেহাবশেষের আবাসস্থল বলে বিশ্বাস করে। এই সমাধিটি মাউন্ট টোমরের দক্ষিণ শিখরে অবস্থিত, যা ১৬২০ সালে নির্মিত হয়েছিল। সমাধিটি বেকতাশি খানকা এর পাশে অবস্থিত, যা ১৯১৬ সালে মাউন্ট টোমরে নির্মিত হয়েছিল।[৩৩]
- ↑ ক খ Hyder 2006, পৃ. 91।
- ↑ ক খ গ ঘ ঙ চ ছ জ ঝ ঞ ট ঠ ড ঢ ণ ত থ দ ধ ন প ফ ব ভ ম য র Bahramian ও Bulookbashi 2015।
- ↑ ক খ গ ঘ ঙ চ ছ জ ঝ ঞ ট ঠ ড ঢ ণ ত থ দ ধ ন প Calmard 1982।
- ↑ Madelung 1997, পৃ. 493-8।
- ↑ Madelung 1997, পৃ. 322।
- ↑ Momen 1985, পৃ. 28।
- ↑ Pinault 2000, পৃ. 70।
- ↑ Abbas 2021, পৃ. 167।
- ↑ Wellhausen 1927, পৃ. 145।
- ↑ Hawting 2000, পৃ. 46।
- ↑ ক খ গ ঘ ঙ চ ছ জ ঝ ঞ ট ঠ Madelung 2004।
- ↑ Munson 1988, পৃ. 22-3।
- ↑ Tabatabai 1975, পৃ. 175, 188।
- ↑ ক খ Adibzadeh 2013, পৃ. 78 – 79।
- ↑ Qutbuddin 2019, পৃ. 106।
- ↑ ক খ Momen 1985, পৃ. 29।
- ↑ ক খ গ ঘ ঙ চ ছ জ ঝ Veccia Vaglieri 2012।
- ↑ Pinault 2000, পৃ. 71।
- ↑ Hamdar 2009, পৃ. 85 – 86।
- ↑ Adibzadeh 2013, পৃ. 82।
- ↑ ক খ গ Momen 1985, পৃ. 30।
- ↑ ক খ Tabatabai 1975, পৃ. 176।
- ↑ Munson 1988, পৃ. 23।
- ↑ ক খ Sindawi 2002, পৃ. 91।
- ↑ Aghaie 2004, পৃ. 128।
- ↑ Wellhausen 1901, পৃ. 66।
- ↑ Hyder 2006, পৃ. 89।
- ↑ Pinault 2001, পৃ. 13।
- ↑ Sindawi 2002, পৃ. 93।
- ↑ Pinault 2001, পৃ. 1।
- ↑ ক খ Momen 1985, পৃ. 33।
- ↑ Popovic 1999, পৃ. 33–35, 150, 155।
- ↑ Elsie 2019।