বংশাণুগতভাবে পরিবর্তিত খাদ্য

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

বংশাণুগতভাবে পরিবর্তিত খাদ্য (জিএম খাদ্য) বা বংশাণু প্রকৌশল ব্যবহারে পরিবর্তিত খাদ্য (জিই খাদ্য) হচ্ছে এমন জীব থেকে প্রাপ্ত খাদ্য যার ডিএনএ বংশাণু প্রকৌশল ব্যবহার করে পরিবর্তন করা হয়েছে। বংশাণু প্রকৌশল পদ্ধতি ব্যবহার করে জীবের মাঝে নতুন বৈশিষ্ট্য প্রবর্তন করার পাশাপাশি জীবের বৈশিষ্ট্যতে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়। পূর্বে ব্যবহৃত কৃত্রিম নির্বাচন এবং পরিব্যক্তি নির্বাচন পদ্ধতির তুলনায় বংশাণু প্রকৌশল পদ্ধতি নতুন। [১] ১৯৯৪ সালে প্রথম বাণিজ্যিকভাবে জিনগত পরিবর্তিত খাবার বাজারজাত করা হয়। যদিও ক্যালজিন কোম্পানির টমেটো দেরিতে পাকানোর এই প্রচেষ্টা সফল হয়নি।[২][৩] পরিবর্তনগুলো প্রধানত কৃষকদের উচ্চ চাহিদা আছে এমন ফসল সয়াবিন, ভুট্টা এবং তুলার উপর আনা হয়েছে। জিনগতভাবে পরিবর্তিত ফসল রোগজীবাণু প্রতিরোধের বিশেষভাবে নকশা করা হয়। এভাবে পশুসম্পদে পরিবর্তন আনা হলেও, ২০১৩ সালে নভেম্বর পর্যন্ত তা বাজারে আসেনি।[৪] বিজ্ঞানীরা এই মর্মে একমত হয়েছেন যে, বর্তমানে প্রাপ্ত জিএম খাদ্য মানবস্বাস্থ্যের জন্য প্রচলিত খাবারের চেয়ে কোনো বড় ঝুঁকি তৈরি করে না। তবে প্রতিটি জিনগত পরিবর্তিত খাদ্য নির্দিষ্টভাবে পরীক্ষা করা অতীব জরুরি। অবশ্য, বিজ্ঞানীদের চেয়ে সাধারণ মানুষের মাঝে জিএম খাদ্য গ্রহণে অনীজ্ঞা পোষণ করতে দেখা যায়। বিভিন্ন দেশে আইন অনুযায়ী জিএম খাদ্য়ে নিষেধাজ্ঞা থেকে শুরু করে বিভিন্ন মাত্রার বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়।

সংজ্ঞা[সম্পাদনা]

খাদ্য উৎপাদনকারী জীবের বৈশিষ্ট্য জিনপ্রকৌশল ব্যবহারে পরিবর্তন করার পরে সেই জীব থেকে আহরিত খাদ্যকে বলা হয় জিনগত পরিবর্তিত খাবার। ক্রস ব্রিডিং পদ্ধতির বিপরীতে এই বংশাণু প্রকৌশল পদ্ধতির সূচনা করা হয়।[৫][৬] মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, কৃষি বিভাগ (ইউএসডিএ) এবং খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন (এফডিএ) "জিনগত পরিবর্তন" এর বদলে "বংশাণু প্রকৌশল ব্যবহৃত" শব্দমালা ব্যবহারে জোর দেয়া হয়। কেননা, এতে আরো সঠিক শব্দচয়ন করা হয়। জিনগত পরিবর্তন শব্দমালা শুধুমাত্র জিনপ্রকৌশলকেই নির্দেশ করেনা। পাশাপাশি আরো অন্য পদ্ধতিকে নির্দেশ করে।[৭][৮] বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুসারে, "জিএম জীব থেকে উৎপাদিত খাবারকে বা প্রায়শঃই জিএম খাবার হিসাবে বলা হয়।" [৫]

ইতিহাস[সম্পাদনা]

১০,৫০০ - ১০,১০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে মানুষ কৃত্রিম নির্বাচন প্রক্রিয়ায় প্রাণী পোষ মানানোর মাধ্যমে খাদ্যের বংশগতীয় পরিবর্তন আনা শুরু করে। : পছন্দসই বংশগতীয় বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন জীবের মাঝে প্রজনন ঘটিয়ে কাঙ্ক্ষিত বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন জীবের সংখ্যাবৃদ্ধিতে বাছাই প্রজননের প্রক্রিয়া ব্যবহার করা হত। যা আধুনিক জিনগত পরিবর্তন পদ্ধতির প্রধান ধারণা।[৯] : [১০] : ১৯ শতক এর শুরুর দিকে ডিএনএ আবিষ্কার এবং ৭০ দশকের মধ্যে জিনগত কৌশলগুলির বিভিন্ন অগ্রগতির ফলে [১১] খাবারের মধ্যে সরাসরি ডিএনএ এবং জিনের পরিবর্তন আনা সম্ভব হয়।

জিনগতভাবে পরিবর্তিত অনুজীবিয় এনজাইম জিনগতভাবে পরিবর্তিত প্রথম কোনো জীব যা ১৯৮৮ সালে মার্কিন খাদ্য ও ঔষধ প্রশাসন থেকে অনুমোদন লাভ করে। [১২] নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে, রিকম্বিন্যান্ট কাইমোসিন বেশ কয়েকটি দেশে ব্যবহারের জন্য অনুমোদিত হয়েছিল। [১৩] পনির সাধারণত জটিল এনজাইম রেনেট ব্যবহার করে তৈরি করা হত । এই এনজাইম গরুর পেটের আস্তরণ থেকে বের করা হতো। বিজ্ঞানীরা কিমোসিন এনজাইম তৈরি করতে ব্যাকটেরিয়াতে পরিবর্তন এনেছিলেন, যা দুধ জমিয়ে পনিরের দই তৈরি করতে পারতো। [১৪]

১৯৯৪ সালে প্রথম কোনো কৃষিজাত জিএম শস্য হুসেবে ফ্লাভ্র সাভর নাম্নী টমেটো অনুমোদন পায়। ক্যালজিন টমেটো দেরিতে পাকার জন্য একটি এন্টিসেন্স বংশাণু প্রবেশ করে জিনপ্রকৌশল ব্যবহার করেছিলো।[১৫] সবার প্রথম চীন ভাইরাস প্রতিরোধী তামাক ট্রান্সজেনিক ফসল হিসেবে বাজারে ছাড়ে। ১৯৯৩ সালের এই তামাক দ্বারা চীন টোবাকো ভাইরাস প্রতিরোধে সক্ষম এমন জাতের তামাক বাজারে নিয়ে আসে।[১৬][১৭] ২০০০ সালে স্বর্ণ ধান তৈরির মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা প্রথমবারের জন্য খাদ্যপুষ্টির মান বাড়ানোর জন্য জিনগতভাবে খাদ্যে পরিবর্তন এনেছিলেন।[১৮] ২০১৪ সালে বিটি বেগুন দিয়ে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম দেশ হিসেবে জিনগত পরিবর্তিত শস্য দেশের কৃষিতে প্রবর্তন করে।[১৯]

প্রক্রিয়া[সম্পাদনা]

জিনগতভাবে পরিবর্তিত খাদ্য প্রস্তুতপ্রণালী একটি বহুধাপী প্রক্রিয়া। প্রথমেই একটি উপকারী বৈশিষ্ট্যসপন্ন জিন শনাক্ত করতে হয়। এই জিন একটি কোষ থেকে নেওয়া যেতে পারে [২০] বা কৃত্রিমভাবে সংশ্লেষকরা যায়। [২১] এরপর অন্য বংশগতীয় উপাদান প্রমোটার ও টার্মিনেটর অঞ্চলসহ, একটি শনাক্তকারী মার্কারের সাথে মেশানো হয়।[২২] তারপরে এসমস্ত বংশগতীয় উপাদানগুলি টার্গেট জিনোম বা জিনোমকে উদ্দেশ্য করা হয়েছে প্রথমে, সেটাতে প্রবেশ করা হয়। সাধারণত মাইক্রোইনজেকশন ব্যবহার করে প্রাণী কোষে ডিএনএ প্রবেশ করানো হয়, এই প্রক্রিয়ার জন্য ডিএনএ সরাসরি কোষের নিউক্লিয়াসে নিউক্লিয়ার খামের (nuclear envelope ) মাধ্যমে বা ইনজেকশনের মাধ্যমে ভাইরাল ভেক্টর ব্যবহার করা হয়। [২৩] উদ্ভিদের মধ্যে ডিএনএ প্রবেশের জন্য প্রায়ই ব্যবহার ঢোকানো হয় এগ্রোব্যক্টেরিয়াম-মেডিয়েটেড রিকম্বিনেশন,[২৪][২৫] বায়োলিস্টিক্স [২৬] বা ইলেক্ট্রোপরেশন পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। যেহেতু জিনগত পরিবর্তন একটি মাত্র কোষে সম্পাদন করা হয়, সেহেতু পূর্ণাঙ্গ জীবকে সেই কোষ থেকে রূপান্তরিত হ্তে হবে। উদ্ভিদের ক্ষেত্রে টিস্যু কালচার পদ্ধতিতে এ কাজ করা যায়। [২৭][২৮] প্রাণীদের ক্ষেত্রে নতুন সংযুক্ত করা জিনটি যে ভ্রুণীয় কোষে উপস্থিত তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। পিসিআর, ডিএনএ সিকোয়েন্সিং এর মতো প্রযুক্তি ব্যবহার করে নতুন জীব নকশাকৃত জিনবহন করছে কি না তা নিশ্চিত হওয়া যায়। [২৯]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. GM Science Review First Report ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ১৬ অক্টোবর ২০১৩ তারিখে, Prepared by the UK GM Science Review panel (July 2003). Chairman Professor Sir David King, Chief Scientific Advisor to the UK Government, P 9
  2. James, Clive (১৯৯৬)। "Global Review of the Field Testing and Commercialization of Transgenic Plants: 1986 to 1995" (পিডিএফ)। The International Service for the Acquisition of Agri-biotech Applications। সংগ্রহের তারিখ ১৭ জুলাই ২০১০ 
  3. Weasel, Lisa H. 2009. Food Fray. Amacom Publishing
  4. "Consumer Q&A"। FDA। ২০০৯-০৩-০৬। সংগ্রহের তারিখ ২০১২-১২-২৯ 
  5. World Health Organization। "Frequently asked questions on genetically modified foods"। সংগ্রহের তারিখ ২৯ মার্চ ২০১৬ 
  6. "Genetically engineered foods"। University of Maryland Medical Center। সংগ্রহের তারিখ ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৫ 
  7. "Glossary of Agricultural Biotechnology Terms"। United States Department of Agriculture। ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৩। সংগ্রহের তারিখ ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৫ 
  8. "Questions & Answers on Food from Genetically Engineered Plants"। US Food and Drug Administration। ২২ জুন ২০১৫। সংগ্রহের তারিখ ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৫ 
  9. Daniel Zohary; Maria Hopf (২০১২)। Domestication of Plants in the Old World: The Origin and Spread of Plants in the Old World। Oxford University Press। 
  10. Clive Root (২০০৭)। Domestication। Greenwood Publishing Groups। 
  11. Jackson, DA; Symons, RH (১ অক্টোবর ১৯৭২)। "Biochemical Method for Inserting New Genetic Information into DNA of Simian Virus 40: Circular SV40 DNA Molecules Containing Lambda Phage Genes and the Galactose Operon of Escherichia coli": 2904–09। ডিওআই:10.1073/pnas.69.10.2904পিএমআইডি 4342968পিএমসি 389671অবাধে প্রবেশযোগ্য 
  12. "FDA Approves 1st Genetically Engineered Product for Food"Los Angeles Times। ২৪ মার্চ ১৯৯০। সংগ্রহের তারিখ ১ মে ২০১৪ 
  13. Staff, National Centre for Biotechnology Education (২০০৬)। "Chymosin"। মে ২২, ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। 
  14. Campbell-Platt, Geoffrey (২৬ আগস্ট ২০১১)। Food Science and Technology। John Wiley & Sons। আইএসবিএন 978-1-4443-5782-0 
  15. Bruening, G.; Lyons, J. M. (২০০০)। "The case of the FLAVR SAVR tomato": 6–7। ডিওআই:10.3733/ca.v054n04p6অবাধে প্রবেশযোগ্য 
  16. James, Clive (২০১০)। "Global Review of the Field Testing and Commercialization of Transgenic Plants: 1986 to 1995: The First Decade of Crop Biotechnology"। ISAAA Briefs No. 1: 31। 
  17. Jazeera, Al। "Bangladesh's genetically modified eggplants 🍆"interactive.aljazeera.com (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৭-২০ 
  18. Ye, Xudong; Al-Babili, Salim (২০০০-০১-১৪)। "Engineering the Provitamin A (β-Carotene) Biosynthetic Pathway into (Carotenoid-Free) Rice Endosperm": 303–05। ডিওআই:10.1126/science.287.5451.303পিএমআইডি 10634784 
  19. "5-yr after releasing its first GM crop Bangladesh says farmers gain by adopting Bt brinjal"Dhaka Tribune। ২০১৯-০৩-০৭। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৭-২০ 
  20. Nicholl, Desmond S. T. (২০০৮-০৫-২৯)। An Introduction to Genetic Engineering। Cambridge University Press। পৃষ্ঠা 34। আইএসবিএন 9781139471787 
  21. Liang J, Luo Y, Zhao H (২০১১)। "Synthetic biology: putting synthesis into biology": 7–20। ডিওআই:10.1002/wsbm.104পিএমআইডি 21064036পিএমসি 3057768অবাধে প্রবেশযোগ্য 
  22. Berg P, Mertz JE (জানুয়ারি ২০১০)। "Personal reflections on the origins and emergence of recombinant DNA technology": 9–17। ডিওআই:10.1534/genetics.109.112144পিএমআইডি 20061565পিএমসি 2815933অবাধে প্রবেশযোগ্য 
  23. Chen I, Dubnau D (মার্চ ২০০৪)। "DNA uptake during bacterial transformation": 241–9। ডিওআই:10.1038/nrmicro844পিএমআইডি 15083159 
  24. National Research Council (US) Committee on Identifying and Assessing Unintended Effects of Genetically Engineered Foods on Human Health (২০০৪-০১-০১)। Methods and Mechanisms for Genetic Manipulation of Plants, Animals, and Microorganisms। National Academies Press (US)। 
  25. Gelvin SB (মার্চ ২০০৩)। "Agrobacterium-mediated plant transformation: the biology behind the "gene-jockeying" tool": 16–37, table of contents। ডিওআই:10.1128/MMBR.67.1.16-37.2003পিএমআইডি 12626681পিএমসি 150518অবাধে প্রবেশযোগ্য 
  26. Head, Graham; Hull, Roger H (২০০৯)। Genetically Modified Plants: Assessing Safety and Managing Risk। Academic Pr। পৃষ্ঠা 244আইএসবিএন 978-0-12-374106-6 
  27. Tuomela M, Stanescu I, Krohn K (অক্টোবর ২০০৫)। "Validation overview of bio-analytical methods": S131–8। ডিওআই:10.1038/sj.gt.3302627অবাধে প্রবেশযোগ্যপিএমআইডি 16231045 
  28. Narayanaswamy S (১৯৯৪)। Plant Cell and Tissue Culture। Tata McGraw-Hill Education। পৃষ্ঠা vi। আইএসবিএন 9780074602775 
  29. Setlow, Jane K. (২০০২-১০-৩১)। Genetic Engineering: Principles and Methods। Springer Science & Business Media। পৃষ্ঠা 109। আইএসবিএন 9780306472800