তাম্রশাসন
তাম্রশাসন হলো মূলত তামার পাত বা তাম্রপট্টে খোদিত ভারতবর্ষীয় রাজাদের জারিকৃত আইনের লিখিত দলিল।[১]
দাতার সিলযুক্ত বলয়সহ তাম্রশাসন সম্পত্তি প্রদান বা বিতরণের রাজকীয় আইনি নথি হিসেবে চিহ্নিত হতো। সম্ভবত সম্পত্তি বা অধিকার দাবির ক্ষেত্রে এই শাসনগুলোর প্রয়োজন হতো।[১] এ কারণে নতুন স্থানে বসতি স্থাপনের ক্ষেত্রে তাম্রফলকগুলোর পুনরুদ্ধারযোগ্যতা গুরুত্বপূর্ণ ছিল[২] এবং ফলকগুলোতেও সম্পত্তির শর্তাদি এবং করসংক্রান্ত আদেশ সবিস্তারে লেখা থাকত।[১] এইসব দলিলপত্রে জমির অবস্থান, অবস্থা,বৈশিষ্ট্য এবং আশেপাশে থাকা অনেক বস্তু থেকে তখনকার মানুষের সামাজিক বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের ধারনা পাওয়া যায়। এইসব তাম্রশাসন পাঠোদ্ধারের মাধ্যমে ইতিহাসবিদগন প্রতিনিয়ত উপকৃত হন।
ইতিহাস
[সম্পাদনা]দক্ষিণ ভারতে প্রাপ্ত অধিকাংশ তাম্রফলকে উৎকীর্ণ লিপি বা তাম্রশাসনগুলোতেই ভূমি দান বা রাজকীয় সিলমোহরসহ রাজ পরিবারের বংশপরিক্রমার উল্লেখ করা হয়েছে। প্রাচীনকালে সাধারণত তালপাতায় লিখে নথি সংরক্ষণ করা হলেও রাজকীয় আদেশসংক্রান্ত নথিসমূহ, যেমন রাজার দানপত্র বা উল্লেখযোগ্য কর্মসমূহ গুহায় বা মন্দিরের দেয়ালে এবং উল্লেখযোগ্যভাবে, তামার পাতে খোদাই করে রাখা হতো। খোদিত তাম্রপাতগুলো পাথরের চাঁইয়ের নিচে, মন্দিরের দেয়াল বা ভিত্তির পেছনে ইত্যাদি সুরক্ষিত জায়গায় লুকিয়ে রাখা হতো। এই দানসমূহ কোনো কারণে বাতিল করা হলে পাতগুলো পুনর্বার ব্যবহৃত হতো। সম্ভবত খ্রিষ্টীয় প্রথম সহস্রাব্দ থেকেই এভাবে তামার পাতে খোদাই করে নথি সংরক্ষণ প্রচলিত হয়।
ভারতে প্রাপ্ত সবচেয়ে পুরনো খোদিত তাম্রফলকের নমুনাটি পরিণত হরপ্পা যুগের। ফলকটিতে ৩৪টি অক্ষর ছিল। ধারণা করা হয়, ফলকটি লেখার ছাঁচ হিসেবে ব্যবহৃত হতো।[৩]
পরবর্তীতে ব্রাহ্মী লিপিতে লেখা সোহগৌরা তাম্রলিপি, এবং খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকের মৌর্যদের তাম্রলিপির ক্ষেত্রে অগ্রদূত ধরা হয়।[৪] যদিও, সোহগৌরা লিপিটি তামার সংকর ব্রোঞ্জের ওপর লিখিত।[৫] তক্ষশিলা ও কালাওয়ানে প্রাপ্ত তাম্রফলকগুলোই (খ্রিষ্টীয় প্রথম শতক বা তার পূর্বের) ভারতবর্ষে সরাসরি তামার পাতে লেখার সবচেয়ে পুরনো উদাহরণ। কিন্তু এই পাতগুলো পরবর্তী যুগের তাম্রশাসনের মতো শাসন জারির জন্য ব্যবহৃত হয়নি।[৬]
খ্রিষ্টীয় তৃতীয় শতাব্দীর ইক্ষবাকু রাজা ইহুবালা চামতামুলা জারিকৃত পাতগণ্ডিগুড়েম শাসনটিই ভারতবর্ষে আবিষ্কৃত প্রথম তাম্রশাসনের নমুনা। আবার ইতিহাসবিদদের মতে, উত্তর ভারতের সবচেয়ে পুরনো তাম্রশাসনটি হলো ঈশ্বররতের কলাচল দানপত্র, যা চতুর্থ শতাব্দীর শেষ ভাগে জারি করা হয়।[৭]
খ্রিষ্টীয় চতুর্থ শতাব্দীর দিকে পহ্লব বংশের জারিকৃত সংস্কৃত ও প্রাকৃত ভাষায় লিখিত শাসনগুলো তাম্রশাসনের আদি নিদর্শনগুলোর অন্যতম। পশ্চিম গঙ্গ রাজ্যের তুম্বুলা লিপিটি সংস্কৃত ভাষায় লেখা হলেও জমির সীমানা নির্দেশ করতে এতে কন্নড় লিপি ব্যবহৃত হয়েছে। ২০০৪ সালে প্রকাশিত ভারতীয় গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী লিপিটি ৪৪৪ সালে লেখা।[৮] এছাড়াও উত্তর ভারতে গুপ্ত যুগের বিরল তাম্রশাসন আবিষ্কৃত হয়েছে। এই সময়ে তাম্রশাসনের ব্যবহার ব্যাপক বৃদ্ধি পায় এবং পরবর্তী কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত প্রধান রাজকীয় নথি হিসেবে ব্যবহৃত হয়।[৯]
অধিকাংশ জমি অনুদান সংক্রান্ত তাম্রশাসনগুলোতে একক বা সমষ্টিগতভাবে ব্রাহ্মণদের জমি দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি শাসনের সাধারণ কাঠামো অনুযায়ী প্রথমে জমি দানকারী রাজা ও তাঁর উত্তরপুরুষদের প্রশংসা বা স্তুতি, দীর্ঘ সম্মানিক নাম, বীরত্বগাথা ও ব্যক্তিগত মহানুভবতার দীর্ঘ বর্ণনা করা হয়। এরপর কারণসহ ভূমি অনুদানের বর্ণনা, সীমানা, প্রাপক এবং সবশেষে শাসনের ব্যত্যয়ের অপরাধ ও শাস্তির বর্ণনা করা হয়। যদিও শাসনগুলোতে সম্মানিক পদের অত্যুক্তি থাকে, তবুও এগুলো ইতিহাস উদঘাটনে অত্যন্ত সহায়ক।[৯][১০]
তিরুমালার বেঙ্কটেশ্বর মন্দিরে এখন পর্যন্ত তেলুগু ভাষায় লিখিত প্রায় ৩০০০ তাম্রশাসনের সবচেয়ে সমৃদ্ধ নিদর্শন পাওয়া গেছে। তাম্রশাসনগুলোতে তল্লাপাকা অন্নামাচার্য ও তাঁর উত্তরপুরুষদের বর্ণনামূলক সংকীর্তন উৎখোদিত হয়েছে।[১১]
তামিল তাম্রশাসন
[সম্পাদনা]তামিল তাম্রশাসন হলো মূলত তামিল ভাষায় লিখিত তামার পাতে খোদাই করা কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্যে ভূমিবণ্টন, ভূমি প্রদান বা বিশেষ সুবিধা প্রদান করে প্রাচীন দক্ষিণ ভারতীয় রাজ্যসমূহ কর্তৃক জারিকৃত তাম্রশাসন।[১২] তামিল নাড়ুর ইতিহাস বিশ্লেষণে এই শাসনগুলোর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করে।[১৩] শাসনগুলো খ্রিষ্টীয় ১০ম শতাব্দী থেকে ১৯শ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত জারি করা হয়েছিল। এগুলোর অধিকাংশ চালুক্য, চোল ও বিজয়নগর সাম্রাজ্যের রাজারা জারি করেন। এই শাসনগুলো মধ্যযুগীয় দক্ষিণ ভারতের সামাজিক অবস্থা সম্পর্কে ধারণা দেয়, এবং একই সাথে রাজবংশগুলোর শাসনকাল, রাজাদের পরম্পরাগত পরিচয় দান করে, যার মাধ্যমে ঐতিহাসিক অসম্পূর্ণতা লুপ্ত হয়। উদাহরণস্বরূপ, ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ সুন্দর চোলের লেইডেন দানপত্র (নেদারল্যান্ডসের লেইডেন জাদুঘরে সংরক্ষিত হওয়ায় এরূপ নামকরণ) ও উত্তম চোলের দানপত্রের নাম করা যায়। যদিও দানপত্রের পরবর্তী অংশ বা সবচেয়ে গুরুত্ববাহী অংশটিই (বিশেষ করে বংশানুক্রম অংশ) খুঁজে পাওয়া যায় না।
-
প্রথম পাতের সম্মুখ ও পশ্চাৎ অংশ
-
দ্বিতীয় পাত[১৪]
পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলোর তুলনায় তামিলনাড়ুর আদি তাম্রশাসনগুলো সংস্কৃত ভাষায় লেখা হয়নি, বরং এগুলোতে প্রাকৃত ভাষার সাথে তামিল ভাষা ব্যবহৃত হয়েছে।[১৫] দ্রাবিড় ভাষাসমূহের মধ্যে তামিল ভাষার সাহিত্য অনেক বিস্তৃত। তাই এই ভাষা ও সাহিত্যের আরম্ভ কোথায় হয়েছে, তা জানা যায় না। প্রাচীন ভারতের সাহিত্যগুলো তালপাতার পুঁথি আকারে (বারংবার মূল থেকে নকল করে ও পুনরায় নকল থেকে নকল করে) অথবা মৌখিকভাবে বংশপরম্পরায় বাহিত হয়েছে, যার ফলে ভারতীয় সাহিত্যের আরম্ভকাল সরাসরি স্থির করা প্রায় অসম্ভব।[১৬] রাজবংশীয় ধারাপরম্পরা ও ভাষাগত বৈশিষ্ট্য থেকে থেকে ধারণা করা হয়, এগুলো খ্রিষ্টপূর্ব ৪র্থ শতক থেকে খ্রিষ্টীয় ৩য় শতকের মধ্যে প্রণীত।[১৭][১৮][১৯] খ্রিষ্টপূর্ব ৩য় শতকে ব্রাহ্মী লিপির সম্প্রসারিত রূপ তামিল-ব্রাহ্মী লিপির মাধ্যমে লিপিকর্মে তামিল ভাষার প্রচলন শুরু হয়।[২০][২১] এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত তামিল ভাষার সবচেয়ে পুরনো নিদর্শন হলো তোলকাপ্পিয়াম নামক তালপাতার পুঁথি, যার লিখন কাল খ্রিষ্টপূর্ব ৫ম শতাব্দী থেকে খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দী পর্যন্ত। এই পুঁথিতে ধ্রুপদী যুগের তামিল ভাষার কিছু কবিতা ও ব্যাকরণ আলোচনা করা হয়েছে। এ থেকে সে যুগের তামিল ভাষার ধারণা পাওয়া যায়।
দানপত্র
[সম্পাদনা]ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাস বিশ্লেষণে তামার পাতে খোদিত দানপত্র (তাম্রশাসন বা তাম্রপত্র; তাম্র সংস্কৃত শব্দ, যার অর্থ তামা) খুবই গুরুত্ববাহী উৎস। তামা সাধারণত নষ্ট বা ক্ষয়প্রাপ্ত হয় না এবং শতাব্দীর পর শতাব্দী টিকে থাকে।
তাম্রশাসন ও শিলালিপিতে উৎকীর্ণ বিষয়বস্তুসমূহ বিগত শতাব্দীতে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া কর্তৃক সমন্বিত আকারে প্রকাশ করা হয়েছে।
তাম্রশাসনের সাধারণ আকার হলো ৯৩⁄৪ ইঞ্চি লম্বা × ৩১⁄৪ ইঞ্চি উঁচু × ১/১০ (থেকে ১/১৬) ইঞ্চি পুরু।
মৌর্য যুগের সোহগৌরা তাম্রশাসনে, যেটি এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত সবচেয়ে পুরনো তাম্রশাসন, দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধের তৎপরতার বর্ণনা করা আছে। এটি অশোক-পূর্ব যুগের ব্রাহ্মী লিপিতে লেখা সামান্য কিছু লিপিকর্মের অন্যতম।[২২]
আরও দেখুন
[সম্পাদনা]তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ ক খ গ Thapar, Romila, The Penguin History of Early India: From the Origins to AD 1300. Penguin Books, 2002. 295-96 and 339.
- ↑ Thapar, Romila, The Penguin History of Early India: From the Origins to AD 1300. Penguin Books, 2002. 409.
- ↑ Shinde, Vasant; Willis, Rick J. (৮ অক্টোবর ২০১৪)। "A New Type of Inscribed Copper Plate from Indus Valley (Harappan) Civilisation"। Ancient Asia। 5। ডিওআই:10.5334/aa.12317 । ২১ জুলাই ২০১৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৪ আগস্ট ২০২০।
- ↑ F. R. Allchin; George Erdosy (১৯৯৫)। The Archaeology of Early Historic South Asia: The Emergence of Cities and States। Cambridge University Press। পৃষ্ঠা 212–215। আইএসবিএন 978-0-521-37695-2।
- ↑ D. C. Sircar 1996, পৃ. 79।
- ↑ D. C. Sircar 1996, পৃ. 107।
- ↑ Emmanuel Francis (২০১৮)। "Indian Copper-Plate Grants: Inscriptions or Documents?"। Alessandro Bausi; Christian Brockmann; Michael Friedrich; Sabine Kienitz। Manuscripts and Archives: Comparative Views on Record-Keeping। De Gruyter। পৃষ্ঠা 389। আইএসবিএন 978-3-11-054139-7।
- ↑ N. Havalaiah (২০০৪-০১-২৪)। "Ancient inscriptions unearthed"। The Hindu, Saturday, Jan 24, 2004। Chennai, India: The Hindu। ২০০৪-০২-১৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৬-১১-২৫।
- ↑ ক খ Keay, John (২০০০)। India: A History। New York: Grove Press। পৃষ্ঠা 155–157। আইএসবিএন 0-8021-3797-0।
- ↑ "Nature and Importance of Indian Epigraphy"। ২০০৭-০৯-২৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৭-০৩-১৬।
- ↑ Epigraphical lore of Tirupati published in Saptagiri magazine. ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২০০৩-০২-১৬ তারিখে
- ↑ "Nature and Importance of Indian Epigraphy - Chapter IV"। ২০০৭-০৯-২৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৭-০৩-১৪।
- ↑ "History and Culture of Tamil Nadu : As Gleaned from the Sanskrit Inscriptions"। সংগ্রহের তারিখ ২০০৭-০৩-১৪।
- ↑ Rice, Benjamin Lewis (১৮৯৪)। Epigraphia Carnatica: Volume IX: Inscriptions in the Bangalore District। Mysore State, British India: Mysore Department of Archaeology। সংগ্রহের তারিখ ৫ আগস্ট ২০১৫।
- ↑ Caldwell, Robert (১৮৭৫)। A comparative grammar of the Dravidian or South-Indian family of languages। Trübner & co। পৃষ্ঠা 88।
In southern states, every inscription of an early date and majority even of modern-day inscriptions were written in Sanskrit...In the Tamil country, on the contrary, all the inscriptions belonging to an early period are written in Tamil with some Prakrit
- ↑ Dating of Indian literature is largely based on relative dating relying on internal evidences with a few anchors. I. Mahadevan’s dating of Pukalur inscription proves some of the Sangam verses. See George L. Hart, "Poems of Ancient Tamil, University of Berkeley Press, 1975, p.7-8
- ↑ George Hart, "Some Related Literary Conventions in Tamil and Indo-Aryan and Their Significance" Journal of the American Oriental Society, 94:2 (Apr-Jun 1974), pp. 157-167.
- ↑ Kamil Veith Zvelebil, Companion Studies to the History of Tamil Literature, pp12
- ↑ Nilakanta Sastri, K.A. (1955). A History of South India, OUP, New Delhi (Reprinted 2002)
- ↑ "Tamil"। The Language Materials Project। UCLA International Institute, UCLA। ২০০৭-১০-১১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৭-০৩-২৫।
- ↑ Iravatham Mahadevan (2003). Early Tamil Epigraphy from the Earliest Times to the Sixth Century A.D. Cambridge, Harvard University Press.
- ↑ Thapar, Aśoka and the Decline of the Mauryas,2014, pp. 10
আরও পড়ুন
[সম্পাদনা]- D. C. Sircar (১৯৯৬)। Indian Epigraphy। Motilal Banarsidass। আইএসবিএন 978-81-208-1166-9।