দেবেন্দ্র মোহন বসু

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
দেবেন্দ্র মোহন বসু
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য বিজ্ঞানীদের সাথে দেবেন্দ্র মোহন বসু (দাঁড়ানো, বাম থেকে তৃতীয়)
জন্ম২৬ নভেম্বর ১৮৮৫
মৃত্যু২ জুন ১৯৭৫
জাতীয়তাভারতীয়
পেশাশিক্ষাবিদ, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক
আত্মীয়জগদীশ চন্দ্র বসু (মামা)

দেবেন্দ্র মোহন বসু (২৬ নভেম্বর ১৮৮৫, কিশোরগঞ্জ - ২ জুন ১৯৭৫) একজন বাঙালি পদার্থবিজ্ঞানী ছিলেন। মহাজাগতিক রশ্মি, পারমাণবিক ও নিউক্লিয়ার পদার্থবিদ্যার গবেষণায় তার অবদান অপরিসীম। [১] তিনিই প্রথম ফটোগ্রাফিক ইমালশন পদ্ধতিতে মেসনের এর ভর নির্ণয় করেছিলেন। তার পদ্ধতি অনুরসণ করে মেসনের ভর নির্ণয়ের জন্য ১৯৫০ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন ব্রিটিশ বিজ্ঞানী সিসিল ফ্রাঙ্ক পাওয়েল (Cecil Frank Powell)। বিখ্যাত বিজ্ঞানী স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু ছিলেন তার আপন মামা।

শৈশব ও শিক্ষাজীবন[সম্পাদনা]

বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জ জেলার ইটনা থানার জয়সিদ্ধি গ্রামে ১৮৮৫ খ্রিষ্টাব্দে বিজ্ঞানী দেবেন্দ্র মোহন বসু জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম মোহিনী মোহন বসু। তিনি প্রথম ভারতীয় যিনি যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে উচ্চশিক্ষা লাভ করেন। রেংলার আনন্দ মোহন বসু তার সহোদর কাকা। বাল্যকালে পিতৃবিয়োগ ঘটলে মাতুল বিজ্ঞানী আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসুর সান্নিধ্যে ভারতে বসবাস করেন।[২] শৈশবে দেবেন্দ্রমোহনের আনুষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হয়েছিল একটি ব্রাহ্ম বালিকা বিদ্যালয়ে। বালিকা বিদ্যালয় হলেও এতে প্রাথমিক স্তর পর্যন্ত সহশিক্ষা চালু ছিল। এরপর তিনি আনন্দমোহন বসু প্রতিষ্ঠিত সিটি কলেজিয়েট স্কুলে লেখাপড়া করেন এবং এ স্কুল থেকেই এন্ট্রান্স পাশ করেছেন। ১৯০১ খ্রিষ্টাব্দে তার পিতার মৃত্যু হয়। এসময় তিনি অভিভাবক হিসেবে পেলেন বৈজ্ঞানিক জগদীশচন্দ্র বসুকে। এন্ট্রান্স পাশ ক'রে দেবেন্দ্রমোহন প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন। কিন্তু পিতার মৃত্যুর পর দ্রুত জীবিকা অর্জনের তাগিদে ভর্তি হলেন শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে, প্রকৌশলী হওয়ার লক্ষ্য নিয়ে। এ সময় তিনি ছাত্রাবাসে অবস্থান করতেন। কিছুদিন পর ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে তাকে বাড়ী ফরেঁ আসতে হয় ; আর তার শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ফিরে যাওয়া হয় নি। এসময় কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পরামর্শ দিলেন মামা জগদীশচন্দ্রের মত পদার্থবিজ্ঞান পড়তে। দেবেন্দ্রমোহন পুনরায় প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হলেন পদার্থবিদ্যা আর ভূতত্ত্ব নিয়ে। যথাসময়ে প্রথম শ্রেণী সহ বিএসসি পাস করলেন। ১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দে এমএসসি পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হলেন;- জগদীশচন্দ্র বসু তখন বায়োফিজিক্স ও প্ল্যান্ট ফিজিওলজি নিয়ে গবেষণা করছেন। দেবেন্দ্র মোহন যোগ দিলেন জগদীশচন্দ্রের রিসার্চ গ্রুপে শিক্ষানবিশ গবেষক হিসেবে [3]। ১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দে দেবেন্দ্র মোহন ইংল্যান্ডে গিয়ে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রাইস্ট কলেজে ভর্তি হলেন। এখানে তিনি ক্যাভেনডিশ ল্যাবে স্যার জে জে থমসন ও চার্লস উইলসনের সাথে কাজ করার সুযোগ লাভ করলেন। ১৯০৮ থেকে ১৯১১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ক্যাভেন্ডিশ ল্যাবে কাজ করেছেন দেবেন্দ্রমোহন। ১৯১০ খ্রিষ্টাব্দে দেবেন্দ্রমোহন লন্ডনের রয়েল কলেজ অব সায়েন্সে ভর্তি হলেন। ১৯১২ খ্রিষ্টাব্দে এখান থেকেই ডিপ্লোমা ও প্রথম শ্রেণীর অনার্স সহ বিএসসি ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। [৩]

কর্মজীবন[সম্পাদনা]

১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতায় ফিরে এলেন দেবেন্দ্রমোহন। দেবেন্দ্রমোহন পদার্থবিজ্ঞানের প্রভাষক হিসেবে যোগ দিলেন সিটি কলেজে। ১৮৭৮ খ্রিষ্টাব্দে এই কলেজটি স্থাপন করেছিলেন তার কাকা আনন্দমোহন বসু। সিটি কলেজে বেশিদিন ছিলেন না দেবেন্দ্রমোহন। ১৯১৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞান কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। দেবেন্দ্রমোহন নব-প্রতিষ্ঠিত সায়েন্স কলেজে পদার্থবিজ্ঞানের ‘রাসবিহারী ঘোষ প্রফেসর’ পদে যোগ দেন। বিজ্ঞান কলেজে যোগ দিয়েই উচ্চশিক্ষার জন্য ‘ঘোষ ভ্রমণ বৃত্তি’ পেলেন দেবেন্দ্রমোহন। ১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দে রওনা দিলেন ইউরোপ। ভর্তি হলেন বার্লিনের হামবোল্ড ইউনিভার্সিটিতে। দু’বছর পড়াশোনা ও গবেষণা করলেন প্রফেসর এরিখ রিগনারের গবেষণাগারে। রিগনার দেবেন্দ্রমোহনকে কাজ দিলেন নতুন একটা ক্লাউড চেম্বার তৈরি করে আলফা ও বিটা কণিকার গতিপথ শনাক্ত করার [৪] দেবেন্দ্রমোহন তৈরি করলেন ক্লাউড চেম্বার। হাইড্রোজেন গ্যাস দিয়ে ভর্তি করা হলো চেম্বার। এরপর চেম্বারে পাঠানো হলো আলফা-কণার স্রোত। এই আলফা-কণা হাইড্রোজেন থেকে ইলেকট্রনকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো। ঋণাত্মক চার্জের ইলেকট্রন হারিয়ে হাইড্রোজেন হয়ে পড়লো ধনাত্বক চার্জের প্রোটন। এই প্রোটনের গতিপথ শনাক্ত করতে সমর্থ হলেন দেবেন্দ্রমোহন। এখান ত্থেকে এরকম কণার মধ্যে সংঘর্ষের ফলে যে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া হয় তার একটা হিসেব পাওয়া গেল। এই কাজ দিয়েই পি-এইচ-ডি থিসিস লিখে ফেললেন দেবেন্দ্রমোহন। কিন্তু ততদিনে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে ইউরোপে। যুদ্ধের কারণে থিসিস জমা দিতে পারলেন না তিনি। পাঁচ বছর তাকে জার্মানিতে থাকতে হলো। প্রোটনের গতিপথ সনাক্তকরণের ওপর দেবেন্দ্রমোহন বসুর প্রথম বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় ১৯১৬ সালে – জার্মানির Physikalische Zeitschrift এ [6]। ১৯১৯ সালের মার্চ মাসে পিএইচডি সম্পন্ন করে ভারতে ফিরে আসেন দেবেন্দ্রমোহন। যোগ দিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তার আগের পদে। ‘রাসবিহারী ঘোষ প্রফেসর’ পদে তিনি ছিলেন ১৯৩৫ সাল পর্যন্ত। ১৯৩৫ সালে সি ভি রমন ব্যাঙ্গালোরের ইনস্টিটিউট অব সায়েন্সের পরিচালক পদে যোগ দিলে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘পালিত প্রফেসর’র পদ খালি হয়। দেবেন্দ্রমোহন ‘ঘোষ প্রফেসর’ পদ ছেড়ে ‘পালিত প্রফেসর’ পদে যোগ দিলেন। তিন বছর ছিলেন তিনি এই পদে।

কৃত্রিম তেজস্ক্রিয়তা[সম্পাদনা]

১৯২৩ সালে দেবেন্দ্রমোহন তার গবেষক ছাত্র এস কে ঘোষকে সাথে নিয়ে ক্লাউড চেম্বারে কৃত্রিম তেজস্ক্রিয়তা নিয়ে কাজ শুরু করলেন। হিলিয়াম গ্যাসের মধ্যে পোলোনিয়াম থেকে উৎসরিত আলফা কণার গতিপথ পর্যবেক্ষণ করেন এবং নিউক্লিয়াস ও ইলেকট্রনের গতিপথের ছবি তোলেন। ছবিতে ধরা পড়লো যে নাইট্রোজেন নিউক্লিয়াস বিয়োজিত হয়েছে। বিখ্যাত নেচার সাময়িকীতে প্রকাশিত হলো তাদের তোলা ছবি ও গবেষণাপত্র [10]। আন্তর্জাতিক মহলে সাড়া পড়ে গেল।

চৌম্বকত্ব[সম্পাদনা]

চৌম্বকত্বের গবেষণাতেও প্রচুর উল্লেখযোগ্য অবদান আছে দেবেন্দ্রমোহনের। গটিনগেন ইউনিভার্সিটির প্রফেসর হুন্ড (F. Hund) পরমাণুর চৌম্বক ভ্রামক (magnetic moment) হিসেব করার একটি পদ্ধতি আবিষ্কার করেন [14]। দেবেন্দ্রমোহন দেখলেন হুন্ডের পদ্ধতি বিরল মৃত্তিকা গ্রুপের ত্রিযোজী ও চতুর্যোজী মৌলের ক্ষেত্রে সঠিকভাবে কাজ করলেও আয়রন গ্রুপের কোন আয়নের ক্ষেত্রেই সঠিক ভাবে কাজ করে না। তিনি বিখ্যাত নেচার সাময়িকীতে লিখে জানালেন এ কথা [15]। নতুন একটা পদ্ধতি আবিষ্কার করলেন দেবেন্দ্রমোহন যা হুন্ডের পদ্ধতির চেয়েও অনেক বেশি কার্যকর। ১৯২৭ সালে দেবেন্দ্রমোহনের এই গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে বিখ্যাত জার্মান সাময়িকী Zeitschrift fur Physik তে [16]। সে বছর লাহোরে অনুষ্ঠিত ইন্ডিয়ান সায়েন্স কংগ্রেসে চৌম্বকত্বের সাম্প্রতিক গবেষণা বিষয়ে বক্তৃতা করেন দেবেন্দ্রমোহন। চৌম্বকত্বের গবেষণায় ভারতে অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠেন দেবেন্দ্রমোহন। ফলে বিখ্যাত ‘কোমো কনফারেন্স’ এ চৌম্বকত্বের ওপর বক্তৃতা দেয়ার আমন্ত্রণ পান দেবেন্দ্রমোহন। তার বক্তৃতার বিষয় ছিল বিষয় ছিল – “On the magnetic moments of ions of the transitional group of elements”। জটিল যৌগের চৌম্বকধর্ম নিয়ে পরীক্ষা করার সময় (১৯২৯) স্টোনারের তত্ত্বে (E. C. Stoner) ত্রুটি দেখতে পেয়ে সংশোধন করেন তিনি। স্টোনারের সূত্র তার সংশোধনী সহ পরিণত হয় ‘বোস-স্টোনার’ তত্ত্বে [৫]

নোবেল মনোনয়ন কমিটি[সম্পাদনা]

১৯২৯ সালে নোবেল পুরস্কার মনোনয়ন কমিটি দেবেন্দ্রনাথ বসুর কাছ থেকে ১৯৩০ সালের পদার্থবিজ্ঞান/রসায়নে নোবেল পুরস্কারের জন্য যোগ্য ব্যক্তির মনোনয়ন আহ্বান করেন। দেবেন্দ্রনাথ পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কারের জন্য মেঘনাদ সাহার নাম প্রস্তাব করেছিলেন [৬]

বসু বিজ্ঞান মন্দির পরিচালনা[সম্পাদনা]

জগদীশচন্দ্র বসুর মৃত্যুর পর কলকাতার বসু বিজ্ঞান মন্দিরের পরিচালনার ভার এসে পড়ে দেবেন্দ্রমোহনের ওপর। ১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি বসু বিজ্ঞান মন্দিরের পরিচালক নিযুক্ত হন। ১৯৬৭ পর্যন্ত তিনি বসু বিজ্ঞান মন্দির পরিচালনা করেন। এসময় দেবেন্দ্রমোহন নতুন নতুন বিভাগ খুলে প্রতিষ্ঠানের শিক্ষাপ্রদান ও গবেষণামূলক কাজের ব্যাপক প্রসার ঘটান।

বিভা চৌধুরীর সাথে গবেষণা[সম্পাদনা]

১৯৩৮ সালের একটি সায়েন্স কনফারেন্সে গিয়ে জার্মান নিউক্লিয়ার পদার্থবিজ্ঞানী ওয়ালথার বোথের (১৯৫৪ সালে বোথে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন) সাথে আলাপের পর ফটোগ্রাফিক প্লেটের ওপর কসমিক রে বা মহাজাগতিক রশ্মির প্রভাব বিষয়ক গবেষণার উৎসাহ জাগে দেবেন্দ্রমোহনের। সহকর্মী বিভা চৌধুরির সাথে গবেষণা শুরু করলেন। তখনো পার্টিক্যাল এক্সিলারেটর আবিষ্কৃত হয় নি। ফলে অব-পারমাণবিক (সাব-এটমিক) কণার একমাত্র উৎস সূর্য। ওয়ালথার বোথে তাদের পরামর্শ দিলেন ফটোগ্রাফিক ইমালশনকে ক্লাউড চেম্বারে ডিটেক্টর হিসেবে ব্যবহার করে তার ওপর মহাজাগতিক রশ্মির গতিপথের ছাপ পড়ে কি না দেখতে। ফটোগ্রাফিক প্লেট ব্যবহার করলে তার ওপর স্থায়ী ছাপ আশা করা যায়। ১৯৩৯-১৯৪২ সালের মধ্যে দেবেন্দ্রমোহন ও বিভা চৌধুরি দার্জিলিং এর পাহাড়ে গিয়ে ইলফোর্ড হাফ-টোন ফটোগ্রাফিক প্লেটের ওপর দিনের পর দিন সূর্যালোকের বিচ্ছুরণ ঘটান। প্লেটের ওপর লম্বা বক্রাকার আয়নিত গতিপথ দেখতে পান। তারা ব্যাখ্যা করে দেখান যে এগুলো প্রোটনের ট্র্যাক বা আলফা কণিকার ট্র্যাক থেকে ভিন্ন। তবে নিশ্চয় এরা অব-পারমাণবিক কণা ‘মেসোট্রন’ এর গতিপথ। তাদের ফলাফল প্রকাশিত হয় বিখ্যাত ‘নেচার’ সাময়িকীতে [23]। কিন্তু গতিপথগুলোকে তারা ঠিকমত বুঝতে পারছিলেন না। তারা আরো পরীক্ষা করার জন্য ফটোগ্রাফিক প্লেটগুলোকে এক নাগাড়ে ২০২ দিন সূর্যালোকে রেখে দিলেন। কিন্তু উচ্চ-শক্তির প্রোটন কণার গতিপথ দেখলেন না। তাদের গবেষণা এতই চাঞ্চল্যকর ছিল যে ‘নেচার’ সাময়িকীতে তা ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হতে থাকে [৭] দেবেন্দ্রমোহন ও বিভা চৌধুরির গবেষণার প্রতি সবার এত আগ্রহের কারণ হলো অব-পারমাণবিক কণা ‘মেসোট্রন’ বা ‘মেসন’ এর আবিষ্কারের প্রত্যাশা। জাপানী পদার্থবিজ্ঞানী হাইডেকি ইউকাওয়া ১৯৩৫ সালে (নোবেল পুরস্কার ১৯৪৯) তত্ত্বীয় ভাবে প্রমাণ করেছেন যে নিউক্লিয়ার বলের আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে কিছু নতুন ধরনের কণা বিনিময় হয় – যে গুলোকে ইউকাওয়া নাম দিয়েছেন এক্সচেঞ্জ পার্টিক্যাল (বিনিময়-কণা)। এই কণাগুলোর ভর হতে হবে ইলেকট্রনের ভরের চেয়ে সামান্য বেশি – কিন্তু প্রোটনের ভরের চেয়ে অনেক কম। ইউকাওয়া হিসেব করে দেখিয়েছেন যে এ ধরনের অব-পারমাণবিক কণার ভর হবে ইলেকট্রনের ভরের ২৭০ গুণ (প্রোটনের ভর ইলেকট্রনের ভরের ১৮৪০ গুণ) [5]। এদের ভর ইলেকট্রনের ভর ও প্রোটনের ভরের মাঝামাঝি বলে এদের নাম দেয়া হয় ‘মেসোট্রন’ – গ্রিক ভাষায় যার অর্থ ‘মধ্যবর্তী’। ‘মেসোট্রন’ থেকে আরো সংক্ষিপ্ত হয়ে এদের নাম হয় ‘মেসন’।

ইতোমধ্যে ক্যালটেকের প্রফেসর কার্ল এন্ডারসন ইলেকট্রনের ভরের সমান ভর ও ধনাত্মক চার্জ বিশিষ্ট পজিট্রন আবিষ্কার করেছেন।। একই বছর তিনি আরেক ধরনের অব-পারমাণবিক কণা আবিষ্কার করে ভেবেছিলেন সেগুলো ইউকাওয়ার মেসন। কিন্তু দেখা গেলো এন্ডারসনের কণাগুলোর ভর ইলেকট্রনের ভরের ২০৭ গুণ। ইউকাওয়ার মেসনের ভর ইলেকট্রনের ২৭০ গুণ। এন্ডারসন তার কণাগুলোর নাম দিলেন ‘মিউ-মেসন’ বা সংক্ষেপে ‘মিউয়ন’।

দেবেন্দ্রমোহন ও বিভা চৌধুরি তাদের কণাগুলোর ভর হিসেব করে দেখলেন ইলেকট্রনের ভরের ১৬০ গুণ [25]। বুঝতে পারলেন কোথাও ভুল হচ্ছে। যে ফটোগ্রাফিক প্লেট ব্যবহার করছেন তা ‘হাফ-টোন’। কিন্তু যুদ্ধের বাজারে ভারতে বসে ‘ফুল-টোন’ প্লেট পাওয়া অসম্ভব। তবুও পরীক্ষণ পদ্ধতি যতটুকু সম্ভব নিখুঁত করে আবার পরীক্ষা করলেন। এবার কণাগুলোর ভর পাওয়া গেলো ইলেকট্রনের ভরের ১৮৬ গুণ [৮]। দেবেন্দ্রমোহন বুঝতে পারলেন আরো উন্নতমানের আরো স্পর্শকাতর ফটোগ্রাফিক প্লেট ছাড়া তাদের পরীক্ষা চালিয়ে যাওয়া অর্থহীন। আক্ষরিক অর্থেই অর্থের কারণে তারা কাঙ্ক্ষিত ফলাফল পেলেন না। ১৯৪৫ সালে বিভা চৌধুরি ইংল্যান্ডে চলে যান প্যাট্রিক ব্ল্যাকেটের সাথে কাজ করার জন্য। দেবেন্দ্রমোহন গবেষণা আর বেশিদূর চালিয়ে নিতে পারেন নি।

এদিকে ইংরেজ পদার্থবিদ সিসিল পাওয়েল দেবেন্দ্রমোহনের পদ্ধতি অনুসরণ করে পরীক্ষা শুরু করলেন বলিভিয়ায় গিয়ে। কসমিক রশ্মি এখানে ইংল্যান্ডের চেয়ে প্রবল। পরীক্ষার ফলাফল হিসেব করে দেখলেন নতুন কণিকার ভর হয়েছে ইলেকট্রনের ভরের ২৭৩ গুণ। ইউকাওয়ার মেসনের ভরের সাথে প্রায় হুবহু মিলে গেছে পাওয়েলের ফলাফল। ১৯৫০ সালে এ কাজের জন্য তিনি নোবেল পুরস্কার পান।

ভারতীয় বিজ্ঞানে অবদান[সম্পাদনা]

ভারতে বিজ্ঞানের প্রসারে নিরলস কাজ করে গেছেন দেবেন্দ্রমোহন। ১৯৪৩ সালে প্ল্যানিং কমিশনের সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। ১৯৪৫ সালে নিউক্লিয়ার কেমিস্ট্রি বিশেষজ্ঞ হিসেবে এটমিক এনার্জি কমিশনের সদস্য নির্বাচিত হন। সিটি কলেজের ব্যবস্থাপনার সাথেও জড়িত ছিলেন তিনি। দীর্ঘ আঠারো বছর বিশ্বভারতীর সাম্মানিক কোষাধ্যক্ষ ছিলেন দেবেন্দ্রমোহন। ২৫ বছর ‘সায়েন্স এন্ড কালচার’ ম্যাগাজিনের সম্পাদক ছিলেন তিনি। প্রেসিডেন্ট ছিলেন ইন্ডিয়ান সায়েন্স নিউজ এসোসিয়েশনের। এশিয়াটিক সোসাইটির সভাপতি ছিলেন। সমরেন্দ্রনাথ সেন ও সুব্বারাপ্পার সাথে যৌথভাবে সম্পাদনা করেছেন ভারতবর্ষের বিজ্ঞানের ইতিহাস। ‘ইন্ডিয়ান জার্নাল অব হিস্ট্রি অব সায়েন্স’ সাময়িকীর প্রধান সম্পাদক ছিলেন দেবেন্দ্রমোহন।

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. Indian National Science Academy. Biographical memories of fellows of the Indian National Science Academy vol. 7,. Calcutta: INSC, 1983
  2. আমাদের কিশোরগঞ্জ
  3. সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত ও অঞ্জলি বসু সম্পাদিত, সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান, প্রথম খণ্ড, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, আগস্ট ২০১৬, পৃষ্ঠা ৩০৫, আইএসবিএন ৯৭৮-৮১-৭৯৫৫-১৩৫-৬
  4. শ্যামল চক্রবর্তী. বিশ্বসেরা বিজ্ঞানী. কলকাতা: শিশু সাহিত্য সংসদ ১৯৯৯
  5. শ্যামল চক্রবর্তী. বিশ্বসেরা বিজ্ঞানী. কলকাতা: শিশু সাহিত্য সংসদ
  6. Rajinder Singh. Notes. Rec. R. Soc. London, 2007;61:333-45
  7. D. M. Bose, B. Chowdhury. Nature 1941;147:240-1
  8. D. M. Bose, B. Chowdhury. Nature 1942;149:302