এটারনাল অবলিভিয়ন

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
একটি মানুষের মস্তকের খুলি যাকে অনেক জায়গায় মৃত্যুর প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করা হয়

দর্শনশাস্ত্রে এটারনাল অবলিভিয়ন (ননএক্সিস্টেন্স বা অনস্তিত্ব এবং নাথিংনেসও বলা হয়)[১][২] হল মৃত্যুর পর স্থায়ীভাবে ব্যক্তির চেতনা বন্ধ হয়ে যাওয়া। এই ধারণাটিকে প্রায়ই ধর্মীয় সংশয়বাদ এবং নাস্তিক্যবাদের সাথে সম্পর্কিত করা হয়[৩] এবং এই ধারণার ভিত্তি হচ্ছে পরকালের সাক্ষ্যপ্রমাণের অভাব।

চেতনা হল সকল আশেপাশের পরিবেশের ব্যক্তিবাচক অভিজ্ঞতা, এজেন্সি (কার্যক্ষমতা), আত্ম-অবগতি এবং সচেতনতার ভিত্তি। স্নায়ুবিজ্ঞানী গিউলিও তুননির মতে, চেতনা হল "আমরা যা তার সব এবং আমাদের যা আছে তার সব: চেতনা হারানো মাত্রই আপনার নিজের আত্ম এবং সমগ্র জগৎ নাথিংনেস বা অনস্তিত্বে বিলীন হয়ে যাবে।""[৪]

ব্রেইন ডেথ এর বেলায় মস্তিষ্কের সকল রকমের কার্যকলাপ স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যায়। যেসব ব্যক্তি বিশ্বাস করেন যে মৃত্যু হল চেতনার স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়া, তারা এও বিশ্বাস করেন যে চেতনা মস্তিষ্কের কার্যকলাপের উপর নির্ভরশীল। বৈজ্ঞানিক গবেষণার মাধ্যমে আবিষ্কার করা গেছে যে মস্তিষ্কের কিছু স্থান যেমন রেগুলার একটিভেটিং সিস্টেম বা থ্যালামাস চেতনার জন্য প্রয়োজনীয় এবং পর্যাপ্ত, কারণ এসব অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হলে বা এদের কার্যকলাপে সমস্যা দেখা গেলে চেতনার অভাব দেখা যায়।

এছাড়ায় মনকে মস্তিষ্কের উপর নির্ভরশীল ভাবা হয়, এবং বিভিন্ন ধরনের ব্রেইন ড্যামেজের প্রভাবের দ্বারা এটা এই নির্ভরশীলতা দেখানো যায়।[৫] দার্শনিক পল এডোয়ার্ডের কথায়, "মস্তিষ্কে ক্ষতির যত বেশি হবে, মনের ক্ষতিও তত বেশি হবে। এই প্যাটার্ন থেকে স্বাভাবিক এক্সট্রাপোলেশনও খুব পরিষ্কার- মস্তিষ্কের সমস্ত ক্রিয়া একসাথে বন্ধ করে দেয়া হলে, সকল মানষিক বা মনের ক্রিয়াও বন্ধ হয়ে যাবে।"[৬]

অবলিভিয়ন এবং ব্যক্তিবাচকতা[সম্পাদনা]

সেন্টার ফর নেচারালিজম এর প্রতিষ্ঠাতা থমাস ডব্লিউ কার্ক "Death, Nothingness, and Subjectivity"' (মৃত্যু, অনস্তিত্ব এবং ব্যক্তিবাচকতা) নামে একটি পেপার লেখেন।[৭] সেখানে তিনি এটারনাল অবলিভিয়নের ত্রুটিপূর্ণ ব্যাখ্যা "অন্ধকারে নিমজ্জিত হওয়া" এর সমালোচনা করেন। যখন কেউ তার মৃত্যুকে কল্পনা করেন (নন-রেলিজিয়াসরাও), তিনি নিজেকে তার ভবিষ্যৎ আত্ম বা সেলফে নিয়ে যান যা একটি চিরস্থায়ী নীরব অন্ধকারের অভিজ্ঞতা লাভ করছে। এটা ভুল কারণ চেতনা ছাড়া স্থানের সম্পর্কিত কোন সচেতনতা এবং সময়ের কোন ভিত্তি থাকতে পারে না। ক্লার্কের মতে, অবলিভিয়নে অভিজ্ঞতার অনুপস্থিতিও থাকতে পারে না কারণ অভিজ্ঞতার কথা তখনই বলা যায় যখন কোন ব্যক্তিবাচক আত্ম বা সাবজেক্টিভ সেলফ এর অস্তিত্ব থাকে।

পদার্থবিজ্ঞান এবং মৃত্যু[সম্পাদনা]

দ্য বিগ পিকচার নামক বইতে পদার্থবিজ্ঞানী শন বলেন, পদার্থবিজ্ঞান অনুসারে মৃত্যু এটারনাল অবলিভিয়নের সমতুল্য। তিনি লেখেন, "আমাদের প্রতিদিনকার অভিজ্ঞতার এই জগতের মাঝে থাকা কোর থিওরিকে মেনে নেয়ার নিহিতার্থ অনেক বেশি। এই কোর থিওরি হল মৃত্যুর পর কোন জীবন নেই। জীবিত প্রাণী হিসেবে আমাদের প্রত্যেকের একটি সীমাবদ্ধ সময় আছে, আর যখন এটা শেষ হয়ে যাবে, তখন এটা শেষ, এটা শেষ। এরকম সোজাসাপ্টা দাবীর পেছনের যুক্তি এস্ট্রোলজি বা টেলিকিনেসিস এর বিরুদ্ধের যুক্তিগুলোর চেয়েও সরল। এই কোর থিওরি অনুসারে প্রতিটি প্রাণ যদি কোনরকম আবাস্তব আত্মা ছাড়া পার্টিকেল এবং বল দ্বারা গঠিত হয়, তাহলে যে ইনফরমেশন বা তথ্য "আপনাকে" তৈরি করে তা আপনার মস্তিষ্ক সহও শরীরকে তৈরি করা পরমাণুগুলোর বিণ্যাসের মধ্যেই বিদ্যমান থাকবে। এই ইনফরমেশনের যাওয়ার জন্য আর কোন জায়গা বা উপায় নেই। আপনার শরীরের বাইরে এর সংরক্ষিত হবারও কোন উপায় নেই। কোন পারটিকেল বা ফিল্ড নেই যা এটাকে নিয়ে নিতে পারে বা সংরক্ষণ করে রাখতে পারে।"

এটারনাল অবলিভিয়ন এর দর্শন[সম্পাদনা]

প্লেটোর লেখা এপোলজি অব সক্রেটিস অনুসারে, মৃত্যুদণ্ড পাবার পর সক্রেটিস বিচারসভার উদ্দেশ্য বক্তব্য দান করেন। তিনি মৃত্যুর প্রকৃতি সম্পর্কে ভাবেন, এবং এটার সম্পর্কে সংক্ষেপে বলেন, মৃত্যু সম্পর্কিত দুটি মতামত আছে। প্রথমটি অনুসারে মৃত্যু হল এই বর্তমান অস্তিত্ব থেকে আরেকটি অস্তিত্বে আত্মা বা চেতনার স্থানান্তর যেখানে পূর্বের সকল মৃত ব্যক্তির আত্মাও থাকবে। এটা সক্রেটিসের জন্য আনন্দদায়ক কারণ তার ফলে তিনি সকল বিখ্যাত গ্রীক বীর এবং চিন্তাবিদদেরকে তার দ্বান্দ্বিক প্রশ্নগুলো জিজ্ঞাসা করতে পারবেন। অন্য মতটি হল, এই মৃত্যু একটি অবলিভিয়ন, চেতনার সম্পূর্ণ সমাপ্তি। এটা কেবল অনুভবেরই অভাব নয় সচেতনতারও সম্পূর্ণ অভাব, এটা যেন একটি গভীর স্বপ্নবিহীন ঘুম। সক্রেটিস বলেন, এই অবলিভিয়নও তাকে খুব বেশি ভীত করে না। কারণ যখন তিনি অচেতন থাকবেন, তিনি সব ধরনের ব্যাথা ও ভোগান্তির হাত থেকে মুক্ত থাকবেন। তিনি আরও বলেন, এমনকি পারস্যের মহান রাজাও বলতে পারবেন না যে তিনি স্বপ্নহীন ঘুমের চেয়ে কখনও সুন্দর ও শান্তিময় অবস্থায় বিশ্রাম নিতে পেরেছেন।

এর তিন শতক পর সিসেরো তার গ্রন্থ অন ওল্ড এজ এ মৃত্যু সম্পর্কে একই রকম আলোচনা করেন। তিনি তার লেখায় বারবার পূর্ববর্তী গ্রীক লেখকদের প্রসঙ্গ তুলেছেন। সিসেরো এও মন্তব্য করেছেন যে, মৃত্যু হয় চেতনার ধারাবাহিকতা অথবা চেতনার সমাপ্তি। যদি চেতনা কোন আকার বা ধরনে গিয়ে তার ধারাবাহিকতা বজায় রাখে, এতে ভয়ের কোন কারণ নেই। যদি এটারনাল অবলিভিয়ন সত্য হয়, তাহলে তিনি সকল জাগতিক দুঃখ-কষ্ট থেকে মুক্ত হবেন। এক্ষেত্রেও তার মৃত্যুকে ভয় পাবার কিছু নেই।

মৃত্যু নিয়ে একই রকম চিন্তা করেছেন রোমান কবি ও দার্শনিক লুক্রেটিয়াস তার খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম শতকের ডিডাক্টিভ কাব্য ডে রেরাম নেচারা তে। প্রাচীন গ্রীক দার্শনিক এপিকিউরাসও একই রকম চিন্তা করেছিলেন। তিনি তার লেটার টু মেনোসিয়াস এ লিখেছেন, "মৃত্যু আমাদের কাছে যে কিছুই না এটা বিশ্বাস করায় নিজেকে অভ্যস্ত করে নাও। মৃত্যুর পর ভালমন্দ যাই হোক না কেন সেটা একটি অনুভূতি পাবার ক্ষমতাকে নির্দেশ করে, আর মৃত্যু হল সকল অনুভূতির অভাব। তাই মৃত্যু যে আমাদের কাছে কিছুই না, এই সঠিক উপলব্ধি আমাদের জীবনের নৈতিকতাকে আরও উপভোগ্য করে তোলে। জীবনকে একটি অসীম সময় দান করা নয়, বরং অমরত্বের লোভ থেকে মুক্ত হওয়ার মাধ্যমেই এটা আরও উপভোগ্য হয়। যিনি বোঝেন যে জীবনের সমাপ্তিতে কোন ভয় নেই তার কাছে জীবনও ভয়ের কিছু নয়। বরং সেই ব্যক্তিই বোকা যিনি বলেন যে তিনি মৃত্যুকে ভয় পান। এই ভয়ের কারণ এটা নয় যে যখন মৃত্যু আসবে তখন ব্যাথা হবে, এর কারণ এই যে মৃত্যুর মানষিক দৃশ্যেই ভয় লুকিয়ে আছে। যখন মৃত্যু আসে তখন কোন ব্যাথা থাকে না, কিন্তু যখন মৃত্যুর প্রত্যাশা আসে তখনই ভিত্তিহীন ব্যাথা দেখা যায়। তাই সবচেয়ে ভয়ংকর এবং খারাপ এই মৃত্যু আমাদের কাছে আসলে কিছুই না যদি আমরা এভাবে দেখি, আমরা যখন আছি মৃত্যু তখন আসে না, আর মৃত্যু যখন আসে, আমরা তখন থাকি না। তাই মৃত্যু আসলে জীবিত বা মৃত কারোর জন্যই কিছু না। কারণ যারা জীবিত তাদের কাছে মৃত্যু আসে নি, আর যারা মৃত তাদের আর অস্তিত্বই নেই।"[৮][৯]

আরও দেখুন[সম্পাদনা]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. Clark, Thomas W.। "Death, Nothingness, and Subjectivity"Naturalism.org। Center for Naturalism। ৪ ফেব্রুয়ারি ২০১২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৪ ফেব্রুয়ারি ২০১২ 
  2. Schell, Jonathan (২০০৪)। The Jonathan Schell Reader: On the United States at War, the Long Crisis of the American Republic, and the Fate of the Earth। New York: Nation Booksআইএসবিএন 9781560254072। সংগ্রহের তারিখ ৪ ফেব্রুয়ারি ২০১২ 
  3. Heath, Pamela; Klimo, Jon (২০১০)। Handbook to the Afterlife। Berkeley, CA: North Atlantic Books। পৃষ্ঠা 18। আইএসবিএন 9781556438691। সংগ্রহের তারিখ ৪ ফেব্রুয়ারি ২০১২ 
  4. Tononi, Giulio (২০০৮)। "Consciousness as Integrated Information: A Provisional Manifesto"The Biological Bulletin215 (3): 216–42। ডিওআই:10.2307/25470707পিএমআইডি 19098144। সংগ্রহের তারিখ ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ 
  5. Hallquist, Chris (২০ জানুয়ারি ২০১৩)। "Neuroscience and the Soul"The Uncredible HallQ। Patheos.com। ৯ নভেম্বর ২০১৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৫  Quoting neuroscientist Sam Harris (video).
  6. Edwards, 1996, pp. 282-283.
  7. "সংরক্ষণাগারভুক্ত অনুলিপি"। ৪ ফেব্রুয়ারি ২০১২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০ জানুয়ারি ২০১৭ 
  8. "সংরক্ষণাগারভুক্ত অনুলিপি"। ৩ জানুয়ারি ২০১৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০ জানুয়ারি ২০১৭ 
  9. "সংরক্ষণাগারভুক্ত অনুলিপি"। ২৬ আগস্ট ২০১৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০ জানুয়ারি ২০১৭ 

আরও পড়ুন[সম্পাদনা]