বিষয়বস্তুতে চলুন

বিটি বেগুন

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
বিটি বেগুন

বিটি বেগুন হলো ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকা প্রতিরোধী বেগুন, যা বংশাণু প্রকৌশলের মাধ্যমে তৈরি করা হয়েছে। সারা বিশ্বে বেগুন এগপ্লান্ট (eggplant) বা অবারজিন (aubergine) নামে পরিচিত। বেগুন বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ সবজি। এ ফসলটি সারাদেশব্যাপী প্রধানত: শীত মৌসুমে আবাদ হয়। বেগুন ফসলের সবচেয়ে বড় শত্রু, ক্ষতিকর ফল ও ডগা ছিদ্রকারী পোকা। শুধু এই পোকার আক্রমণে বেগুনের ফলন ৩০-৭০ শতাংশ কমে যেতে পারে।এ পোকার আক্রমণ থেকে বেগুন ফসল রক্ষা করতে বিজ্ঞানীরা জনপ্রিয় কিছু বেগুনের জাতের জিন প্রকৌশলের মাধ্যমে ফল ও ডগা ছিদ্রকারী পোকা প্রতিরোধ ক্ষমতা সৃষ্টি করেছেন। অনেকে মনে করেন 'বায়োটেকনোলজি' শব্দ থেকে বিটি বেগুনের নামকরণ করা হয় যা সঠিক নয়। বিটি হল Bacillus thuringensis (বেসিলাস থুরেনজেনসিস) এর সংক্ষিপ্ত নাম। বেসিলাস থুরেনজেনসিস মাটিতে বসবাসকারী এক ধরনের ব্যকটেরিয়া যা Cry1AC বংশাণু (জিন) ধারণ করে। Cry1AC বংশাণু এক ধরনের কীটনাশক প্রোটিন উৎপন্ন করে যা বেগুনের ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকা দমন করতে পারে। Cry1AC বংশাণু থেকে সৃষ্ট প্রোটিন শুধু মাত্র ফল ডগা ছিদ্রকারি পোকার ক্ষতি সাধন করে। এটা মানুষ বা অন্য কোন প্রাণীর জন্যে ক্ষতিকর নয়। সাধারন জাত্যের বেগুন চাষে ফল ডগা ছিদ্রকারি পোকার আক্রমণ প্রতিরোধ করতে মৌসুমে ৭০-১০০ বার কীটনাশক ব্যবহার করতে। বিটি বেগুন প্রাকৃতিক ভাবেই ফল ডগা ছিদ্রকারি পোকা প্রতিরোধ করতে পারে এতে আলাদা করে কীটনাশক প্রয়োগ করতে হয়না তাই বিটি বেগুন পরিবেশ ও মানব স্বাস্থ্যের জন্যে উপকারি। বাংলাদেশ সরকার ২০১৩-১৪ সালে ফল ও ডগা ছিদ্রকারী পোকা প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন বিটি বেগুনের নামে চারটি জাত বাংলাদেশে  সীমিত আকারে চাষাবাদের জন্য অবমুক্ত করেছেন। বাংলাদেশের কৃষক বিটি বেগুনকে সাদরে গ্রহণ করেছেন এবং বর্তমানে দেশটির ৬৪ জেলায় প্রায় ২৭০০০ কৃষক বিটি বেগুন চাষ করছেন। বাংলাদেশের পাশাপাশি ভারত এবং ফিলিপাইনে বিটি বেগুনের গবেষণা কার্যক্রম শুরু হয়। পরিবেশ রক্ষার জন্য আন্দোলনকারীদের দাবি ও প্রতিবাদের কারণে ভারত ও ফিলিপাইনের সরকার বিটি বেগুন চাষাবাদের জন্যে উন্মুক্ত করতে পারেনি। তারা দাবি করেন বিটি বেগুন পরিবেশ ও মানুষের জন্যে ক্ষতিকর। অপরদিকে বিজ্ঞানীদের দীর্ঘ গবেষণায় জানা যায় বিটি বেগুন মানুষ বা পরিবেশের জন্যে ক্ষতিকর নয়।

ভারতের মহারাষ্ট্রভিত্তিক একটি কোম্পানি মাহিকো বিটি বেগুনের জাত নিয়ে গবেষণা করে। মাহিকো এই পরিবর্তিত জিনের নামকরণ করে ইই-১ এবং আরও দুটি জেনেটিক্যালি মডিফাইড বেগুনের জন্য সরকারের কাছে আবেদন করে। ইউনিভার্সিটি অফ এগ্রিকালচারাল সাইন্স, ধারওয়াদ ও এবং তামিল নাড়ু এগ্রিকালচারাল ইউনিভার্সিটিতে বিভিন্ন জাতের বেগুনের মধ্যে প্রজনন ঘটিয়ে সর্বপ্রথম এই ইই-১ এর উন্নয়ন ঘটানো হয়। মালপুর লোকাল, মঞ্জেরি গোতা, কুদাচি লোকাল, উদুপি লোকাল ও পাবকাভি লোকাল হল বিটি বেগুনের কয়েকটি জাত। ২০০৯ সালে বাণিজ্যিক ব্যবহারের জন্য এই জাতকে ছাড়পত্র দেওয়ার পর থেকেই কৃষক, সমাজকর্মী ও বিভিন্ন স্তরের মনুষ্যের মধ্যে গুঞ্জন ওঠে এবং বহুল আলোচনা, সমালোচনা ও বিতর্কের পর ভারতের পরিবেশ মন্ত্রী জয়রাম রমেশ পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত এই জাতের বাণিজ্যিক ব্যবহার নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন।

বিটি বেগুনের সুবিধা

[সম্পাদনা]
  1. বেগুনের প্রধান শত্রু ফল ও ডগা ছিদ্রকারী পোকার আক্রমণ থেকে বেগুন ফসলকে রক্ষা করে।
  2. কীটনাশক ব্যবহার সীমিত হওয়ায় পরিবেশ ও কৃষকের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় অবদান রাখে।
  3. উৎপাদন খরচ কম এবং কাক্সিক্ষত উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে কৃষকের আয় বৃদ্ধি করে।

চাষাবাদ পদ্ধতি

[সম্পাদনা]

বিটি বেগুনের চাষাবাদ পদ্ধতি অন্যান্য প্রচলিত জাতের বেগুন চাষের মতোই তবে কয়েকটি বিষয়ে অতিরিক্ত বা বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা অত্যাবশ্যক।

বীজ সংগ্রহ: বিটি বেগুনের বীজ বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনিস্টিটিউট (বারি) অথবা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে সংগ্রহ করা যাবে।

বীজের হার: প্রতি বিঘা বা ৩৩ শতক জমিতে ১৫ গ্রাম বিটি বেগুনের বীজ ব্যবহার করতে হবে।

সুষম সারের মাত্রা ও প্রয়োগ:  বেগুন চাষে পর্যাপ্ত পরিমাণ সার প্রয়োগ আবশ্যক। প্রতি ২০ শতক জমিতে ৯০০ কেজি গোবর, ২০ কেজি টিএসপি, ৬ কেজি এমওপি, ৭ কেজি জিপ্সাম, ৬০০ গ্রাম দস্তা ও ৬০০ গ্রাম বোরন শেষ চাষের সময় প্রয়োগ করতে হবে। ইউরিয়া ২৭ কেজি মোট ৫ কিস্তিতে দিতে হবে (১ম কিস্তি ৫.৪ কেজি চারা লাগানোর ১৫ দিন পর, ২য় কিস্তি ৫.৪ কেজি ফুল ধরার সময়, ৩য় কিস্তি ৫.৪ কেজি ফল ধরার সময় এবং ৪র্থ ও ৫ম কিস্তি ৫.৪ কেজি করে ফসল তোলার সময় (এক মাস অন্তর)। বাকী ১২ কেজি এমওপি মোট ২ কিস্তিতে প্রতিবারে ৬ কেজি করে দিতে হবে (১ম কিস্তি ফুল আসার সময় এবং ২য় কিস্তি ফল ধরার সময়)

বিটি বেগুন চাষে আবশ্যকরণীয় বিষয়

[সম্পাদনা]

১। বিটি বেগুনের মাঝে প্রচলিত বেগুন গাছ লাগানো: বেগুনের ফল ও ডগা  ছিদ্রকারী পোকা যাতে বিটি প্রযুক্তি সহনীয় না হতে পারে সেজন্য বিটি বেগুনের জমিতে প্রচলিত জাতের বেগুন চারা উদ্বাস্ত ফসল হিসাবে রোপণ করা অত্যন্ত জরুরী। এক্ষেত্রে মোট বিটি ফসলের ৫% উদ্বাস্ত ফসল রোপণ করা সমীচীন। অর্থাৎ ২০ শতক জমিতে প্রয়োজনীয় মোট ১০০০টি বেগুনের চারা রোপণ করলে কমবেশি ৯৫০টি হবে বিটি বেগুনের চারা এবং কমবেশি ৫০টি হবে প্রচলিত একই জাতের বেগুনের চারা। তবে একই জাতের প্রচলিত  বেগুনের বীজ বা চারা পাওয়া না গেলে অন্য যে কোন প্রচলিত বেগুনের চারা ব্যবহার করা যেতে পারে।

বারি বিটি বেগুন ফসলের চারপাশে একটি সারিতে প্রচলিত বেগুন জাতের ফসল অবশ্যই রোপণ করতে হবে।

২। দুরত্ব বজায়: বিটি বেগুনের জমি অন্যান্য বেগুনের জমি থেকে অন্তত: ৩০ মিটার বা ৩৩ গজ দুরত্ব বজায়  রেখে চাষ করা আবশ্যক।

৩। পোকা দমন: মনে রাখতে হবে, বিটি বেগুন কেবলমাত্র ফল ও ডগা ছিদ্রকারী পোকা প্রতিরোধী। বিটি বেগুন ফসলে অন্যান্য রসচুষে খাওয়া পোকা যেমন, সাদামাছি, এফিড, স্প্রিস, হপার, কাঁটালে পোকা ও মাকড় ইত্যাদির আক্রমণ হতে পারে। এসকল পোকা/মাকড় দমনের জন্য স্বাভাবিক নিয়মে প্রয়োজনীয় প্রতিরোধ ব্যবস্থা অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে।

রোগ বালাই নিয়ন্ত্রণ

[সম্পাদনা]

বিটি বেগুন শুধুমাত্র ফল ডগা ছিদ্রকারি পোকা প্রতিরোধ করতে পারে তাই অন্য রোগা বা পোকার আক্রমণ থেকে ফসলকে রক্ষা করতে যথাযথ পরিচর্যা প্রয়োজন। বিটি বেগুনের রোগ বালাই প্রতিরোধের ক্ষেত্রে বীজতলায় বপনের পূবের্ বীজ শোধন করে নেওয়া উচিত। ফসলে রোগের প্রাদুর্ভাব হলে তা দমনের জন্য প্রচলিত বেগুন জাতের মতোই প্রয়োজনীয় বালাই নাশক ব্যবহার করতে হবে।

ফসল সংগ্রহ

[সম্পাদনা]
  • চারা লাগানোর ২-৩ মাস পরই বেগুন সংগ্রহের উপযোগী হয়।
  • বেগুনের ফলন এমন পর্যায় সংগ্রহ করতে হয় যখন ফল পূর্ণ আকার প্রাপ্ত হয় অথচ বীজ শক্ত হয় না।
  • প্রতি সপ্তাহে ২ বার গাছ থেকে ধারাল ছুরির সাহায্যে বেগুন কাটা ভাল।

বিতর্ক

[সম্পাদনা]

জেনেটিক্যালি মডিফাইড খাদ্য নিয়ে অনেক বিতর্ক রয়েছে। সমালোচকরা মনে করেন এই জাতীয় ফসল মানুষের স্বাস্থ্য ও পরিবেশের ক্ষতি করতে পারে এবং একই সাথে এটি কীটপতঙ্গ ও বিভিন্ন প্রজাতির পোকামাকড়ের জন্যও হুমকি স্বরূপ।

তথ্যসূত্র

[সম্পাদনা]

http://journals.plos.org/plosone/article?id=10.1371/journal.pone.0165190

http://www.bari.gov.bd/site/page/f0dfb28d-c3d9-4818-b412-7397aeb53c94/%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%9F%E0%A6%BF-%E0%A6%AC%E0%A7%87%E0%A6%97%E0%A7%81%E0%A6%A8

https://www.isaaa.org/resources/publications/briefs/53/download/isaaa-brief-53-2017.pdf

https://allianceforscience.cornell.edu/blog/2016/07/bangladeshi-bt-brinjal-farmer-speaks-out-in-gmo-controversy/ ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ১৫ জুন ২০১৮ তারিখে

https://bteggplant.cornell.edu/content/news/blog/photo-blog-bt-brinjal-bangladesh

https://geneticliteracyproject.org/2015/12/14/politics-of-gmos-in-india-bt-cotton-vs-bt-brinjal/

বহিঃসংযোগ

[সম্পাদনা]