সোজন বাদিয়ার ঘাট
লেখক | জসীম উদ্দিন |
---|---|
ভাষা | বাংলা |
ধারাবাহিক | নমুদের কালো মেয়ে, নীড়, পলায়ন, পূর্ব্বরাগ, বেদের বহর, বেদের বেসাতি |
বিষয় | প্রেম এবং পরিণতি |
ধরন | কবিতা |
প্রকাশনার তারিখ | ১ম প্রকাশ: ২৮শে ফাল্গুন, ১৩৪০ বঙ্গাব্দ (১৯৩৩ ইং) |
মিডিয়া ধরন | মুদ্রিত কাব্যগ্রন্থ |
পৃষ্ঠাসংখ্যা | ১৬২ |
সোজন বাদিয়ার ঘাট বাংলা সাহিত্যের অন্যতম দিকপাল কবি জসীম উদদীনের অত্যন্ত সুপরিচিত একটি কাব্যগ্রন্থ। গ্রাম বাংলার অপুর্ব অনবদ্য রূপকল্প এই কাব্যগ্রন্থটি ১৯৩৩ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়। সোজন বাদিয়ার ঘাট কাব্যের প্রধান চরিত্র মুসলমান চাষির ছেলে সোজন ও নমুর মেয়ে দুলালী (ওরফে দুলি)। আর তার সঙ্গে বিগত জমিদারি আমলের সামন্ততান্ত্রিক নিষ্ঠুরতার চালচিত্র। ১৯৩৩ সালে কবি এই কবিতাটি লেখেন মাত্র ৩০ বছর বয়সে।[১]
কাহিনীবিন্যাস
[সম্পাদনা]"সোজন বাধিয়ার ঘাট" কাব্যগ্রন্থে মোট ছয়টি পর্ব। কবি জসীমউদ্দিন এই ছয় পর্বকে ভিন্ন নামে আখ্যায়িত করেছেন। যথা:- নমুদের কালো মেয়ে, নীড়, পলায়ন, পূর্ব্বরাগ,বেদের বহর, বেদের বসাতি।
কাহিনীসংক্ষেপ
[সম্পাদনা]শিমুলতলী গ্রামে বাস করে দুটি সম্প্রদায়, হিন্দু এবং মুসলিম। দুটি ভিন্ন সম্প্রদায় হলেও তাদের মধ্যকার সম্পর্ক থাকে ভ্রাতৃত্বের চেয়েও বেশী। দেখা যায় মুসলিম বাড়িতে কেউ মারা গেলে তার জন্য হিন্দু বাড়ির তুলসী তলায় প্রদীপ জ্বলে। আবার হিন্দু বাড়িতে ছেলে অসুস্থ হলে তার জন্য পানি পড়া দেন মুসলিম পীর সাহেব। এক কথায় পুরো গ্রামটি মিলে একটি পরিবারের রূপ নেয়। যেখানে প্রত্যেকেই অপরের শুভাকাঙ্ক্ষী। এই গ্রামেরই নমুদের নেতা গদাই মোড়লের চঞ্চল কন্যা দুলালী, যার ডাকনাম দুলী। সদা উড়ে বেড়ান পাখির ন্যায় দুলীও ঘুরে বেড়ায় পুরো গ্রাম জুড়ে। তার সব সময়ের সাথী একই গ্রামের দমির শেখের ছেলে সোজন। ছোটবেলা থেকেই একে অপরের খেলার সাথী, একে অপরের পরম আপনজন। সোজন কখনো পেছন থেকে দুলীকে ডাক দিলে, দুলীর পাকা আম কুড়িয়ে পাওয়ার মত আনন্দ হয়। দুলীর ইচ্ছে হয়, সিঁদুরের কৌটোয় সোজনকে আপন করে লুকিয়ে রাখতে। আবার সোজনের ইচ্ছে বড় হয়ে তার বাড়ির আঙ্গিনায় কুমড়ো চাষ করবে, তবে তা সবজীর জন্য নয়, দুলী যদি শখের বসে একটি কুমড়ো ফুল খোপায় বাঁধে!
একসময় মুসলিমদের মহরম অনুষ্ঠানে শিমুলতলীর হিন্দুদের মারধোর করে পাশের গ্রামের মুসলিমরা। এতে করে তারা নায়েব মশায়ের কাছে বিচারের জন্য গেলে হিন্দু নায়েব তার স্ব সম্প্রদায়ের লোকদের প্রতিশোধ নিতে ক্ষেপিয়ে তোলেন। এবং তা শিমুলতলীর নিরীহ মুসলমানদের প্রতি। কিন্তু শিমুলতলীর হিন্দুরা তাদের প্রতিবেশী, ভ্রাতৃসম শিমুলতলীর মুসলিমদের প্রতি প্রতিশোধ নিতে অপারগতা জানায়। এতে করে ক্ষেপে যান হিন্দু নায়েব। অত:পর তিনি হিন্দুদের দেব-দেবীর আক্ষ্যা দিয়ে প্রতিশোধে উদ্বুদ্ধ করেন। হিন্দুদের এই আক্রমণের সংবাদ মুসলিমরা আগেই পেয়ে থাকে, তাই রাতের অন্ধকারে তারা প্রিয় গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যায়। কিন্তু শেষ সময়ে এসে যে হিন্দুরা তাদের প্রতিবেশীর প্রতি আক্রমণের মত পাল্টায় তা মুসলিমরা কখনোই জানতে পারে না।
এক পর্যায়ে সমাজের চোখে ছেলে-মেয়ে দুটো বড় হয় এবং দুলীর অন্যত্র বিয়ে ঠিক হয়। তখন দুলী বুঝতে পারে যে তার ছোটবেলার খেলার সাথী সোজনকে ছেড়ে যেতে পারবে না। সে তার একটাও মন সোজনকে দিয়ে ফেলেছি, চাইলেই কুমড়োর ফালির মত কেটে কেটে সবাইকে বিতরণ করতে পারবে না। বিয়ের দিনে দুলী, সোজনকে আড়ালে ডেকে তার মনের কথা খুলে বলে। সোজনের নিজের সাথে মিলে গেলেও সে তার পরিবার, সম্প্রদায়ের কথা ভেবে দুলীকে বোঝাতে চেষ্টা করে। এবং যখন দুলী আকাশ-বাতাস সাক্ষী রেখে সোজনকে স্বামী বলে ঘোষণা করে তখন আর সোজনের কিছুই করার থাকে না।
চরিত্র পরিচিতি
[সম্পাদনা]দুলালি (দুলি) হচ্ছে হিন্দু সম্প্রদায় নমু গোত্রের এক লোক গদাই নমুর মেয়ে। দুলি মেয়েটির গায়ের রঙ কালো, তবে চেহারার গড়ন অনন্য। তার রূপের কদর করতে গিয়ে কবি বলেছেন,
- "সোনা রূপার গয়না তাহার পড়িয়ে দিলে গায়। বাড়তো না রূপ,অপমানই করা হতো তায়!"
- দুলি স্বভাবত বেশ চঞ্চল এবং ভবঘুরে স্বভাবের ছিলো। বেথুল তুলে, ফুল কুড়িয়ে, ফলের ডাল ভেঙ্গে এবং সারাটি গ্রাম টহল দিয়ে তার দিন কেটে যেতো। মাঝে মাঝে সে তার পুতুলের বিয়ে দিতো, এবং গায়ের অনেক কিশোর কিশোরীকে নিমন্ত্রণ করতো।
সোজন একজন মুসলিম পরিবারের ছেলে। দুলির সকল কাজের সবচাইতে বড় সহযোগী ছিলো সে। তার বাবার নাম ছিলো ছমির শেখ। সেও যেন দুলিরই এক অন্য সংস্করণ। দুলির মতো সেও ছিলো ভবঘুরে স্বভাবের।
- সারাদিন ভর সেও বনে বাদাড়ে ঘুরে বেড়াতো। গাছে গাছে ফল পাকুর পারতো এবং পাখির বাসার সন্ধান করতো। বাসায় গিয়ে দেখতো কয়টা ছানা ফুটেছে। তার রূপের ছটা সম্পর্কে ওতটা না জানা গেলেও জানা যায় তার মাথায় বাবরি চুল ছিলো।
অন্য ভাষায়
[সম্পাদনা]১৯৭০ সালের ১লা জানুয়ারী বার্বার পেইন্টার এবং ইয়ান লাভলক নামক দু'জন লেখক আমেরিকান পেগাসাস প্রকাশনী থেকে জসীমউদদীনের বাংলা "সোজন বাদিয়ার ঘাট"-এর ইংরেজি অনুবাদগ্রন্থ "জিপ্সি ওয়ার্ফ" প্রকাশ করেন।[২][৩]
সংস্কৃতিতে জনপ্রিয়তা
[সম্পাদনা]কবি জসীমউদদীনের 'নকশীকাঁথার মাঠ' এবং 'সোজন বাদিয়ার ঘাট' উভয়ই কাব্যগ্রন্থই দেশ এবং দেশের বাইরে সমানভাবে জনপ্রিয়। উভয় কাব্যের কাহিনীই বাংলার মানুষের আত্মার সাথে মিশে আছে। বাঙালির আবেগ অনুভূতির অনেকটা জায়গা জুরেই দখল করে নিয়েছে এসব কাব্যকাহিনীগুলো। যাত্রাপালা, মঞ্চনাটকসহ অসংখ্য ভিডিও নাটক সবখানেতেই এই কাব্যগুলোকে সর্বোচ্চ স্থানে স্থান দেওয়া হয়।[৪][৫][৬]
আন্তঃমহলে জনপ্রিয়তা
[সম্পাদনা]কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও বইটির প্রশংসা করেছেন।[৭] কাবোপন্যাসটির প্রশংসা করে তিনি লেখেন,
“ | তোমার "সোজন বাদিয়ার ঘাট" অতীব প্রশংসার যোগ্য। এ বই যে বাংলার পাঠক সমাজে আদৃত হবে সে বিষয়ে আমার লেশমাত্র সন্দেহ নেই | ” |
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের একজন পণ্ডিত চেকোশ্লাভাকিয়ার ভাষাবিদ প্রফেসর ডঃ দুশন জুবভিতেল জসীম উদ্দীন সম্পর্কে বলেন,
“ | ... জসীম উদ্দীনের বই যখন পড়ি তখনই তাতে নতুন নতুন সৌন্দর্য আবিষ্কার করি। ...কবি জসীম উদ্দীন ..... এইসব গ্রাম্য সাহিত্য ঘনিষ্ঠভাবে চেনেন, লম্বা লম্বা বছর ধরে নিজেই গ্রাম্য গান সংগ্রহ করেছিলেন। উনি কবি, বাল্যকাল থেকে কবিশিষ্যের মত সবচেয়ে বড় কবির পায়ে বসেছিলেন যার নাম হচ্ছে জনসাধারণ। আমার বিশ্বাস ওর থেকে উনি তাঁর 'নকশী কাঁথার মাঠ', 'সোজন বাদিয়ার ঘাট' 'সকিনা' ইত্যাদি বইগুলির বাইরের রূপ পেয়েছেন, প্রামা কবিদের সঙ্গে একই অতল সৌন্দর্যের সাগর থেকে পান করতে শিখেছেন। ... জনসাধারণের প্রতি জসীম উদ্দীনের অপরিসীম মমতা ও সমবেদনাবোধ যাকে বলা যায় কাব্যিক মানবতাবাদ.... ঊনি তো গ্রামের মানুষ, মাটির মানুষ, বাংলা জনসাধারণের সঙ্গে অসংখ্য বন্ধন নিয়ে বাঁধা কবি। তাদের সুখ দুঃখ বুঝতে পারেন, তাদের আনন্দ-বেদনা মুখরিত করতে জানেন | ” |
সংরক্ষণ এবং সম্মাননা
[সম্পাদনা]জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান এবং সংস্কৃতিমূলক সংস্থা ইউনেস্কো জসীমউদদীনের "সোজন বাদিয়ার ঘাট"-কে এশীয় সিরিজের শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকর্মের সম্মাননা দিয়েছে, আর এশীয় সংস্কৃতিস্বরূপ ১৯৯৩ সাল হতে ২০০২ সাল পর্যন্ত মোট ১৬ বার এই বইটির সংস্করণ সংরক্ষণ করেছে।[৮][৯]
অভিযোজন
[সম্পাদনা]চলচ্চিত্র
[সম্পাদনা]খ্যাতিমান নির্মাতা তানভীর মোকাম্মেলের পরিচালনায় এবং কিনো-আই ফিল্মসের ব্যানারে জসীমউদ্দীনের কাব্য অবলম্বনে এবার ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ চলচ্চিত্র নির্মিত হচ্ছে। চলচ্চিত্রটি পরিচালনার পাশাপাশি এর চিত্রনাট্যও রচনা করেছেন তানভীর মোকাম্মেল। চিত্রগ্রহণে আছেন রাকিবুল হাসান। প্রধান সহকারী পরিচালক ও শিল্পনির্দেশকের দায়িত্ব পালন করবেন উত্তম গুহ। ছবিটি সম্পাদনা করবেন মহাদেব শী ও আবহসঙ্গীত পরিচালনা করবেন সৈয়দ সাবাব আলী আরজু। ছবিটির কাস্টিং ডিরেক্টর ও পোষাকের দায়িত্ব পালন করবেন চিত্রলেখা গুহ। ছবিটির সহকারী পরিচালকেরা হচ্ছেন সৈয়দ সাবাব আলী আরজু, সগীর মোস্তফা ও রানা মাসুদ। চলচ্চিত্রটির সহপ্রযোজনা করবেন কবি জসীমউদ্দীনের কন্যা হাসনা জসীমউদ্দীন মওদুদ।[১০][১১]
তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ "জসীম উদ্দীনের 'সোজন বাদিয়ার ঘাট'"। bdlive24.com। ২০২১-০৭-১৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৭-১৮।
- ↑ Jasīmauddīna (১৯৬৯-০১-০১)। Gipsy wharf:।
- ↑ "Formats and Editions of Gypsy wharf [WorldCat.org]"। www.worldcat.org (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৭-১৮।
- ↑ মজিদ, পিয়াস। "তাঁর কবিতা বাংলার হৃদয়ের ভাষা"। প্রথম আলো। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৭-১৯।[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
- ↑ "দৈনিক জনকন্ঠ || জসীমউদ্দীনের পল্লী বাংলা"। দৈনিক জনকন্ঠ। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৭-১৯।
- ↑ "লোকসংস্কৃতিতে ঋদ্ধ এক কাব্যোপন্যাস: সোজন বাদিয়ার ঘাট"। suprovatsydney.com.au। ২০২১-০৭-১৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৭-১৯।
- ↑ "সোজন বাদিয়ার ঘাট"। কালের কণ্ঠ। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৭-১৮।
- ↑ "সোজন বাদিয়ার ঘাট PDF রিভিউ"। বইয়ের ফেরিওয়ালা। ২০২১-০৪-২৮। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৭-১৯।
- ↑ জসিমউদ্দিন; পেইন্টার, বারবারা; লাভলক, ইয়ান (১৯৬৯)। Gipsy wharf (Sojan badiar ghat), (ইংরেজি ভাষায়)। অ্যালেন অ্যান্ড আনউইন। আইএসবিএন 978-0-04-891035-6। ওসিএলসি 105496।
- ↑ প্রতিবেদক, বিনোদন। "যে কারণে জসীমউদ্দীনের 'সোজন বাদিয়ার ঘাট' থেকে সিনেমা বানাচ্ছেন পরিচালক"। www.prothomalo.com। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-১০-৩১।
- ↑ "রুপালি পর্দায় আসছে পল্লীকবির ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ – [[যমুনা টিভি]]"। www-jamuna-tv.cdn.ampproject.org। ২০২২-১০-৩১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-১০-৩১। ইউআরএল–উইকিসংযোগ দ্বন্দ্ব (সাহায্য)