পর্তুগালের ইতিহাস

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
পর্তুগালের কোট অফ আর্মস, ১৯১১ সালের ৩০ জুন সরকারিভাবে গৃহীত।

পর্তুগালের ইতিহাস বলতে আমরা যদি শুধুমাত্র পর্তুগাল দেশটির ইতিহাসকে বুঝি তবে তার সূচনা মধ্যযুগের দ্বিতীয়ার্ধে।[১] এর পূর্বে দেশটির সুদীর্ঘ ইতিহাস ইবেরীয় উপদ্বীপের সামগ্রিক ইতিহাসের সাথেই সংশ্লিষ্ট। কিন্তু মধ্যযুগের দ্বিতীয়ার্ধ থেকেই দেশটির পৃথক জাতিরাষ্ট্র হিসেবে উত্থান ঘটে; ভৌগোলিক আবিষ্কারের যুগে তার আবিষ্কৃত ও অধিকৃত ভূখণ্ডের ক্রমাগত ব্যাপক বিস্তারের ফলে এক বিশাল সাম্রাজ্যের পত্তন হয়[২] ও খ্রিস্টীয় ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীতে পর্তুগাল বিশ্বের একটি প্রধান শক্তি হিসেবে পরিগণিত হতে থাকে। কিন্তু ১৫৭৮ খ্রিষ্টাব্দে আলকাথারকিবিরের যুদ্ধের পর থেকেই তার পতনের সূচনা ঘটে।[৩] তার আন্তর্জাতিক মর্যাদা হ্রাস পায়, সম্পদে ঘাটতি দেখা দেয়, তার সেনাবাহিনী দুর্বল হয়ে পড়ে, নৌবাহিনীরও শক্তিক্ষয় ঘটে এবং শেষপর্যন্ত তা স্পেনীয় আর্মাদার অংশে পরিণত হয়। সপ্তদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি তার পূর্বতন মর্যাদা পুনরুদ্ধার সম্ভব হলেও ১৭৫৫ সালে এক বিধ্বংসী ভূমিকম্পে তার রাজধানী শহর ভীষণরকম ক্ষতিগ্রস্ত হয়।[৪][৫] ঊনবিংশ শতাব্দীর সূচনাপর্বে নেপলিয়নীয় যুদ্ধে এবং ১৮২২ খ্রিষ্টাব্দে তার বৃহত্তম উপনিবেশ ব্রাজিল স্বাধীনতা ঘোষণা করলে[৬] দেশটির অর্থনীতি অত্যন্ত দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থায় নিমজ্জিত হয়ছত ও রাজনৈতিক প্রভাব হ্রাস পায়। ১৯১০ সালে এক অভ্যুত্থানে রাজতন্ত্রের উচ্ছেদ ঘটে ও প্রজাতন্ত্র স্থাপিত হয়।[৭] কিন্ত দুর্নীতিতে নিমজ্জিত, সামাজিক সংঘর্ষে দীর্ণ একটি দেশে সর্বোপরি গির্জার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে এই প্রজাতন্ত্রের পক্ষে বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করে দীর্ঘদিন স্থায়িত্ব বজায় রাখা সম্ভব হয়নি। ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দে এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে প্রজাতন্ত্রের অবসান ঘটে ও দেশে এক একনায়কতন্ত্রী সরকারের প্রতিষ্ঠা হয়। ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত এই একমায়কতন্ত্রই বজায় থাকে। কিন্তু এইসময় সামরিক বাহিনী বিদ্রোহ করলে একনায়কতন্ত্রের অবসান ঘটে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পায়। পরের বছর পর্তুগাল আফ্রিকায় তার অবশিষ্ট সমস্ত উপনিবেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে। ১৯৮৬ থেকে এই দেশ তৎকালীন ইউরোপীয় ইকনমিক কমিউনিটি, বর্তমানে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য।

পর্তুগাল নামের উৎপত্তি[সম্পাদনা]

পর্তুগাল নামটি এসেছে রোমান ভাষার পর্তুস কালে শব্দগুচ্ছ থেকে। বাস্তবে কালে ছিল দোরু নদীর মোহনায় অবস্থিত একটি প্রাচীন জনবসতির নাম। বর্তমান পর্তুগাল দেশটির উত্তরাংশ দিয়ে পূর্ব থেকে পশ্চিমে প্রবাহিত হয়ে এই নদীটি অতলান্ত মহাসাগরে পড়েছে। খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে কার্থেজের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় পুনিক যুদ্ধ বা হ্যানিবলীয় যুদ্ধের সময় রোমান সেনা ইবেরীয় উপদ্বীপে প্রবেশ করে প্রথম এই অঞ্চলে পদার্পণ করে। এই সংঘর্ষের সময়েই কালে অঞ্চলটি রোমানদের অধিকারে আসে। এখানে বর্তমান পোর্তু বা ওপোর্তো শহরের কাছে কেল্টীয়দের একটি প্রাচীন বন্দর ছিল। এই প্রাচীন বন্দরটির জন্যই সম্ভবত রোমানরা অঞ্চলটিকে পোর্তুস কালে (অর্থাৎ কালের বন্দর) নামে অভিহিত করে। মধ্যযুগে ভিসিগথরা এই কালে বন্দর ও তার চারপাশের অঞ্চলকে পর্তুকালে বলে অভিহিত করতো। সপ্তম ও অষ্টম শতাব্দীতে এই পর্তুকালে শব্দটিই অপভ্রংশ হয়ে পর্তুগালেতে পরিণত হয়। এইসময় শব্দটি দ্বারা দোরু নদী ও মিনিও নদীর অন্তর্বর্তী ভূভাগকে বোঝানো হত। এই অঞ্চলটি বর্তমানে স্পেন ও পর্তুগালের সীমান্তবর্তী অঞ্চল।

কিছু ঐতিহাসিকের মতে কালে শব্দটি এসেছে গ্রিক শব্দ "কালেস" (Kalles) থেকে, যার অর্থ 'সুন্দর'। আসলে গ্রিকরা দোরু নদীর উপত্যকার সৌন্দর্য্যে আকৃষ্ট হয়েই এই অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেছিল। ফিনিশীয়দের মুখে শব্দটি পালটে গিয়ে 'কালে'তে পরিণত হয়। শব্দটির এই পরিবর্তিত রূপটিই পরে রোমানরা গ্রহণ করে। আবার অন্যদের মতে, 'কালে' হল কেল্টীয়দের এক দেবীর নাম।[৮] তার নাম থেকেই এই স্থাননামের উৎপত্তি। আবার এই অঞ্চলের প্রাচীন স্থানীয় অধিবাসী গালিথীয়দের ভাষায় 'কালে' বা 'কালা' (Cale বা Cala) শব্দটি বন্দরের একটি প্রতিশব্দ হিসেবেই ব্যবহৃত হত। সেই অর্থেও এই অঞ্চলের স্থাননাম হিসেবে 'কালে' নামটির উৎপত্তি হয়ে থাকতে পারে। সেক্ষেত্রে শব্দটি যে এই অঞ্চলে সুপ্রাচীনকাল থেকেই একটি বন্দরের অস্তিত্ব ছিল তারই সাক্ষবহন করে।[৯]

অপরদিকে ঐ রোমান বিশেষণ পোর্তু শব্দটি এখনও থেকে গেছে ঐ অঞ্চলে দোরু নদীর মোহনায় অবস্থিত বন্দর শহর পোর্তুর নাম হিসেবে। আর নদীর অন্যদিকে অবস্থিত গাইয়া (বিলা নোবা দে গাইয়া) নামক ছোট শহরটি আজও সেই সুপ্রাচীন 'কালে' বসতির নামটিই কিছুটা পরিবর্তিত আকারে বহন করে চলেছে।

প্রাচীন যুগ[সম্পাদনা]

প্রাকরোমীয় যুগ[সম্পাদনা]

মূল নিবন্ধ - প্রাকরোমীয় যুগের ইবেরীয় অধিবাসী (পর্তুগাল)

৩০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ নাগাদ ইবেরীয় উপদ্বীপে বসবাসকারী বিভিন্ন প্রাকরোমীয় জনগোষ্ঠী ও প্রচলিত বিভিন্ন ভাষার অবস্থান সংবলিত মানচিত্র

খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দের শেষের দিকে আজকের ইবেরীয় উপদ্বীপের দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব উপকূল অঞ্চল গ্রিক ও ফিনিশীয় নাবিকদের সংস্পর্শে আসে। এইসময় থেকেই উপদ্বীপের এই অঞ্চলের উপকূল বরাবর বেশ কিছু অস্থায়ী বা কিছু সময়ের জন্য স্থায়ী বাণিজ্যকেন্দ্র গড়ে উঠতে শুরু করে।[১০] উপদ্বীপের অতলান্তিক উপকূলাঞ্চল (অর্থাৎ, আজকের পর্তুগাল যে অংশে অবস্থিত) যেহেতু এই সংস্পর্শ থেকে তুলনামূলকভাবে দূরে ছিল, ভূমধ্যসাগর তীরবর্তী অঞ্চলের তুলনায় এই অঞ্চলের এই সময়ের ইতিহাসের উপাদান তুলনামূলকভাবে অপ্রতুল। উপদ্বীপের প্রথম রাজনৈতিক অস্তিত্ব হিসেবে গ্রিক নথিতে যে উপকথার তারতেসোস রাজত্বের কথা আমরা জানতে পারি, তা এই যুগের (খ্রিস্টপূর্ব নবম শতাব্দী থেকে খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দীর প্রথম দিক) বলেই মনে করা হয়।[১১]

খ্রিস্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দে ইবেরীয় উপদ্বীপে যারা বসবাস করতো তাদের সাধারণভাবে প্রাক-রোমীয় বলে অভিহিত করা হয়ে থাকে। এদের মধ্যে যারা ভূমধ্যসাগরীয় উপকূল অঞ্চলে, এবরো উপত্যকায় এবং গুয়াদালকিবির অঞ্চলে বসবাস করতো - তাদের একত্রে ইবেরো নামে অভিহিত করা হত।[১২] অন্যদিকে ভূমধ্যসাগর থেকে দূরবর্তী দেশাভ্যন্তরের অঞ্চলগুলিতে যারা বসবাস করতো তারা ও তাদের সংস্কৃতি ছিল মূলত কেল্টিক। তবে এই শব্দগুলিকে একটি জাতিগত, সাংস্কৃতিক বা ভাষিক একক হিসেবে ধরে নেওয়াটা বোধহয় ঠিক হবে না। কারণ তখনও পর্যন্ত সেরকম কোনও নির্দিষ্ট জাতি, সংস্কৃতি বা ভাষা হিসেবে তাদের বিকাশ ঘটেনি। তবে এটুকু জানা যায়, খ্রিস্টপূর্ব ২ সহস্রাব্দের শেষদিক থেকে মোটামুটি খ্রিস্টপূর্ব ৭০০ অব্দের মধ্যে বিভিন্ন কেল্টিক উপজাতি উপদ্বীপে প্রবেশ করে ও বর্তমান গালিথিয়া, আস্তুরিয়াস, কান্তাব্রিয়া, কাস্তিয়ার উত্তর অংশ ও বর্তমান পর্তুগালের বিভিন্ন অংশে বসবাস শুরু করে। তার সাথেই এই অঞ্চলগুলিতে সংস্কৃতি ও ভাষার কেল্টীয়করণের একটি প্রক্রিয়া চালু হয়, যা পরবর্তী কয়েক শতাব্দী ধরে সংহত রূপ ধারণ করে।[১৩][১৪] রোমান বিভিন্ন লেখাপত্র থেকে যতদূর জানা যায়, বর্তমান পর্তুগাল অঞ্চলে তখন বসবাস করতো লুসিতানো, গালাইকো বা গাইয়েথি এবং কোনিও উপজাতির মানুষেরা। এছাড়াও অপেক্ষাকৃত কম পরিচিত বা গুরুত্বপূর্ণ যেসব উপজাতি এই অঞ্চলে বসবাস করতো, তারা হল - ব্রাকারো, কেলতিকো, কোয়েলেরনো, একেসো, ইন্তেরামিকো, গ্রোভিও, লেউনো, লুয়ানকো, লিমিকো, নারবাসো, নেমেতাতো, পেসুরে, কুয়াকেরনো, সেউরবো, তামাগানি, তাপোরো, থোয়েলা, তুরদুলো, প্রভৃতি।[১৫]

রোমীয় যুগ[সম্পাদনা]

মূল নিবন্ধ - রোমানদের ইবেরীয় উপদ্বীপ বিজয়

১৯৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ইবেরীয় উপদ্বীপের রোমের অধীন অংশের দুটি প্রশাসনিক প্রদেশ - উত্তর হিসপানিয়া (Hispania Citerior) ও দক্ষিণ হিসপানিয়া (Hispania Ulterior)

ইবেরীয় উপদ্বীপ ছিল ইতালির উত্তরাঞ্চলের সাথে কার্থেজরোম সাম্রাজ্যের মধ্যে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় পুনিক যুদ্ধের অন্যতম পটভূমি। এই যুদ্ধের সময়েই রোমান সেনা ২১৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে প্রথম ইবেরীয় উপদ্বীপের বিভিন্ন উপকূলীয় এলাকায় পদার্পণ করে।[১৬] ২০৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে কার্থেজীয়রা রোমানদের হাতে পরাজিত হলে উপদ্বীপের শাসনক্ষমতা রোমানদের হাতে হস্তান্তরিত হয়।[১৬] ২০২ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে রোমানরা উপদ্বীপের বিভিন্ন অংশের উপর তাদের অধিকার বিস্তার করতে শুরু করে। ১৯৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে রোমানরা উপদ্বীপের ভূমধ্যসাগরীয় উপকূলের নিজেদের শাসনাধীন এলাকাকে প্রশাসনিকভাবে দু'টি পৃথক প্রদেশে ভাগ করে - উত্তর হিসপানিয়া (Hispania Citerior) ও দক্ষিণ হিসপানিয়া (Hispania Ulterior)।[১৬]

তবে স্থানীয় কেল্টীয় জনসমষ্টি স্বেচ্ছায় বা বিনাসংগ্রামে রোমানদের শাসন মেনে নেয়নি। বস্তুত যে মুহূর্তে রোমানরা উপদ্বীপের মাটিতে পা রাখে, সেই মুহূর্ত থেকেই শুরু হয় তাদের প্রতিরোধ। ১৯৭ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে হিসপানিয়ায় রোমানদের শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সময় থেকেই তাদের সাথে স্থানীয় কেল্টীয় জনসমষ্টির এই বিরোধ কিছুদিনের মধ্যেই থেলতিবেরীয় যুদ্ধের রূপ পরিগ্রহ করে। যুদ্ধে শেষপর্যন্ত রোমানরা জয়ী হলে ১৭৯ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে প্রখ্যাত রোমান রাজনীতিবিদ তিবেরিয়াস সেমপ্রোনিয়াস গ্রাকাসের উদ্যোগে উভয়পক্ষের মধ্যে যে চুক্তি হয়, তার মধ্য দিয়ে বিশেষত লুসো জনগোষ্ঠী রোমের কাছে আত্মসমর্পণ করে ও তাদের অধীনতা মেনে নেয়।[১৭] তবে এই চুক্তিও হিসপানিয়ার রোমান প্রদেশদু'টিতে শান্তি প্রতিষ্ঠিত করতে ব্যর্থ হয়। কারণ আরেকটি কেল্টীয় গোষ্ঠী লুসিতানোরাও রোমানদের অধীনতা স্বীকার করতে অস্বীকার করে। বিরোধ ক্রমাগত বাড়তে বাড়তে অচিরেই বিদ্রোহের রূপ নেয়।

১৫৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ইবেরীয় উপদ্বীপে রোমান ও অন্যান্য কেল্টীয় শক্তির অবস্থান সংবলিত মানচিত্র

১৫৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে থেলতিবেরীয়রা বিদ্রোহ করলে আবার যুদ্ধ শুরু হয়। ইতিহাসে এই যুদ্ধ লুসিতানিয়ার যুদ্ধ নামে পরিচিত। শেষপর্যন্ত চার বছর পরে রোমানদের পক্ষে লুসিতানীয়দের পরাজিত করে বিদ্রোহ দমন করা সম্ভব হয়। তবে তাতেও দীর্ঘস্থায়ী শান্তিপ্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়নি। লুসিতানোদের নতুন নেতা হন ভিরিয়াতো বলে একজন ইতিপূর্বে স্বল্পপরিচিত মানুষ, কিন্তু রোমানদের বিরুদ্ধে তিনি সংগ্রাম চালিয়ে যান। কিছুদিনের মধ্যেই তিনি বিদ্রোহী লুসিতানোদের মধ্যে প্রচণ্ড জনপ্রিয়তা অর্জন করেন এবং আশেপাশের বিভিন্ন কেল্টীয় ও ইবেরো উপজাতিদের সাথে মিলে ১৪৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ১৩৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে রোমানদের বারবার পরাজিত করেন। শেষপর্যন্ত ১৩৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে বর্তমান পর্তুগালের ভিসেও শহরের কাছে বিশ্বাসঘাতকতার ফলে ঘুমের মধ্যে খুন হন তিনি। এর পিছনে রোমানদের হাত থাকার অভিযোগে আবার নতুন করে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে।

সম্রাট অগাস্টাসের সময়ে হওয়া প্রশাসনিক কাঠামো সংস্কারের ফলে জন্ম নেওয়া ইবেরীয় উপদ্বীপের তিনটি রোমান প্রদেশ

১৩৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে রোমানরা বর্তমান লিসবন শহর যেখানে অবস্থিত সেখানে একটি দুর্গ গড়ে তুলতে শুরু করে। খ্রিস্টপূর্ব ৬০ অব্দে সেখানে জুলিয়াস সিজার নিজে পদার্পণ করেন ও লুসিতানোদের শেষ বিদ্রোহের কেন্দ্রটিও রোমানদের হাতে চলে যায়। পরবর্তী প্রায় চার শতাব্দী এই অঞ্চল রোমের অধীনে থাকে। ২৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সম্রাট অগাস্টাসের সময় একটি উল্লেখযোগ্য প্রশাসনিক কাঠামোর রদবদল অনুষ্ঠিত হয়। এইসময় সমগ্র ইবেরীয় উপদ্বীপকে তিনটি প্রদেশে ভাগ করা হয় - বেতিকা, হিসপানিয়া তারাকোনেনসে (পূর্বতন নিকট হিসপানিয়ার পরিবর্ধিত রূপ) ও লুসিতানিয়া। এই লুসিতানিয়া প্রদেশের প্রশাসনিক প্রধানকেন্দ্র ছিল এমেরিতা আউগুস্তা (Emérita Augusta) - বর্তমান স্পেনের মেরিদা শহর। লুসিতানিয়া প্রদেশটিকেও আবার প্রশাসনিকভাবে তিনটি বিচারবিভাগীয় কনভেন্ট'এ (conventos) ভাগ করা হয়: পাথেনসিস (প্রশাসনিক সদরদপ্তর প্রাক্স ইউলিয়া, বর্তমান পর্তুগালের বেজা শহর), স্কালাবিটানুস (প্রশাসনিক সদরদপ্তর স্কালাবিস, বর্তমান পর্তুগালের সাঁতারিয়া) ও এমেরিটেনসিস (প্রশাসনিক সদরদপ্তর এমেরিতা আউগুস্তা, বর্তমান মেরিদা)। দোরু নদীর দক্ষিণে আজকের প্রায় সমগ্র পর্তুগালই ছিল এই লুসিতানিয়ার অঙ্গ। তাছাড়াও বর্তমান স্পেনের সালামানকাকাথেরেস প্রদেশ, আবিলা প্রদেশের বৃহদংশ, থামোরা প্রদেশের একটি অংশ, তোলেদো প্রদেশের পূর্বাংশ ও বাদাখোথেরও একটি অংশ লুসিতানিয়ার মধ্যে পড়েছিল।

খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতাব্দীর শেষদিকে রোমের সম্রাট ডিওক্লেশিয়ানুসের আমলে হিসপানিয়া তারাকোনেনসেকে পুনরায় তিনটি প্রদেশে বিভক্ত করা হয়। এর মধ্যে একেবারে উত্তরপশ্চিমের প্রদেশটি ছিল ইসপানিয়া কার্তাখিনেনসে ও কাইয়েথিয়া বা গাইয়েথিয়াদোরু নদীর উত্তরে বর্তমানে পর্তুগালের যে অংশ আছে, তা এই গাইয়েথিয়া প্রদেশের অধীন ছিল।

এই অঞ্চলে বসবাসকারী কেল্টীয় বিভিন্ন জনগোষ্ঠী ছিল মূলত খ্রিস্টধর্মপূর্ব বিভিন্ন প্যাগান ধর্মের অনুসারী। তাদের মধ্যে এমনকি মানুষ বলী দেওয়ার প্রথাও চালু ছিল। অন্তত আলেক্সান্দ্রিয়ার গ্রিক বংশোদ্ভূত রোমান ঐতিহাসিক আপিয়ানুসের লেখা সেই সাক্ষ বহন করে।[১৮] খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতক থেকে এই অঞ্চলে সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক হারে খ্রিস্টধর্ম ছড়িয়ে পড়তে থাকে; চারটি পৃথক ডিওসেসিসও (ব্রাগা, ওসোনবা, এবোরা ও লিসবন) তৈরি হয়। এদের মধ্যে ব্রাগা ছিল প্রাচীনতম।

মধ্যযুগ[সম্পাদনা]

বর্বর জার্মানিক জাতিগুলির আক্রমণ[সম্পাদনা]

খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতাব্দীর শেষের দিকে ভিসিগথ রাজা দ্বিতীয় আলারিকোর সময়ে ইবেরীয় উপদ্বীপে সুয়েবীয় ও ভিসিগথদের রাজ্য

৪০৯ খ্রিষ্টাব্দে বিভিন্ন বর্বর জাতি, যেমন - সুয়েবীয়, আলান, ভ্যান্ডাল (আসডিঙ্গারসিলিঙ্গার), প্রভৃতি মূলত উত্তরের দিক থেকে ইবেরীয় উপদ্বীপে প্রবেশ করে। একমাত্র আলানরা বাদে এরা প্রায় সবাই ছিল জার্মানিক উপজাতি; আলানরা ছিল ইরানীয়। ৪১১ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে এরা সমগ্র উপদ্বীপই দখল করে ফেলে নিজেদের অধীন অঞ্চলে নিজেদের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। ফলে সমগ্র উপদ্বীপ অনেকগুলি রাজ্যে ভাগ হয়ে পড়ে: ভ্যান্ডাল আসডিঙ্গাররা গাইয়েথিয়া অধিকার করে বসে, দোরু নদীর উত্তরের অঞ্চল দখল করে সুয়েবীয়রা; লুসিতানিয়া ও কার্তাখিনেনসের দখল যায় আলানদের হাতে, অন্যদিকে বেতিকা দখল করে ভ্যান্ডাল সিলিঙ্গাররা।

ঐ একই সময়ে ভিসিগথরাও ইবেরীয় উপদ্বীপে পদার্পণ করে। তবে তারা আসে প্রথমে রোমানদের দ্বারাই নিয়োজিত হয়ে। লক্ষ্য ছিল আক্রমণকারী বর্বর জাতিগুলিকে প্রতিরোধ করা।

উপরে উল্লিখিত বিভিন্ন উপজাতির মধ্যে সুয়েবীয় ও ভিসিগথরা বর্তমান পর্তুগাল অঞ্চলে তাদের দীর্ঘ উপস্থিতির কারণে এই আলোচনায় বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সুয়েবীয়রা তাদের রাজ্যের রাজধানী স্থাপন করে ব্রাগাতে (তৎকালীন নাম ব্রাকারা) ও সেখান থেকে গালিথিয়া এবং লুসিতানিয়ার দিকে তাদের রাজত্বের বিস্তার ঘটায়। তারা প্রথমদিকে ছিল প্যাগান, কিন্তু পরে স্থানীয় রোমান ক্যাথলিক আর্চবিশপ সাধু মার্তিন দে ব্রাগার প্রভাবে তারা খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণ করে। ৪৭০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে সুয়েবীয়দের সাথে প্রতিবেশী ভিসিগথদের বিরোধ দানা বেঁধে উঠতে শুরু করে। ৫৮৫ খ্রিষ্টাব্দে তোলেদোর ভিসিগথ রাজা লেওভিগিলড ব্রাগা দখল করেন ও সুয়েবীয়দের আলাদা রাজ্যের অবসান ঘটিয়ে ভিসিগথদের রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করে নেন। এইসময় থেকে প্রায় সমগ্র ইবেরীয় উপদ্বীপই ভিসিগথদের অধীনে চলে যায়। শুধুমাত্র ভূমধ্যসাগর তীরবর্তী সামান্য কিছু অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ তখনও থেকে গিয়েছিল পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের হাতে।

এইসময় শাসক জার্মানিক উপজাতিগুলি উপদ্বীপের বেশিরভাগ অঞ্চলেই স্থানীয়দের তুলনায় ছিল সংখ্যালঘু। সেইকারণেই নিজেদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখার স্বার্থে তারা প্রথমদিকে স্থানীয়দের থেকে কঠোরভাবে নিজেদের দূরত্ব বজায় রাখত। ফলে স্বাভাবিকভাবেই ধর্মীয় ও ভাষাগত দিক থেকেও সেইসময় তাদের মধ্যে সেরকম কোনও মিশ্রণ ঘটেনি। এমনকি স্থানীয় ও শাসক জার্মানিক উপজাতির মধ্যে বিবাহও তখন নিষিদ্ধ ছিল। যাইহোক, উপদ্বীপের বেশিরভাগ অঞ্চলে ভিসিগথদের রাজত্ব এবং উত্তরপশ্চিম অংশে সুয়েবীয় রাজ্য যত সংহত হয়ে শক্তিসঞ্চয় করতে শুরু করে, শাসক ও শাসিত উপজাতিগুলির মধ্যে এই বিভাজনও ততই কমে আসতে শুরু করে। স্থানীয় জনসমষ্টিগুলি একদিকে রাজনৈতিকভাবে শাসকদের কাছাকাছি আসতে সক্ষম হয়, অন্যদিকে উভয়পক্ষই খ্রিস্টধর্মের ছত্রছায়ায় আসার ফলে তাদের মধ্যে ধর্মীয় পার্থক্যও মুছে যায়। ধীরে ধীরে উভয়পক্ষের মধ্যে আইনি অধিকারের পার্থিক্যও মোটের উপর অন্তর্হিত হয়; মিশ্র বিবাহও স্বীকৃতি পায়। ফলে সমগ্র উপদ্বীপ জুড়েই একধরনের জাতিগত ও সাংস্কৃতিক মিশ্রণ গতি লাভ করে ও তার মধ্য দিয়ে এক বৃহত্তর জাতীয় ও সাংস্কৃতিক ঐক্যের সূচনা ঘটে।

মধ্যযুগের ইউরোপে সর্বত্র যা বৈশিষ্ট্য ছিল, সেই একইভাবে এইসময় ইবেরীয় উপদ্বীপেও অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি হয়ে দাঁড়ায় গ্রামগুলি। গ্রামীণ অর্থনীতির এই বিকাশের সাথে সাথেই শহরগুলি দুর্বল হয়ে পড়তে শুরু করে এবং শহুরে জীবনের আগের বৈচিত্র ও আকর্ষণও বহুলাংশে হারিয়ে যায়।

মুসলমান আমল[সম্পাদনা]

মূল নিবন্ধ - ইবেরীয় উপদ্বীপে মুসলমান আগ্রাসন (অষ্টম শতাব্দী)
৭১১ খ্রিষ্টাব্দে ইবেরীয় উপদ্বীপ ও তার অঙ্গ হিসেবে আজকের পর্তুগালও দামাস্কাসের খলিফাদের অধীন হয়ে পড়ে। মূলত উত্তর আফ্রিকার অধিবাসী বেরেবেররা কিছু আরব সৈন্য ও সেনাধিপতির সহায়তায় উপদ্বীপে এই জয় অর্জন করে। পরবর্তী দুই শতাব্দী ধরে দামাস্কাসের খলিফার বাহিনী ও উপদ্বীপে খলিফা নিযুক্ত প্রশাসকদের মূল লড়াই হয়ে দাঁড়ায় সমগ্র উপদ্বীপের উপর তাদের কব্জা প্রতিষ্ঠা করা ও বজায় রাখা। কিন্তু খ্রিস্টীয় শক্তি রুখে দাঁড়িয়ে উপদ্বীপে তাদের প্রাথমিক বিজয় অর্জন করার পর আল আন্দালুস উমাইয়া খিলাফতের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে নিজস্ব স্বাধীন আমিরশাহী প্রতিষ্ঠা করে; আরও পরে কর্দোবাতে স্বাধীন কর্দোবা খিলাফত প্রতিষ্ঠিত হয়। ৭১২ খ্রিষ্টাব্দে ভিসিগথদের রাজধানী তোলেদোর পতন ঘটে। এরপর মুসলমান শাসন ক্রমাগত উপদ্বীপের উত্তরে ছড়িয়ে পড়ে ও একের পর এক শহর ও জনপদ তাদের পদানত হয়। ৭১৬ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যেই সমগ্র উপদ্বীপই তাদের অধীনস্থ হয়ে পড়ে। অবশ্য উত্তরের অংশে তাদের কর্তৃত্ব ছিল তুলনামূলকভাবে দুর্বল। সেখানে মুসলমানদের সামরিক উপস্থিতিও ছিল তুলনামূলকভাবে নগন্য। এরপরে তাদের মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় পিরেনিজ পর্বতমালা ডিঙিয়ে বর্তমান ফ্রান্সে প্রবেশ করা ও সেখানের তৎকালীন ক্যারোলিনীয় সাম্রা্জ্যকে নিজেদের অধীনে নিয়ে আসা।

৭১৮ খ্রিষ্টাব্দে তাদের এই ক্রমাগত উত্তরমুখী জয়যাত্রা প্রথম বাধাপ্রাপ্ত হয়। আস্তুরিয়াসের অধিবাসীরা একজন অভিজাত ভিসিগথ দন পেলাইয়োর নেতৃত্বে তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। ৭২২ খ্রিষ্টাব্দে কোবাদোঙ্গার যুদ্ধে পেলাইয়োর নেতৃত্বে বিদ্রোহীরা জয়ী হলে স্বাধীন আস্তুরিয়াস রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়।

৮ম ও ৯ম খ্রিষ্টাব্দের ইবেরীয় উপদ্বীপের ইতিহাস মুসলমান শাসকদের ক্রমান্বয়ে ক্ষমতাবৃদ্ধিরই ইতিহাস। যদিও সে'সময়েও উপদ্বীপের উত্তরাংশে খ্রিস্টীয় শাসকদের শাসন অন্তত কিছু অংশে বজায় ছিল। ১০ম শতাব্দীতে তৃতীয় আবদুর রহমান আল আন্দালুসকে এক পৃথক ও স্বাধীন খিলাফতে পরিণত করেন।

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. Ribeiro, Ângelo; Hermano, José (2004). História de Portugal I – a Formação do Território [পর্তুগালের ইতিহাস – দেশের সীমানা গঠন] (পর্তুগিজ ভাষায়). QuidNovi. ISBN 978-989-554-106-5.
  2. Juang, Richard M.; Morrissette, Noelle (2008). Africa and the Americas: Culture, Politics, and History : a Multidisciplinary Encyclopedia. ABC-CLIO. p. 894. ISBN 9781851094417. সংগৃহীত ২৬ মার্চ, ২০১৯।
  3. Livermore, Harold V. (1969). A New History of Portugal. Cambridge University Press. পৃঃ - ১৫৭-৮।
  4. Between History and Periodicity: Printed and Hand-Written News in 18th-Century Portugal
  5. Pereira, A.S. "The Opportunity of a Disaster: The Economic Impact of the 1755 Lisbon Earthquake". Discussion Paper 06/03, Centre for Historical Economics and Related Research at York, York University, 2006.
  6. Levine, Robert M. (2003). The History of Brazil. Palgrave Macmillan. pp. 59–61. ISBN 978-1-4039-6255-3.
  7. Wheeler, Douglas L. (1998). Republican Portugal: A Political History, 1910–1926. University of Wisconsin Press. ISBN 0-299-07450-1. পৃঃ- ৪৮-৬১।
  8. JULIEN, Nadia (2008). Enciclopedia de los mitos. Teia: Swing. p. 21. ISBN 978-84-967-4-6305.
  9. Pezron, Paul (1706). Celtic Linguistics. P. 270. ISBN 978-0-415-20479-8. সংগৃহীত ৭/৪/২০১৯।
  10. Patérculo, Veleyo (29 a. C.). Historiarum Libri Duo. সংগৃহীত ৬ জুলাই, ২০১৯।
  11. Aunión, Juan Antonio (9 de junio de 2017). "Tartesos trata de sobrevivir a sus mitos". El País. সংগৃহীত ০৭ জুলাই, ২০১৯।
  12. Rueda, Carmen; Sánchez, Alberto; Amate, Pilar (2018-11-30). "The history of the Iberians" ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ৬ এপ্রিল ২০২০ তারিখে. blog.europeana.eu. Europeana – CC BY-SA. সংগৃহীত ২৭ জুন, ২০১৯।
  13. R. Luján Martínez, Eugenio (2005) "The Language(s) of the Callaeci"; Journal of Interdisciplinary Celtic Studies 6: 715–748.
  14. Coutinhas, José Manuel (2006) Aproximação à identidade etno-cultural dos Callaici Bracari, Porto. (পর্তুগিজ ভাষায়)
  15. Luís Fraga da Silva Ethnologic Map of Pre-Roman Iberia (circa 200 B.C.).
  16. "Artigo de apoio Infopédia – Romanização da Península Ibérica". Infopédia – Dicionários Porto Editora. (পর্তুগিজ ভাষায়) সংগৃহীত ২৭ জুন, ২০১৯।
  17. Appian. Roman History, The Foreigh Wars, Book 6, The Wars in Spain, 141-301. সংগৃহীত ১৬ আগস্ট, ২০১৯।
  18. Apiano de Alejandría: Historia de Roma, Sobre Iberia Textos clasicos. (স্পেনীয় ভাষা) সংগৃহীত ৭ জুলাই, ২০১৯।