সংস্কৃতির প্রতিভূ

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
(সাংস্কৃতিক প্রতিভূ থেকে পুনর্নির্দেশিত)
বিভিন্ন দেশের সংস্কৃতির প্রতিভূ হিসেবে গণ্য মানবনির্মিত স্থাপনা (উপর থেকে নিচে ও বাম থেকে ডানে): মিশরের পিরামিড, ফ্রান্সের আইফেল টাওয়ার বুরূজ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যাচু অফ লিবার্টি, যুক্তরাজ্যের বিগ বেন ঘণ্টাবুরূজ
নাট্যকার উইলিয়াম শেকসপিয়ারকে ইংরেজ সংস্কৃতির একজন প্রতিভূ হিসেবে গণ্য করা হয়।

কোনও সংস্কৃতির প্রতিভূ বলতে এমন কোনও ব্যক্তি,বস্তু, স্থান বা ধারণাকে বোঝায়, যাকে কোনও মানব সংস্কৃতির সদস্যদের সিংহভাগ ঐ সংস্কৃতির একটি প্রতিনিধি হিসেবে চিহ্নিত ও স্বীকৃতি দান করে। প্রতিভূ চিহ্নিতকরণের প্রক্রিয়াটি বস্তুনিষ্ঠ নয়, বরং ব্যক্তিনিষ্ঠ। কোনও সংস্কৃতির সদস্যদের চোখে আপাতদৃষ্টিতে কিছু মানদণ্ডে উত্তীর্ণ হলে কেউ বা কোনও কিছুকে "প্রতিভূ" হিসেবে চিহ্নিত করা হতে পারে। সাধারণত অসাধারণ মাত্রায় ব্যাপকভাবে পরিচিত কোনও ব্যক্তি বা বস্তু যদি বহুসংখ্যক লোকের কাছে স্থান ও কালের সীমা ছাড়িয়ে বহু-বিভিন্নভাবে অর্থবহ হয়ে ওঠে ও তার আদি অর্থ, কার্য, পরিপ্রেক্ষিত ও তাৎপর্যকে অতিক্রম করে, তবে তাকে প্রতিভূর মর্যাদা দেওয়া হতে পারে।[১] সংস্কৃতির প্রতিভূগুলিকে কোনও সংস্কৃতির মাইলফলক বা কষ্টিপাথর হিসেবে ও সেটির অনন্য পরিচয় ও ঐতিহ্যের প্রতিনিধি হিসেবে গণ্য করা হতে পারে। সংস্কৃতির প্রতিভূরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ ও উদযাপনে ব্যবহৃত হতে পারে। আবার এগুলিকে পণ্য ও সেবার বাণিজ্যিকীকরণেও ব্যবহার করা হতে পারে। সাধারণত এগুলি বৃহৎ সংখ্যক লোকের সামষ্টিক স্মৃতিতে বিরাজ করে ও টিকে থাকে, আকর্ষণীয় হয়, অতীতবিধুরতার সৃষ্টি করে এবং বিভিন্নজনের কাছে বিভিন্ন অর্থ বহন করে।[২]

রাজনৈতিক নেতা, শিল্পী ও বিখ্যাত ব্যক্তি, বিশিষ্ট স্থান ও স্মৃতিসৌধকে সাংস্কৃতিক প্রতিভূর কিছু উদাহরণ হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে। যেমন আইফেল টাওয়ার ফ্রান্সের, ফুজি পর্বত জাপানের ও স্ট্যাচু অভ লিবার্টি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংস্কৃতির প্রতিভূ হিসেবে পরিগণিত হয়।

জনপ্রিয় সংস্কৃতিতে ও অন্যান্য স্থানে "প্রতিভূ" শব্দটি দিয়ে বহু বিভিন্ন প্রকারের ব্যক্তি, স্থান ও বস্তুকে চরিত্রায়িত করা হতে পারে। কোনও কোনও ভাষ্যকার বিশ্বাস করেন যে ইংরেজি ভাষাভাষী বিশ্বে "প্রতিভূ" কথাটির ইংরেজি পরিভাষা "আইকন" শব্দটি অতিব্যবহৃত হয়ে পড়েছে। ব্রিটিশ শিল্পকলা ঐতিহাসিক মার্টিন কেম্পের মতে "আইকন (প্রতিভূ) পরিভাষাটি এখন এমন উদারহস্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেওয়া হয় এবং এমনভাবে ক্ষণস্থায়ী ও স্থানীয় খ্যাতিবিশিষ্ট ব্যক্তি বা বস্তুর উপর প্রয়োগ করা হয় যে এটির গুরুত্ব হ্রাস পেতে শুরু করেছে।"[৩]

শ্রেণিবিভাজন[সম্পাদনা]

কানাডীয় যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ এমিলি ট্রুম্যান ২০১৭ সালে একটি নিবন্ধে সাংস্কৃতিক প্রতিভূগুলিকে ব্যক্তি, স্থান ও বস্তু - এই তিনটি প্রধান শ্রেণীতে বিভক্ত করেন। তিনি অতঃপর ব্যক্তি শ্রেণীটিকে একক ব্যক্তি, ব্যক্তির দল ও প্রাণী - এই তিনটি উপশ্রেণীতে, স্থান শ্রেণীটিকে ভৌগোলিক ও ধারণাগত - এই দুইটি উপশ্রেণীতে এবং বস্তু শ্রেণীটিকে বস্তু, ধারণা ও সংগঠন -এই তিনটি উপশ্রেণীতে ভাগ করেন।[৪]

সাংস্কৃতিক প্রতিভূর মানদণ্ড[সম্পাদনা]

একটি সাংস্কৃতিক প্রতিভূর মানদণ্ডগুলি নিম্নরূপ।

  1. শনাক্তযোগ্যতা - কোনও সংস্কৃতির প্রতিভূকে অবশ্যই বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কাছে সহজে শনাক্তযোগ্য ও খ্যাতিমান হতে হবে।[৫]
  2. গণ-আকর্ষণ ক্ষমতা - তাকে অবশ্যই ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় ও স্বীকৃত হতে হবে।
  3. কালোত্তীর্ণতা - তাকে অবশ্যই সময়ের সীমানা পেরিয়ে টিকে থাকতে হবে ও বহু প্রজন্ম ধরে স্বীকৃত বা পরিচিত থাকতে হবে।[৬]
  4. সংস্কৃতি-ঘনিষ্ঠতা - তাকে অবশ্যই কোনও বিশেষ সংস্কৃতি বা সম্প্রদায়ের সাথে সংশ্লিষ্ট হতে হবে।
  5. স্মরণীয়তা - তাকে অবশ্যই স্মরণীয় হতে হবে ও লোকমানসে দীর্ঘস্থায়ী ছাপ ফেলতে হবে।[৭]
  6. প্রথাবিরুদ্ধতা - তাকে অবশ্যই প্রতিষ্ঠিত প্রথাগত রীতিনীতি ও ধ্যানধারণার বিরোধী হতে হবে।
  7. বিনোদন দানের ক্ষমতা - তাকে অবশ্যই বিনোদনধর্মী বা উপভোগ্য হতে হবে।
  8. আবেগ উদ্রেকের ক্ষমতা - তাকে অবশ্যই মানুষের মনে গভীর আবেগের সঞ্চার করতে হবে, যেমন আনন্দ, উচ্ছ্বাস, অতীতবিধুরতা, অনুপ্রেরণা, সহমর্মিতা, ইত্যাদি
  9. ইন্দ্রিয় উদ্দীপক ক্ষমতা - তাকে অবশ্যই একাধিক ইন্দ্রিয়কে উদ্দীপ্ত করতে হবে, যেমন দৃশ্য, শব্দ ও স্পর্শ।[৮]
  10. প্রাসঙ্গিকতা - তাকে বর্তমান জনগণের কাছে অর্থবহ ও প্রাসঙ্গিক হতে হবে।
  11. অকৃত্রিমতা - তাকে অবশ্যই সংস্কৃতির সাথে অকৃত্রিমভাবে সংযুক্ত হতে হবে, কৃত্রিমভাবে নির্মিত হওয়া যাবে না।
  12. রূপান্তরকারক ক্ষমতা - তার অবশ্যই মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি বদলানো ও তাদেরকে অনুপ্রাণিত করার ক্ষমতা থাকতে হবে ও সংস্কৃতির সামষ্টিক স্মৃতির পুনর্নির্মাণ করার ক্ষমতা থাকতে অহবে।[৯]
  13. দ্ব্যর্থবোধকতা - তার মাঝে কিছু মাত্রায় দ্ব্যর্থবোধকতা ও জটিলতা থাকতে হবে, যাতে তাকে বিভিন্নভাবে ও বিভিন্ন অর্থে ব্যাখ্যা করা যায়।
  14. পুনরুৎপাদনযোগ্যতা - তার একটি স্মরণীয় স্থিতিশীল মান রূপ থাকতে হবে, যাতে সেটির মোটা দাগের রূপরেখা পরিবর্তনের মধ্য দিয়েও টিকে থাকে।
  15. উপাখ্যান - তার তাৎপর্য ব্যাখাকারী একটি কাহিনী বা উপাখ্যান থাকতে হবে।[১০]


তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. Martin Kemp (২০১২), Christ to Coke: How Image Becomes Icon, Oxford University Press, পৃষ্ঠা 3, An iconic image is one that has achieved wholly exceptional levels of widespread recognisability and has come to carry a rich series of varied associations for very large numbers of people across time and cultures 
  2. Trudie Walters (২০১৪), "'Cultural icons': media representations of second homes in New Zealand", Journal of Tourism Consumption and Practice, 6: 81–103, [Cultural icons] represent something distinct in a culture or way of life, they are recognisable as such, they are durable, they reside in the collective memory of a large group of people, they provoke nostalgia and are seductive, and are filled with meaning which may vary between people. 
  3. Martin Kemp (২০১২), Christ to Coke: How Image Becomes Icon, Oxford University Press, পৃষ্ঠা 3, The term iconic is now scattered around so liberally and applied to f igures or things of passing and local celebrity it has tended to become debased. 
  4. Truman, Emily (২০১৭)। "Rethinking the Cultural Icon: Its Use and Function in Popular Culture"Canadian Journal of Communication42 (5): 829–849। ডিওআই:10.22230/cjc.2017v42n5a3223 
  5. Erica van Boven; Marieke Winkler, সম্পাদকগণ (২০২১), "Introduction", The Construction and Dynamics of Cultural Icons, Amsterdam University Press, পৃষ্ঠা 11–24, An icon is always widely known and instantly recognized by a certain audience 
  6. Erica van Boven; Marieke Winkler, সম্পাদকগণ (২০২১), "Introduction", The Construction and Dynamics of Cultural Icons, Amsterdam University Press, পৃষ্ঠা 11–24, Continuity is also a main quality of icons. 
  7. M. F. Rogers (১৯৯৯), Barbie culture, SAGE publications, পৃষ্ঠা 6, [icon] is a memorable something. 
  8. Erica van Boven; Marieke Winkler, সম্পাদকগণ (২০২১), "Introduction", The Construction and Dynamics of Cultural Icons, Amsterdam University Press, পৃষ্ঠা 11–24, [Icons] appeal to basic visual and conceptual senses in such a way that they become iconic. 
  9. Erica van Boven; Marieke Winkler, সম্পাদকগণ (২০২১), "Introduction", The Construction and Dynamics of Cultural Icons, Amsterdam University Press, পৃষ্ঠা 11–24, ...icons are not just representations...they play an important role in shaping both individual and collective values. 
  10. Erica van Boven; Marieke Winkler, সম্পাদকগণ (২০২১), "Introduction", The Construction and Dynamics of Cultural Icons, Amsterdam University Press, পৃষ্ঠা 11–24, A narrative is needed to reveal their significance. 

গ্রন্থ ও উৎসপঞ্জি[সম্পাদনা]

  • Biedermann, Hans (১৯৯৪)। Dictionary of Symbolism: Cultural Icons and the Meanings Behind Them। Meridan। 
  • Brooker, Will (২০০১)। Batman Unmasked: Analysing a Cultural Icon। Continuum। 
  • Edwards, Peter; Enenkel, Karl; Graham, Elspeth, সম্পাদকগণ (২০১১)। The Horse as Cultural Icon: The Real and the Symbolic Horse in the Early Modern World। Brill। 
  • Foudy, Julie; Leslie Heywood; Shari L Dworkin (২০০৩)। Built to Win: The Female Athlete as Cultural Icon। University of Minnesota Press। 
  • Gilbert, Erik (২০০৮)। The Dhow as Cultural Icon। Boston University। * Heyer, Paul (২০১২)। Titanic Century: Media, Myth, and the Making of a Cultural Icon। Praeger। 
  • Heyer, Paul (২০১২)। Titanic Century: Media, Myth, and the Making of a Cultural Icon। Praeger। 
  • Meyer, Denis C. (২০১০)। Cles Pour la France en 80 Icones Culturelles। Hachette। 
  • Nelkin, Dorothy; M Susan Lindee (২০০৪)। The DNA Mystique: The Gene as a Cultural Icon। University of Michigan Press। 
  • Reydams-Schils, Gretchen J (২০০৩)। Plato's Timaeus as Cultural Icon। University of Notre Dame Press। 

বহিঃসংযোগ[সম্পাদনা]