শাফিয়া খাতুন

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
শাফিয়া খাতুন
জন্ম (1931-01-15) জানুয়ারি ১৫, ১৯৩১ (বয়স ৯৩)
মৃত্যু১১ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৩
জাতীয়তা বাংলাদেশ
মাতৃশিক্ষায়তনলেডি ব্রাবোর্ন কলেজ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
যুক্তরাষ্ট্রের উত্তর কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয়
পেশাশিক্ষাবিদ, সংগঠক
পরিচিতির কারণভাষা সৈনিক
পিতা-মাতা
  • আসগর আলী (পিতা)

শাফিয়া খাতুন (১৫ জানুয়ারি ১৯৩১ - ১১ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৩) ছিলেন একজন বাংলাদেশি ভাষাসৈনিক, শিক্ষাবিদ, সংগঠক এবং সাবেক সমাজ কল্যাণ ও মহিলা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা (মন্ত্রী)। এক সময়ের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রীদের একমাত্র আবাসস্থল চামেলি হাউস ছাত্র সংসদের ভিপি ছিলেন। [১]

প্রারম্ভিক জীবন[সম্পাদনা]

শাফিয়া ১৯৩১ সালের ১৫ জানুয়ারি লালমনিরহাট জেলার আদিতমারী উপজেলাধীন বিন্নাগারী (বর্তমান দক্ষিণ বত্রিশ হাজারী) গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা মীর আসগর আলী ছিলেন খ্যাতনাম আইনজীবী। আসগর আলী কলকাতায় আইন পেশায় নিযুক্ত ছিলেন।

শিক্ষা জীবন[সম্পাদনা]

শাফিয়া খাতুন ১৯৪৬ সালে মেট্রিক, ১৯৪৮ সালে লেডি ব্রাবোর্ন কলেজ থেকে আইএ ও পরে বিএ পাস করেন। ১৯৫০ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমএ প্রথম পর্বে ভর্তি হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ থেকে তিনি এমএ, ১৯৬১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনসটিটিউট থেকে এম.এড. ডিগ্রী এবং ১৯৬৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের উত্তর কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মনোবিজ্ঞানে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন।

কর্মজীবন[সম্পাদনা]

শাফিয়া খাতুন ১৯৬৬ সালে অধ্যাপক হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা ও গবেষণা ইনসটিটিউটে যোগদান করেন। তিনি ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সদস্য নিযুক্ত হন। ১৯৮৩ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট এইচ. এম. এরশাদ তাকে সমাজ কল্যাণ ও মহিলা বিষয়ক মন্ত্রনালয়ের উপদেষ্টা নিয়োগ করেন। তার হাত দিয়েই ১৯৮৪ সালের ১ ফেব্রুয়ারি লালমনিরহাট জেলা উদ্বোধন হয়। [২]

ভাষা সৈনিক[সম্পাদনা]

১৯৫২ সালে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার কথা ঘোষণা করলে ছাত্র-জনতার মধ্যে তাৎক্ষণিকভাবে যে প্রতিক্রিয়া হয় শাফিয়া খাতুন তাতে আন্দোলিত হন। তিনি উইমেন স্টুডেন্টস ইউনিয়নের ভিপি হিসেবে এ সময় ভাষা আন্দোলনে ছাত্রীদের সংগঠিত করার কাজে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। শাফিয়া খাতুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রীনিবাস ‘চামেলি হাউসে’র ছাত্রীদের নিয়ে বৈঠক করেন এবং তাদের রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে আন্দোলনে শরিক হতে আহ্বান জানান। ভাষা সৈনিক রওশন আরা বাচ্চু তার স্মৃতিচারণে শাফিয়া খাতুন সরাসরি ভাষা আন্দোলনের যোগ দেয়ার বিষয়ে বলেন একুশে ফেব্রুয়ারির ঠিক আগের রাত। যাখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা আঁচ করতে পারলেঅ পরের দিন ১৪৪ ধারা ভাঙা হবে না। রাতে এ খবর শোনার সঙ্গে সঙ্গে ছাত্রীদের মাঝে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। ২১ ফেব্রুয়ারির দিন বিভিন্ন স্কুল কলেজ থেকে ছাত্রীদেও নিয়ে আসার ভার ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের ওপর। ছাত্রীরা কয়েকটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে এ দায়িত্ব নেয়। প্রথম দলেই মেয়েরা ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে বেরিয়ে যায় এ দলে ছিলেন শাফিয়া খাতুন। সাফিয়া খাতুন লাাঠর ওপর দিয়ে লাফ দিয়ে চলে যান। পরে তার দেখাদেখি অন্য নারী শিক্ষার্থীরাও ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ভাষা আন্দোলনে অংশ নেয়।[৩] তিনি ঢাকা শহরের বিভিন্ন মহিলা কলেজে ও গার্লস স্কুলে ছাত্রীদের সুসংগঠিত করে আন্দোলনমুখী করার কাজে নানা কৌশল অবলম্বন করেন। এক একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একজন বা একাধিক সহপাঠী ছাত্রীকে দায়িত্ব বণ্টন করে তিনি আন্দোলনে জনমত গঠনের কাজে প্রবৃত্ত হন। চামেলি হাউসে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে বেশ কয়েকটি বৈঠক, সমাবেশ ও মিছিলে তিনি নেতৃত্ব দেন। [৪]

১৯৫২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়। ধর্মঘট চলাকালীন ছাত্রীদের একটি মিছিলে শাফিয়া খাতুন নেতৃত্ব দেন। মিছিলটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ছাত্রদের মিছিলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন অভিমুখে গমন করে। ফেব্রুয়ারি মাসব্যাপী অনুষ্ঠিত ভাষা আন্দোলনের প্রায় প্রতিটি সভা ও সমাবেশে শাফিয়া খাতুনকে আপসহীন ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে দেখা গেছে। ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় অনুষ্ঠিত ছাত্রজনতার সমাবেশকে সাফল্যমণ্ডিত করার জন্য ছাত্রীদের পরিচালনার নেতৃত্বে ছিলেন শাফিয়া খাতুন। তিনি বিভিন্ন ছাত্রী নেত্রীদের ঢাকা শহরের বিভিন্ন মহিলা কলেজ ও বালিকা বিদ্যালয়ে গমন করে সেখান থেকে মিছিল সহকারে অকুস্থলে ছাত্রীদের নিয়ে আসতে উদ্বুদ্ধ করেন। তার সাংগঠনিক দূরদর্শিতার জন্যই সে দিন বিপুলসংখ্যক ছাত্রীকে আমতলার সমাবেশস্থলে যোগ দেয়। আমতলার সমাবেশে প্রথম চারজন করে বের হওয়ার কথা যখন আলোচিত হয়, তিনি তাতে উত্তেজিত হয়ে পড়েন। শাফিয়া খাতুন মনে করেন, চারজন করে ভিন্ন ভিন্ন গ্রুপে ছাত্রছাত্রীদের বের হওয়ার ফলে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ হবে না। তিনি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে সব ছাত্রছাত্রীর এক সঙ্গে বের হওয়ার পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার প্রক্রিয়া শুরুর নেতৃত্ব দেন শাফিয়া খাতুন। এসব আন্দোলনে তার সাথে ছিলেন সুফিয়া ইব্রাহীম, রওশন আরা বাচ্চু, শামসুন্নাহার, হালিমা খাতুন[৪]

রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড[সম্পাদনা]

ছাত্রজীবনে ড. শাফিয়া খাতুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ইউনিয়নের সহ সভাপতি ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওমেন হল ইউনিয়নের (১৯৫০-৫১) জি.এস [৫] ও এক সময়ের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের একমাত্র আবাসস্থল চামেলি হাউস ছাত্র সংসদের ভিপি (১৯৫১-১৯৫২) ছিলেন। ১৯৫২ সালে পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙ্গে ১৪৪ ধারা ভাঙার মূখ্য ভূমিকা ছিল তার। ওই বছরই তিনি শুভেচ্ছা সফরে তুরস্কে যান। [৬]

স্বীকৃতি ও সম্মাননা[সম্পাদনা]

২০১৭ সালে ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে আদিতমারী উপজেলা প্রশাসন তাকে মরণোত্তর সংবর্ধনা দেন। তার জন্মস্থানে লালমনিরহাট আদিতমারী উপজেলায় একটি বিদ্যালয়ের নামকরণ করা হয়েছে তার ড. শাফিয়া খাতুন উচ্চ বিদ্যালয় [৭] ভাষা আন্দোলনে তার ভূমিকার কথা স্মরণ করে ঢাকা করপোরেশন ধানমন্ডিতে একটি রাস্তার নামকরণ করেছে ‘ভাষাসৈনিক শাফিয়া খাতুন সড়ক’।[২]

মৃত্যু[সম্পাদনা]

শাফিয়া খাতুন ১৯৯৩ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি মৃত্যুবরণ করেন।

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. একুশ ভাষা আন্দোলনের সচিত্র ইতিহাস, (১৯৪৭-১৯৫৬)। লেখক- সিএম তারেক রেজা। প্রকাশক : নিমফিয়া পাবলিকেশন। আইএসবিএন 9843214536 
  2. "শাফিয়া খাতুন"। ভোরের কাগজ। ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯। ৭ মে ২০১৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৭ মে ২০১৯ 
  3. "ছাত্রীদের মধ্যে ১৪৪ ধারা ভাঙার প্রবণতা ছিলো বেশি : রওশন আরা বাচ্চু"। ওমেনআই টোয়েন্টিফোর। ৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৪। ৭ মে ২০১৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৭ মে ২০১৯ 
  4. "শাফিয়া খাতুনের সাক্ষাতকার"। ৭ মে ২০১৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৭ মে ২০১৯ 
  5. "ভাষা আন্দোলনে নারীদের ভূমিকা"। লেখক- সুরাইয়া বানু ডলি। সাতক্ষীরা নিউজ টোয়েন্টিফোর। ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৮। সংগ্রহের তারিখ ৭ মে ২০১৯ 
  6. "ভাষা আন্দোলনে নারীর ভূমিকা"। রিপোর্ট- ডা. ফজল মোবারক। ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৫। সংগ্রহের তারিখ ৭ মে ২০১৯ 
  7. "আদিতমারীতে দুই ভাষা সৈনিককে সংবর্ধনা"। দৈনিক ইত্তেফাক। ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৭। ৭ মে ২০১৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৭ মে ২০১৯