রান্নামারি

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

রান্নামারি হলো মালদ্বীপের লোককাহিনীর এক সামুদ্রিক দানব।[১] লোককাহিনী মতে, এই সামুদ্রিক দানবের ভয়ে তত্কালীন মালদ্বীপবাসী তথষ্ট থাকতো এবং এর অনিষ্ট হতে নিস্তারের জন্য প্রতি মাসে তাকে একজন করে কুমারী নারী দেয়া হতো। পরবর্তীতে, মরক্কো হতে মালদ্বীপে আগত বণিক ও ইসলাম প্রচারকারী আবু আল বারাকাত ইউসুফ বারবারের সহায়তায় এই দানবকে নিবৃত্ত করা সম্ভব হয় এবং এর প্রেক্ষিতে কৃতজ্ঞতাস্বরূপ মালদ্বীপবাসী ইসলাম কবুল করে নেয়।[২]

ব্যুত্পত্তি[সম্পাদনা]

প্রাচীন ধিবেহী ভাষার শব্দ রান্না অর্থ সর্বশক্তিমান এবং মার অর্থ মহাসাগর; অর্থ্যাত্ রান্নামারি দ্বারা সমুদ্রের দেবতা বুঝানো হয়।[৩]

বিবরণ[সম্পাদনা]

মালদ্বীপের উপকথা অনুযায়ী, আজ থেকে প্রায় এক হাজার বছর আগে সামুদ্রিক দানব রান্নামারির উৎপাত শুরু হয়। উপকথা অনুযায়ী, এই দানব যখন সমুদ্রের তলদেশ থেকে লোকালয়ে পা রাখত, তখন বিকট আওয়াজের পাশাপাশি তার বিশালাকৃতির শরীর জ্বলজ্বল করত, যেন তার পুরো শরীরে রেডিয়াম দেয়া রয়েছে।[৪] এটি তাল গাছের চেয়ে লম্বা, পিচের মতো কালো বর্ণের এবং পায়ের আঙ্গুল পর্যন্ত সুদীর্ঘ বাহু বিশিষ্ট এক কল্পিত চরিত্র। প্রতিদিন রাতের বেলা এই দানব সমুদ্রের তলদেশ থেকে উঠে এসে রাজধানী মালের লোকালয়ে পা রাখত এবং এরপর চলত তার ধ্বংসযজ্ঞ। এই দানবটি হাজার হাজার তরুণীকে ধর্ষণ ও হত্যা করেছে বলে বিশ্বাস করা হয়। গল্প-গাঁথা অনুসারে, দ্বীপবাসীরা প্রতিমাসে একত্রিত হয়ে একটি তন্ত্র-অনুষ্ঠানের আয়োজন করতো এবং এরপর তারা দ্বীপের তখনকার সবচেয়ে সুন্দরী কুমারীকে তুলে নিয়ে রান্নামারীর জন্য সমুদ্র সৈকতের একটি মন্দিরে রেখে আসতো যেন সে এতে তু্ষ্ট হয়ে অন্য নারীদের অপহরণ করা থেকে বিরত থাকে।[১] ইবনে বতুতার বর্ণা অনুসারে,[৫] রাজা সেই সময়কার মালদ্বীপবাসীকে বাধ্য করেন প্রতি মাসে একজন কুমারী মেয়েকে বলি দিয়ে দানবটিকে তুষ্ট করতে। প্রতি মাসের শেষ দিন দ্বীপের মহিলাদের মধ্য হতে রাজার ইচ্ছানুসারে একজন নারীকে নির্বাচিত করা হত। তারপর নির্বাচিত নারীকে একটি মন্দিরে রাত কাটানোর জন্য পাঠানো হতো। পরের দিন সকালে, মহিলাকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যেতো এবং দ্বীপবাসীরা তার শেষকৃত অনুষ্ঠানের আয়োজন করতো।

প্রচলিত লোকগাঁথা[সম্পাদনা]

এই দানবের মূল কাজ ছিল লোকালয়ের যত কুমারী নারী রয়েছে তাদের ধর্ষণ ও হত্যা করা। মাসের পর মাস এই দানবের আক্রমণে মালদ্বীপের সমাজে নারীদের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে কমতে শুরু করে; চরম আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে সময় অতিবাহিত করতে থাকে অধিবাসীরা। এই সমস্যা সমাধানে মালদ্বীপের তৎকালীন রাজা সভাসদদের নিয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেন যে প্রতি মাসে একজন করে কুমারীকে মন্দিরে রেখে আসা হবে। সিদ্ধান্ত মতো, প্রতি মাসের শেষ দিন সন্ধ্যায় দ্বীপের সবচেয়ে সুন্দরী কুমারীকে সাজিয়ে মন্দিরে নিয়ে শক্ত করে বেঁধে রেখে আসা হতো। পরদিন সকালে গিয়ে দেখা যেতো সেই নারীকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। সেই নারীর পরিবারের সদস্যরা তখন তার প্রাণহীন দেহ বহন করে নিয়ে এসে সৎকার করতো।

১২০০ সালের দিকে মালদ্বীপে ইসলাম প্রচারের জন্য আগত মরক্কান পর্যটক আবু আল বারাকাত ইউসুফ বারবার এই ঘটনা শুনে বিস্মিত হন এবং কুমারী নারীর পরিবর্তে তিনি নিজে একরাত সেখানে কাটানোর প্রস্তাব করেন। রাতের বেলা তাকে মন্দিরের ভেতর রেখে আসা হলে তিনি সেখানে কোরআন পাঠ করতে থাকলে দানব তাকে আক্রমণ না-করে সমু্দ্রে ফিরে যায়। তার এই অসাধারণ কর্মকাণ্ডে বিস্মিত হয়ে মালদ্বীপের তৎকালীন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী রাজা ও জনগণকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে এবং এভাবেই মালদ্বীপে ইসলামের আগমন ঘটে।[৪]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. "The Maldives"। Guardian News and Media Limited। সংগ্রহের তারিখ ৪ নভেম্বর ২০২৩ 
  2. Battuta, Ibn (১১ মে ২০১১)। Travels in Asia and Africa 1325-1354। London: Routledge and CRC Press। আইএসবিএন 9780415612142 
  3. "Rannamaari"। Google Books। সংগ্রহের তারিখ ৪ নভেম্বর ২০২৩ 
  4. "পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত শুনে গায়েব হয়ে যায় মালদ্বীপের রান্নামারি দানব"। চ্যানেল ২৪। ২৯ এপ্রিল ২০২২। সংগ্রহের তারিখ ৪ নভেম্বর ২০২৩ 
  5. "Maldives Culture – Explore The Beauty of Maldives" 

বহিঃসংযোগ[সম্পাদনা]