রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিশ্বভ্রমণ
এই নিবন্ধের ভূমিকাংশ তার সামগ্রিক দৈর্ঘের তুলনায় অতি দীর্ঘ। (নভেম্বর ২০১৭) |
১৯১৩-এ নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির পর সারা বিশ্ব ভারতীয় কবি রবীন্দ্রনাথের ব্যাপারে বিশেষভাবে আগ্রহী হয়ে ওঠে। ফলে বিভিন্ন দেশ থেকে আসতে থাকে আমন্ত্রণের পর আমন্ত্রণ। অধিকাংশ আমন্ত্রণে সাড়া দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ; জাহাজযোগে বহু দেশে গেছেন ; পরিচিত হয়েছেন বিভিন্ন দেশের বিদ্যজন ও রাজ-রাজড়াদের সাথে। বহু স্থানে, বহু বিদ্যায়তনে, বহু সভায় স্বকণ্ঠে কবিতা পাঠ করে শুনিয়েছেন, বক্তৃতা দিয়েছেন। তার জীবনোপলব্ধি ও দর্শন এবং তার কাব্যের মর্মবাণী এভাবে কবি সরাসরি বিশ্বমানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। প্রবাসের জীবনে তার হাতে পূরবী'র মতো গুরুত্বপূর্ণ কাব্য রচিত হয়েছে। তার সঙ্গে সাক্ষাতের ফলে বহুজন তার কবিতা অনুবাদে উদ্যোগী হয়েছেন।
১৮৭৮ থেকে ১৯৩২ সাল পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পাঁচটি মহাদেশের তেত্রিশটিরও বেশি দেশ ভ্রমণ করেছিলেন।[১] তবে ইংল্যান্ড ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাদ দিলে অন্যান্য দেশসমূহ ভ্রমণ করেছেন ১৯১৩-তে নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির পর। দেশগুলো হলোঃ ফ্রান্স, হংকং, চীন, বেলজিয়াম, সুইজারল্যান্ড, জার্মানি, ডেনমার্ক, সুইডেন, অস্ট্রিয়া, চেকোশ্লোভাকিয়া, আর্জেন্টিনা, ইতালি, নরওয়ে, হাঙ্গেরী, যুগোশ্লাভিয়া, বুলগেরিয়া, রুমানিয়া, গ্রীস, মিশর, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, জাপান, বার্মা, হল্যান্ড, সোভিয়েট রাশিয়া, ইরান, ইরাক ও শ্রীলঙ্কা। ১৯৩৪ এ শ্রীলঙ্কা (সিংহল) ভ্রমণ শেষে কবি শান্তিনিকেতনে ফেরেন ২৮ জুন। এরপর তিনি আর বিদেশভ্রমণে যান নি। এই ভ্রমণগুলির মধ্যে অনেকগুলিই রবীন্দ্রনাথের জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে। এর মাধ্যমে তিনি ভারতের বাইরে নিজের রচনাকে সুপরিচিত করে তোলেন এবং প্রচার করেন তার রাজনৈতিক মতাদর্শ। একই সংগে বহু আন্তজার্তিক সাহিত্যিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সংগে তার সাক্ষাৎ হয়।
তার বিদেশ ভ্রমণ শুরু হয় ১৮৭৮ সালে প্যারিস হয়ে লন্ডন গমনের মাধ্যমে। বিদেশ বিভুঁইয়ে অবস্থানকারে খুব ঘরকাতর হয়ে পড়েছিলেন বলে দীর্ঘকার আর বিলেত যাওয়ার কথা ভাবেন নি। তার দ্বিতীয় লন্ডন ভ্রমণ ১৮৯০-এ। ১৯১২ সালের ২৭ মে রবীন্দ্রনাথ যুক্তরাষ্ট্র[২] ও যুক্তরাজ্য ভ্রমণে বের হন। সংগে ছিল নিজের একগুচ্ছ রচনার ইংরেজি অনুবাদ। লন্ডনে মিশনারি তথা গান্ধীবাদী চার্লস এফ. অ্যান্ড্রুজ, অ্যাংলো-আইরিশ কবি উইলিয়াম বাটলার ইয়েটস, এজরা পাউন্ড, রবার্ট ব্রিজেস, আর্নেস্ট রাইস, টমাস স্টার্জ মুর প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ তার গুণমুগ্ধে পরিণত হন।[৩] ইয়েটস গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদের মুখবন্ধটি লিখে দেন। অ্যান্ড্রুজ শান্তিনিকেতনে এসে বিদ্যালয়ের কাজে যোগ দেন। যুক্তরাজ্যে স্ট্যাফোর্ডশায়ারের বাটারটনে অ্যান্ড্রুজের ধর্মযাজক বন্ধুদের সঙ্গে কিছুদিন অতিবাহিত করেন কবি।[৪] যুক্তরাষ্ট্র সফরে তিনি লন্ডন ত্যাগ করেন ১৬ জুন ; যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছান ১৯ শে অক্টোবরে। তিনি দেশে ফিরে আসেন পরের বছর অর্থাৎ ১৯১৩ সালের ৬ অক্টোবর। ১৯১৬ সালের ৩ মে থেকে ১৯১৭ সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রে বক্তৃতা দিয়ে বেড়ান।[৫] এই সব বক্তৃতায় কবি তার জাতীয়তাবাদ-বিরোধী মতামত ব্যক্ত করেছিলেন।[৬] এছাড়াও তিনি রচনা করেন "ন্যাশানালিজম ইন ইন্ডিয়া" নামে একটি প্রবন্ধও। এটি যুগপৎ নিন্দিত ও নন্দিত হয়। রোমা রোঁলা প্রমুখ বিশ্বশান্তিবাদীরা এই প্রবন্ধের ভূয়সী প্রশংসা করেন।[৭]
ভারতে প্রত্যাবর্তনের অব্যবহিত পরেই ৬৩ বছর বয়সী রবীন্দ্রনাথ পেরু সরকারের কাছ থেকে পেরু ভ্রমণের একটি আমন্ত্রণ পান। পেরু থেকে তিনি যান মেক্সিকোতেও। উভয় দেশের সরকারই এই ভ্রমণকে স্মরণীয় করে রাখতে শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতী বিদ্যালয়ে ১০০,০০০ মার্কিন ডলার অর্থ দান করেন।[৮] ১৯২৪ সালের ৬ নভেম্বর আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনর্স এয়ার্সে উপস্থিত হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন রবীন্দ্রনাথ।[৯] এই সময় ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর আতিথেয়তায় ভিলা মিরালরিওতে চলে আসেন কবি। ১৯২৫ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি যাত্রা করেন ভারতের উদ্দেশ্যে। ১৯২৬ সালের ৩০ মে ইতালির নেপলসে উপস্থিত হন তিনি। পরদিন রোমে সাক্ষাৎ করেন ফ্যাসিবাদী একনায়ক বেনিতো মুসোলিনির সঙ্গে।[১০] প্রথম দিকে উভয়ের মধ্যে উষ্ণ সম্পর্ক থাকলেও, ১৯২৬ সালের ২০ জুলাই প্রথম মুসোলিনির বিরুদ্ধে বক্তব্য রাখেন রবীন্দ্রনাথ। তারপরই এই সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায়।[১১]
১৯২৭ সালের ১৪ জুলাই দুই সঙ্গীকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এক চারমাসব্যাপী সফরে বের হন। এই সফরে তিনি ভ্রমণ করেন বালি, জাভা, কুয়ালালামপুর, মালাক্কা, পেনাং, সিয়াম ও সিঙ্গাপুর। "যাত্রী" গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ এই ভ্রমণের বিবরণ লিপিবদ্ধ করেন।[১৩] ১৯৩০ সালের গোড়ার দিকে প্রায় বর্ষব্যাপী এক সফরে তিনি বেরিয়ে পড়েন ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্যে। যুক্তরাজ্যে ফিরে তিনি বার্মিংহামে একটি ভাতৃসংঘের আশ্রয়ে অবস্থান করেন। এই সময় লন্ডন ও প্যারিস নগরীতে তার অঙ্কিত চিত্রের প্রদর্শনী হয়। বার্মিংহামে বসেই তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রদানের জন্য তার হিবার্ট বক্তৃতামালা রচনা করেন। এই বক্তৃতাগুলির উপজীব্য ছিল "আমাদের ঈশ্বরের মানবতাবোধ সম্পর্কে ধারণা, বা চিরন্তন মানবের দৈবসত্ত্বা"। এই সময় তিনি লন্ডনের বার্ষিক কোয়েকার সম্মেলনেও ভাষণ দেন।[১৪] এখানে তার ভাষণের বিষয়বস্তু ছিল ভারতীয় ও ব্রিটিশদের সম্পর্ক। এই প্রসঙ্গে তিনি এক "নিরাসক্তির কৃষ্ণগহ্বর"-এর উল্লেখ করেন। পরবর্তী দুই বছর এই বিষয় নিয়ে তিনি অনেক চিন্তাভাবনা করেছিলেন।[১৫] পরে তিনি ডার্টিংটন হলে অবস্থান করে তৃতীয় আগা খানের সঙ্গে দেখা করেন। ১৯৩০ সালের জুন থেকে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত তিনি ডেনমার্ক, সুইজারল্যান্ড ও জার্মানি পর্যটন করেন। এরপর যান সোভিয়েত ইউনিয়নে।[১৬] অতিন্দ্রীয়বাদী পারসিক কবি হাফিজের কিংবদন্তি ও রচনার গুণমুগ্ধ ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ১৯৩২ সালের এপ্রিলে জীবনের শেষপর্বে তিনি তাই যান ইরানে। গ্রহণ করেন রেজা শাহ পাহলভির আতিথেয়তা।[১৭][১৮] এই ভ্রমণের সময়েই তিনি সফর করেন ইরাক (১৯৩২) ও সিংহল (১৯৩৩)।
জীবনের শেষার্ধব্যাপী এই বিশ্বভ্রমণে রবীন্দ্রনাথ হেনরি বার্গসন, আলবার্ট আইনস্টাইন, রবার্ট ফর্স্ট, টমাস মান, জর্জ বার্নার্ড শ, এইচ. জি. ওয়েলস ও রোমা রোঁলা হেলেন কেলার প্রমুখ সমসাময়িক যুগের বিশিষ্ট বহু ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন।[১৯][২০] পরিচিত হয়েছেন অসংখ্য রাজন্যবর্গের সঙ্গে। এর ফলে জগৎব্যাপী মানব সমাজের নানা বিভাজন ও জাতীয়তাবাদের প্রকৃত স্বরূপটি অনুসন্ধান করতে সমর্থ হন কবি।[২১]
পাদটীকা
[সম্পাদনা]- ↑ Dutta ও Robinson 1995, পৃ. 374–376
- ↑ "History of the Tagore Festival", Tagore Festival Committee, University of Illinois at Urbana-Champaign: College of Business, ১৩ জুন ২০১৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা, সংগ্রহের তারিখ ১৩ আগস্ট ২০০৯
- ↑ Dutta ও Robinson 1995, পৃ. 178–179
- ↑ Chakravarty 1961, পৃ. 1–2
- ↑ Dutta ও Robinson 1995, পৃ. 206
- ↑ Hogan, PC; Pandit, L (২০০৩), Rabindranath Tagore: Universality and Tradition, Fairleigh Dickinson University Press, পৃষ্ঠা 56–58, আইএসবিএন 0-8386-3980-1
- ↑ Chakravarty 1961, পৃ. 182
- ↑ Dutta ও Robinson 1995, পৃ. 253
- ↑ Dutta ও Robinson 1995, পৃ. 256
- ↑ Dutta ও Robinson 1995, পৃ. 267
- ↑ Dutta ও Robinson 1995, পৃ. 270–271
- ↑ Photo of Tagore in Shiraz
- ↑ Chakravarty 1961, পৃ. 1
- ↑ Dutta ও Robinson 1995, পৃ. 289–292
- ↑ Dutta ও Robinson 1995, পৃ. 303–304
- ↑ Dutta ও Robinson 1995, পৃ. 292–293
- ↑ Chakravarty 1961, পৃ. 2
- ↑ Dutta ও Robinson 1995, পৃ. 315
- ↑ Chakravarty 1961, পৃ. 99
- ↑ Chakravarty 1961, পৃ. 100–103
- ↑ Dutta ও Robinson 1995, পৃ. 317