বিষয়বস্তুতে চলুন

ব্রাহ্মী লিপিসমূহ

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

ব্রাহ্মী লিপি পরিবার হল কয়েকটি লিখন পদ্ধতির সমষ্টি, যেগুলি প্রাচীন ব্রাহ্মী লিপি থেকে উদ্ভূত হয়েছে। এগুলির প্রত্যেকটিই শব্দীয় বর্ণমালা লিপি। সমগ্র দক্ষিণ এশিয়া (পাকিস্তানআফগানিস্তান বাদে), দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং মধ্যপূর্ব এশিয়ার কিছু অংশে এই লিপিগুলি প্রচলিত। এদের প্রত্যেকেই  প্রাচীন ভারতের ব্রাহ্মী লিপি থেকে সৃষ্ট হয়েছে। এই লিপিমালাগুলি কতকগুলি ভাষা-পরিবারের অন্তর্ভুক্ত ভাষায় ব্যবহৃত হয়। যথা – ইন্দো-ইওরোপীয়, দ্রাবিড়ীয়, তিব্বতি-বর্মী, মঙ্গোলীয়, অস্ট্রো-এশিয়াটিক, অস্ট্রোনেশীয় প্রভৃতি। এই লিপিগুলি জাপানের ‘কানা’ লিপির আভিধানিক বর্ণানুক্রমেরও উৎস হিসেবে পরিচিত।

মা, ওঁ এবং আঠারোটি ভিন্ন ব্রহ্মীক বা ভারতীয় লিপিতে লেখা রয়েছে।

[]

ইতিহাস

[সম্পাদনা]
সম্রাট অশোকের ষষ্ঠ স্তম্ভলেখমালায় ব্যবহৃত ব্রাহ্মী লিপি

পূর্বেই বলা হয়েছে, এই পরিবারের লিপিগুলি প্রাচীন ব্রাহ্মী লিপির বংশধর। মৌর্য সম্রাট অশোকের রাজত্বকালে (খ্রিস্টপূর্ব ৩ শতক) ব্রাহ্মী লিপির প্রকৃষ্ট ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়, যা ঐ সময় রাজ্যের শাসন সংক্রান্ত নিয়ম-নির্দেশ লিপিবদ্ধ করতে ব্যবহৃত হত। অশোকের স্তম্ভ লেখমালাগুলিতে ব্রাহ্মী লিপির প্রকৃষ্ট নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে। ব্রাহ্মীর সর্বাপেক্ষা নির্ভরযোগ্য উদাহরণটি হল খ্রিস্টপূর্ব ৪ শতকে লিখিত একটি স্তম্ভলিপি।[] উত্তর ভারতীয় ব্রাহ্মী থেকে গুপ্ত যুগে ‘গুপ্ত লিপি’র উদ্ভব হয়েছিল, যেটি মধ্যযুগে আরও নানা শাখায় বিভক্ত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে, এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল – সিদ্ধং, শারদানাগরী লিপি।

সিদ্ধং’ লিপি বৌদ্ধধর্মের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিল, প্রচুর বৌদ্ধ ‘সূত্র’ এর মাধ্যমেই লিখিত হয়। সিদ্ধং হস্তলিপি বর্তমানে  নিজস্ব অস্তিত্ব বজায় রেখেছে জাপানে। সম্ভবত বৌদ্ধধর্মের প্রচারকার্যের ফলেই জাপানের কানা বর্ণানুক্রম সৃষ্ট হয়েছে সিদ্ধং লিপি থেকেই।[]

দক্ষিণ ভারতীয় ব্রাহ্মীর মধ্যে প্রাচীন কন্নড়, পল্লব ও ভাট্টেলুত্তু লিপিই অধিক প্রসিদ্ধ। এই লিপিগুলি দক্ষিণ ও দক্ষিণতর এশিয়ায় নানা বিভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে।

ভাট্টিপ্রোলু খ্রিস্টপূর্ব ৩য় শতকে বৌদ্ধধর্মের প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয়, এবং এই স্থান থেকেই পূর্ব এশিয়ায় বৌদ্ধধর্ম প্রচারিত হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বর্তমানে তেলুগু লিপি এই ভাট্টিপ্রোলু বা কন্নড়-তেলুগু লিপি থেকেই উদ্ভূত হয়েছে।

প্রথমাবস্থায়, তামিল ব্রাহ্মী লিপিগুলি ধীরে ধীরে ঈষৎ পরিবর্তিত হতে থাকে, এই কারণেই বর্তমান তামিল লিপিটি অন্যান্য ভারতীয় লিপিগুলির থেকে ভিন্ন, এই লিপির বর্ণমালায় তুলনামূলকভাবে বর্ণসংখ্যা কম, এতে মহাপ্রাণ ও সঘোষ বর্ণগুলি পৃথকভাবে স্থান পায়নি।

বৈশিষ্ট্য

[সম্পাদনা]

এই লিপিগুলির প্রত্যেকটির মধ্যেই কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য দেখা যায়, যদিও কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমও থাকতে পারে। যথা:

  • স্বাভাবিকভাবে প্রত্যেকটি ব্যঞ্জনের সাথে একটি হ্রস্ব ‘a’ (अ) স্বরধ্বনি যুক্ত অবস্থায় থাকে (বাংলা, অসমীয়াওড়িয়াতে উচ্চারণ বিভেদে এই ধ্বনিটি হল হ্রস্ব ‘অ/ô’)। অন্যান্য স্বরধ্বনিগুলিকে নির্দিষ্ট অক্ষর বা চিহ্নের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়। আর স্বরহীন শুদ্ধ ব্যঞ্জনধ্বনিকে প্রকাশ করতে একটি ‘হসন্ত’ (সংস্কৃত: বিরাম) চিহ্ন যুক্ত করতে হয়।
  • প্রতিটি স্বরধ্বনির দুইটি রূপ রয়েছে, একটি হল স্বতন্ত্র রূপ, যখন এটি ব্যঞ্জনের সাথে যুক্ত অবস্থায় থাকে না, এবং অন্যটি হল নির্ভরশীল রূপ বা চিহ্ন, যেটি ব্যঞ্জনের সাথে যুক্ত হয়ে থাকে। এই নির্ভরশীল রূপটিকে (‘কার’ চিহ্ন) নিয়মানুযায়ী মূল ব্যঞ্জনের উপরে, নিচে, ডান দিকে, বাঁ দিকে, কিংবা দু’দিকেই বসানো যেতে পারে।
  • একাধিক ব্যঞ্জনবর্ণ পরস্পরের সাথে মিলিত হয়ে যুক্তাক্ষর গঠন করতে পারে। বেশিরভাগ লিপিতেই ‘র’ (r) বর্ণটি অন্য ব্যঞ্জনের সাথে যুক্ত হলে বিশেষ চিহ্ন ব্যবহৃত হয়।
  • অনুনাসিক স্বরধ্বনি ও সঘোষ স্বরকে চিহ্নিত করতে স্বরবর্ণ কিংবা স্বরচিহ্নের সাথে নির্দিষ্ট চিহ্ন ব্যবহৃত হয়।
  • বর্ণমালার বর্ণানুক্রমটি এইরূপ: স্বরবর্ণ, কণ্ঠ্য ব্যঞ্জনবর্ণ, তালব্য ব্যঞ্জনবর্ণ, মূর্ধন্য ব্যঞ্জনবর্ণ, দন্ত্য ব্যঞ্জনবর্ণ, ওষ্ঠ্য ব্যঞ্জনবর্ণ, অন্তঃস্থ ব্যঞ্জনবর্ণ, ঊষ্ম ব্যঞ্জনবর্ণ ও অন্যান্য ব্যঞ্জনবর্ণ। প্রত্যেটি ব্যঞ্জন বিভাগে ৪টি বর্ণ (সম্ভাব্য ঘোষতা ও শ্বাসপ্রাণের ভিত্তিতে) ও একটি নাসিক্য বর্ণ থাকে।

তুলনা

[সম্পাদনা]

নিচে ব্রাহ্মী লিপিজাত লিখন পদ্ধতিগুলির বর্ণমালার তুলনামূলক ছক দেওয়া হল, যার একই কলামে থাকা বর্ণগুলি ব্রাহ্মীর মূল একই বর্ণ থেকে সৃষ্ট হয়েছে। যথাক্রমে:

  • ছকটিতে প্রতিটি বর্ণমালার বৈশিষ্ট্য সম্পূর্ণরূপে দেওয়া হয় নি। কোনো বর্ণমালার যেসব বর্ণ ব্রাহ্মী লিপি থেকে নেওয়া হয়নি, তাদের বাদ দেওয়া হয়েছে।
  • একই কলামে অবস্থিত প্রতিটি বর্ণের উচ্চারণ একই নাও হতে পারে। কারণ, অঞ্চলগত প্রভেদে উচ্চারণ রীতি বদলে যেতে পারে।

বর্ণগুলির ইংরেজি লিপ্যন্তর ISO 15919 এর মাধ্যমে করা হয়েছে।

ব্যঞ্জনবর্ণ

[সম্পাদনা]
ISOkakhagaghacachajajhañaṭaṭhaḍaḍhaṇatathadadhanapaphababhamayaralaḷavaśaṣasaha
ব্রাহ্মী    
দেবনাগরী    
বঙ্গ‌অসমীয়া  র,ৰ   
সারদা 𑆑𑆒𑆓𑆔𑆕𑆖𑆗𑆘𑆙𑆚𑆛𑆜𑆝𑆞𑆟𑆠𑆡𑆢𑆣𑆤 𑆥𑆦𑆧𑆨𑆩𑆪𑆫 𑆬𑆭 𑆮𑆯𑆰𑆱𑆲
গুরমুখী   ਲ਼ ਸ਼ 
গুজরাতি    
ওড়িয়া    
তামিল     ஜ*          ஶ*ஷ*ஸ*ஹ*
তেলুগু   
কন্নড়  
মালায়ালাম
সিংহলী    
থাই    
লাও                
তিব্বতি          
বর্মী က/  
খ্‌মের    

তামিল: পল্লব গ্রন্থ বর্ণগুলি খাঁটি তামিলে ব্যবহৃত হয় না , কিন্তু বিদেশি শব্দগুলি লিখতে ব্যবহৃত হয়।

স্বরবর্ণ

[সম্পাদনা]
ISOaāæǣiīuūeēaioōaur̥̄l̥̄
ব্রাহ্মী                 
দেবনাগরী काअॅकॅकॉकिकीकुकूकॆकेकैकॊकोकौकृकॄकॢकॣअंकंअःकः
অসমীয়া কাঅ্যাক্যাকিকীকুকূ  কেকৈ  কোকৌকৃকৄকৢকৣ কং কঃ
বাংলা কাঅ্যাক্যাকিকীকুকূ  কেকৈ  কোকৌকৃকৄকৢকৣকংকঃ
গুরমুখী ਕਾ    ਕਿਕੀਕੁਕੂ  ਕੇਕੈ  ਕੋਕੌ        
গুজরাতি કાકૅકૉકિકીકુકૂ  કેકૈ  કોકૌકૃકૄકૢકૣઅંકંઅઃકઃ
তামিল கா    கிகீகுகூகெகேகைகொகோகௌ        
তামিল கா    கிகீகுகூகெகேகைகொகோகௌ        
তেলুগু కా    కికీకుకూకెకేకైకొకోకౌకృకౄకౢకౣఅంకంఅఃకః
কন্নড় ಕಾ    ಕಿಕೀಕುಕೂಕೆಕೇಕೈಕೊಕೋಕೌಕೃಕೄಕೢಕೣఅంಕಂఅఃಕಃ
মালয়ালম കാ    കികീകുകൂകെകേകൈകൊകോകൗകൃകൄകൢകൣഅംകംഅഃകഃ
সিংহলি කාකැකෑකිකීකුකූකෙකේකෛකොකෝකෞකෘකෲකෟකෳ
থাই   กา     กิ กี กุ กู   เก ไก/ใก   โก เกา/กาวกฤฤๅกฤๅกฦฦๅกฦๅ
লাও  ກັ ກາ     ກິ ກີ ກຸ ກູ   ເກ ໄກ/ໃກ   ໂກ ເກົາ/ກາວ        
তিব্বতি ཨཱཀཱ    ཨིཀིཨཱིཀཱིཨུཀུཨཱུཀཱུ  ཨེཀེཨཻཀཻ  ཨོཀོཨཽཀཽརྀཀྲྀརཱྀཀཷལྀཀླྀལཱྀཀླཱྀ
বর্মী ကအာကာ    ကိကီကုကူကေအေးကေး  ကော  ကော်ကၖကၗကၘကၙ
খ্‌মের កា    កិកីកុកូ  កេកៃ  កោកៅក្ឫក្ឬក្ឭក្ឮ

সংখ্যা

[সম্পাদনা]
হিন্দু-আরবি0123456789
ব্রাহ্মী উঃ 𑁚𑁒𑁓𑁔𑁕𑁖𑁗𑁘𑁙𑁚
ব্রাহ্মী দঃ 𑁦𑁧𑁨𑁩𑁪𑁫𑁬𑁭𑁮𑁯
দেবনাগরী
অসমীয়া
বাংলা
গুরমুখী
গুজরাতি
ওড়িয়া
তামিল
তেলুগু
কন্নড়
মালয়ালম
থাই
লাও
তিব্বতি
বর্মী
খ্‌মের

ব্রাহ্মী লিপি পরিবারের তালিকা

[সম্পাদনা]

ব্রাহ্মী থেকে উৎপন্ন লিপিসমূহ।

ঐতিহাসিক

[সম্পাদনা]

ব্রাহ্মীর সর্বাপেক্ষা প্রাচীন লেখমালাটি খ্রিস্টপূর্ব ৩য় শতাব্দি পর্যন্ত নিজস্ব সত্তা বজায় রেখেছিল, এর পর থেকে এই লিপি আঞ্চলিক ভাবে নানা সংস্করণে বিভক্ত হয়ে পড়ে। ব্রাহ্মীর এই প্রক্রিয়াকরণ ৫ম শতাব্দিতে বিস্তৃত আকার ধারণ করে, তারপর মধ্য যুগে এর থেকে আরও নানা লিপির উৎপত্তি ঘটে। মূলত স্পষ্ট প্রভেদ পরিলক্ষিত হয় উত্তর ও দক্ষিণ ব্রাহ্মীর মধ্যে। উত্তরে গুপ্ত লিপির প্রভার ছিল সর্বাধিক এবং দক্ষিণে গ্রন্থ লিপি হিন্দু ধর্মের প্রসারের জন্য সমগ্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে।

  • উত্তর ব্রাহ্মী
  • দক্ষিণ ব্রাহ্মী (তামিল ব্রাহ্মী, কলিঙ্গ, ভাট্টিপ্রোলু)
    • আদি কন্নড়
      • কদম্ব বা প্রাচীন কন্নড়, ৫ম শতাব্দী
      • পল্লব, ৬ষ্ঠ শতাব্দী
        • কাওয়ী লিপি, ৮ম শতাব্দী
          • জাভা লিপি
        • মন লিপি
          • বর্মী লিপি
        • অহোম লিপি, ১৩ শতাব্দী
        • তাই থাম (লন্না), ১৪ শতাব্দী
        • বাতাক, ১৪ শতাব্দী
    • ভাট্টেলুত্তু
    • গ্রন্থ লিপি, ৬ষ্ঠ শতাব্দী
      • দিবেস আকুরু ও অন্যান্য
  • তোচারীয় লিপি , ৭ম শতাব্দী
  • মীতেই মায়েক

 আরও দেখুন

[সম্পাদনা]

তথ্যসূত্র

[সম্পাদনা]
  1. Trautmann, Thomas R. (2006). Languages and Nations: The Dravidian Proof in Colonial Madras. University of California Press. pp. 65–66.
  2. Coningham, R.A.E.; Allchin, F.R.; Batt, C.M.; Lucy, D. (1996), "Passage to India? Anuradhapura and the Early Use of the Brahmi Script", Cambridge Archaeological Journal 6 (1): 73–97, doi:10.1017/S0959774300001608
  3. "Font: Japanese". Monotype Corporation. Archived from the original on 2007-03-24. Retrieved2010-02-09

 বহিঃসংযোগ

[সম্পাদনা]